সময় অসময় নিঃসময়/উনিশে মে, আমাদের উত্তরাধিকার

উইকিসংকলন থেকে

ভা ষা ও অ স্তি ত্ব

উনিশে মে, আমাদের উত্তরাধিকার

 ‘হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় উনিশ’—এই শিরোনামে এবার শিলচর শহরে প্রতিদিন সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালন করা হলো। পঁচিশে বৈশাখ থেকে এগারোই জ্যৈষ্ঠ, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল। আঁখির দুটি তারা। নিজেদের নতুন ভাবে মনে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে: ‘বাঙালিত্বই অন্বিষ্ট—হিন্দুত্ব নয়, মুসলমানত্ব নয়, অন্ধ ও বধিরদের সমাজে এই বার্তা পৌঁছে দিতে পারে একুশে ফেব্রুয়ারি, উনিশে মে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বন্দিত একুশে ফেব্রুয়ারি তবু তো উদ্‌যাপিত হয় পশ্চিমবঙ্গে, কিন্তু ১৯৬১ সালের ১৯ মে তো ব্রাত্য ছিল ক-বছর আগেও। আসামের শিলচর শহরে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় করতে গিয়ে ওইদিন এগারো জন শহিদ হয়েছিলেন, সে-খবর বহুলোক জানতেন না এই সেদিন পর্যন্ত। শান্তিপূর্ণভাবে সত্যাগ্রহরত বাঙালিদের উপর স্বাধীনতা পরবর্তী গণতান্ত্রিক পর্যায়ে আসাম সরকারের পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছিল। এই ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা আমাদের চেতনায় যতটা আলোড়ন তুলতে পারত, পুনরুজ্জীবনের প্রেরণা দিতে পারত—তা কিন্তু হয়নি। আমাদের পারাপারহীন ঔদাসীন্যে এতটুকু চিড় ধরেনি কোথাও।

 তবু উনিশে মে-র কাছে ফিরে যেতে হয়। নিষ্কর্ষ খুঁজতে হয় পুনর্নির্মাণের। ভাষা আন্দোলন চলমান এক প্রক্রিয়ার নাম: কোনো একটা বিশেষ তারিখ অন্য দিনগুলির তুলনায় উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে, এইমাত্র। ভাষা-সংগ্রামের বহুমুখী মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়ন করে বুঝি, বৃহত্তর গণসংগ্রামের অপরিহার্য অঙ্গ হল ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বরকত-সালাম-জব্বারেরা শহিদ হয়েছিলেন বলেই ধাপে ধাপে তৈরি হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলা নামে দেশের জন্ম-লগ্ন। ইতিহাস ও ভূগোলের যৌথ আক্রমণে বরাক উপত্যকা (আসামের দক্ষিণ অংশে সাবেক কাছাড় জেলা) যেহেতু প্রান্তিকায়িত হয়ে পড়েছিল, তার গভীর সর্বাত্মক সংকট কখনো তেমন মনোযোগের বিষয় হয়ে ওঠেনি। বহুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ঐতিহ্যগত ভাবে শ্রীহট্ট বা সিলেট বৃহত্তর বঙ্গভূমির অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও ধূর্ত ব্রিটিশ ১৮৭৪ সালে তাকে আসামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা-নির্ভর রাষ্ট্রযন্ত্র রাজস্বখাতে অনেকটা লাভবান হল যদিও, ‘বাঙালির আধিপত্য’ নামক জুজুর ভয় দেখতে শুরু করল কেউ কেউ। ক্রমান্বয়ে বিদ্বেষ-বুদ্ধির বিষবৃক্ষে শুধু জল সেচনই করা হল। দেশ বিভাজনের সময় গণভোটে সিলেট আসাম থেকে সরে গিয়ে যুক্ত হল পূর্ব পাকিস্তানে। শুধু সাবেক সিলেটের পূর্ব প্রান্তের কিছু অংশ যুক্ত হল দেশভাগ পরবর্তী কাছাড় জেলার সঙ্গে। এই নতুন কাছাড় ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিকভাবে কিন্তু বৃহত্তর বঙ্গভূমিরই অংশ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এই ভূমিও মমতা-বিহীন কালস্রোতে বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে নির্বাসিত। বহু শতাব্দী থেকে বাঙালিদের নিরন্তর প্রব্রজন চলেছে এখানে, বাংলাই এখানকার ভাষা—কী সাহিত্যে কী গণসংযোগের মাধ্যম হিসেবে। ইতিহাসের বিচিত্র জটিলতায় তা আসামের অঙ্গ হলেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সঙ্গে এর কোনো আত্মিক সংযোগ কখনও ছিল না।

 দেশ বিভাজনের পরে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সর্বস্ব হারিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ বাঙালি এলেন বরাক উপত্যকায়। তাঁরা কয়েক প্রজন্মের ভিটে-মাটি থেকে উৎখাত হয়েছিলেন; কিন্তু নতুন করে ভাষার অভিজ্ঞান হারাতে রাজি ছিলেন না। তাঁরা সবাই উপভাষা অঞ্চলে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন, এখনো বলেন। কিন্তু দেশ বিভাজনের আগে যেহেতু তাদের বাঙালিত্ব বা কথ্যভাষার স্বরূপ সম্পর্কে কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, তেমনি বাস্তুহারা হয়ে বরাক উপত্যকায় আসার পরে নতুনভাবে প্রশ্ন ওঠার কোনো কারণ ছিল না। আসামের পশ্চিম-প্রান্তিক জেলা গোয়ালপাড়াকে অসমিয়াকরণ নীতির সহজলভ্য শিকারে পরিণত করার পরে কাছাড় সম্পর্কেও একই নীতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ভাষিক সম্প্রসারণবাদীদের চক্রান্ত যখন কাছাড়ে প্রতিহত হল, অসম সাহিত্যসভার মতো উগ্র আগ্রাসনপন্থী সংস্থা ও সরকারি আমলাতন্ত্র কাছাড়ের বাঙালিদের ভাষাকে বাংলা নয় বলে প্রমাণ করতে উঠে-পড়ে লাগল। জনগোষ্ঠীর যেসব অংশ শিক্ষার অভাবে পশ্চাৎপর, ভীরু ও লোভী হয়ে উঠেছিল, তাদের নানাভাবে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদীরা দিনকে রাত ও রাতকে দিন করতে চাইল। উপভাষা ও বিভাষার বৈচিত্রকে অসমিয়ার অপভ্রংশ বলে প্রমাণ করার জন্যে সরকারি পণ্ডিতেরা ‘থিসিস’ লিখলেন নানারকম। তাই বরাক উপত্যকার ভাষাসংগ্রামের অনেকগুলি দিক রয়েছে। এখানকার বাঙালিকে তার নিজস্ব জাতিসত্তা ও ভাষিক পরিচয়কে প্রমাণ করতে হচ্ছে তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে। বাংলাদেশে তা অন্তত করতে হয় না। আসলে মূর্খ যখন ধূর্ত ও কুচক্রী হয়ে ওঠে, তাদের সঙ্ঘবদ্ধ ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্যে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়। তাই ভাষা-সংগ্রাম নিয়ত নবায়মান সংকটের দিকেও তর্জনি সংকেত করে। বুঝিয়ে দেয়, এই সংগ্রাম নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলমান এবং স্তর থেকে স্তরাত্তরে আক্রমণ মোকাবিলা করার ধরনও আলাদা-আলাদা।

 এই প্রেক্ষাপট বুঝে নেওয়াটা খুব জরুরি। নইলে, ‘আসামে অসমীয়া ভাষা চলবে না তো কি তামিল, তেলেগু চলবে’ গোছের ফাঁপা সপ্রতিভতা দেখানোর রেওয়াজ চলতে থাকবে। সবচেয়ে পরিতাপের কথা, বাঙালিরাই তাঁদের অনেক ভুবন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন; এমন কী, দূরীকৃত অপর পরিসরগুলি সম্বন্ধে প্রায় নিষ্ঠুরভাবে উদাসীন। এইজন্যে ১৯ মে-র তাৎপর্য অনুধাবন করা সমস্ত বঙ্গভাষীর পক্ষে আবশ্যিক। নিছক কোনও দিবস উদ্‌যাপনের জন্যে নয়, জাতিসত্তা ও ভাষাসত্তার বহুস্বরিক নিষ্কর্ষ পুনঃপাঠ করার জন্যে ১৯ শের চেতনা হয়ে উঠতে পারে দর্পণের মতো। শাসকের তৈরি কৃত্রিম রাজনৈতিক মানচিত্র বাঙালির ভুবনকে বহুধা-বিচ্ছিন্ন করলেও সামূহিক অস্তিত্বের বোধে পুনঃদীক্ষিত হতে পারি যদি, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিভ্রান্তিকে। অনেক কার্যকরী ভাবে প্রতিহত করতে পারব। এ ব্যাপারে বরাক উপত্যকার মতো প্রান্তিক জনপদের সংগ্রামী মানুষেরা অবিভাজ্য বাঙালি সত্তার নিরীক্ষা-সংকট-উত্তরণ সম্পর্কে মূল্যবান উপলব্ধির সংকেত যোগান দিতে পারেন।

 কালের যাত্রার ধ্বনি সবাই শুনতে পান না: অস্বস্তিকর এই সত্য মেনে নিতে হয়। আত্মবিস্মৃতির আয়োজন আঞ্চলিক-জাতীয়-আন্তর্জাতিক স্তরে এত নির্বাধ যে মেকি ইংরেজিয়ানা ও মোটা দাগের হিন্দিয়ানা, বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মকে, প্রায়-সম্পূর্ণ অনিকেত করে দিয়েছে। ব্যক্তি-জীবন ও সামাজিক অস্তিত্ব থেকে ভাবাদর্শের প্রাসঙ্গিকতা নিঃশেষে মুছে দিয়ে আমরা এখন বিশ্বায়নের সর্বগ্রাসী ভোগবাদ ও পণ্যদেববাদের গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছি। ১৯ মে-র এগারো জন শহিদের বুক-মাথা ফুটো-করে দেওয়া বলেটের হিংস্র শিস আমরা কেউ শুনতে পাই না। শুনতে পাই না ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট ও ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই তারিখে শহিদ হওয়া আরও তিনজন মৃত্যুজিৎ তরুণের বার্তা। দেখতেও পাই না কোথায় অন্ধকারের শুরু আর কোথায় শেষ। আমরা বধির, আমরা অন্ধ। আমরা সেই জগদ্দল পাথর, সময়-শৈবাল যাদের ঢেকে দিয়েছে। তারিখ কি কেবলই তারিখ, ক্যালেণ্ডার থেকে ঝরে—যাওয়া যে-কোনো একটি পাতা?

 ‘মনে হয় অজন্ম মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম আজি নব প্রভাতের শিখর চূড়ায়’—রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এরকমও বলা কঠিন। যদিও গত কয়েক বছরে বরাক উপত্যকায় ১৯ মে যথেষ্ট উৎসাহের সঙ্গে পালিত হচ্ছে এবং অন্তত কয়েক বছর ধরে কলকাতায় এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্য দু-তিনটে জেলা শহরে এদিন কিছু কিছু অনুষ্ঠান হচ্ছে—তবু বলা যায়, ১৯-এর চেতনা আজও প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি। পায়নি কারণ দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য গভীরভাবে ভেবে দেখার মতো অবসর বাঙালি বুদ্ধিজীবীর আজও হয়নি। আসলে ইতিহাসও মূলত এক প্রতিবেদন যাকে অনুভূতি দিয়ে আন্তরিকতা দিয়ে অধ্যবসায় দিয়ে গড়ে তুলতে হয়। ইতিহাসের কাছে তেমন কোনও দায় বোধ করিনি বলেই এই সেদিন পর্যন্ত স্বরচিত হিম নীরবতার দুর্গে স্বেচ্ছাবন্দী ছিলাম আমরা।

 মাত্র ক’বছর হল, বরাক উপত্যকায় ভাষা-সংগ্রাম সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য ও স্মৃতিচারণ মূলক বই বেরিয়েছে। এইসব উদ্যমের প্রশংসা করেও বলব, এদের একটিও পূর্ণাঙ্গ নয়। কেননা কোথাও নৈর্ব্যক্তিকতার অভাব খুব প্রকট আর কোথাও নিরপেক্ষতার। ১৯৬১-এর ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলনে আসামের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি সূচনাপর্বে হয়তো বিভ্রান্তির পরিচয় দিয়েছিল কিন্তু ক্রমশ জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের প্রভাবে সেই বিভ্রান্তি অনেকখানি কেটেও গিয়েছিল। এই বিষয়টি জেনেশুনে যাঁরা চেপে যেতে চান, তারা ভাষা-সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে সামান্যতম স্বীকৃতি দিতেও নারাজ। এর প্রভাব স্পষ্টত পড়েছে ভাষা-সংগ্রামের ইতিহাস রচনায়। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকার চিরাচরিত বিপ্রতীপতা কীভাবে কমিউনিস্ট পার্টি সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের রাজ্যিক নেতৃত্বকে ভাষা-সংগ্রামের বাস্তবতা সম্পর্কে অসংবেদনশীল করে তুলেছিল—এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির তথ্য-সমৃদ্ধ বিশ্লেষণ করা হয়নি। ১৯৯৪ সালে শিলচরে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ইতিহাস বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বিভাগ প্রণালীবদ্ধ গবেষণার মাধ্যমে এই জরুরি কৃত্যটি করতে পারতেন। কিন্তু এধরনের কোনও উদ্যম আজ পর্যন্ত গ্রহণ করা হল না কেন, তা ভেবে বিস্মিত ও বিষণ্ণ হই।

 সবেমাত্র ইতিহাস প্রণয়ন শুরু হয়েছে। তাই হয়তো ১৯৭২ ও ১৯৮৬ সালে বরাক উপত্যকার ভাষা-আন্দোলনে কীভাবে দুটি পর্যায় তৈরি হল, তার বিশ্বাসযোগ্য ও বিশ্লেষণগর্ভ প্রতিবেদন এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আসামের মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যদের বিজ্ঞপ্তি ও গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কিত নির্দেশিকার প্রশ্নে গণআন্দোলন কিন্তু ১৯৬১-এর ভাষাসংগ্রাম থেকে চরিত্রগত ভাবে আলাদা। যতদিন পর্যন্ত সমস্ত পর্যায় ইতিহাসের আধেয় না হচ্ছে, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলমান ভাষাসংগ্রাম সম্পর্কে আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ হবে না। আরও কিছু অনাবশ্যক জটিলতাও স্থায়ীভাবে নিরাকৃত হওয়া উচিত। ১৯৭২-এর ভাষা-শহিদ বিজন (বাচ্চু) চক্রবর্তী যেহেতু গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের নেতা ছিলেন এবং সে-সময় কোনো একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সন্দেহজনক, চরম অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে ওই পর্যায়ের ভাষাসংগ্রামকেও অস্বীকার করেছেন কেউ কেউ। এ ধরনের পক্ষপাতপূর্ণ ও রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রবণ মনোভঙ্গি চল্লিশ বছর পরেও অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে; নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস রচনায় আজও তা বড়ো বাধা। উল্টো দিক দিয়ে, উদ্যমের চূড়ান্ত অভাব রয়েছে জনগণের প্রগতিশীল অংশেও। স্মৃতিকথা লিখে উৎসাহ শেষ হয়ে যাচ্ছে এঁদের, প্রণালীবদ্ধ ঐতিহাসিক প্রতিবেদন রচনার কোনো চেষ্টা করেননি এঁরা। সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের ভাষাসংগ্রামের প্রতিতুলনায় কেবল দ্বিমেরুবিষমতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে লাগাতার লড়াই করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উন্মোচন প্রক্রিয়া প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তানে ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ক্রমাগত শানিততর হয়েছে। কিন্তু আধিপত্যবাদী শক্তির প্রতিনিধিরা যেহেতু কৌশলে বরাক উপত্যকার ভাষা-আন্দোলনকে ছিনতাই করে নিয়েছে বারবার, গণতান্ত্রিক চেতনার অন্তঃসার তেমন ভাবে বিকশিত হতে পারেনি। তেমনই মৌলবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবেও তাকে ঠিকমতো ব্যবহার করা যায়নি।

 এই আত্মসমালোচনার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। বস্তুত খোদ বরাক উপত্যকায় প্রতিবাদী চেতনা অস্তমিত। ইণ্টারনেট জমানায় বাংলা-মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিতে অদ্য ভক্ষ্য ধনুর্গুণ পরিস্থিতি। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে-ওঠা ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলগুলিতে হাঁসজারু ও বকচ্ছপদের বাড়বাড়ন্ত। ভাবা যায়, এরা বাংলা বই পড়ে না, বাংলা গান শোনে না, বাঙালির উত্তরাধিকার নিয়ে এদের কোনো শ্রদ্ধা নেই। যে-কোনো মূল্যে সাফল্য-মৃগয়ায় টিকে থাকাই এদের একমাত্র নীতি; এরা প্রকাশ্যে ভাষা-আন্দোলন ও শহিদের স্মৃতিচারণকে বলে ‘টিপিক্যাল সেণ্টিমেণ্টালিটি'। আত্মবিস্মৃত উত্তর-প্রজন্ম এইমাত্র জানে যে উনিশে মে শিলচর রেল স্টেশনে গুলি চলেছিল। মারা গিয়েছিল এগারোজন যাদের বছর-বছর ভাষা-শহিদ বলে প্রচার করা হয়। মোড়ে মোড়ে ধূসর ফটোতে মালা চড়ানো হয়, কয়েক ঘণ্টার জন্যে তৈরি বেদিতে ধূপকাঠি জ্বলে। গান-বক্তৃতা-কবিতা হয় এদিক-ওদিক। গত ক’বছর ধরে ক্যাসেট বেরোচ্ছে, পুস্তিকা বেরোচ্ছে। খবরের কাগজের কলমচিদের সেদিন অন্তত বিষয় খুঁজতে হয় না। বছরের বাকি তিনশ চৌষট্টি দিন যত রবি জ্বলুক না, আঁখি মেলে তাকায় না কেউ। পিঠ পুড়তে থাকলে শুধুমাত্র ফিরে শোওয়ার কষ্টটুকু স্বীকার করে। কিন্তু উত্তর-প্রজন্মের কথাই বা লিখছি কেন, আম-জনতার কাছেও বাংলা নামে দেশের উত্থান কোনো তাৎপর্য নিয়ে আসেনি। ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতার বন্দীশালা ভেঙে বাঙালি জাতি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষায় উত্তরণ ঘটেনি। কালের যাত্রার ধ্বনি শুনতে পাননি কেউ। আপাত-সময়ের রঙিন মুখোশে মুগ্ধ ও বিভ্রান্ত প্রায় সবাই, বিশেষত বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবীরা চূড়ান্ত আত্মপ্রতারক এবং কস্তুরীমৃগের মতো আপনার গন্ধে আপনি বিভোর। প্রকৃত সময়ের গভীর সংবেদনায় প্রাণিত হতে এখনও অনেক বাকি।

 মেকি নাগরিকতার দর্পে আচ্ছন্ন মধ্যবিত্ত বর্গের একটা বড়ো অংশের কাছে ভাষা-সংগ্রামের পরম্পরা কোনও তাৎপর্য বয়ে আনে না। উপভাষাগত পরিচয় কিছু কিছু শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। বাঙালি হয়ে ওঠার চেয়ে নো ম্যানস্‌ ল্যাণ্ডে দাঁড়ানো দোআঁশলা অস্তিত্ব হয়ে ওঠা বরং অনেক সহজ। এরা ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে পড়ান এবং পরে ব্যাঙ্গালোর-হায়দ্রাবাদ কিংবা অন্য কোথাও পাঠিয়ে ডলারের স্বর্গরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার পাসপোর্ট সংগ্রহ করার স্বপ্ন দেখেন। ভাষা-সংস্কৃতি চেতনা নিয়ে এরা কিছুমাত্র চিন্তিত নন বলে অসমিয়াকরণ বা হিন্দিকরণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে এদের কোনও বক্তব্য থাকে না। ফলে বিচিত্র স্ববিরোধিতায় আক্রান্ত এখনকার বাঙালি সমাজ।

 এর একটা বড়ো কারণ সম্ভবত এই যে বঙ্গীয় রেনেসাঁসের তরঙ্গাভিঘাত থেকে দুটো চারটে ছোট ঢেউও এখানে পৌছায়নি। ভাষিক চেতনা বিকশিত হতে পারত। শিক্ষাপ্রসারের আন্দোলন এবং তার সহযোগী দীপায়ন ও সমাজ-সংস্কারমূলক আন্দোলন পরিচালিত হলো। এখানকার মধ্যবিত্ত বর্গের বিলম্বিত বিকাশ এবং নগরায়নের অতিধীর লয়ে গ্রাম-শহরের বিভাজনকে মনস্তাত্ত্বিক স্তরে জগদ্দল পাথর করে তুলছে। তার ওপর মধ্যবিত্ত বর্গের উৎসগত চরিত্র অর্থাৎ উচ্চবর্ণীয় হিন্দু হিসেবে তাদের পরিচিতি এবং শিলচর-করিমগঞ্জের নাগরিক সমাজে তাদের উজ্জ্বল অবস্থান নিম্নবর্গীয় গ্রামীন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ক্রমাগত বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। কৃষিভিত্তিক সামন্ত সমাজের স্বাভাবিক স্থবিরতার সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কূপমণ্ডুকতা যুক্ত হওয়ার ফলে ওই বিরূপতা ভুলভাবে সাম্প্রদায়িক চেহারা নিয়েছে। কিংবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহৃত নিজস্ব বিভাষার গোত্র-পরিচয় জানার কোনও আকাঙ্ক্ষা না থাকাতে সংঘবদ্ধ হীনমন্যতা স্বতঃসিদ্ধ ভাবে আত্ম-নিরাকরণে পরিণত হয়েছে।

 এই আত্ম-অস্বীকৃতির ফলেই বাংলা ভাষা হয়ে পড়ছে দূরবর্তী কোনও নক্ষত্রের মতো ঝাপসা। নিশ্চেতন মন সবচেয়ে আগে উপনিবেশের দখলে যায়, তা বাইরের হোক কিংবা ভেতরের। বরাক উপত্যকার অন্তেবাসী গ্রামীন হিন্দু-মুসলমান এর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। এদের মধ্যে মধ্যবিত্ত বর্গের অনুপস্থিতি এবং ধর্মীয় কুহকের নির্বাধ বিস্তার নিজেদের বাঙালি বলে চিনতে দেয়নি। এছাড়া আরো একটা গুরুতর কথাও আছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার রাজনৈতিক বাস্তবতায় নাড়া বাঁধা বলে ভাষিক সম্প্রসারণবাদ ও অভ্যন্তরীন উপনিবেশবাদের সহজ শিকার বরাক উপত্যকা। একটু আগে বিভাষাগত পরিচয়ে যে-বিভ্রান্তির কথা বলেছি, তা এখানকার আধা-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই। সহজ পথে কিছুই এখানে অর্জনীয় নয় বলে সব কিছু বাঁকা পথে চলে। উপনিবেশীকৃত মনে কোনও প্রতিরোধ থাকে না। তাই শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত নির্বিশেষে একই নিয়ম প্রযোজ্য এখানে। ভাষা-সংগ্রামের উত্তাপ যত বেশি স্তিমিত হয়ে আসছে, আত্মসমর্পণের প্রবণতা বাড়ছে তত। যাদের কাছে বরাকভূমি সহজ মৃগয়াক্ষেত্র, তারা কিছু কিছু মধ্যস্বত্ব-ভোগীদের তৈরি করেছে। এরাই ভাষা-চেতনার হননকারী। চতুর হিসেব কষে এরা উসকে দেয় সাম্প্রদায়িক অপচেতনাকে, অন্ধতাকে নিরঙ্কুশ করে রাখে নানা অজুহাতে এবং এরাই মূঢ়তাকে সম্বল করে। এরাই সাপ হয়ে ছোবল দেয় এবং ওঝা হয়ে বিষ ঝাড়তে আসে। এরাই বরাক উপত্যকার জনজীবনে বহুস্বরসঙ্গতির প্রবণতাকে নষ্ট করতে চায়। বাংলার বিভাষাকে অসমিয়ার গাঁটছড়ায় বাঁধতে চায়। কেননা এতেই আধা-ঔপনিবেশিক রাজনীতি-অর্থব্যবস্থা-অপসংস্কৃতির পুষ্টি। এইসব মধ্যস্বত্বভোগীরা স্থানীয় মোড়ল কিন্তু আসলে রাজ্যিক কেন্দ্র ও দিল্লির মসনদের প্রতাপযন্ত্রের সেবক। এদের থাবার নিচে লুকোনো বাঘনখ সহজে চোখে পড়ে না। সাধারণ মানুষের।

 তাই ভাষা-সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের চেতনাকে জারি রাখার কঠিন লড়াই সামনে: এই বার্তা প্রতিবার নিয়ে আসছে উনিশে মে। নিশ্চয় মুখ্যত বরাক উপত্যকার আত্মবিস্মৃত বাঙালিদের জন্যে, কিন্তু গৌনত কি পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গভাষীদের জন্যেও নয়? এটাও ঠিক, বরাক উপত্যকাতেই শিশুপাঠ্য বইগুলিতে অবাধে চলছে বাংলা ভাষার বিদূষণ। অসমিয়া শব্দ ও বাক্যবদ্ধ ইচ্ছে করে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে চেতনাকে বাঁধতে পারে সহস্র শৈবালদল। বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ঘরে শত্রু বাইরে শক্র, জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের দৌলতে মগজে ধোলাইয়ের আয়োজন নির্বাধ, এব্যাপারে দিল্লি-ওয়াশিংটন একজোট। মুছে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথনজরুলজীবনানন্দসত্যজিৎঋত্বিক। শৈশব থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন সুকুমার রায়উপেন্দ্রকিশোরশিবরাম। কে আর খবর রাখে বিভূতিভূষণতারাশংকরমানিকের কথনবিশ্ব কীভাবে জীবনের জয় ঘোষণা করে, কীভাবে ওয়ালীউল্লাহহাসান আজিজুল হকআখতারুজ্জামান ইলিয়াসশামসুর রাহমানমোহাম্মদ রফিক অবিভাজ্য বাঙালি সত্তার প্রতিবেদন রচনা করেন? একদিকে ভাষিক আগ্রাসন অন্যদিকে ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদের চোরাবালি। এদের সম্মিলিত যোগফল হল ভাষাচেতনার শীতলতা অর্থাৎ বঙ্গীয় সংস্কৃতির উত্তাপকেন্দ্র থেকে দূরবর্তী হওয়াতে এবং নানা ধরনের আক্রমণ সইতে সইতে আস্তিত্বিক অভিজ্ঞান সম্পর্কে নিম্পূহতা। উনিশে মে তাহলে হয়ে উঠুক পুনরুজ্জীবনের প্রতীক ও নবনির্মাণের উৎস। আর, যেকথা বলতে চাইছি, বাঙালির সমস্ত ভুবনে ছড়িয়ে দিক সতর্কীকরণের প্রেরণা। কেননা আস্তিত্বিক অভিজ্ঞানের ওপর আক্রমণ দিনদিন বাড়ছে সর্বত্র। অন্তত গত এক দশকে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ও ভোগবাদের বিশ্বায়ন ক্রমাগত বিষক্রিয়া ছড়িয়ে দিয়েছে সত্তার কোষে কোষে। সন্দেহ নেই যে আপৎকালীন পরিস্থিতি এখন সমগ্র বঙ্গভাষী পরিসরে। হয়তো অবস্থানগত দুর্বলতা ও পশ্চাৎপরতার জন্যে বরাক উপত্যকায় আশঙ্কার কালো মেঘ বেশি ভয়ঙ্কর। সুতরাং উনিশের চেতনা সমস্ত বাঙালির কাছেই বিশল্যকরণী হিসেবে গৃহীত হতে পারে। নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না, এ তো সাধারণ সত্য। সাম্প্রদায়িকতার সস্তা রাজনীতি দিয়ে নব্য উপনিবেশবাদের দোসর ও হিন্দু পুনরুত্থানবাদের পতাকাবাহী আর্যাবর্তের বিপথগামী প্রতিভাবাদর্শ বাঙালি সমাজকে তার হাজার বছরের সংশ্লেষণ মূলক গ্রহিষ্ণু ও উদারনৈতিক ঐতিহ্য থেকে ধ্বস্ত করার জন্যে মরিয়া চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। পৌর সমাজ আজও সাধারণ ভাবে। (বরাক উপত্যকার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চল বাদ দিয়ে) বিকারগ্রস্ত হয়নি; কিন্তু রাজনৈতিক সমাজে কিছু কিছু ট্রয়ের ঘোড়া ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। ভয়টা ওখানেই। আর এইজন্যেই উনিশের চেতনার প্রাসঙ্গিকতা। কবি-লিখিয়ে-চিন্তাজীবীদের হাতে, নিজেদের অজ্ঞাতসারেও যেন, কখনও উঠে না-আসে নিরোর বেহালা। যেন ঘুঁটে পুড়লে গোবর না হাসে।

 শুধু বরাক উপত্যকার জন্যে নয় উনিশে, যেমন একুশ ফেব্রুয়ারি নয় কেবল বাংলাদেশের। উনিশের চেতনা নয় মৃণালভোজী সম্প্রদায়ের জন্যেও। ভালো বাঙালি হওয়ার জন্যেই উনিশে মে আমাদের জীবনের নবীন যাত্রা রচনায় উদ্বুদ্ধ করুক, নিয়ে যাক রূপ থেকে রুপান্তরে, প্রবল থেকে প্রবলতর উদ্‌ভাসনে। ভালো বাঙালি যে হতে পারেনি, ভালো ভারতীয়ও সে হতে পারবে না কখনও—ভালো মানুষও নয়। কেননা মৌলবাদের হিংস্র দাপট ও অজস্র প্ররোচনা সত্ত্বেও অবিচল থাকে যে-বাঙালি, উনিশের চেতনা তাকে ঘিরেই পুষ্পিত হয়। চর্যাপদের যুগে আমাদের জাতীয় চেতনার যে অভিজ্ঞান নিণীত হয়েছিল, সেই প্রতিবাদী মনন ও বোধ পুনরুজ্জীবিত করে একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে। উনিশের চেতনা মানে অপরাজেয় মানবিক পরিসর পুনরাবিষ্কার।