দানবদলন কাব্য/দ্বিতীয় সর্গ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় সর্গ।

একদা দানবপতি শুম্ভ, প্রিয়ানুজ,
সমতেজে তেজী বীর নিশুম্ভের সহ,
পাত্রমিত্রগণে লয়ে আছেন বসিয়া
সতামাঝে, রত্নাসনে, সমুন্নত ভাবে,
(প্রতাপের দাপে মরি আরো সমুন্নত)
কান্তার মাঝারে যেন সতেজ ন্যগ্রধ!—
সাহসে বিস্ফীত বক্ষ, বীরতেজ মরি,
ফুটিয়া পড়িছে যেন আঁখিদ্বয় দিয়া;
ভীমভুজে রাজদণ্ড, রতনে খচিত;
শাসন দণ্ডেতে যেন বাঁধি বীরবর,
রেখেছে নক্ষত্র কুলে মুষ্টির মধ্যেতে।
নাহিক আতপ, তবু ধর‍্যে ছত্র ছত্রী,
ঐশ্বর্য্য আসারে যেন বাঁচাইতে শির;—
রতনের খোলা কত ঝোলে চন্দ্রাতপে!
ঢুলায় চামরী যত্নে কোমল চামর;
লুঠায়ে, বিলাস যেন মাঙে শুম্ভকৃপা!
যোগাইছে গন্ধভার আপনি পবন,
ত্রাসেতে কম্পিতকায় মৃদুমন্দ গতি!
নাচিছে অপ্সরীকুল ভাবে অঙ্গ ঢালি;
সুকোমল গণ্ডে তাল দিতেছে কুণ্ডল;

করতালী দিয়া কভু অমনি ঘূরিছে,
আঁখিতে মানের সোম দেখাইয়া ধনী।
গাইছে গন্ধর্ব্ব, তানে ছাইয়া গগণ,
ছত্রিশ রাগিণীগণে বিবৃত করিয়া।
বাজিছে মৃদঙ্গ, সায়, দিতেছে তাহাতে,
আকাশে জিমূত কুল, মাতঙ্গ কাননে।
মূরজ, ররাব বীণা বাজে নানা রাগে।
ভ্রমর গুঞ্জরে যেন আকুল কানন;—
প্রমোদ আবর্ত্তে সভা ঘূরে অবিরত!
হেন কালে আসি দূত সুগ্রীব চতুর,
সঘনে বহিছে শ্বাস, চকিত নয়ন,
মঞ্চহীন লতা সম ধরণী লুঠায়ে,
নমি রাজপদে, ধীরে, কহিতে লাগিলা
করযোড়ে;—"হে রাজন্‌! ত্রিভুবন মাঝে,
আমি ফিরি তব যোরে, অন্দরে কন্দরে,
অকুত সাহসে; দেখি নাই কোথা, কভু,
অসম্ভব ভব; দেখি কেবল তোমার,
প্রদীপ্ত যশের করে দীপ্ত চতুর্দ্দিক
সৃষ্টির; দীপিতে পারে কোন জ্যোতির্ম্ময়,
এক কালে চারি দিক পদার্থ নিকর!
কিন্তু আজি হেরিলাম হেন রূপছটা,
উজলিল যাহে মোর অন্তর বাহির।

জগত আধার কিন্তু দেখিলাম আমি;
নয়ন ধাঁধিয়া মোর গেল সেই রূপে।
ভ্রমিতেছিলাম আমি বারিদ বাহনে,
ব্যোমযান, রাজকর আদায়ি সংসারে
নিশা অপগমকালে; গুড়গুড় নাদে,
পশ্চিম প্রদেশে রথ উত্তরিলা যবে,
বিজলী বিজয়ধ্বজ উড়াইয়া তব,
লুকাইল তারা দল ভয়ে আমা দেখি।
চাঁদের শুকাল মুখ; দেখি যে পশ্চাদে
হাসিতেছে ঊষা, পাখি চিটিকারি দিছে,
দেখিয়া চাঁদের দশা, ভয়েতে আমার!
পতি দুখে দুখী সেই কুমুদীরে হেরে
সজল নয়ন, মোর দয়া উপজিল;
মেয়াদ দিলাম চাঁদে, নাগাদ প্রদোষ;
কহিলাম তারে, কর ছাড়িব না তদা,
আমিই আসি, কিম্বা দূত আসুক অপর।
দক্ষিণে চালায়ে রথ, গেলাম সাগরে।
থর থর করি অন্ধি কাঁপিল সভয়ে;
চুম্বিয়া রথের তল, বাস্পাকুল মুখে,
কহিল, জালিক এলে দিব রাজকর।
পথি মধ্যে ধরিলাম মলয় পর্ব্বতে;
নীল বেঁটে গেল মুখ আমায় দেখিয়া;

কত যে সুগন্ধি দ্রব্য দিলা উপহার,
আনিতে না পারি, তারে, দিলাম হুকুম,
পবনে বেগার ধরি পাঠাতে সে সব।
পূর্ব্ব রাজ্যে আসি মোর রথ উত্তরিল।
দেখি যে অরুণ মাঝে উদিতেছে রবি,
ধরিলাম রামধনু তাহার আগেতে;
মাথা নমাইয়া মোরে কর রাশি দিল,
উজল হইল যাহে বারিদ বাহন।
সদর্পে চলিল রথ উত্তর প্রদেশে;
ঘর ঘর শব্দে চক্র, ঘূরিল নির্ঘোষে;
মহীধ্র শেখর কত গমন সময়ে,
ধরিলা আমার আগে কলাপ নজর।
বনশ্রেণী গন্ধাধার লয়ে দাঁড়াইল;
অতল গভীর জল ত্যজি জলচর,
সসম্ভ্রমে উঠি মোর সন্মান করিল,
বারিদ বাহনে ধ্বনি শুনিয়া বিমানে।
এই রূপে চলি আমি আদরে আদরে।
কত দূরে গিয়া চাহি হিমাচল পানে;
দেখি যে জ্বলিছে গিরি প্রলয় অনলে,
আলোকে উজল করি জগত সংসার।
বিস্ময় নয়নে চাহি চারি দিক পানে,
দেখি না কারণ কিছু; ভাবিলাম মনে,

আগুনে কি জ্বলে হিম?—আগুন ত নয়,
আগুন হইলে তাহে উঠিত যে ধুম;
বিমল আলোক এ যে উত্তাপ বিহীন।
তবে কি গোলোক ধামে এলাম ভূলিয়া?
সূর্য্যের কি স্তূপ ওটা হিমাচল রূপে?
দেখিতে দেখিতে সেথা উত্তরিল যান;
অমনি হিমাদ্রি তারে আলিঙ্গন দিল।
আমার আহ্লাদ কত কহিব রাজন,
চারিদিক আলোময় দেখিয়া নয়নে—
কভুবা দাঁড়াই উঠি গম্ভীর স্বভাব,
কভুবা অমনি বসি মুচকি হাসিয়া,
বারিদ বাহনে কভু শুয়ে গান ধরি;
খেলি যেন পুটি মাচ নব জল পেয়ে।
সহসা হইল মনে, দেখি নাই কেন
কোথা হতে আসে হেন অদ্ভুত আলোক।
অমনি উঠিয়া ফিরি কন্দরে কন্দরে—
দেখিতে না পাই কিছু; পরে দেখি চেয়ে,
অধিত্যকা দেশে সেই প্রমোদ উদ্যানে,
বিমল আলোকে জ্বলে সেই রূপ রাশি,
উজলিল যাহে মোর অন্তর বাহির।
প্রথমে চাহিতে চোখে লাগিল আঁধার,
হাতে রগড়িয়া আঁখি হেরি পুনরপি,



দেখি যে কামিনী এক হে দানবপতি!
নব যৌবনের ভারে, রূপ রাশি ভারে,
পীনোন্নত স্তনভারে, অধীরা হইয়া,
যেন বসেছে সেখানে; তারি রূপ ছটা
উজল করেছে দেশ; অবাক হইয়া,
এক দৃষ্টে দেখি আমি সেরূপ মাধুরি,
স্তম্বিত নয়ন যুগ অর্দ্ধস্ফুট মুখ।
দেখি মোর ভাব ধনী হাসিলা ঈষৎ,
বিদ্যুতের আভা যেন লাগিল আঁখিতে;
অমনি মুদেছি চোক, দেখিয়ে অন্তরে
কোথা দিয়া গিয়া ধনী করিছে বিরাজ,
মনরূপ রাজ্য মোর উজল করিয়া;
তাই বলি 'দেখিলাম হেন রূপ ছটা
উজলিল যাহে মোর অন্তর বাহির।'"
সম্বরিল জিহ্বা দূত এতেক কহিয়া;
আঁখি প্রকাশিতে তবু লাগিল বিস্ময়।
"কি বলিলে দূত” (দৈত্য কুল মণি শুম্ভ,
কহিল, উল্লাসে)—"সত্য কি তোমার কথা?
দেখিছ কি নিজ চোখে সেই মহিলারে?
এমনি বিচিত্র রূপ, উজলিছে দিক?”
"কেমনে কহিব প্রভো (পুনঃ কহে দূত)
তব আগে, তুমি মোর মাথার মুকুট,

দেখেছি সে রূপসীরে নয়নেতে আমি,
পলকে চাহিতে যেই কেড়ে নিল মন;—
মনের বিহনে আঁখি, কেমনে দেখিবে?—
ইন্দ্রিয়ের সেথো মন। পলকে দেখেছে
আঁখি যাহা, বোধ তার শতাংশের অংশ,
পারে নাই হে রাজন্‌, করিতে ধারণ।
বোধ করেছে ধারণ যাহা, জিহ্বা তাহা
বলিতে অক্ষম।—কাম বিহার কানন,
হবে বুঝি সে ললনা; নয়ন যুগল,
মানস সরসী তাহে শম্বর অরির,
মনোরথ বায়ুভরে, সদা সচঞ্চল!
ফুটেছে শিরীষ দল গণ্ড যুগ ছলে,
বিলুণ্ঠিত মুক্তকেশ তাহে ভৃঙ্গ কুল।
মন্দার কুসুম দল ওষ্ঠাধর যেন।
স্তনযুগ বিরাজিত মঞ্জুকুঞ্জ রূপে;
ধিভ্রমে দুলিছে তাহে আবেশের লতা!
আর কি কহিব মুখে, মূঢ় মতি আমি,
অন্তরের ভাব দেব রহিল অন্তরে।”
নীরব হইল দূত, এতেক কহিয়া।
দূত বাক্য ছদ্মবেশে পশিল মদন,
শ্রবণ বিবর দিয়া শুম্ভের মানসে।
সম্মুখ সমরে যেন ডরাইয়া তারে।

আকুল পরাণ মন চঞ্চল নয়ন,
পুনরপি কহে শুম্ভ দূতেরে সম্ভাষি;—
"সুগ্রীব! বীরেন্দ্র তুমি, সুধুই কি তারে,
দেখিয়া আইলা ফিরে; করীন্দ্র যেমন
আগুন দেখিয়া তার কাছে নাহি যায়?—
কাছে গিয়া কিছু তারে জিজ্ঞাসিয়াছিলা?—
একাকিনী কেন বামা বসিয়া পর্ব্বতে;
কোথায় বসতি তার, কাহার রমণী;—
অনুমানে কি বুঝিলা?—হয়েছে কি বিভা?”
"তব বলে বলী আমি, হে ত্রিলোক পতি,
আমি কি ডরাই কারে?” (কহিলা সুগ্রীব)
"রমণীর রূপ দেখে কেন বা ডরাব?
সব সুধায়েছি তারে; কাহার রমণী,
একাকিনী কেন সেথা, বসতি কোথায়।
কহিলা আমারে বামা;—"কি জিজ্ঞাস বীর,
আমারে যে ভজে আমি, তাহারি রমণী;
চিরকাল একাকিনী, সাথি নাহি মোর;
সর্ব্বত্রেই বাস মোর, যেখানে যে দেখে।
সীমন্তে সিন্দূর বিন্দু দেখি নাই প্রভো,
কেন যে, বলিতে নারি; কুমারী বলিয়া,
কিম্বা, সে রূপের আগে সিন্দূরের বিভা,
খুলিবে না বলি ধনী পরেনি সিন্দূর।”

এতেক কহিয়া দূত, নীরব হইল।
প্রফুল্ল অন্তরে শুম্ভ, কহে পুনরপি,
দূতেরে;—"সুগ্রীব! তবে বিলম্বে কি কাজ;
আর একবার তুমি যাও হিমালয়ে;
কহগে সে প্রেমদারে;—ত্রিলোকের পতি
শুম্ভ প্রণয় আকাঙ্ক্ষী তব; দেবগণ
শিরমালে, শোভে যার চরণ যুগল,
সে জন তোমায় থোবে মাথায় তুলিয়া;
যে জন রাজত্ব করে সংসার উপরে,
মন রাজ্য আসি তার কর অধিকার।
হেন মতে ভাল করে, বুঝাইয়া তারে,
সঙ্গে লইয়া আসিবা, যাহাতে সে আসে;—
অশ্ব, রথ, গজ কিম্বা শিবিকারোহণে।
শীঘ্র গতি এস যেন বিলম্ব না হয়।”
"কেন বা বিলম্ব হবে, (উত্তরিল দূত),
এখনি লইয়া আসি, কৌস্তুভ রতন,
দোলাইয়া তব হৃদে পুরাইব সাধ।”
এত বলি রাজপদে নমিয়া সুগ্রীব,
বিদায় লভিল; শুম্ভ মানস তরণী,
উড়াইলা পালি যেন সুখের বন্দরে।
হেথা মনোরম বেশে, ভবেশ ভাবিনী,
অধিত্যকা দেশে ভ্রমে, প্রমোদকাননে

শুম্ভের;—পশিছে কভু, মঞ্জু কুঞ্জ মাঝে,
শোভার পিঞ্জরে যেন সুখ শুক পাখী!
কখন তুলিয়া ফুল, আঘ্রাণ লইছে।
কভু দাঁড়াইছে গিয়া আল বালোপরি
প্রস্রবণ পাশে; মরি, জলের ফোয়ারা
পাশে, রূপের ফোয়ারা যেন! কখন বা
শিলা পট্টে বসি ধনী ঈষৎ হাসিছে,
কৌতুক আবেগ মনে সম্বরিতে নারি;
আবার উঠিয়া পুনঃ হেট মুখে দেখে,
কুসুমকলিকাকুল কেমনে ফুটিছে।
বৃক্ষশাখা ধরি কভু, এক দৃষ্টে চাহে,
দূর গত কোকিলের কুহুরব পানে।—
রঙ্গে একাকিনী ভ্রমে উল্লাসে বরাঙ্গী,
আপনার ভাবে হয়ে আপনিই ভোর!
হেন কালে আসি দূত, রসিক সুগ্রীব,
অধরে মধুর হাসি, ভাবে ঢুলু ঢুল,
দেখা দিলা সে উদ্যানে মন্দ মন্দ গতি।
দেখিয়া তাহারে গৌরী, হাসিলা অন্তরে।
ভাবিলা, মায়ার জালে পড়েছে শীকার।
ধীরে ধীরে আসি দূত কহিতে লাগিল;—
"কি গো ধনি, কি করিছ, কি ভাবে ভ্রমিছ?
আবার এলাম আমি তোমায় দেখিতে।

হেট মুখে কি দেখিছ কুসুমের দলে?—
রূপের কি প্রতিবিম্ব পড়েছে উহাতে?
ঈষৎ হাসিছ কেন, আমায় দেখিয়া;
প্রদীপ্ত রবির বিভা মন্দীভূত করি?
রূপের সাগর তুমি; কি রূপ আবার,
এক দৃষ্টে চাহি দেখ এদিক ও দিক?”
তাকায়ে দূতের পানে, হরবিমোহিনী,
ঈষৎ হাসিয়া ধনী কহিলা তাহায়;—
"এখনি যে এসেছিলে, কি হেতু আবার?
বার বার কেন হেথা আসিছ একাকী;
মনের কি কথা কেন বল নাই খুলে।”
"বলিতে মনের কথা এসেছি এবার,”
(কহিল সুগ্রীব) “আমি একাকী আসিনি
এসেছে আমার সাথে দৈত্য পতি মম
ভেটিতে তোমায়। চল মোর সাথে ধনী;
ত্রিলোকের পতি শুম্ভ, তব প্রেমাকাঙ্ক্ষী।
যে জনের যশ রাশি জগত প্রদীপ,
মনের প্রদীপ তার হও সিয়ে তুমি।
কল হংস মালা ছলে কীর্ত্তিমালা যার,
নিয়ত আকাশে চলে দিগাঙ্গনাগণ
হৃদয় উদ্দেশে, তুমি আসি সুলোচনে,
হও সিয়ে সে শুম্ভের হৃদয়ের মালা।

যার বাণে জর জর অমর নিকর,
অন্তর জর্জ্জর তার মদনের বাণে,
আজি তোমার লাগিয়া।—এস মোর সাথে,
আমি লয়ে যাই তোমা সে শুম্ভের পাশে।
ত্রিলোকের আধিপত্য মুকুট ফেলিয়া,
অমনি তুলিয়া তোমা, লইবে মস্তকে;
শোভিবে অরুণ যেন উদয় শেখরে!"
হাসিয়া কহিলা গৌরী;—"হাঁহে শুম্ভ দূত,
এই কি মনের কথা? এসেছ কি তুমি
ইহারি লাগিয়া?—মোরে লইবার তরে?
জানি শুম্ভ মহাবীর, ত্রিলোকের পতি,
দেব গণ পরাভূত যার বাহু বলে,
বলগে সে দৈত্যরাজে, যার দূত তুমি,
যে জন সমরে মোরে, পারিবে জিনিতে,
যেজন পারিবে মোর দর্প হরিবারে,
স্ববলে লইতে মোরে পারিবে যে জন,
পতিত্বে বরণ আমি করিব তাহায়।
এই মোর পণ দূত বলগে শুম্ভেরে।
সাধ্য যদি থাকে তাঁর আসিয়া যুঝুন
মোর সাথে। পরাভবি, আমায় সংগ্রামে,
লয়ে যাউন তথা হয় অভিলাষ তাঁর;
বিনা যুদ্ধে এক পদ নড়িব না কভু।”

"সে কি ধনি, এ কি কথা, (কহিলা সুগ্রীব,
বিস্মিত নয়নে) ধনি, তোমারে কি সাজে,
শস্ত্র যুদ্ধ; কোমলাঙ্গী তুমি, ফুল দল,
ছিঁড়িতে কাতরা? বল, কেমনে যুঝিবে,
দৈত্য অনীকিনী সহ, বজ্রবক্ষ তারা?
কেমনে কোমল ভুজে আকর্ষিবা ছিলা,
তুলিয়া ধরিতে যাহা ঢলিয়া পড়িছে?
কমনীয় কলেবরে কেমনে সহিবা,
সে ক্লেশ? ভ্রমিতে সুখে কুসুম কাননে,
স্বেদ রূপে চাঁদ মুখে উথলিছে সুধা,
যদিচ বিজনি করে ফিরিছে পবন
তব সাথে সাথে। যুদ্ধ কি মুখের কথা?—
সুলোচনে, ছাড় হেন সর্ব্বনেশে পণ!
ধূম্রাক্ষ প্রভৃতি সেই সেনাপতি কুল,
পাষাণ হৃদয় তারা নাহি দয়া লেশ।
চোক্‌ বুজে তীক্ষ শর হানিবে বরাঙ্গে,
কোমল শরীরে অস্ত্র কাটিয়া বসিবে
ঠেকিতে ঠেকিতে। আপনার নাশ হেতু
আপনি হয়ো না। এস মোর সাথে ধনি,
এস মোর সাথে, আমি মিলিইগে তোমা,
লয়ে সে শুম্ভের সাথে; মিলিবে সুন্দর;—
চাঁদে চাঁদে যেন মেলা হইবে সংসারে!"

"বৃথা কেন আর বক? (কহিলা রুদ্রাণী)
বলগে যা বলিলাম তব প্রভু পাশে;
ভাঙ্গিব না পণ আমি, করিয়াছি যাহা,
থাকুক বা যাক প্রাণ। দেখিবে এখনি
কেমনে ধরিবে অস্ত্র এ ভুজ মৃণালে,
দৈত্যকুল বজ্র বক্ষ, কেমনে বিন্ধিব
তীক্ষ্ণশরে; প্রাণ লয়ে বাহিরিবে বাণ,
হবে না সাক্ষাত তার শোণিতের সহ,
দেহেতে প্রহরী রূপে সদা ঘুরে যাহা।
শুনিয়া কোদণ্ডধ্বনি খসিয়া পড়িবে,
মেঘ বাহনে বজ্র ভয়ে হাত হতে।
নিবিড় শরের জালে ছাইব জগৎ,
রোধিব বায়ুর গতি দেখাব আঁধার।
যাও যাও দূত, শীঘ্র বলগে শুম্ভেরে,
সাজিতে সমর সাজে—চরমের সাজ।”
আবেগে অধীরা গৌরী, এতেক কহিতে;
চঞ্চল বরাঙ্গে মরি, ধ্বনিল ভূষণ!
অবাক হইয়া দূত দেখিল সে ভাব।
এই মাত্র বলি তবে বিদায় হইল;—
"কহিলে মঙ্গল কথা, মন্দ যদি ভাব
আর না বলিব তবে; বলিয়া কি ফল?
আপনার ভাল যদি আপনি না কর,

আমার কি সাধ্য; মুখে বলা বৈত নয়;
না গিলিলে মুখে তুলে দেওয়ায় কি ফল
থাক থাক ক্ষণকাল, দেখিবে এখনি,
মৃত্যু বিভীষিকা সম, দৈত্য সেনাগণে।
বাসকসজ্জায় হেন, যমেরে ভেটিবে।
ছিটায়ে পড়িয়া রূপ রহিবে ধরায়।”
এতেক কহিয়া দূত, আসি উত্তরিল,
প্রভাতের সম, যথা শুম্ভ মুগ্ধ মন,
প্রেমের স্বপন দেখে মোহ নিদ্রা যোগে?—
আকাশ কুসম কভু তুলিছে উল্লাসে,
সুখের সাগরে কূল, দেখিছে না কভু,
আশারামধনুকেতে কখন বা দেখে,
কতই উজ্জল রঙ্গ মোহিনী মূরতি।
দূতেরে দেখিয়া যেন চৈতন্য হইল!
আস্তে ব্যস্তে জিজ্ঞাসিলা;—"একাকী যে তুমি,
দূত, কোথা সে প্রেমদা?—আসিতে কি পিছে?
আগে কি এসেছ তুমি সুসম্বাদ লয়ে?”
"যে সম্বাদ আনিয়াছি সুসম্বাদ তাহা
কেমনে কহিব প্রভো!” উত্তরিল দূত।
"সামান্য কামিনী, দেব, নহে সে রমণী—
তব সাথে যুঝিবারে কামনা তাহার।”
বিস্তারি কহিল দূত গিরিজার বাণী।

শুনিয়া তেজস্বী বাক্য দৃঢ় পণ কথা
ভবানীর, দূত মুখে, প্রেমস্পৃহা লতা,
ধৈর্য্যের মঞ্চেতে যেন ধরে না শুম্ভের।—
বীরত্ব গুণেতে মজে বীর জন মন?
কেননা মজিবে বল? অনলের প্রেমে
মুগ্ধ, পবন নিয়ত। প্রফুল্ল অন্তরে,
ডাকিলা ধূম্রলোচনে, তবে দৈত্য পতি।—
"কোথা হে ধূম্রলোচন?” অমনি ছুটিল,
প্রতিধ্বনি চারিদিকে, রাজ আজ্ঞা লয়ে,
বার্ত্তাবহ কত শত পশ্চাতে তাহার।
দৈত্য অনীকিনী মাঝে, চমকিল বীর;
অমনি উঠিয়া, নমি, মানসে শুম্ভেরে,
করবার করে বলী, আসি উত্তরিল,
ত্রিলোক জিতের পাশে। প্রণমিয়া ধীরে,
করষোড়ে সবিনয়ে কহিলা;—"রাজন্‌!
উপস্থিত দাস, করে করবার; তব
কি কার্য্য সাধিব? দেহ অনুমতি ত্বরা,
সৃজিব শোণিত অব্ধি, কিম্বা দেব মেধে,
মেদিনীরে আর কিছু করি দিব উচু?
বায়ুরে কি লৌহ সম করি দিব গুরু;
শব পরমানু রাশি মিশায়ে উহাতে?
কি আজ্ঞা দাসের প্রতি কহ দৈত্যরাজ?”

"জানি হে ধূম্র লোচন, তব তেজ আমি,
(কহিলা দনুজ রত্ন) সাহস পতাকা
তুমি, বীরত্বের চূড়া; অসাধ্য কি তব?
সাধ মোর এই কাজ এবে বীর বর,
হিমাদ্রি শেখরে ত্বরা যাহ এক বার,
দেখিবে ভ্রমিছে তথা প্রমোদ উদ্যানে
রঙ্গে, রূপমদে মত্ত কলাপিনী প্রায়,
তরুণী কামিনী এক, প্রেমের আধার;
যুঝ গিয়া তার সাথে লয়ে নিজ বল।
গিয়াছিল দূত মোর আনিতে তাহারে;
তার পাশে এই পণ করেছে সে ধনী,
যে জন সমরে তারে পরিবে জিনিতে,
যে জন পরিবে তার দর্প হরিবারে,
স্ববলে লইতে তারে পারিবে যে জন,
পতিত্বে বরণ বামা করিবে তাহায়।
বীর দর্প কতমত করেছে অপার।
যাও শীঘ্র গতি বীর বিলম্বে কি কাজ,
সমরে সমর সাধ মিটাইয়া তার
বাহুবলে, ত্বরা করি লয়ে এস হেথা।
সেনাপতি পদে আমি বরিলাম তোমা।”
"এখনি এলাম বলি লইয়া তাহারে,
(কহিলা ধূম্র লোচনে) ধীবরের প্রায়,

মীন সম রোধি শরজালে; ভেটি তারে,
ওপদপঙ্কজে প্রভো, সার্থকিব জন্ম।
এত বলি রাজপদে প্রণমিয়া বীর
বিদায় লভিল; শুম্ভ আশা জাল যেন
পশিল সাগর তলে উদ্ধৃতে রতন!

ইতি দানব দলন কাব্যে দূত সম্বাদ নামক দ্বিতীয় সর্গ।