পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সত্তার প্রতিবেদন রচনা করেন? একদিকে ভাষিক আগ্রাসন অন্যদিকে ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদের চোরাবালি। এদের সম্মিলিত যোগফল হল ভাষাচেতনার শীতলতা অর্থাৎ বঙ্গীয় সংস্কৃতির উত্তাপকেন্দ্র থেকে দূরবর্তী হওয়াতে এবং নানা ধরনের আক্রমণ সইতে সইতে আস্তিত্বিক অভিজ্ঞান সম্পর্কে নিম্পূহতা। উনিশে মে তাহলে হয়ে উঠুক পুনরুজ্জীবনের প্রতীক ও নবনির্মাণের উৎস। আর, যেকথা বলতে চাইছি, বাঙালির সমস্ত ভুবনে ছড়িয়ে দিক সতর্কীকরণের প্রেরণা। কেননা আস্তিত্বিক অভিজ্ঞানের ওপর আক্রমণ দিনদিন বাড়ছে সর্বত্র। অন্তত গত এক দশকে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ও ভোগবাদের বিশ্বায়ন ক্রমাগত বিষক্রিয়া ছড়িয়ে দিয়েছে সত্তার কোষে কোষে। সন্দেহ নেই যে আপৎকালীন পরিস্থিতি এখন সমগ্র বঙ্গভাষী পরিসরে। হয়তো অবস্থানগত দুর্বলতা ও পশ্চাৎপরতার জন্যে বরাক উপত্যকায় আশঙ্কার কালো মেঘ বেশি ভয়ঙ্কর। সুতরাং উনিশের চেতনা সমস্ত বাঙালির কাছেই বিশল্যকরণী হিসেবে গৃহীত হতে পারে। নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না, এ তো সাধারণ সত্য। সাম্প্রদায়িকতার সস্তা রাজনীতি দিয়ে নব্য উপনিবেশবাদের দোসর ও হিন্দু পুনরুত্থানবাদের পতাকাবাহী আর্যাবর্তের বিপথগামী প্রতিভাবাদর্শ বাঙালি সমাজকে তার হাজার বছরের সংশ্লেষণ মূলক গ্রহিষ্ণু ও উদারনৈতিক ঐতিহ্য থেকে ধ্বস্ত করার জন্যে মরিয়া চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। পৌর সমাজ আজও সাধারণ ভাবে। (বরাক উপত্যকার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চল বাদ দিয়ে) বিকারগ্রস্ত হয়নি; কিন্তু রাজনৈতিক সমাজে কিছু কিছু ট্রয়ের ঘোড়া ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। ভয়টা ওখানেই। আর এইজন্যেই উনিশের চেতনার প্রাসঙ্গিকতা। কবি-লিখিয়ে-চিন্তাজীবীদের হাতে, নিজেদের অজ্ঞাতসারেও যেন, কখনও উঠে না-আসে নিরোর বেহালা। যেন ঘুঁটে পুড়লে গোবর না হাসে।

 শুধু বরাক উপত্যকার জন্যে নয় উনিশে, যেমন একুশ ফেব্রুয়ারি নয় কেবল বাংলাদেশের। উনিশের চেতনা নয় মৃণালভোজী সম্প্রদায়ের জন্যেও। ভালো বাঙালি হওয়ার জন্যেই উনিশে মে আমাদের জীবনের নবীন যাত্রা রচনায় উদ্বুদ্ধ করুক, নিয়ে যাক রূপ থেকে রুপান্তরে, প্রবল থেকে প্রবলতর উদ্‌ভাসনে। ভালো বাঙালি যে হতে পারেনি, ভালো ভারতীয়ও সে হতে পারবে না কখনও—ভালো মানুষও নয়। কেননা মৌলবাদের হিংস্র দাপট ও অজস্র প্ররোচনা সত্ত্বেও অবিচল থাকে যে-বাঙালি, উনিশের চেতনা তাকে ঘিরেই পুষ্পিত হয়। চর্যাপদের যুগে আমাদের জাতীয় চেতনার যে অভিজ্ঞান নিণীত হয়েছিল, সেই প্রতিবাদী মনন ও বোধ পুনরুজ্জীবিত করে একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে। উনিশের চেতনা মানে অপরাজেয় মানবিক পরিসর পুনরাবিষ্কার।

৫৯