মানুষের ধর্ম্ম/২

উইকিসংকলন থেকে


মানুষের ধর্ম্ম

দুই

অথর্ব্ববেদ বলেচেন:—

ঋতং সত্যং তপো রাষ্ট্রং শ্রমো ধর্ম্মশ্চ কর্ম্ম চ
ভূতং ভবিষ্যদুচ্ছিষ্টে বীর্য্যং লক্ষ্মীর্বলং বলে।

ঋত সত্য তপস্যা রাষ্ট্র শ্রম ধর্ম্ম কর্ম্ম ভূত ভবিষ্যৎ বীর্য্য সম্পদ বল সমস্তই উচ্ছিষ্টে অর্থাৎ উদ্বৃত্তে আছে। অর্থাৎ মানবধর্ম্ম বলতে আমরা যা বুঝি প্রকৃতির প্রয়োজন সে পেরিয়ে, সে আসচে অতিরিক্ততা থেকে। জীবজগতে মানুষ বাড়তির ভাগ। প্রকৃতির বেড়ার মধ্যে তাকে কুলোলো না। ইতিপূর্ব্বে জীবাণুকোষের সঙ্গে সমগ্র দেহের সম্বন্ধ আলোচনা করেছিলুম। অথর্ব্ববেদের ভাষায় বলা যেতে পারে প্রত্যেক জীবকোষ তার অতিরিক্তের মধ্যে বাস করে। সেই অতিরিক্ততাতেই উৎপন্ন হচ্চে স্বাস্থ্য আনন্দ শক্তি, সেই অতিরিক্ততাকেই অধিকার ক'রে আছে সৌন্দর্য্য, সেই অতিরিক্ততাতেই প্রসারিত ভূত ভবিষ্যৎ। জীবকোষ এই সমগ্র দেহগত বিভূতি উপলব্ধি করে না। কিন্তু মানুষ প্রকৃতিনির্দ্দিষ্ট আপন ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যকে পেরিয়ে যায়; পেরিয়ে গিয়ে যে-আত্মিক সম্পদকে উপলব্ধি করে অথর্ব্ববেদ তাকেই বলেচেন ঋতং সত্যং। এ সমস্তই বিশ্বমানবমনের ভূমিকায়, যারা এ'কে স্বীকার করে তারাই মনুষ্যত্বের পদবীতে এগোতে থাকে। অথর্ব্ববেদ যে সমস্ত গুণের কথা বলেচেন তার সমস্তই মানবগুণ। তার যোগে আমরা যদি আমাদের জীবধর্ম্ম-সীমার অতিরিক্ত সত্তাকে অনুভব করি তবে বলতে হবে সে সত্তা কখনোই অমানব নয় তা মানবব্রহ্ম। আমাদের ঋতে সত্যে তপস্যায় ধর্ম্মে কর্ম্মে সেই বৃহৎ মানবকে আমরা আত্মবিষয়ীকৃত করি। এই কথাটিকেই উপনিষদ আর এক রকম ক'রে বলেচেন—

এষাস্য পরমা গতি রেষাস্য পরমা সম্পদ্‌
এষোঽস্য পরমো লোক এষোঽস্য পরম আনন্দঃ।

এখানে উনি এবং এ, এই দুয়ের কথা। বলচেন, উনি এর পরম গতি, উনি এর পরম সম্পদ, উনি এর পরম আশ্রয়, উনি এর পরম আনন্দ। অর্থাৎ এর পরিপূর্ণতা তাঁর মধ্যে। উৎকর্ষের পথে এ চলেচে সেই বৃহতের দিকে, এর ঐশ্বর্য্য সেইখানেই, এর প্রতিষ্ঠা তাঁর মধ্যেই, এর শাশ্বত আনন্দের ধন যা-কিছু সে তাঁতেই।

এই তিনি, বস্তু-অবচ্ছিন্ন একটা তত্ত্বমাত্র নন। যাকে বলি আমার আমি সে যেমন অন্তরতমভাবে আমার একান্ত বোধ-বিষয় তিনিও তেমনি। যখন তাঁর প্রতি ভক্তি জেগে ওঠে, যখন তাঁতে আনন্দ পাই তখন আমার এই আমি-বোধই বৃহৎ হয় গভীর হয় প্রসারিত হয় আপন সীমাতীত সত্যে। তখন অনুভব করি, এক বৃহৎ আনন্দের অন্তর্গত আমার আনন্দ। অন্য কোনো গ্রন্থে এ-সম্বন্ধে যে-উপমা ব্যবহার করেচি এখানে তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই।

একখণ্ড লোহার রহস্যভেদ ক'রে বৈজ্ঞানিক বলেচেন সেই টুক্‌রোটি আর কিছুই নয়, কতকগুলি বিশেষছন্দের বিদ্যুৎমণ্ডলীর চিরচঞ্চলতা। সেই মণ্ডলীর তড়িৎকণাগুলি নিজেদের আয়তনের অনুপাতে পরস্পরের থেকে বহু দূরে দূরে অবস্থিত। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যা ধরা পড়েচে সহজ দৃষ্টিতে যদি সেই রকম দেখা যেত তাহলে মানবমণ্ডলীতে প্রত্যেক ব্যক্তিকে যেমন পৃথক দেখি তেমনি তাদেরও দেখতুম। এই অণুগুলি যত পৃথকই হোক এদের মধ্যে একটা শক্তি কাজ করচে। তাকে শক্তিই বলা যাক। সে সম্বন্ধ-শক্তি, ঐক্য-শক্তি, সে ঐ লৌহখণ্ডের সংঘ-শক্তি। আমরা যখন লোহা দেখচি তখন বিদ্যুৎকণা দেখচিনে, দেখচি সংঘরূপকে। বস্তুত এই যে লোহার প্রতীয়মান রূপ এ একটা প্রতীক। বস্তুটা পরমার্থত যা এ তা নয়। অন্যবিধ দৃষ্টি যদি থাকে তবে এর প্রকাশ হবে অন্যবিধ। দশটাকার নোট পাওয়া গেল, বিশেষ রাজত্বে তার বিশেষ মূল্য। এ'কে দেখবামাত্র যে জানে যে এই কাগজখানা স্বতন্ত্র দশসংখ্যক টাকার সংঘরূপ তাহলেই সে এ'কে ঠিক জানে। কাগজখানা ঐ সংঘের প্রতীক।

আমরা যাকে চোখে দেখচি লোহা সেও প্রকাশ করচে সেই সংঘকে যাকে চোখে দেখা যায় না, দেখা যায় স্থূল প্রতীকে। তেমনি ব্যক্তিগত মানুষগুলির মধ্যে দেশকালের ব্যবধান যথেষ্ট, কিন্তু সমস্ত মানুষকে নিয়ে আছে একটি বৃহৎ এবং গভীর ঐক্য। সেই ইন্দ্রিয়বোধাতীত ঐক্য সাংখ্যিক সমষ্টিকে নিয়ে নয়, সমষ্টিকে অতিক্রম ক'রে। সেই হচ্চে সমস্তের এক গূঢ় আত্মা, একধৈবানুদ্রষ্টব্যঃ, কিন্তু বহুধাশক্তিযোগে তার প্রকাশ। সমস্ত মানুষের মধ্যে সেই এক আত্মাকে নিজের মধ্যে অনুভব করবার উদার শক্তি যাঁরা পেয়েচেন তাঁদেরই তো বলি মহাত্মা, তাঁরাই তো সর্ব্বমানবের জন্যে প্রাণ দিতে পারেন। তাঁরাই তো এই এক গূঢ় আত্মার প্রতি লক্ষ্য ক'রে বলতে পারেন, তদেৎ প্রেয়ঃ পুত্রাৎ প্রেয়ো বিত্তাৎ প্রেয়োঽন্যস্মাৎ সর্ব্বস্মাদ্‌ অন্তরতরং যদয়মাত্মা,—তিনি পুত্রের চেয়ে প্রিয়, বিত্তের চেয়ে প্রিয়, অন্যসকল-হতে প্রিয় এই আত্মা যিনি অন্তরতর।

বৈজ্ঞানিক এই কথা শুনে ধিক্কার দেন, বলেন, দেবতাকে প্রিয় বললে দেবতার প্রতি মানবিকতা আরোপ করা হয়। আমি বলি মানবত্ব আরোপ করা নয় মানবত্ব উপলব্ধি করা। মানুষ আপন মানবিকতারই মাহাত্ম্যবোধ অবলম্বন ক'রে আপন দেবতায় এসে পৌঁছেচে। মানুষের মন আপন দেবতায় আপন মানবত্বের প্রতিবাদ করতে পারে না। করা তার পক্ষে সত্যই নয়। ঈথরের কম্পনে মানুষ আলোকত্ব আরোপ করে না, তাকে স্বতই আলোকরূপে অনুভব করে, আলোকরূপেই ব্যবহার করে, ক'রে ফল পায়, এও তেমনি।

পরম মানবিক সত্তাকে পেরিয়ে গিয়েও পরম জাগতিক সত্তা আছে। সূর্য্যলোককে ছাড়িয়ে যেমন আছে নক্ষত্রলোক। কিন্তু যার অংশ এই পৃথিবী, যার উত্তাপে পৃথিবীর প্রাণ, যার যোগে পৃথিবীর চলাফেরা, পৃথিবীর দিনরাত্রি, সে একান্তভাবে এই সূর্য্যলোক। জ্ঞানে আমরা নক্ষত্রলোককে জানি কিন্তু জ্ঞানে কর্ম্মে আনন্দে দেহমনে সর্ব্বতোভাবে জানি এই সূর্য্যলোককে। তেমনি জাগতিক ভূমা আমাদের জ্ঞানের বিষয়, মানবিক ভূমা আমাদের সমগ্র দেহমন ও চরিত্রের পরিতৃপ্তি ও পরিপূর্ণতার বিষয়। আমাদের ধর্ম্মশ্চ কর্ম্ম চ, আমাদের ঋতং সত্যং, আমাদের ভূতং ভবিষ্যৎ সেই সত্তারই অপর্য্যাপ্তিতে।

মানবিক সত্তাকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে যে নৈর্ব্যক্তিক জাগতিক সত্তা, তাঁকে প্রিয় বলা বা কোনো কিছুই বলার কোনো অর্থ নেই। তিনি ভালোমন্দ সুন্দর অসুন্দরের ভেদবর্জ্জিত। তাঁর সঙ্গে সম্বন্ধ নিয়ে পাপপুণ্যের কথা উঠতে পারে না। অস্তীতিব্রুবতোঽন্যত্র কথং তদুপলভ্যতে। তিনি আছেন এ ছাড়া তাঁকে কিছুই বলা চলে না। মানবমনের সমস্ত লক্ষণ সম্পূর্ণ লোপ ক'রে দিয়ে সেই নির্ব্বিশেষে মগ্ন হওয়া যায় এমন কথা শোনা গেছে। এ নিয়ে তর্ক চলে না। মন-সমেত সমস্ত সত্তার সীমানা কেউ একেবারেই ছাড়িয়ে গেছে কিনা আমাদের মন নিয়ে সে কথা নিশ্চিত বলব কী ক'রে। আমরা সত্তামাত্রকে যে-ভাবে যেখানেই স্বীকার করি সেটা মানুষের মনেরই স্বীকৃতি। এই কারণেই দোষারোপ ক'রে মানুষের মন স্বয়ং যদি তাকে অস্বীকার করে তবে শূন্যতাকেই সত্য বলা ছাড়া উপায় থাকে না। এমন নাস্তিবাদের কথাও মানুষ বলেচে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক তা বললে তার ব্যবসা বন্ধ করতে হয়। বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতায় আমরা যে-জগৎকে জানি বা কোনো কালে জানবার সম্ভাবনা রাখি সেও মানবজগৎ। অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধির, যুক্তির কাঠামোর মধ্যে কেবল মানুষই তাকে আপন চিন্তার আকারে আপন বোধের দ্বারা বিশিষ্টতা দিয়ে অনুভব করে। এমন কোনো চিত্ত কোথাও থাকতেও পারে যার উপলব্ধ জগৎ আমাদের গাণিতিক পরিমাপের অতীত, আমরা যাকে আকাশ বলি সেই আকাশে যে বিরাজ করে না। কিন্তু যে-জগতের গূঢ় তত্ত্বকে মানব আপন অন্তর্নিহিত চিন্তাপ্রণালীর দ্বারা মিলিয়ে পাচ্চে তাকে অতিমানবিক বলব কী ক'রে। এই জন্যে কোনো আধুনিক পণ্ডিত বলেচেন, বিশ্বজগৎ গাণিতিক মনের সৃষ্টি। সেই গাণিতিক মন তো মানুষের মনকে ছাড়িয়ে গেল না। যদি যেত তবে এ জগতের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আমরা জানতেই পারতুম না, যেমন কুকুর বিড়াল কিছুতেই জানতে পারে না। যিনি আমাদের দর্শনে শাস্ত্রে সগুণ ব্রহ্ম তাঁর স্বরূপসম্বন্ধে বলা হয়েচে সর্ব্বেন্দ্রিয়গুণাভাসম্‌। অর্থাৎ মানুষের বহিরিন্দ্রিয় অন্তরিন্দ্রিয়ের যত কিছু গুণ তার আভাস তাঁরই মধ্যে। তার অর্থই এই যে মানবব্রহ্ম, তাই তাঁর জগৎ মানবজগৎ। এ ছাড়া অন্য জগৎ যদি থাকে তাহলে সে আমাদের সম্বন্ধে শুধু যে আজই নেই তা নয়, কোনো কালেই নেই।

এই জগৎকে জানি আপন বোধ দিয়ে। যে-জানে সেই আমার আত্মা। সে আপনাকেও আপনি জানে। এই স্বপ্রকাশ আত্মা একা নয়। আমার আত্মা, তোমার আত্মা, তার আত্মা এমন কত আত্মা। তারা যে-এক আত্মার মধ্যে সত্য, তাঁকে আমাদের শাস্ত্রে বলেন পরমাত্মা। এই পরমাত্মা মানবপরমাত্মা, ইনি সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ, ইনি আছেন সর্ব্বদা জনে জনের হৃদয়ে।

 বলা হয়েচে বটে আমাদের সকল ইন্দ্রিয়গুণের আভাস এঁর মধ্যে, কিন্তু এতেই সব কথা শেষ হোলো না। এক-আত্মার সঙ্গে আর-এক আত্মার যে-সম্বন্ধ সকলের চেয়ে নিবিড় সকলের চেয়ে সত্য তাকেই বলে প্রেম। ভৌতিক বিশ্বের সঙ্গে আমাদের বাস্তব পরিচয় ইন্দ্রিয়বোধে, আত্মিক বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সত্য পরিচয় প্রেমে। আত্মিক বিশ্বের পরিচয় মানুষ জন্মমুহূর্ত্তেই আরম্ভ করেচে পিতামাতার প্রেমে। এইখানে অপরিমেয় রহস্য, অনির্ব্বচনীয়ের সংস্পর্শ। প্রশ্ন উঠল মনে, এই পিতামাতার সত্য কোথায় প্রতিষ্ঠিত। দাল্‌ভ্য যদি উত্তর করেন এই পৃথিবীর মাটিতে, প্রবাহণ মাথা নেড়ে বলবেন যিনি পিতৃতমঃ পিতৃণাম্‌, সকল পিতাই যাঁর মধ্যে পিতৃতম হয়ে আছেন তাঁরই মধ্যে। মাটির অর্থ বুঝতে পারি বাহির থেকে তাকে নেড়ে চেড়ে দেখে, পিতামাতার রহস্য বুঝতে পারি আপনারই আত্মার গভীরে এবং সেই গভীরেই উপলব্ধি করি পিতৃতমকে। সেই পিতৃতম বিশেষ কোনো স্বর্গে নেই, বিশেষ কোনো দেশকালে বদ্ধ ইতিহাসে নেই, ইনি বিশেষ কোনো একটি মানুষে একদা অবতীর্ণ নন, ইনি প্রেমের সম্বন্ধে মানবের ভূতভবিষ্যৎকে পূর্ণ ক’রে আছেন নিখিল মানবলোকে। আহ্বান করচেন দুর্গম পথের ভিতর দিয়ে পরিপূর্ণতার দিকে, অসত্যের থেকে সত্যের দিকে, অন্ধকার থেকে জ্যোতির দিকে, মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে, দুঃখের মধ্য দিয়ে, তপস্যার মধ্য দিয়ে।

 এই আহ্বান মানুষকে কোনো কালে কোথাও থামতে দিলে না, তাকে চিরপথিক ক’রে রেখে দিলে। ক্লান্ত হয়ে যারা পথ ছেড়ে পাকা ক’রে ঘর বেঁধেচে তারা আপন সমাধিঘর রচনা করেচে। মানুষ যথার্থই অনাগারিক। জন্তুরা পেয়েচে বাসা, মানুষ পেয়েচে পথ। মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যাঁরা তাঁরা পথনির্ম্মাতা, পথপ্রদর্শক। বুদ্ধকে যখন কোনো একজন লোক চরমতত্ত্বের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিল তিনি বলেছিলেন আমি চরমের কথা বলতে আসিনি আমি বলব পথের কথা। মানুষ এক-যুগে যাকে আশ্রয় করচে আর-এক যুগে উন্মাদের মতো তার দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে পড়েচে পথে। এই যে বারে বারে ঘর ভেঙে দিয়ে চলবার উদ্দামতা, যার জন্যে সে প্রাণপণ করে, এ প্রমাণ করচে কোন্‌ সত্যকে। সেই সত্যসম্বন্ধেই উপনিষদ বলেন, মনসো জবীয়ো নৈনদ্দেবা আপ্নুবন্‌ পুর্ব্বমর্ষৎ। তিনি মনকে ইন্দ্রিয়কে ছাড়িয়ে চলে গেছেন। ছাড়িয়ে যদি না যেতেন তবে পদে পদে মানুষও আপনাকে ছাড়িয়ে যেত না। অথর্ব্ববেদ বলেচেন এই আরোর দিকে, এই ছাড়িয়ে যাবার দিকে মানুষের শ্রী, তার ঐশ্বর্য্য, তার মহত্ত্ব।

 তাই মানবদেবতার সম্বন্ধে এই কথা শুনি:—


যদ্‌ যদ্‌ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদ্‌ ঊজ্জিতমেব বা
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোঽংশসম্ভবম্‌।

যা কিছুতে ঐশ্বর্য্য আছে, শ্রী আছে, শ্রেষ্ঠতা আছে সে আমারই তেজের অংশ থেকে সম্ভূত।

 বিশ্বে ছোটো বড়ো নানা পদার্থই আছে। থাকামাত্রের যে দাম তা সকলের পক্ষেই সমান। নিছক অস্তিত্বের আদর্শে মাটির ঢেলার সঙ্গে পদ্মফুলের উৎকর্ষ অপকর্ষের ভেদ নেই। কিন্তু মানুষের মনে এমন একটি মূল্যভেদের আদর্শ আছে, যাতে প্রয়োজনের বিচার নেই, যাতে আয়তনের বা পরিমাণের তৌল চলে না। মানুষের মধ্যে বস্তুর অতীত একটি অহৈতুক পূর্ণতার অনুভূতি আছে, একটা অন্তরতম সার্থকতার বোধ। তাকেই সে বলে শ্রেষ্ঠতা। অথচ এই শ্রেষ্ঠতাসম্বন্ধে মতের ঐক্য তো দেখিনে। তাহলে সেটা যে নৈর্ব্যক্তিক শাশ্বত সত্যে প্রতিষ্ঠিত এ কথা বলা যায় কী ক’রে।

 জ্যোতির্ব্বিদ দূরবীন নিয়ে জ্যোতিষ্কের পর্য্যালোচনা করতে চান, কিন্তু তার বাধা বিস্তর। আকাশে আছে পৃথিবীর ধূলো, বাতাসের আবরণ, বাষ্পের অবগুণ্ঠন, চার দিকে নানা প্রকার চঞ্চলতা। যন্ত্রের ক্রটিও অসম্ভব নয়, যে-মন দেখচে তার মধ্যে আছে পূর্ব্বসংস্কারের আবিলতা। ভিতর-বাহিরের সমস্ত ব্যাঘাত নিরস্ত করলে বিশুদ্ধ সত্য পাওয়া যায়। সেই বিশুদ্ধ সত্য এক, কিন্তু বাধাগ্রস্ত প্রতীতির বিশেষত্ব অনুসারে ভ্রান্ত মত বহু।

 পুরোনো সভ্যতার মাটিচাপা ভাঙাচোরা চিহ্নশেষ উদ্ধার করলে তার মধ্যে দেখা যায় আপন শ্রেষ্ঠতাকে প্রকাশ করবার জন্যে মানুষের প্রভূত প্রয়াস। নিজের মধ্যে যে-কল্পনাকে সকল কালের সকল মানুষের ব’লে সে অনুভব করেচে তারি দ্বারা সর্ব্বকালের কাছে নিজের পরিচয় দিতে তার কত বল, কত কৌশল। ছবিতে মূর্ত্তিতে, ঘরে ব্যবহারের সামগ্রীতে সে ব্যক্তিগত মানুষের খেয়ালকে প্রচার করতে চায়নি, বিশ্বগত মানুষের আনন্দকে স্থায়ী রূপ দেবার জন্যে তার দুঃসাধ্য সাধনা। মানুষ তাকেই জানে শ্রেষ্ঠতা যাকে সকল কাল ও সকল মানুষ স্বীকার করতে পারে। সেই শ্রেষ্ঠতার দ্বারা মানুষ আত্মপরিচয় দিয়ে থাকে। অর্থাৎ আপন আত্মীয় সকল মানুষের আত্মার পরিচয় দেয়। এই পরিচয়ের সম্পূর্ণতাতেই মানুষের অভ্যুদয়, তার বিকৃতিতেই মানুষের পতন। বাহ্যসম্পদের প্রাচুর্য্যের মাঝখানেই সেই বিনষ্টির লক্ষণ সহসা এসে দেখা দেয় যখন মদান্ধ স্বার্থান্ধ মানুষ চিরমানবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। পাশ্চাত্য মহাদেশে কি সেই লক্ষণ আজ দেখা দেয়নি। সেখানে বিজ্ঞান আছে, বাহুবল আছে, অর্থবল আছে, বুদ্ধিবল আছে কিন্তু তার দ্বারাও মানুষ রক্ষা পায় না। স্বাজাত্যের শিখরের উপরে চ’ড়ে বিশ্বগ্রাসী লোভ যখন মনুষ্যত্বকে খর্ব্ব করতে স্পর্দ্ধা করে, রাষ্ট্রনীতিতে নিষ্ঠুরতা ও ছলনার সীমা থাকে না, পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা এবং সংশয় যখন নিদারুণ হিংস্রতায় শান দিতে বসে তখন মানবের ধর্ম্ম আঘাত পায় এবং মানবের ধর্ম্মই মানুষকে ফিরে আঘাত করে। এ কোনো পৌরাণিক ঈশ্বরের আদিষ্ট বিধির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা নয়। এই সব আত্মম্ভরিরা আত্মহনো জনাঃ। এরা সেই আত্মাকে মারে যে-আত্মা স্বদেশের বা স্বগোষ্ঠীর মধ্যে বদ্ধ নয়, যে-আত্মা নিত্যকালের বিশ্বজনের। একলা নিজেকে বা নিজেদেরকে বড়ো করবার চেষ্টায় অন্য সকল প্রাণীরই উন্নতি ঘটতে পারে, তাতে তাদের সত্যদ্রোহ ঘটে না, কিন্তু মানুষের পক্ষে সেইটেই অসত্য, অধর্ম্ম, এই জন্যে সকলপ্রকার সমৃদ্ধির মাঝখানেই তার দ্বারাই মানুষ “সমূলেন বিনশ্যতি।”

 বিশুদ্ধ সত্যের উপলব্ধিতে বিশ্বমানবমনের প্রকাশ, এ কথা স্বীকার করা সহজ, কিন্তু রসের অনুভূতিতে সেই বিশ্বমনকে হৃদয়ঙ্গম করি কিনা এ নিয়ে সংশয় জন্মাতে পারে। সৌন্দর্য্যে আনন্দবোধের আদর্শ দেশকালপাত্রভেদে বিচিত্র যদি হয় তবে এর শাশ্বত আদর্শ কোথায়। অথচ বৃহৎ কালে মেলে দিয়ে মানুষের ইতিহাসকে যখন দেখি তখন দেখতে পাই শিল্পসৌন্দর্য্যের শ্রেষ্ঠতাসম্বন্ধে সকল কালের সকল সাধকদের মন মেলবার দিকেই যায়। এ কথা সত্য যে নিশ্চিতভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিই সুন্দর সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ রস পায় না। অনেকের মন রূপকাণা, তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচির সঙ্গে বিশ্বরুচির মিল নেই। মানুষের মধ্যে অনেকে আছে স্বভাবতই বিজ্ঞানমূঢ়, বিশ্বসম্বন্ধে তাদের ধারণা মোহাচ্ছন্ন ব’লেই তা বহু, এক-সংস্কারের সঙ্গে আর-এক সংস্কারের মিল হয় না, অথচ নিজ নিজ অন্ধ সংস্কারের সত্যতাসম্বন্ধে তাদের প্রত্যেকের এমন প্রচণ্ড দম্ভ যে তা নিয়ে তারা খুনোখুনি করতেও প্রস্তুত। তেমনি সংসারে স্বভাবতই অরসিক বা বেরসিকের অভাব নেই তাদেরও মতভেদ সাংঘাতিক হয়ে ওঠে। নিম্নসপ্তক থেকে উচ্চসপ্তক পর্য্যন্ত উদারা মুদারা তারা নানা পর্য্যায়ের জন্মমূঢ়তা আছে ব’লেই যেমন জ্ঞানের বিশ্বভূমীন সম্পূর্ণতায় অশ্রদ্ধা করা যায় না সৌন্দর্য্যের আদর্শসম্বন্ধেও তেমনি।

 বার্ট্রাণ্ড্‌ রাসেল কোনো এক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেচেন যে, বেটোভনের সিম্ফনিকে বিশ্বমনের রচনা বলা যায় না, সেটা ব্যক্তিগত। অর্থাৎ সেটা তো গাণিতিক তত্ত্বের মতো নয়, যার উদ্ভাবনাসম্বন্ধে ব্যক্তিগত মন উপলক্ষ্য মাত্র, যা নিখিল মনের সামগ্রী। কিন্তু যদি এ কথা স্বীকার করতে হয় যে বেটোভনের রচনা সকলেরই ভালো লাগা উচিত, অর্থাৎ ঠিকমতো শিক্ষা পেলে, স্বাভাবিক চিত্তজড়তা না থাকলে, অজ্ঞান অনভ্যাসের আবরণ দূর হোলে সকল মানুষের তা ভালো লাগবে, তাহলে বলতেই হবে শ্রেষ্ঠগীত রচয়িতার শ্রেষ্ঠত্ব সকল মানুষের মনেই সম্পূর্ণ আছে, শ্রোতৃরূপে ব্যক্তিবিশেষের মনে তা বাধাগ্রস্ত।

 বুদ্ধি জিনিষটা অস্তিত্বরক্ষার পক্ষে অপরিহার্য্য কিন্তু সৌন্দর্য্যবোধের অপূর্ণতাসত্ত্বেও সংসারে সিদ্ধিলাভের দৃষ্টান্ত অনেক আছে। সৌন্দর্য্যবোধের কোনো সাংঘাতিক তাগিদ নেই। এ-সম্বন্ধে যথেচ্ছাচারের কোনো দণ্ডনীয় বাধা নেই। যুক্তি-স্বীকারকারী বুদ্ধি মানুষের মনে যত সুনিশ্চিত হয়েচে প্রাণের বিভাগে শাসনের অভাবে সৌন্দর্য্যস্বীকারকারী রুচি তেমন পাকা হয়নি। তবু সমস্ত মানবসমাজে সৌন্দর্য্যসৃষ্টির কাজে মানুষের যত প্রভূত শক্তির প্রয়োগ হচ্চে এমন অল্প বিষয়েই। অথচ জীবনধারণে এর প্রয়োজন নেই, এর প্রয়োজন আত্মিক। অর্থাৎ এর দ্বারা বাইরের জিনিষকে পাইনে অন্তরের দিক থেকে দীপ্তিমান হই, পরিতৃপ্ত হই। এই পরিতৃপ্ত হওয়ার দ্বারা যাঁকে জানি তাঁকে বলি রসো বৈ সঃ।

 এই হওয়ার দ্বারা পাওয়ার কথা উপনিষদে বারবার শোনা যায়, তার থেকে এই বুঝি, মানুষের যা চরম পাবার বিষয় তার সঙ্গে মানুষ একাত্মক, মানুষ তারই মধ্যে সত্য, কেবল তার বোধের বাধা আছে।


নাবিরতো দুশ্চরিতান্‌ নাশান্তো নাসমাহিতঃ
নাশান্তো মানসো বাপি প্রজ্ঞানেনৈনমাপ্নুয়াৎ।

 বলচেন, কেবল জানার দ্বারা তাঁকে পাওয়া যায় না। হওয়ার দ্বারা পেতে হবে, দুশ্চরিত থেকে বিরত হওয়া, সমাহিত হওয়া, রিপুদমন ক’রে আচঞ্চলমন হওয়া দ্বারাই তাঁকে পেতে হবে। অর্থাৎ এ এমন পাওয়া যা আপনারই চিরন্তন সত্যকে পাওয়া।

 পূর্ব্বে বলেচি ভৌতিক সত্যকে বিশুদ্ধ ক’রে দেখতে গেলে কাছের সমস্ত মলিনতা ও চাঞ্চল্য, ব্যক্তিগত সমস্ত বিকার দূর করা চাই। আত্মিক সত্যসম্বন্ধে সে কথা আরো বেশি খাটে। যখন পশুসত্তার বিকার আমরা আত্মিক সত্যে আরোপ করি তখন সেই প্রমাদ সব চেয়ে সাংঘাতিক হয়ে ওঠে। কেননা, তখন আমাদের হওয়ার ভিত্তিতেই লাগে আঘাত। জানার ভুলের চেয়ে হওয়ার ভুল কত সর্ব্বনেশে তা বুঝতে পারি যখন দেখতে পাই বিজ্ঞানের সাহায্যে যে-শক্তিকে আমরা আয়ত্ত করেচি সেই শক্তিই মানুষের হিংসা ও লোভের বাহন হয়ে তার আত্মঘাতকে বিস্তার করচে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এই জন্যেই সম্প্রদায়ের নামে ব্যক্তিগত বা বিশেষ জনগত স্বভাবের বিকৃতি মানুষের পাপবুদ্ধিকে যত প্রশ্রয় দেয় এমন বৈজ্ঞানিক ভ্রান্তিতে কিংবা বৈষয়িক বিরোধেও না। সাম্প্রদায়িক দেবতা তখন বিদ্বেষবুদ্ধির, অহঙ্কারের, অবজ্ঞাপরতার, মূঢ়তার দৃঢ় আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়, শ্রেয়ের নামাঙ্কিত পতাকা নিয়ে অশ্রেয় জগদ্ব্যাপী অশান্তির প্রবর্ত্তন করে,—স্বয়ং দেবত্ব অবমানিত হয়ে মানুষকে অবমানিত ও পরস্পরব্যবহারে আতঙ্কিত ক’রে রাখে। আমাদের দেশে এই দুর্য্যোগ আমাদের শক্তি ও সৌভাগ্যের মূলে আঘাত করচে।

 অন্য দেশেও তার দৃষ্টান্ত আছে। সাম্প্রদায়িক খৃষ্টান ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক দেবচরিত্রে পূজাবিধিতে চরিত্রবিকৃতি বা হিংস্রতা দেখে অবজ্ঞা প্রকাশ করেন। সংস্কারবশত দেখতে পান না মানুষের আপন অহিতবুদ্ধি তাঁদেরও দেবতার ধারণাকে কীরকম নিদারুণভাবে অধিকার করতে পারে। অপ্সুদীক্ষা বা ব্যাপ্টিজ্‌ম্‌ হবার পূর্ব্বে কোনো শিশুর মৃত্যু হোলে যে-সাম্প্রদায়িক শাস্ত্রমতে তার অনন্ত নরকবাস বিহিত হতে পারে সেই শাস্ত্রমতে দেবচরিত্রে যে অপরিসীম নির্দ্দয়তার আরোপ করা হয় তার তুলনা কোথায় আছে। বস্তুত যে-কোনো পাপের প্রসঙ্গেই হোক অনন্ত নরকের কল্পনা হিংস্রবুদ্ধির চরম প্রকাশ। য়ুরোপে মধ্যযুগে শাস্ত্রগত ধর্ম্মবিশ্বাসকে অবিচলিত রাখবার জন্যে যে-বিজ্ঞানবিদ্বেষী ও ধর্ম্মবিরুদ্ধ উৎপীড়ন আচরিত, তার ভিত্তি এইখানে। সেই নরকের আদর্শ সভ্যমানুষের জেলখানায় আজো বিভীষিকা বিস্তার ক’রে আছে। সেখানে শোধন করবার নীতি নেই, আছে শাসন করবার হিংস্রতা।

 মনুষ্যত্বের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই দেবতার উপলব্ধি মোহমুক্ত হতে থাকে, অন্তত হওয়া উচিত। হয় না যে তার কারণ ধর্ম্মসম্বন্ধীয় সব কিছুকেই আমরা নিত্য ব’লে ধরে নিয়েচি। ভুলে যাই যে, ধর্ম্মের নিত্য আদর্শকে শ্রদ্ধা করি ব’লেই ধর্ম্মমতকেও নিত্য ব’লে স্বীকার করতে হবে এমন কথা বলা চলে না। ভৌতিক বিজ্ঞানের মূলে নিত্য সত্য আছে ব’লেই বৈজ্ঞানিক মত মাত্রই নিত্য এমন গোঁড়ামির কথা যদি বলি তাহলে আজও বলতে হবে সূর্য্যই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করচে। ধর্ম্মসম্বন্ধে সাধারণত এই ভুলই ঘটে, সম্প্রদায় আপন মতকেই বলে ধর্ম্ম, আর ধর্ম্মকেই করে আঘাত। তারপরে যে বিবাদ, যে নির্দ্দয়তা, যে বুদ্ধিবিচারহীন অন্ধসংস্কারের প্রবর্ত্তন হয় মানুষের জীবনে আর কোনো বিভাগে তার তুলনাই পাওয়া যায় না।

 এ কথা মানতে হবে ভুল মত মানুষেরই আছে জন্তুর নেই। আদিম কাল থেকে আজ পর্য্যন্ত ভুলমতবাদের উদ্ভব হচ্চে, যে হেতু মানুষের একটা দুর্নিবার সমগ্রতার বোধ আছে। কোনো একটা তথ্য যখন স্বতন্ত্রভাবে বিচ্ছিন্নভাবে তার সামনে আসে তখন তাকেই সম্যক ব’লে সে স্বীকার ক’রে নিতে পারে না। তাকে পূর্ণ করবার আগ্রহে কল্পনার আশ্রয় নেয়। সেই কল্পনা প্রকৃতিভেদে মূঢ় বা প্রাজ্ঞ, সুন্দর বা কুৎসিত, নিষ্ঠুর বা সকরুণ নানা প্রকার হতে পারে। কিন্তু মূল কথাটা হচ্চে তার এই বিশ্বাস যে, প্রত্যক্ষ বিচ্ছিন্নতাকে পরিপূর্ণ ক’রে আছে অপ্রত্যক্ষ নিখিলতার সত্য। সমগ্রকে উপলব্ধি করবার যে প্রেরণা আছে তার মনে, সেই তার ভূমার বোধ।

 মানুষ অন্তরে বাহিরে অনুভব করে সে আছে একটি নিখিলের মধ্যে। সেই নিখিলের সঙ্গে সচেতন সচেষ্ট যোগসাধনের দ্বারাই সে আপনাকে সত্য ক’রে জানতে থাকে। বাহিরের যোগে তার সম্বৃদ্ধি, ভিতরের যোগে তার সার্থকতা।

 আমাদের ভৌতিক দেহ স্বতন্ত্র পদার্থ নয়। পৃথিবীর মাটি জল বাতাস উত্তাপ, পৃথিবীর ওজন আয়তন গতি সমস্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যে এই শরীর; কোথাও তার সঙ্গে এর একান্ত ছেদ নেই। বলা যেতে পারে পৃথিবী মানুষের পরম দেহ, সাধনার দ্বারা যোগবিস্তারের দ্বারা এই বিরাটকে মানুষ আপন ক’রে তুলচে, বড়ো দেহের মধ্যে ছোটো দেহকে প্রসারিত করচে, বিশ্বভৌতিক শক্তিকে আয়ত্ত ক’রে পরিমিত দেহের কর্ম্মশক্তিকে পরিপূর্ণ করেচে, চোখ স্পষ্টতর ক’রে দেখচে সুদূরস্থ মহীয়ান ও নিকটস্থ কনীয়ানকে; দুই হাত পাচ্চে বহুসহস্র হাতের শক্তি, দেশের দূরত্ব সঙ্কীর্ণ হয়ে আমাদের দেহের নিকটবর্ত্তী হচ্চে। একদিন সমস্ত ভৌতিক শক্তি দেহশক্তির পরিশিষ্ট হয়ে উঠবে মানুষের এই সঙ্কল্প।


সর্ব্বতঃ পাণিপাদন্তৎ সর্ব্বতোঽক্ষিশিরোমুখম্‌
সর্ব্বতঃ শ্রুতিমল্লোঁকে সর্ব্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।

 এই বাণীকে নিজের মধ্যে সার্থক করবে সেই স্পর্দ্ধা নিয়ে মানুষ অগ্রসর। একেবারে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে তা নয়, নিজের দেহশক্তির সঙ্গে বিরাট ভৌতিক শক্তির সংযোগকে উত্তরতর ক’রে তুলবে।

 মনে করা যাক সবই হোলো, ভৌতিক শক্তির পূর্ণতাই ঘটল। তবু কি মানুষ বলতে ছাড়বে ততঃ কিম্‌। রামায়ণে বর্ণিত দশাননের শরীরে মানবের স্বভাবসিদ্ধ দেহশক্তি বহুগুণিত হয়েছিল, দশদিক থেকে আহরিত ঐশ্বর্য্যে পূর্ণ হয়েছিল স্বর্ণলঙ্কাপুরী। কিন্তু মহাকাব্যে শেষ জায়গাটা সে পেল না। তার পরাভব হোলো রামচন্দ্রের কাছে। অর্থাৎ বাহিরে যে দরিদ্র, আত্মায় যে ঐশ্বর্য্যবান, তার কাছে। সংসারে এই পরাভব আমরা যে সর্ব্বদা প্রত্যক্ষ ক’রে থাকি তা নয়, অনেক সময়ে তার বিপরীত দেখি, তবু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে মানুষ এ’কে পরাভব বলে। মানুষের আর একটা গূঢ় জগৎ আছে সেইখানেই এই পরাভবের অর্থ পাওয়া যায়। সেই হোলো তার আত্মার জগৎ।

 আপন সত্তার পরিচয়ে মানুষের ভাষায় দুটি নাম আছে। একটি অহং, আর-একটি আত্মা। প্রদীপের সঙ্গে একটিকে তুলনা করা যায় আর-একটিকে শিখার সঙ্গে। প্রদীপ আপনার তেল সংগ্রহ করে। আপনার উপাদান নিয়ে প্রদীপের বাজারদর, কোনোটার দর সোনার, কোনোটার মাটির। শিখা আপনাকেই প্রকাশ করে, এবং তারি প্রকাশে আর সমস্তও প্রকাশিত। প্রদীপের সীমাকে উত্তীর্ণ হয়ে সে প্রবেশ করে নিখিলের মধ্যে।

 মানুষের আলো জ্বালায় তার আত্মা, তখন ছোটো হয়ে যায় তার সঞ্চয়ের অহঙ্কার। জ্ঞানে প্রেমে ভাবে বিশ্বের মধ্যে ব্যাপ্তি-দ্বারাই সার্থক হয় সেই আত্মা। সেই যোগের বাধাতেই তার অপকর্ষ। জ্ঞানের যোগে বিকার ঘটায় মোহ, ভাবের যোগে অহঙ্কার, কর্ম্মের যোগে লোভ স্বার্থপরতা। ভৌতিক বিশ্বে সত্য আপন সর্ব্বব্যাপক ঐক্য প্রমাণ করে, সেই ঐক্য-উপলব্ধিতে আনন্দিত হয় বৈজ্ঞানিক। তেমনি আত্মার আনন্দ আত্মিক ঐক্যকে উপলব্ধি-দ্বারা, যে-আত্মার সম্বন্ধে উপনিষদ বলেচেন, তমেবৈকং জানথ আত্মানম্‌—সেই আত্মাকে জানো সেই এককে, যাকে সকল আত্মার মধ্যে এক ক’রে জানলে সত্যকে জানা হয়। প্রার্থনামন্ত্রে আছে, য একঃ যিনি এক, স নো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনক্তু—শুভবুদ্ধির দ্বারা তিনি আমাদের সকলকে এক ক’রে দিন। যে-বুদ্ধিতে আমরা সকলে মিলি সেই বুদ্ধিই শুভবুদ্ধি, সেই বুদ্ধিই আত্মার। যথৈবাত্মা পরস্তদ্বদ্‌ দ্রষ্টব্যঃ শুভমিচ্ছতা,—আপনার মতো ক’রে পরকে দেখার ইচ্ছাকেই বলে শুভ ইচ্ছা, সিদ্ধিলোভেও শুভ নয় পুণ্যলোভেও শুভ নয়। পরের মধ্যে আপন চৈতন্যের প্রসারণেই শুভ কেননা পরম মানবাত্মার মধ্যেই আত্মা সত্য।

সর্ব্বব্যাপী স ভগবান্‌ তস্মাৎ সর্ব্বগতঃ শিবঃ—

যে-হেতু ভগবান সর্ব্বগত, সকলকে নিয়ে আছেন সেই জন্যেই তিনি শিব। সমগ্রের মধ্যেই শিব, শিব ঐক্যবন্ধনে। আচারীরা সামাজিক কৃত্রিম বিধির দ্বারা যখন খণ্ডতার সৃষ্টি করে তখন কল্যাণকে হারায়, তার পরিবর্ত্তে যে-কাল্পনিক পদার্থ দিয়ে আপনাকে ভোলায় তার নাম দিয়েচে পুণ্য। সেই পুণ্য আর যাই হোক সে শিব নয়। সেই সমাজবিধি আত্মার ধর্ম্মকে পীড়িত করে। স্বলক্ষণন্তু যো বেদ স মুনিঃ শ্রেষ্ঠ উচ্যতে। আত্মার লক্ষণকে যে জানে সেই মুনি সেই শ্রেষ্ঠ। আত্মার লক্ষণ হচ্চে শুভবুদ্ধি, যে-শুভবুদ্ধিতে সকলকে এক করে।

পৃথিবী আপনাতে আপনি আবর্ত্তিত, আবার বৃহৎ কক্ষপথে সে সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করচে। মানুষের সমাজেও যা-কিছু চলচে সেও এই দুই রকমের বেগে। এক দিকে ব্যক্তিগত আমি-র টানে ধনসম্পদপ্রভুত্বের আয়োজন পুঞ্জিত হয়ে উঠচে আর-এক দিকে অমিতমানবের প্রেরণায় পরস্পরের সঙ্গে তার কর্ম্মের যোগ, তার আনন্দের যোগ, পরস্পরের উদ্দেশে ত্যাগ। এইখানে আত্মার লক্ষণকে স্বীকার করার দ্বারাই তার শ্রেষ্ঠতার উপলব্ধি। উভয়ের মধ্যে পাশাপাশি কীরকম বিপরীত অসঙ্গতি দেখা যায় একটা তার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।

 কয়েক বৎসর পূর্ব্বে লণ্ডনের টাইম্‌স পত্রে একটি সংবাদ বেরিয়েছিল, আমেরিকার নেশন পত্র থেকে তার বিবরণ পেয়েচি। বায়ুপোতে চ’ড়ে ব্রিটিশ বায়ুনাবিকসৈন্য আফগানিস্থানে মাহ্‌সুদ্‌ গ্রাম ধ্বংস করতে লেগেছিল। শতঘ্নীবর্ষিণী একটা বায়ুতরী বিকল হয়ে গ্রামের মাঝখানে গেল পড়ে। একজন আফগান মেয়ে নাবিকদের নিয়ে গেল নিকটবর্ত্তী গুহার মধ্যে, একজন মালিক তাদের রক্ষার জন্যে গুহার দ্বার আগলিয়ে রইল। চল্লিশজন ছুরি আস্ফালন ক’রে তাদের আক্রমণ করতে উদ্যত, মালিক তাদের ঠেকিয়ে রাখলে। তখনো উপর থেকে বোমা পড়চে, ভিড়ের লোক ঠেলাঠেলি করচে গুহায় আশ্রয় নেবার জন্যে। নিকটবর্ত্তী স্থানের অন্য কয়েকজন মালিক এবং একজন মোল্লা এদের আনুকূল্যে প্রবৃত্ত হোলো। মেয়েরা কেউ কেউ নিলে এদের আহারের ভার। অবশেষে কিছু দিন পরে মাহ্‌সুদের ছদ্মবেশ পরিয়ে এরা তাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছিয়ে দিল।

 এই ঘটনার মধ্যে মানবস্বভাবের দুই বিপরীত দিক চূড়ান্তভাবেই দেখা দিয়েচে। এরোপ্লেন থেকে বোমাবর্ষণে দেখা যায় মানুষের শক্তির আশ্চর্য্য সমৃদ্ধি, ভূতল থেকে নভস্তল পর্য্যন্ত তার সশস্ত্র বাহুর বিপুল বিস্তার। আবার হননে প্রবৃত্ত শত্রুকে ক্ষমা ক’রে তাকে রক্ষা করতে পারল মানুষের এই আর এক পরিচয়। শত্রু-হননের সহজ প্রবৃত্তি মানুষের জীবধর্ম্মে, তাকে উত্তীর্ণ হয়ে মানুষ অদ্ভুত কথা বললে, শত্রুকে ক্ষমা করো। এ কথাটা জীবধর্ম্মের হানিকর কিন্তু মানবধর্ম্মের উৎকর্ষলক্ষণ।

 আমাদের ধর্ম্মশাস্ত্রে বলে, যুদ্ধকালে যে-মানুষ রথে নেই যে আছে ভূতলে, রথী তাকে মারবে না। যে ক্লীব, যে কৃতাঞ্জলি, যে মুক্তকেশ, যে আসীন, যে সানুনয়ে বলে আমি তোমারি তাকেও মারবে না। যে ঘুমচ্চে, যে বর্ম্মহীন, যে নগ্ন, যে নিরস্ত্র, যে অযুধ্যমান, যে যুদ্ধ দেখচে মাত্র, যে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত তাকেও মারবে না। যার অস্ত্র গেছে ভেঙে, যে শোকার্ত্ত, যে পরিক্ষত, যে ভীত, যে পরাবৃত্ত, সতের ধর্ম্ম অনুস্মরণ ক’রে তাকেও মারবে না।

 সতের ধর্ম্ম বলতে বোঝায় মানুষের মধ্যে যে সত্য তারই ধর্ম্ম, মানুষের মধ্যে যে মহৎ, তাঁরই ধর্ম্ম। যুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষ যদি তাঁকে অস্বীকার করে তবে ছোটো দিকে তার জিৎ হোলেও বড়ো দিকে তার হার। উপকরণের দিকে তার সিদ্ধি, অমৃতের দিকে সে বঞ্চিত, এই অমৃতের আদর্শ মাপজোখের বাইরে।

 স্বর্ণলঙ্কার মাপজোখ চলে। দশাননের মুণ্ড ও হাত গণনা ক’রে বিস্মিত হবার কথা। তার অক্ষৌহিণী সেনারও সংখ্যা আছে, জয়বিস্তারের পরিধি-দ্বারা সেই সেনার শক্তিও পরিমেয়। আত্মার মহিমার পরিমাণ নেই। শত্রুকে নিধনের পরিমাপ আছে শত্রুকে ক্ষমার পরিমাপ নেই। আত্মা যে-মহার্ঘ্যতায় আপন পরিচয় দেয় ও পরিচয় পায় সেই পরিচয়ের সত্য কি বিরাজ করে না অপরিমেয়ের মধ্যে, যাকে অথর্ব্ববেদ বলেচেন সকল সীমার উদ্বৃত্ত, সকল শেষের উৎশেষ। সে কি এমন একটি স্বয়ম্ভুব বুদ্বুদ কোনো সমুদ্রের সঙ্গে যার কোনো যোগ নেই। মানুষের কাছে শুনেচি, ন পাপে প্রতিপাপঃ স্যাৎ—তোমার প্রতি পাপ যে করে তার প্রতি ফিরে পাপ কোরো না। কথাটাকে ব্যবহারে ব্যক্তিবিশেষ মানে বা নাই মানে তবু মন তাকে পাগলের প্রলাপ ব’লে হেসে ওঠে না। মানুষের জীবনে এর স্বীকৃতি দৈবাৎ দেখি, প্রায় দেখি বিরুদ্ধতা, অর্থাৎ মাথা গণ্‌তি ক’রে এর সত্য চোখে পড়ে না বললেই হয়। তবে এর সত্যতা কোন্‌খানে। মানুষের যে স্বভাবে এটা আছে তার আশ্রয় কোথায়। মানুষ এ প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েচে শুনি।


যস্যাত্মা বিরতঃ পাপাৎ কল্যাণে চ নিবেশিতঃ
তেন সর্ব্বমিদং বুদ্ধং প্রকৃতির্বিকৃতিশ্চ যা।

 আত্মা যাঁর পাপ থেকে বিরত ও কল্যাণে নিবিষ্ট, তিনি সমস্তকে বুঝেচেন। তাই তিনি জানেন কোন্‌টা স্বভাবসিদ্ধ কোন্‌টা স্বভাববিরুদ্ধ।

 মানুষ আপনার স্বভাবকে তখনি জানে যখন পাপ থেকে নিবৃত্ত হয়ে কল্যাণের অর্থাৎ সর্ব্বজনের হিতসাধনা করে। অর্থাৎ মানুষের স্বভাবকে জানে মানুষের মধ্যে যারা মহাপুরুষ। জানে কী ক’রে। তেন সর্ব্বমিদং বুদ্ধম্‌। স্বচ্ছমন নিয়ে সমস্তটাকে সে বোঝে। সত্য আছে শিব আছে সমগ্রের মধ্যে। যে পাপ অহংসীমাবদ্ধ স্বভাবের, তার থেকে বিরত হোলে তবে মানুষ আপনার আত্মিক সমগ্রকে জানে, তখনি জানে আপনার প্রকৃতি। তার এই প্রকৃতি কেবল আপনাকে নিয়ে নয়, তাঁকেই নিয়ে যাঁকে গীতা বলচেন তিনিই পৌরুষং নৃষু, মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব। মানুষ এই পৌরুষের প্রতিই লক্ষ্য ক’রে বলতে পারে ধর্ম্মযুদ্ধে মৃতো বাপি তেন লোকত্রয়ং জিতম্‌। মৃত্যুতে সেই পৌরুষকে সে প্রমাণ করে যা তার দেবত্বের লক্ষণ, যা মৃত্যুর অতীত।

 শ্রেয় প্রেয় নিয়ে এতক্ষণ যা বলা হোলো সেটা সমাজস্থিতির দিক দিয়ে নয়। নিন্দা প্রশংসার ভিত্তিতে পাকা ক’রে গেঁথে শাসনের দ্বারা উপদেশের দ্বারা আত্মরক্ষার উদ্দেশে সমাজ যে-ব্যবস্থা ক’রে থাকে তাতে চিরন্তন শ্রেয়োধর্ম্ম গৌণ, প্রথাঘটিত সমাজরক্ষাই মুখ্য। তাই এমন কথা শোনা যায় শ্রেয়োধর্ম্মকে বিশুদ্ধভাবে সমাজে প্রবর্ত্তন করা ক্ষতিকর। প্রায়ই বলা হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভূরিপরিমাণ মূঢ়তা আছে এই জন্যে অনিষ্ট থেকে ঠেকিয়ে রাখতে হোলে মোহের দ্বারাও তাদের মন ভোলানো চাই, মিথ্যা উপায়েও তাদের ভয় দেখানো বা সান্ত্বনা দেওয়া দরকার, তাদের সঙ্গে এমন ভাবে ব্যবহার করা দরকার, যেন তারা চিরশিশু বা চিরপশু। ধর্ম্মসম্প্রদায়েও যেমন সমাজেও তেমনি, কোনো এক পূর্ব্বতনকালে যে সমস্ত মত ও প্রথা প্রচলিত ছিল সেগুলি পরবর্ত্তীকালেও আপন অধিকার ছাড়তে চায় না। পতঙ্গমহলে দেখা যায় কোনো কোনো নিরীহ পতঙ্গ ভীষণ পতঙ্গের ছদ্মবেশে নিজেকে বাঁচায়। সমাজরীতিও তেমনি। তা নিত্যধর্ম্মের ছদ্মবেশে আপনাকে প্রবল ও স্থায়ী করতে চেষ্টা করে। এক দিকে তার পবিত্রতার বাহ্যাড়ম্বর, অন্য দিকে পারত্রিক দুর্গতির বিভীষিকা, সেই সঙ্গে সম্মিলিত শাসনের নানাবিধ কঠোর, এমন কি, অন্যায় প্রণালী,—ঘর-গড়া নরকের তর্জ্জনীসঙ্কেতে নিরর্থক অন্ধ আচারের প্রবর্ত্তন। রাষ্ট্রতন্ত্রে এই বুদ্ধিরই প্রতীক আণ্ডামান, ফ্রান্সের ডেভিল আইলাণ্ড, ইটালির লিপারি দ্বীপ। এদের ভিতরের কথা এই যে, বিশুদ্ধ শ্রেয়োনীতি ও লোকস্থিতি এক তালে চলতে পারে না। এই বুদ্ধির সঙ্গে চিরদিনই তাঁদের লড়াই চ’লে এসেচে যাঁরা সত্যকে শ্রেয়কে মনুষ্যত্বকে চরম লক্ষ্য ব’লে শ্রদ্ধা করেন।

 রাজ্যের বা সমাজের উপযোগিতারূপে শ্রেয়ের মূল্যবিচার এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। শ্রেয়কে মানুষ যে স্বীকার করেচে সেই স্বীকৃতির আশ্রয় কোথায়, সত্য কোথায়, সেইটেই আমার আলোচ্য। রাজ্যে সমাজে নানাপ্রকার স্বার্থসাধনের ক্ষেত্রে প্রতিদিনের ব্যবহারে তার প্রতিবাদ পদে পদে, তবুও আত্মপরিচয়ে মানুষ তাকে শ্রেষ্ঠ স্থান দিয়েচে, তাকেই বলেচে ধর্ম্ম অর্থাৎ নিজের চরম স্বভাব, শ্রেয়ের আদর্শসম্বন্ধে দেশকালপাত্রভেদে যথেষ্ট মতভেদ সত্ত্বেও সেই শ্রেয়ের সত্যকে সকল মানুষই শ্রদ্ধা করেচে এইটেতে মানুষের ধর্ম্মের কোন্‌ স্বরূপ প্রমাণিত হয় সেইটে আমি বিচার করেচি। হয় এবং হওয়া উচিত এই দ্বন্দ্ব মানব-ইতিহাসের আরম্ভকাল থেকেই প্রবলবেগে চলচে, তার কারণ বিচার করতে গিয়ে বলেচি মানুষের অন্তরে এক দিকে পরমমানব আর এক দিকে স্বার্থসীমাবদ্ধ জীবমানব, এই উভয়ের সামঞ্জস্য-চেষ্টাই মানবমনের নানা অবস্থা অনুসারে নানা আকারে প্রকারে ধর্ম্মতন্ত্ররূপে অভিব্যক্ত। নইলে কেবল সুবিধা অসুবিধা প্রিয় অপ্রিয় প্রবল থাকত জৈবিক ক্ষেত্রে জীবধর্ম্মে; পাপ পুণ্য কল্যাণ অকল্যাণের কোনো অর্থই থাকত না।

 মানুষের এই যে কল্যাণের মতি এর সত্য কোথায়? ক্ষুধাতৃষ্ণার মতো প্রথম থেকেই আমাদের মনে তার বোধ যদি পূর্ণ থাকত তাহলে তার সাধনা করতে হ’ত না। বলব বিশ্বমানবমনে আছে। কিন্তু সকল মানুষের মন সমষ্টীভূত হয়ে বিশ্বমানবমনের মহাদেশ সৃষ্ট, এ কথা বলব না। ব্যক্তিমন বিশ্বমনে আশ্রিত কিন্তু ব্যক্তিমনের যোগফল বিশ্বমন নয়। তাই যদি হ’ত তাহলে যা আছে তাই হ’ত একান্ত, যা হতে পারে তার জায়গা পাওয়া যেত না। অথচ যা হয়নি, যা হ’তে পারে মানুষের ইতিহাসে তারি জোর তারি দাবী বেশি। তারি আকাঙ্ক্ষা দুর্নিবার হয়ে মানুষের সভ্যতাকে যুগে যুগে বর্ত্তমানের সীমা পার করিয়ে দিচ্চে। সেই আকাঙ্ক্ষা শিথিল হোলেই সত্যের অভাবে সমাজ শ্রীহীন হয়।

 দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে আমার ব্যক্তিগত মনে সুখদুঃখের যে-অনুভূতি সেটা বিশ্বমনের মধ্যেও সত্য কিনা। ভেবে দেখলে দেখা যায় অহংসীমার মধ্যে যে সুখদুঃখ, আত্মার সীমায় তার রূপান্তর ঘটে। যে মানুষ সত্যের জন্যে জীবন উৎসর্গ করেচে দেশের জন্যে, লোকহিতের জন্যে,—বৃহৎ ভূমিকায় যে নিজেকে দেখচে, ব্যক্তিগত সুখদুঃখের অর্থ তার কাছে উল্‌টো হয়ে গেছে। সে মানুষ সহজেই সুখকে ত্যাগ করতে পারে এবং দুঃখকে স্বীকার ক’রে দুঃখকে অতিক্রম করে। স্বার্থের জীবনযাত্রায় সুখদুঃখের ভার গুরুতর, মানুষ স্বার্থকে যখন ছাড়িয়ে যায় তখন তার ভার এত হাল্‌কা হয়ে যায় যে, তখন পরম দুঃখের মধ্যে তার সহিষ্ণুতাকে পরম অপমানের আঘাতে তার ক্ষমাকে অলৌকিক ব’লে মনে হয়। আপনাকে বৃহতে উপলব্ধি করাই সত্য, অহংসীমায় অবরুদ্ধ জানাই অসত্য। ব্যক্তিগত দুঃখ এই অসত্যে।

 আমরা দুঃখকে যে ভাবে দেখি বৃহতের মধ্যে সে ভাব থাকতে পারে না, যদি থাকত তাহলে সেখানে দুঃখের লাঘব বা অবসান হ’ত না। সঙ্গীতের অসম্পূর্ণতায় বিস্তর বেসুর আছে, সেই বেসুরের একটিও থাকতে পারে না সম্পূর্ণ সঙ্গীতে—সেই সম্পূর্ণ সঙ্গীতের দিকে যতই যাওয়া যায় ততই বেসুরের হ্রাস হ’তে থাকে। বেসুর আমাদের পীড়া দেয়, যদি না দিত তাহলে সুরের দিকে আমাদের যাত্রা এগোত না। তাই বিরাটকে বলি রুদ্র, তিনি মুক্তির দিকে আকর্ষণ করেন দুঃখের পথে। অসর্ণতাকে ক্ষয় করার দ্বারা পূর্ণের সঙ্গে মিলন বিশুদ্ধ আনন্দময় হবে এই অভিপ্রায় আছে বিশ্বমানবের মধ্যে। তাঁর প্রতি প্রেমকে জাগরিত ক’রে তাঁরই প্রেমকে সার্থক করব যুগে যুগে এই প্রতীক্ষার আহ্বান আসচে আমাদের কাছে।

 সেই আহ্বানের আকর্ষণে মানুষ বেরিয়ে পড়েচে অজানার দিকে, এই যাত্রার ইতিহাসই তার ইতিহাস। তার চলার পথপার্শ্বে কত সাম্রাজ্য উঠল এবং পড়ল, ধনসম্পদ হোলো স্তূপাকৃত আবার গেল মিলিয়ে ধূলোর মধ্যে। তার আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দেবার জন্যে কত প্রতিমা সে গড়ে তুললে আবার ভেঙে দিয়ে গেল, বয়স পেরিয়ে ছেলে-বেলাকার খেলনার মতো। কত মায়ামন্ত্রের চাবি বানাবার চেষ্টা করলে, তাই দিয়ে খুলতে চেয়েছিল প্রকৃতির রহস্যভাণ্ডার, আবার সমস্ত ফেলে দিয়ে নূতন ক’রে খুঁজতে বেরিয়েচে গহনে প্রবেশের গোপন পথ,—এমনি ক’রে তার ইতিবৃত্তে এক যুগের পর আর এক যুগ আসচে, মানুষ অশ্রান্ত যাত্রা করেচে অন্নবস্ত্রের জন্যে নয়, আপনার সমস্ত শক্তি দিয়ে মানবলোকে মহামানবের প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে, আপনার জটিল বাধার থেকে আপনার অন্তরতম সত্যকে উদ্ধার করবার জন্যে; সেই সত্য যা তার পুঞ্জিত দ্রব্যভারের চেয়ে বড়ো, তার সমস্ত কৃতকর্ম্মের চেয়ে বড়ো, তার সমস্ত প্রথামত বিশ্বাসের চেয়ে বড়ো, যার মৃত্যু নেই, যার ক্ষয় নেই। প্রভূত হয়েচে মানুষের ভুলভ্রান্তি নিষ্ফলতা, পথে পথে তারা প্রকাণ্ড ভগ্নস্তূপরূপে ছড়িয়ে আছে; মানুষের দুঃখ ব্যথার আঘাত হয়েচে অপরিসীম, তারা অবরুদ্ধ সার্থকতার শৃঙ্খল-ছেদনের কঠিন অধ্যবসায়, এ সমস্ত এক মুহূর্ত্তও কে সহ্য করতে পারত মানুষের অন্তরবাসী ভূমার মধ্যে যদি এর চিরন্তন কোনো অর্থ না থাকত। মানুষের সকল দুঃখের উপরকার কথা এই যে, মানুষ আপন চৈতন্যকে প্রসারিত করচে আপন অসীমের দিকে, জ্ঞানে প্রেমে কর্ম্মে বৃহত্তর ঐক্যকে আয়ত্ত করতে চলেচে, আপনার সকল মহৎ কীর্ত্তিতে তাঁর নিকটতর সামীপ্য পাবার জন্যে ব্যগ্র বাহু বাড়িয়েচে যাঁকে তে সর্ব্বগং সর্ব্বতঃ প্রাপ্য ধীরা যুক্তাত্মানঃ সর্ব্বমেবাবিশন্তি। মানুষ হয়ে জন্মলাভ ক’রে আরাম চাইবে কে, বিশ্রাম পাব কোথায়, মুক্তি পেতে হবে মুক্তি দিতে হবে এই যে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য—

মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা,
মৃত্যুরে না করি' শঙ্কা। দুর্দ্দিনের অশ্রুজলধারা
মস্তকে পড়িবে ঝরি’, তারি মাঝে যাব অভিসারে
তারি কাছে, জীবনসর্ব্বস্বধন অর্পিয়াছি যারে
জন্ম জন্ম ধরি’।

কে সে। জানি না কে। চিনি নাই তারে,
শুধু এইটুকু জানি, তারি লাগি রাত্রি অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হ’তে যুগান্তর পানে,
ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তর প্রদীপখানি। শুধু জানি যে শুনেছে কানে
তাহার আহ্বানগীত, ছুটেছে সে নির্ভীক পরাণে,
সঙ্কট-আবর্ত্তমাঝে দিয়েছে সে সর্ব্ব বিসর্জ্জন,
নির্য্যাতন লয়েছে সে বক্ষ পাতি, মৃত্যুর গর্জ্জন
শুনেছে সে সঙ্গীতের মতো। দহিয়াছে অগ্নি তারে,
বিদ্ধ করিয়াছে শূল, ছিন্ন তারে করেছে কুঠারে,
সর্ব্বপ্রিয়বস্তু তার অকাতরে করিয়া ইন্ধন
চিরজন্ম তারি লাগি জ্বেলেছে সে হোমহুতাশন।

শুনিয়াছি তারি লাগি
রাজপুত্র পরিয়াছে ছিন্ন কন্থা, বিষয়ে বিরাগী
পথের ভিক্ষুক। মহাপ্রাণ সহিয়াছে পলে পলে
প্রত্যহের কুশাঙ্কুর।

তারি পদে মানী সঁপিয়াছে মান,
ধনী সঁপিয়াছে ধন, বীর সঁপিয়াছে আত্মপ্রাণ।



শুধু জানি
সে বিশ্বপ্রিয়ার প্রেমে ক্ষুদ্রতারে দিয়া বলিদান
বর্জ্জিতে হইবে জীবনের সর্ব্ব অসম্মান,
সম্মুখে দাঁড়াতে হবে উন্নতমস্তক উচ্চে তুলি’,
যে-মস্তকে ভয় লেখে নাই লেখা, দাসত্বের ধূলি
আঁকে নাই কলঙ্কতিলক।