ঐতিহাসিক চিত্র/১৩১১/ভাদ্র/জাতীয় ইতিহাস চর্চ্চার ফল

উইকিসংকলন থেকে




জাতীয় ইতিহাস চর্চ্চার ফল।


 আমরা অতি প্রাচীন জাতি। কিন্তু পৃথিবীর অপরাপর জাতিও খুব প্রাচীন। আমরা সকলেই মনুর বংশে জন্মিয়া মানব হইয়াছি, কিম্বা আদম ও হিভার সন্ততি—এই হিসাবে সঁওতাল, ভিল, আমেরিকার রেড ইণ্ডিয়ান ও বর্ণিওর অসভ্য মানব জাতির এই সকল শাখাই তুল্যরূপ প্রাচীন,—বৈজ্ঞানিকগণের হিসাবে মর্কটাদি জীব মনুষ্যজাতি অপেক্ষাও প্রাচীন হইয়া পড়ে, এ প্রাচীনত্বের আর তাহা হইলে গৌরব কি থাকে?

 আমরা পূর্ব্বোক্ত প্রকারের প্রাচীনত্বের কথা বলিতেছি না,—যে সময় হইতে জাতীয় চিন্তার একটা উন্নতি আরব্ধ হইয়াছে, সেই সময়ের হিসাবে আমরা প্রাচীনত্বের নির্দ্দেশ করিতেছি,—মর্কটজাতির অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ মানবজাতির আদিপুরুষ হইতে প্রাচীন হইতে পারে, কিন্তু প্রথমোক্ত জীব যে ভাবে শাখা প্রশাখায় বিহার করিয়া গিয়াছে, তাহার বংশধরগণ আজও ঠিক সেই প্রণালীতেই জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছে—সুতরাং তাহাদের সম্বন্ধে কালের নবীনত্ব বা প্রাচীনত্ব কল্পনা মিথ্যা, কালের কোন রেখাই তাহাদের জাতীয় জীবনে পড়ে নাই; যে জাতির জীবনে কালের স্তরবিভাগ নির্দ্দিষ্ট হয়, একটা পৌর্ব্বপর্য্য এবং পরম্পরাক্রমে বিকাশের প্রণালী দৃষ্ট হয়—তাহাদের সম্বন্ধেই বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যত-প্রভৃতিরূপে কালের অসীম রূপ সীমাবদ্ধ হইয়া উঠে।

 এই হিসাবে আমরা নিশ্চয়ই বলিতে পারি। আমাদের জাতি আতি প্রাচীন,—এই ভারতবর্ষে আমাদিগের পূর্ব্বপুরুষগণ অনেক প্রকার কীর্ত্তি রাখিয়া গিয়াছেন,—বেদ তাঁহাদের কীর্ত্তি, ইহার প্রাচীনতম অথচ চিরনবীন পতকা জগতের মস্তকের উর্দ্ধে উড্ডীন হইয়া ভারতীয় চিন্তাকে জগতের পূজনীয় করিয়া রাখিয়াছে,—হিমালয়ের উচ্চতম শৈলশৃঙ্গের ন্যায় মানবজাতির ইতিহাসে ইহাই উচ্চতর চিহ্ন, ইহার ঊর্দ্ধে কাহারও দৃষ্টি যায় না; তৎপর বেদান্তের অপূর্ব্ব শ্রীসম্পন্ন তত্ত্বরাশি, মানবজাতি তাহা ঋষিগণের শ্রেষ্ঠতম দান বলিয়া অবনত মস্তকে গ্রহণ করিতেছে—এইরূপে ভারতীয় উন্নতির স্তর—সাহিত্যে, দর্শনে ও ধর্ম্মশাস্ত্রে আকারিত হইয়া রহিয়াছে, আমরা উত্তরাধিকারসত্বে তাহা হস্তগত করিয়াছি। কিন্তু একজন বিদেশীয় লোকও ত সেই গ্রন্থগুলি পাঠ করিয়া তাঁহার নিজস্ব করিয়া লইতে পারেন, আমাদের সঙ্গে তাঁহার কি ভিন্নতা রহিল? প্রভেদ একটা বিশেষরূপে বিছমান আছে—আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণের চিন্তা আমাদের অস্থিমজ্জার ভিতর রহিয়াছে। সেই প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থাবলী পাঠে আমাদের চিন্তার যেরূপ উন্মেষ করিবে—আমাদিগের জাতীয় উন্নতির যেরূপ বিকাশ করিবে, অন্যজাতির পক্ষে তাহা অসম্ভব,—প্রত্যেক জাতিরই কোন না কোনরূপ বিশেষত্ব আছে,—সেই বিশেষত্বটুকু তাঁহাদের সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়,—আমাদের উন্নতিকল্পে ভিন্ন দেশীয় ইতিহাস জানা আবশ্যক, কিন্তু জাতীয় ইতিহাস জানা অপরিহার্য্য,—জাতীয় ইতিহাস আমাদের ভিত্তি গড়িয়া দিবে, নতুবা আমাদের উন্নতির গৃহপ্রতিষ্ঠা অসম্ভব। আমরা কি—এই জ্ঞানটুকু জাতীয় ইতিহাস হইতে সংগ্রহ করিয়া, সেই উপাদান দ্বারা ভাবী ইতিহাস গড়িয়া তুলিতে হইবে। বিদেশী মাল মসলা হইতে সহায়তা লইব, কিন্তু ভিত্তির উপাদান অন্যত্র হইতে সংগ্রহচেষ্টা বৃথা।

 আমি যে বহু প্রাচীনকাল হইতে শ্রেষ্ঠতম মহাজনগণের প্রদত্ত ধনরত্নের মালিক,—ইহা ভুলিয়া গেলে আমাকে কৌপিনসার ভিখারী সাজিতে হইবে,—আমার জন্য খষিগণ ঋক্‌মন্ত্র উচ্চারণ করিতেছেন বাক্য ও মন যাঁহার সম্মুখীন হইতে যাইয়া ফিরিয়া আসে,—যিনি অবাঙ্‌মানসগোচর, সেই নিখিল বিশ্বের হেতুভূত ব্রহ্মতত্ত্ব বেদান্তকারগণ আমার জন্য এখনও সম্মুখে আনিয়া দিতেছেন, আমার জন্য রামায়ণের অপূর্ব্ব ত্যাগশীলতার চিত্র বাল্মীকি অমর অক্ষরে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন,—ব্যাস তাহার বিরাট গ্রন্থ সঙ্কলন করিয়াছেন,—কালিদাস, ভবভূতি সৌন্দর্য ও প্রেমের আদর্শ রচনা করিয়াছেন—এই বহুধনরত্ন লইয়া প্রাচীন ইতিহাসের পেটিকা আমার নিকট উন্মোচিত-আবরণ হইয়া প্রতীক্ষা করিতেছে—আমি ইহাদের উত্তরাধিকারী। এই বিরাট জাতীয় ইতিহাসচর্চ্চায় আমার মনে যে স্ফূর্ত্তি ও উৎসাহের সঞ্চার করিবে—আমার যে লুক্কায়িত শক্তির সন্ধান বলিয়া দিবে ও উদ্যম উদ্বোধন করিবে—প্রাচীনকালে তাঁহারা যাহা করিয়াছিলেন—তাহা শুনিতে শুনিতে আমিও যে সেইরূপ উজ্জ্বল ও গৌরবান্বিত আদর্শের সন্নিহিত হইতে পারি, সেই ভরসা নবভাবে উজ্জীবিত হইয়া আমার মধ্যে যেরূপ কার্য্য করিবে—সেরূপ আশা, সেইরূপ প্রাণসঞ্চারিণী শক্তি আমরা আর কিসে পাইব?

 তার পর অতীত ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় কারণ এবং সেই কারণের অবশ্যম্ভাবী ফল— স্পষ্টরূপে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে—সেই ফলাফলের বিচার দ্বার এবং আমাদের জাতীয় অভাব ও শক্তি কোথায় তাহা আবিস্কার করিয়া আমরা ভবিষ্যগঠনে আমাদের হস্ত সবল করিয়া লইতে পারিব।

 সমস্ত ভারতবর্ষের ইতিহাস যে সকল শিক্ষা আমাদিগকে প্রদান করিবে, বিশেষ ভাবে বঙ্গদেশের ইতিহাসপাঠে আমরা আবার আমাদের প্রকৃতির তদপেক্ষা ঘনিষ্ঠতররূপ পরিচয় পাইব। আমরাও পৃথিবীতে নিতান্ত নগণ্য ছিলাম না, এক সময়ে বাঙ্গালীরা চীন, জাপান প্রভৃতি দেশের সভ্যতাকে নবশ্রী প্রদান করিয়াছিল, এক সময়ে জাবা ও বালিদ্বীপে বাঙ্গালী উপনিবিষ্ট হইয়া পররাজ্যে হিন্দুসভ্যতা চিহ্নিত। করিয়াছিল,—সিংহলে বিজয়কেতু উড্ডীন করিয়াছিল। অল্পদিন হইল ঢাকার মসলিন্ জগতের বিলাসসামগ্রীর শীর্ষস্থান অধিকার করিয়া বিলাতে পর্য্যন্ত প্রভুত্ব স্থাপন করিয়াছিল, তখন ম্যানচেস্টার বিস্ময়পূরিত চক্ষে ভারতীয় শিল্পের সৌন্দর্য্য দর্শনে স্বীয় অপটুত্ব ভাবিয়া ক্ষুব্ধ ও কুণ্ঠিত ছিল,—আমাদের দেশ পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায়শাস্ত্রের সৃষ্টি করিয়াছিল এবং আমাদের দেশের একজন দীনদরিদ্র পল্লীব্রাহ্মণ জগতে যে অপূর্ব প্রেমধর্মের শিক্ষা দিয়া গিয়াছেন—পৃথিবী সেই অতিসাত্ত্বিক ধর্ম্মতত্ত্ব গ্রহণে আজিও সমর্থ হয় নাই,—সুতরাং প্রাদেশিক ইতিহাসচর্চ্চায় আমাদের জাতীয় শক্তিরই বিশেষভাবে আবিষ্কার হইবে,—আমরা এককালে জগতকে কোন কোন বিষয়ে শিক্ষা দিয়াছি,—এই জ্ঞান বদ্ধমূল হইলে আমরা ভবিষ্যতে উন্নতির শীর্ষস্থানে দাঁড়াইতে পারিব। ইতিহাসের সঙ্গে সম্বন্ধবিচ্যুত হইলে আমরা দীনাতিদীন, পরপ্রেক্ষী হইয়া নিজের অযোগ্যতার গহ্বরে লুক্কায়িত হইয়া থাকিব। জার্ম্মানজাতি একসময়ে যখন হীন অবস্থায় পতিত হইয়াছিল, তখন জাতীয় ইতিহাসপাঠে তাহারা পূর্ব্বগৌরবদৃপ্ত হইয়া নবপ্রতিষ্ঠা লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিল,—আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ যাহা করিয়াছেন,—সেই জ্ঞানে আমাদের উদ্যমকে সুপ্রসার কর্ম্মক্ষেত্রে প্রবাহিত করিয়া দিবে,—গঙ্গার স্রোত যখন স্মরণ করে—যে সে হিমালয় হইতে নিঃসৃত হইয়াছে, তখন মহাসাগরের সঙ্গে সম্মিলিত হইবার যোগ্যতা বিশেষরূপে অনুভব করিয়া দ্বিগুণতর বেগে প্রবাহিত হয়। কূপের জল স্বীয় সংকীর্ণতার গণ্ডী অতিক্রম করিয়া প্রবাহিত হইতে পারে না,—কারণ সে প্রথমেও যেখানে ছিল, এখনও সেই খানে।

শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন।

এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।