মানুষের ধর্ম্ম/৩

উইকিসংকলন থেকে

তিন

বৃহদারণ্যকে একটি আশ্চর্য্য বাণী আছে:—


অথ যোঽন্যাং দেবতাম্‌ উপাস্তে
অন্যোঽসৌ অন্যোঽহম্‌ অস্মীতি
ন স বেদ, যথা পশুরেবং স দেবানাম্‌।

—যে মানুষ অন্য দেবতাকে উপাসনা করে, সেই দেবতা অন্য আর আমি অন্য এমন কথা ভাবে, সে তো দেবতাদের পশুর মতোই।

 অর্থাৎ সেই দেবতার কল্পনা মানুষকে আপনার বাইরে বন্দী করে রাখে; তখন মানুষ আপন দেবতার দ্বারাই আপন আত্মা হতে নির্ব্বাসিত অপমানিত।

 এই যেমন শোনা গেল উপনিষদে আবার সেই কথাই আপন ভাষায় বলচে নিরক্ষর অশাস্ত্রজ্ঞ বাউল। সে আপন দেবতাকে জানে আপনার মধ্যেই, তাকে বলে মনের মানুষ। বলে “মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ।”

 মানুষের ইতিহাসে এমন অনেক ধর্ম্মসম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েচে যারা কাঠ পাথর পূজাকে বলেচে হীনতা এবং তাই নিয়ে তারা মারকাট করতে ছোটে। স্বীকার করি কাঠ পাথর বাইরের জিনিষ, সেখানে সর্ব্বকালের সর্ব্বমানুষের পূজা মিলতে পারে না। মানুষের ভক্তিকে জাতিতে জাতিতে প্রথায় প্রথায় সেই পূজা বিচ্ছিন্ন করে, তার ঐতিহাসিক গণ্ডীগুলি সঙ্কীর্ণ।

 কিন্তু তাদের বিরুদ্ধ সম্প্রদায়েরও দেবতা প্রতিমার মতোই বাইরে অবস্থিত, নানা প্রকার অমানুষিক বিশেষণে লক্ষণে সজ্জিত, শুধু তাই নয়, বিশেষ জাতির ঐতিহাসিক কার্য্যকলাপে জড়িত ও কাল্পনিক কাহিনী-দ্বারা দৈশিক ও কালিক বিশেষত্বগ্রস্ত। এই পৌত্তলিকতা সূক্ষ্মতর উপাদানে রচিত ব’লেই নিজেকে অপৌত্তলিক ব’লে গর্ব্ব করে। বৃহদারণ্যক এই বাহ্যিকতাকেও হীন ব’লে নিন্দা করেচেন। তিনি বলেন যে-দেবতাকে আমার থেকে পৃথক ক’রে বাইরে স্থাপন করি তাঁকে স্বীকার করার দ্বারাই নিজেকে নিজের সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দিই।

 এমনতরো কথায় একটা ক্রুদ্ধ কলরব উঠতে পারে। তবে কি মানুষ নিজেকে নিজেই পূজা করবে। নিজেকে ভক্তি করা কি সম্ভব। তাহলে পূজা ব্যাপারকে তো বলতে হবে অহঙ্কারের বিপুলীকরণ।

 একেবারে উল্‌টো। অহংকে নিয়েই অহংকার। সে তো পশুও করে। অহং থেকে বিযুক্ত আত্মায় ভূমার উপলব্ধি একমাত্র মানুষের পক্ষেই সাধ্য। কেননা মানুষের পক্ষে তাই সত্য। ভূমা আহারে বিহারে আচারে বিচারে ভোগে নৈবেদ্যে মন্ত্রে তন্ত্রে নয়। ভূমা বিশুদ্ধ জ্ঞানে, বিশুদ্ধ প্রেমে, বিশুদ্ধ কর্ম্মে। বাইরে দেবতাকে রেখে স্তবে অনুষ্ঠানে পূজোপচারে শাস্ত্রপাঠে বাহ্যিক বিধি নিষেধ পালনে উপাসনা করা সহজ কিন্তু আপনার চিন্তায় আপনার কর্ম্মে পরম মানবকে উপলব্ধি ও স্বীকার করা সবচেয়ে কঠিন সাধনা। সেই জন্যেই কথিত আছে নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ। তারা সত্যকে অন্তরে পায় না যারা অন্তরে দুর্ব্বল। অহঙ্কারকে দূর করতে হয় তবেই অহংকে পেরিয়ে আত্মাতে পৌঁছতে পারি।

য আত্মা অপহতপাপ্মা বিজরো বিমৃত্যুর্বিশোকোঽবিজিঘৎসোঽপিপাসঃ সত্যকামঃ সত্যসংকল্পঃ সোঽন্বেষ্টব্যঃ স বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ

—আমার মধ্যে যে মহান আত্মা আছেন যিনি জরামৃত্যুশোক ক্ষুধাতৃষ্ণার অতীত, যিনি সত্যকাম সত্যসঙ্কল্প তাঁকে অন্বেষণ করতে হবে তাঁকে জানতে হবে “মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ।” এই যে তাঁকে সন্ধান করা তাঁকে জানা এ তো বাইরে জানা বাইরে পাওয়া নয়, এ যে আপন অন্তরে আপনি হওয়ার দ্বারা জানা, হওয়ার দ্বারা পাওয়া।

প্রজ্ঞানেনৈনমাপ্লুয়াৎ

—যুক্তিতর্কের যোগে বাহ্যজ্ঞানের বিষয়কে যেমন করে জানি এ তো তেমন করে জানা নয়, অন্তরে হওয়ার দ্বারা জানা। নদী সমুদ্রকে পায় যেমন করে, প্রতিক্ষণেই সমুদ্র হতে হতে। এক দিকে সে ছোটনদী, আর-এক দিকে সে বৃহৎ সমুদ্র। সেই হওয়া তার পক্ষে সম্ভব, কেননা সমুদ্রের সঙ্গে তার স্বাভাবিক ঐক্য; বিচ্ছেদের ভিতর দিয়ে সেই ঐক্য। জীবধর্ম্ম যেন উঁচু পাড়ির মতো জন্তুদের চেতনাকে ঘিরে আটক করেচে। মানুষের আত্মা জীবধর্ম্মের পাড়ির ভিতর দিয়ে তাকে কেবলি পেরিয়ে চলেচে—মিলেচে আত্মার মহাসাগরে—সেই সাগরের যোগে সে জেনেচে আপনাকে। যেমন নদী পায় আপনাকে যখন সে বৃহৎ জলরাশিকে আপন করে, নইলে সে থাকে বদ্ধ হয়ে, বিল হয়ে, জলা হয়ে। তাই বাউল মানুষকে বলেচে, “তোরি ভিতর অতল সাগর।” পূর্ব্বেই বলেচি মানুষ আপন ব্যক্তিগত সংস্কারকে পার হয়ে যেজ্ঞানকে পায়, যাকে বলে বিজ্ঞান, সেই জ্ঞান নিখিল মানবের, তাকে সকল মানুষই স্বীকার করবে, সেই জন্যে তা শ্রদ্ধেয়। তেমনি মানুষের মধ্যে স্বার্থগত আমির চেয়ে যে-বড়ো আমি, সেই আমির সঙ্গে সকলের ঐক্য, তার কর্ম্ম সকলের কর্ম্ম। একলা আমির কর্ম্মই বন্ধন, সকল আমির কর্ম্ম মুক্তি। আমাদের বাংলা দেশের বাউল বলেচে—

মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ
একবার দিব্যচক্ষু খুলে গেলে দেখতে পাবি সর্ব্বঠাঁই।

 সেই মনের মানুষ সকল মনের মানুষ, আপন মনের মধ্যে তাঁকে দেখতে পেলে সকলের মধ্যেই তাঁকে পাওয়া হয়। এই কথাই উপনিষদ বলেচেন,

যুক্তাত্মানঃ সর্ব্বমেবাবিশন্তি।

 বলেচেন,

তং বেদ্যং পুরুষং বেদ

—যিনি বেদনীয় সেই পূর্ণ মানুষকে জানো, অন্তরে আপনার বেদনায় যাঁকে জানা যায় তাঁকে সেই বেদনায় জানো, জ্ঞানে নয়, বাইরে নয়।

 আমাদের শাস্ত্রে সোঽহম্‌ ব’লে যে তত্ত্বকে স্বীকার করা হয়েচে তা যত বড়ো অহঙ্কারের মতো শুনতে হয় আসলে তা নয়। এতে ছোটোকে বড়ো বলা হয়নি, এতে সত্যকে ব্যাপক বলা হয়েচে। আমার যে ব্যক্তিগত আমি তাকে ব্যাপ্ত করে আছে বিশ্বগত আমি। মাথায় জটা ধারণ করলে গায়ে ছাই মাখলে বা মুখে এই শব্দ উচ্চারণ করলেই সোঽহম্‌-সত্যকে প্রকাশ করা হোলো এমন কথা যে মনে করে সেই অহঙ্কৃত। যে-আমি সকলের, সেই আমিই আমারও, এটা সত্য, কিন্তু এই সত্যকে আপন করাই মানুষের সাধনা। মানুষের ইতিহাসে চিরকাল এই সাধনাই নানা রূপে নানা নামে নানা সঙ্কল্পের মধ্য দিয়ে চলেচে। যিনি পরম আমি, যিনি সকলের আমি সেই আমিকেই আমার ব’লে সকলের মধ্যে জানা যে পরিমাণে আমাদের জীবনে আমাদের সমাজে উপলব্ধ হচ্চে সেই পরিমাণেই আমরা সত্য মানুষ হয়ে উঠচি। মানুষের রিপু মাঝখানে এসে এই সোঽহম্‌ উপলব্ধিকে দুইভাগ করে দেয়, একান্ত হয়ে ওঠে অহম্‌

 তাই উপনিষদ বলেন,

মা গৃধঃ

—লোভ কোরো না। লোভ বিশ্বের মানুষকে ভুলিয়ে বৈষয়িক মানুষ করে দেয়। যে-ভোগ মানুষের যোগ্য তা সকলকে নিয়ে, তা বিশ্বভৌমিক, তা মানুষের সাহিত্যে আছে, শিল্পকলায় আছে, তাই প্রকাশ পায় মানুষের সংসারযাত্রায়, তার হৃদয়ের আতিথ্যে। তাই আমাদের শাস্ত্রে বলে

অতিথিদেবো ভব।

কেননা আমার ভোগ সকলের ভোগ এই কথাটা অতিথিকে দিয়ে গৃহস্থ স্বীকার করে, তার ঐশ্বর্য্যের সঙ্কোচ দূর হয়। ব্যক্তিগত মানবের ঘরে সর্ব্বমানবের প্রতিনিধি হয়ে আসে অতিথি, তার গৃহসীমাকে বিশ্বের দিকে নিয়ে যায়। না নিয়ে গেলে সেটা রাজপ্রাসাদের পক্ষেও দীনতা। এই আতিথ্যের মধ্যে আছে সোঽহংতত্ত্ব—অর্থাৎ আমি তাঁর সঙ্গে এক যিনি আমার চেয়ে বড়ো। আমি তাঁর সঙ্গে মিলে আছি যিনি আমার এবং আমার অতিরিক্ত।

 আমাদের দেশে এমন সকল সন্ন্যাসী আছেন, যাঁরা সোঽহংতত্ত্বকে নিজের জীবনে অনুবাদ করে নেন নিরতিশয় নৈষ্কর্ম্ম্যে ও নির্ম্মমতায়। তাঁরা দেহকে পীড়ন করেন জীবপ্রকৃতিকে লঙ্ঘন করবার জন্যে, মানুষের স্বাধীন দায়িত্বও ত্যাগ করেন মানবপ্রকৃতিকে অস্বীকার করবার স্পর্দ্ধায়। তাঁরা অহংকে বর্জ্জন করেন যে-অহং বিষয়ে আসক্ত, আত্মাকেও অমান্য করেন যে-আত্মা সকল আত্মার সঙ্গে যোগে যুক্ত। তাঁরা যাঁকে ভূমা বলেন তিনি উপনিষদে উক্ত সেই ঈশ নন যিনি সকলকেই নিয়ে আছেন, তাঁদের ভূমা সবকিছু হতে বর্জ্জিত সুতরাং তাঁর মধ্যে কর্ম্মতত্ত্ব নেই। তাঁরা মানেন না তাঁকে, যিনি

পৌরুষং নৃষু

মানুষের মধ্যে যিনি মনুষ্যত্ব, যিনি বিশ্বকর্ম্মা মহাত্মা, যাঁর কর্ম্ম খণ্ডকর্ম্ম নয়, যাঁর কর্ম্ম বিশ্বকর্ম্ম; যাঁর

স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ

যাঁর মধ্যে জ্ঞানশক্তি ও কর্ম্ম স্বাভাবিক, যে-স্বাভাবিক জ্ঞানশক্তিকর্ম্ম অন্তহীন দেশে কালে প্রকাশমান।

 পূর্ব্বেই বলেচি মানুষের অভিব্যক্তির গতি অন্তরের দিকে। এই দিকে তার সীমার আবরণ খুলে যাবার পথ। একদা মানুষ ছিল বর্ব্বর, সে ছিল পশুর মতো, তখন ভৌতিক জীবনের সীমায় তার মন তার কর্ম্ম ছিল বদ্ধ। জ্বলে উঠল যখন ধীশক্তি, তখন চৈতন্যের রশ্মি চলল সঙ্কীর্ণ জীবনের সীমা ছাড়িয়ে, বিশ্বভৌমিকতার দিকে। ভারতীয় মধ্যযুগের কবিস্মৃতিভাণ্ডার সুহৃদ ক্ষিতিমোহনের কাছ থেকে কবি রজ্জবের একটি বাণী পেয়েচি। তিনি বলেচেন,—

সব সাঁচ মিলৈ সে সাঁচ হৈ
না মিলৈ সো ঝূঁঠ।
জন রজ্জব সাঁচী কহী
ভাবই রিঝি ভাবই রূঠ।

সব সত্যের সঙ্গে যা মেলে তাই সত্য, যা মিলল না তা মিথ্যে, রজ্জব বলচে এই কথাই খাঁটি, এতে তুমি খুসিই হও আর রাগই করো।

 ভাষা থেকে বোঝা যাচ্চে রজ্জব বুঝেচেন এ কথায় রাগ করবার লোকই সমাজে বিস্তর। তাদের মত ও প্রথার সঙ্গে বিশ্বসত্যের মিল হচ্চে না, তবু তারা তাকে সত্য নাম দিয়ে জটিলতায় জড়িয়ে থাকে,—মিল নেই বলেই এই নিয়ে তাদের উত্তেজনা উগ্রতা এত বেশি। রাগারাগির দ্বারা সত্যের প্রতিবাদ, অগ্নিশিখাকে ছুরি দিয়ে বেঁধবার চেষ্টার মতো। সেই ছুরি সত্যকে মারতে পারে না, মারে মানুষকে। তবু সেই বিভীষিকার সামনে দাঁড়িয়েই বলতে হবে,

সব সাঁচ মিলৈ সো সাঁচ হৈ
না মিলৈ সো ঝূঁঠ।

 একদা যে-দিন কোনো একজন মাত্র বৈজ্ঞানিক বললেন, পৃথিবী সূর্য্যের চার দিকে ঘুরচে সে-দিন সেই একজন মাত্র মানুষই বিশ্বমানুষের বুদ্ধিকে প্রকাশ করেচেন। সে-দিন লক্ষ লক্ষ লোক সে কথায় ক্রুদ্ধ, তারা ভয় দেখিয়ে জোর করে বলাতে চেয়েচে সূর্য্যই পৃথিবীর চার দিকে ঘুরচে; তাদের সংখ্যা যতই বেশি হোক, তাদের গায়ের জোর যতই থাক, তবু তারা প্রজ্ঞাকে অস্বীকার করবামাত্র চিরকালের মানবকে অস্বীকার করলে। সে-দিন অসংখ্য বিরুদ্ধবাদীর মাঝখানে একলা দাঁড়িয়ে কে বলতে পেরেচে সোঽহং অর্থাৎ আমার জ্ঞান আর মানবভূমার জ্ঞান এক, তিনিই বলেচেন যাঁকে সে-দিন বিপুল জনসংঘ সত্য প্রত্যাখ্যান করাবার জন্যে প্রাণান্তিক পীড়ন করেছিল।

 যদি লক্ষ লক্ষ লোক বলে, কোটি যোজন দূরে কোনো বিশেষ গ্রহ-নক্ষত্রের সমবায়ে পৃথিবীর কোনো একটি প্রদেশের জলধারায় এমন অভৌতিক যাদুশক্তির সঞ্চার হয় যাতে স্নানকারীর নিজের ও পূর্ব্বপুরুষের আন্তরিক পাপ যায় ধুয়ে তাহলে বলতেই হবে,

সব সাঁচ মিলৈ সো সাঁচ হৈ
না মিলৈ সো ঝূঁঠ।

বিশ্বের বুদ্ধি এ বুদ্ধির সঙ্গে মিলল না। কিন্তু যেখানে বলা হয়েচে,

অদ্ভির্গাত্রাণি শুধ্যন্তি মনঃ সত্যেন শুধ্যতি

—জল দিয়ে কেবল দেহেরই শোধন হয়, মনের শোধন হয় সত্যে সেখানে বিশ্বমানবমনের সম্মতি পাওয়া যায়। কিংবা যেখানে বলা হয়েচে—


কৃত্বা পাপং হি সন্তপ্য তস্মাৎ পাপাৎ প্রমুচ্যতে।
নৈবং কুর্য্যাম্‌ পুনরিতি নিবৃত্ত্যা পুয়তে তু সঃ॥

—পাপ করে সন্তপ্ত হোলে সেই সন্তাপ থেকেই পাপের মোচন হয়, এমন কাজ আর করব না বলে নিবৃত্ত হোলেই মানুষ পবিত্র হতে পারে, সেখানে এই বলাতেই মানুষ আপন বুদ্ধিতে স্বীকার করে বিশ্বমনের প্রজ্ঞাকে,

তং হ দেবম্‌ আত্মবুদ্ধিপ্রকাশম্‌

—সেই দেবতাকে আমাদের আত্মীয় জানি যিনি আত্ম-বুদ্ধি-প্রকাশক। আমার মন আর বিশ্বমন একই এই কথাই সত্য সাধনার মূলে, আর ভাষান্তরে এই কথাই সোঽহম্‌।

 একদিন ব্রাহ্মণ রামানন্দ তাঁর শিষ্যদের কাছ থেকে চলে গিয়ে আলিঙ্গন করলেন নাভা চণ্ডালকে, মুসলমান জোলা কবীরকে, রবিদাস চামারকে। সেদিনকার সমাজ তাঁকে জাতিচ্যুত করলে। কিন্তু তিনি একলাই সেদিন সকলের চেয়ে বড়ো জাতিতে উঠেছিলেন যে-জাতি নিখিল মানুষের। সেদিন ব্রাহ্মণমণ্ডলীর ধিক্কারের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে রামানন্দই বলেছিলেন সোঽহম্‌; সেই সত্যের শক্তিতেই তিনি পার হয়ে গিয়েছিলেন সেই ক্ষুদ্র সংস্কারগত ঘৃণাকে, যা নিষ্ঠুর হয়ে মানুষে মানুষে ভেদ ঘটিয়ে সমাজস্থিতির নামে সমাজধর্ম্মের মূলে আঘাত করে।

 একদিন যিশুখৃষ্ট বলেছিলেন “সোঽহম্‌” আমি আর আমার পরমপিতা একই। কেননা তাঁর যে-প্রীতি যে-কল্যাণবুদ্ধি সকল মানুষের প্রতি সমান প্রসারিত সেই প্রীতির আলোকেই আপন অহংসীমাকে ছাড়িয়ে পরম মানবের সঙ্গে তিনি আপন অভেদ দেখেছিলেন।

 বুদ্ধদেব উপদেশ দিলেন, সমস্ত জগতের প্রতি বাধাশূন্য হিংসাশূন্য শত্রুতাশূন্য মানসে অপরিমাণ মৈত্রী পোষণ করবে। দাঁড়াতে বসতে চলতে শুতে যাবৎ নিদ্রিত না হবে এই মৈত্রীস্মৃতিতে অধিষ্ঠিত থাকবে, এ’কেই বলে ব্রহ্মবিহার।

 এত বড়ো উপদেশ মানুষকেই দেওয়া চলে। কেননা মানুষের মধ্যে গভীর হয়ে আছে সোঽহংতত্ত্ব সে কথা বুদ্ধদেব নিজের মধ্য থেকেই জেনেচেন, তাই বলেচেন অপরিমাণ প্রেমেই আপনার অন্তরের অপরিমেয় সত্যকে মানুষ প্রকাশ করে।

 অথর্ব্ববেদ বলেন,

তস্মাদ্‌ বৈ বিদ্বান্‌ পুরুষমিদং ব্রহ্মেতি মন্যতে

—যিনি বিদ্বান তিনি মানুষকে তার প্রত্যক্ষের অতীত বৃহৎ ব’লেই জানেন। সেই জন্যে তিনি তার কাছে প্রত্যাশা করতে পারেন দুঃসাধ্য কর্ম্মকে অপরিমিত ত্যাগকে।

যে পুরুষে ব্রহ্ম বিদুস্তে বিদুঃ পরমেষ্ঠিনম্‌

—যাঁরা ভূমাকে জানেন মানুষে, তাঁরা জানেন পরম দেবতাকেই। সেই মানবদেবতাকে মানুষের মধ্যে জেনেছিলেন ব’লেই বুদ্ধদেব উপদেশ দিতে পেরেছিলেন—

মাতা যথা নিয়ং পুত্তং
আয়ুসা এক পুত্তমনুরক্‌খে,

এবম্পি সব্বভূতেসু
মানসম্ভাবয়ে অপরিমাণং।

মা যেমন আপন আয়ু ক্ষয় করেই নিজের একমাত্র পুত্রকে রক্ষা করে তেমনি সকল প্রাণীর প্রতি মনে অপরিমাণ দয়াভাব জন্মাবে।

 মাথা গণে’ বলব না ক’জন এই উপদেশ পালন করতে পারে। সেই গণনায় নয় সত্যের বিচার।

 মানুষের অসীমতা যিনি নিজের মধ্যে অনুভব করেছিলেন তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়নি মাথা গোণবার। তিনি অসঙ্কোচে মানুষের মহামানবকে আহ্বান করেছিলেন, বলেছিলেন অপরিমাণ ভালোবাসায় প্রকাশ করো আপনার অন্তরে ব্রহ্মকে। এই বাণী অসঙ্কোচে সকলকে শুনিয়ে তিনি মানুষকে শ্রদ্ধা করেছিলেন।

 আমাদের দেশে এমন আত্মাবমাননার কথা প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায় যে সোঽহংতত্ত্ব সকলের নয়, কেবল তাঁদেরই যাঁরা ক্ষণজন্মা। এই ব’লে মানুষের অধিকারকে শ্রেষ্ঠ ও নিকৃষ্টভেদে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ক’রে নিশ্চেষ্ট নিকৃষ্টতাকে আরাম দেওয়া হয়েচে। আমাদের দেশে যাদের অন্ত্যজ বলা হয় তারা যেমন নিজের হেয়তাকে নিশ্চল করে রাখতে কুণ্ঠিত হয় না, তেমনি এ দেশে অগণ্য মানুষ আপন কনিষ্ঠ অধিকার নিঃসঙ্কোচে মেনে নিয়ে মূঢ়তাকে, চিত্তের ও ব্যবহারের দীনতাকে, বিচিত্র আকারে প্রকাশ করতে বাধা পায় না। কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মেচি, ললাটের লিখনে নিয়ে এসেচি সোঽহম্‌, এই বাণীকে সার্থক করবার জন্যেই আমরা মানুষ। আমাদের একজনেরও অগৌরব সকল মানুষের গৌরব ক্ষুণ্ণ করবে। যে সেই আপন অধিকারকে খর্ব্ব করে সে নিজের মধ্যে তাঁর অসম্মান করে যিনি

কর্ম্মাধ্যক্ষঃ সর্ব্বভুতাধিবাসঃ সাক্ষী

—যিনি সকলের কর্ম্মের অধ্যক্ষ, সকলের যিনি অন্তরতম সাক্ষী, সকলের মধ্যে যাঁর বাস।

 পূর্ব্বেই দেখিয়েচি অথর্ব্ববেদ বলেচেন মানুষ প্রত্যক্ষত যা পরমার্থত তার চেয়ে বেশি, সে আছে অসীম উদ্বৃত্তের মধ্যে। সেই উদ্বৃত্তেই মানুষের যা-কিছু শ্রেষ্ঠ, তার

ঋতং সত্যং তপো রাষ্ট্রং শ্রমো ধর্ম্মশ্চ কর্ম্ম চ।

স্থূল দ্রব্যময়ী এই পৃথিবী। তাকে বহুদূর অতিক্রম করে গেছে তার বায়ুমণ্ডল। সেই অদৃশ্য বায়ুলোকের ভিতর দিয়ে আসচে তার আলো, তার বর্ণচ্ছটা, বইচে তার প্রাণ, এরই উপর জমচে তার মেঘ, ঝরচে তার বারিধারা, এইখানকার প্রেরণাতেই তার অঙ্গে অঙ্গে রূপধারণ করচে পরম রহস্যময় সৌন্দর্য্য, এইখান থেকেই আসচে পৃথিবীর যা শ্রেষ্ঠ, পৃথিবীর শ্রী, পৃথিবীর প্রাণ। এই বায়ুমণ্ডলেই পৃথিবীর সেই জানলা খোলা রয়েচে যেখানে নক্ষত্রলোক থেকে অন্ধকার পেরিয়ে প্রতিরাত্রে দূত আসচে আত্মীয়তার জ্যোতির্ম্ময় বার্ত্তা নিয়ে। এই তার প্রসারিত বায়ুমণ্ডলকেই বলা যেতে পারে পৃথিবীর উদ্বৃত্ত ভাগের আত্মা, যেমন পূর্ণ মানুষকে বলা হয়েচে, ত্রিপাদস্যামৃতম্‌ তাঁর এক অংশ প্রত্যক্ষ বাকি তিন অংশ অমৃতরূপে তাঁকে ছাড়িয়ে আছে ঊর্দ্ধে। এই সূক্ষ্মবায়ুলোক ভূলোকের একান্ত আপনারই ব’লে সম্ভব হয়েচে পৃথিবীর ধূলিস্তরে এত বিচিত্র ঐশ্বর্য্য বিস্তার যার মূল্য ধূলির মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি।

 উপনিষদ বলেন অসম্ভূতি ও সম্ভূতিকে এক ক’রে জানলেই তবে সত্য জানা হয়। অসম্ভূতি, যা অসীমে অব্যক্ত, সম্ভূতি যা দেশে কালে অভিব্যক্ত। এই সীমায় অসীমে মিলে মানুষের সত্য সম্পূর্ণ। মানুষের মধ্যে যিনি অসীম তাঁকে সীমার মধ্যে জীবনে সমাজে ব্যক্ত করে তুলতে হবে। অসীম সত্যকে বাস্তব সত্য করতে হবে। তা করতে গেলে কর্ম্ম চাই। ঈশোপনিষদ তাই বলেন শত বৎসর তোমাকে বাঁচতে হবে কর্ম্ম তোমার না করলে নয়। শত বৎসর বাঁচাকে সার্থক করো কর্ম্মে, এমনতরো কর্ম্মে যাতে প্রত্যয়ের সঙ্গে প্রমাণের সঙ্গে বলতে পারা যায় সোঽহম্‌। এ নয় যে, চোখ উলটিয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে মানুষের থেকে দূরে। অসীম উদ্বৃত্ত থেকে মানুষের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠতা সঞ্চারিত হচ্চে সে কেবল সত্যং ঋতং নয়, তার সঙ্গে আছে রাষ্ট্রং শ্রমো ধর্ম্মশ্চ কর্ম্ম চ ভূতং ভবিষ্যৎ। এই যে-কর্ম্ম এই যে-শ্রম যা জীবিকার জন্যে নয় এর নিরন্তর উদ্যম কোন্‌ সত্যে? কিসের জোরে মানুষ প্রাণকে করচে তুচ্ছ, দুঃখকে করচে বরণ, অন্যায়ের দুর্দ্দান্ত প্রতাপকে উপেক্ষা করচে বিনা উপকরণে, বুক পেতে নিচ্চে অবিচারের দুঃসহ মৃত্যুশেল। তার কারণ, মানুষের মধ্যে শুধু কেবল তার প্রাণ নেই, আছে তার মহিমা। সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষেরই মাথা তুলে বলবার অধিকার আছে সোঽহম্‌। সেই অধিকার জাতিবর্ণনির্ব্বিচারে সকল মানুষেরই। ক্ষিতিমোহনের অমূল্য সংগ্রহ থেকে বাউলের এই বাণী পাই—

জীবে জীবে চাইয়া দেখি সবই যে তার অবতার,
ও তুই নূতন লীলা কী দেখাবি যার নিত্য লীলা চমৎকার।

প্রতিদিনই মানবসমাজে এই লীলা। অসংখ্য মানুষ জ্ঞানে প্রেমে ত্যাগে নানা আকারেই অপরিমেয়কে প্রকাশ করচে। ইতিহাসে তাদের নাম ওঠে না, আপন প্রাণ থেকে মানুষের প্রাণপ্রবাহে তারা ঢেলে দিয়ে যায় তাঁরই অমিততেজ

যশ্চায়মস্মিন্‌ তেজোময়োঽমৃতময়ঃ পুরুষঃ সর্ব্বানুভুঃ

—যিনি এই আত্মার মধ্যেই তেজোময় অমৃতময় পুরুষ, যিনি সমস্তই অনুভব করেন, যেমন আকাশব্যাপী তেজকে উদ্ভিদ আপন প্রাণের সামগ্রী করে নিয়ে পৃথিবীর প্রাণলোকে উৎসর্গ করে।

 উদ্ভিদের ভিতর দিয়ে বিশ্বতেজ যদি প্রাণবস্তুতে নিয়ত পরিণত না হোতে পারত তাহলে জীবলোক যেমন মরুশয্যাশায়ী হোত তেমনি আমাদের গোচরে অগোচরে দেশে দেশে কালে কালে নরনারী নিজের অন্তরস্থিত পরম পুরুষের অমিততেজ যদি কল্যাণে ও প্রেমে জ্ঞানে ও কর্ম্মে নিরন্তর সমাজের প্রাণবস্তুতে পরিণত না করত তাহলে সমাজ সোঽহংতত্ত্ববর্জ্জিত হয়ে পশুলোকের সাথে এক হয়ে যেত। তাও নয়, আপন সত্য হোতে স্খলিত হয়ে বাঁচতেই পারত না। ডাক্তার বলেন, মানুষের দেহে পশুরক্ত সঞ্চার করলে তাতে তার প্রাণবৃদ্ধি না হয়ে প্রাণনাশ হয়। পশুসমাজ পশুভাবেই চিরদিন বাঁচতে পারে মানুষের সমাজ পশু হয়ে বাঁচতেই পারে না। তার্কিক বলবে নরলোকে তো অনেক পশু আরামেই বেড়ে ওঠে। শরীরে ফোড়াও তো বাড়ে। আশপাশের চেয়ে তার উন্নতি বেশি বই কম নয়। সমস্ত দেহে স্বাস্থ্যের গৌরব সেই ফোড়াকে যদি ছাড়িয়ে না যায় তাহলে সে মারে এবং মেরে মরে। প্রকৃতিস্থ সমাজ অনেক পাপ সইতে পারে কিন্তু যখন তার বিকৃতিটাই হয়ে ওঠে প্রধান, তখন চিন্তায় ব্যবহারে সাহিত্যে শিল্পকলায় পশুরক্তস্রোত আত্মস্থ করে সমাজ বেশি দিন বাঁচতেই পারে না। বিলাসোন্মত্ত রোম কি আপন ঐশ্বর্য্যের মধ্যেই পাকা ফলে কীটের মতো মরেনি? কালিদাস রঘুবংশের যে পতনের ছবি দিয়েচেন সে কি মানুষের জীবনে পশু প্রবেশের ফলেই না।

 অথর্ব্ববেদে শুধু কেবল সত্য ও ঋতের কথা নেই আছে রাষ্ট্রের কথাও। জনসংঘের শ্রেষ্ঠরূপ প্রকাশ করবার জন্যে তার রাষ্ট্র। ছোটো টবের বাইরে বনস্পতি যদি তার হাজার শিকড় মেলতে না পারে তাহলে সে বেঁটে হয়ে কাঠি হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের প্রশস্ত ভূমি না পেলে জনসমূহ পৌরুষবর্জ্জিত হয়ে থাকে। আপনার মধ্যে যে-ভূমাকে প্রমাণ করবার দায়িত্ব মানুষের, সমস্ত জাতি বৃহৎ জীবনযাত্রায় তার থেকে বঞ্চিত হোলে ইতিহাসে ধিক্কৃত হয়। সকলের মাঝখানে সকল কালের সম্মুখে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলতে পারে না সোঽহম্‌, বলতে পারে না আমি আছি আমার মহিমায়, যে-আমি কেবল আজকের দিনের জন্যে নয়, যার আত্মঘোষণা ভাবী কালের তোরণে তোরণে ধ্বনিত হোতে থাকবে। ইতিহাসের সেই ধিক্কার বহুকালের সুপ্তিমগ্ন এসিয়া মহাদেশের বক্ষে দিয়েচে আজ আঘাত; সকল দিকেই শুনচি জনগণের অন্তর্যামী মহান পুরুষ তামসিকতার বন্দীশালায় শৃঙ্খলে দিয়েচেন ঝঙ্কার, তাঁর প্রকাশের তপোদীপ্তি জ্বলে উঠেচে তমসঃ পরস্তাৎ। রব উঠেচে, শৃণ্বন্ত বিশ্বে শোনো বিশ্বজন তাঁর আহ্বান শোনো, যে-আহ্বানে ভয় যায় ছুটে, স্বার্থ হয় লজ্জিত, মৃত্যুঞ্জয় শৃঙ্গধ্বনি ক’রে ওঠেন মৃত্যুদুঃখবন্ধুর অমৃতের পথে।

 ভূমা থেকে উৎশিষ্ট যে-শ্রেষ্ঠতার কথা অথর্ব্ববেদ বলেচেন সে কোনো একটিমাত্র বিশেষ সিদ্ধিতে নয়। মানুষের সকল তপস্যাই তার মধ্যে, মানুষের বীর্য্যং লক্ষ্মীর্বলং সমস্ত তার অন্তর্গত। মনুষ্যত্বের বহুধা বৈচিত্র্যকে একটিমাত্র বিন্দুতে সংহত ক’রে নিশ্চল করলে হয় তো তার আত্মভোলা একটা আনন্দ আছে। কিন্তু ততঃ কিম, কী হবে সে আনন্দে। সে আনন্দকে বলব না শ্রেয়, বলব না চরম সত্য। সমস্ত মানব-সংসারে যতক্ষণ দুঃখ আছে অভাব আছে অপমান আছে ততক্ষণ কোনো একটিমাত্র মানুষ নিষ্কৃতি পেতে পারে না। একটিমাত্র প্রদীপ অন্ধকারে একটুমাত্র ছিদ্র করলে তাতে রাত্রির ক্ষয় হয় না, সমস্ত অন্ধকারের অপসারণে রাত্রির অবসান। সেই জন্যে মানুষের মুক্তি যে-মহাপুরুষেরা কামনা করেচেন তাঁদেরই বাণী

সম্ভবামি যুগে যুগে।

যুগে যুগেই তো জন্মাচ্চেন তাঁরা দেশে দেশে। আজও এই মুহূর্ত্তেই জন্মেচেন কালও জন্মাবেন। সেই জন্মের ধারা চলেচে ইতিহাসের মধ্য দিয়ে, এই বাণী বহন ক’রে, সোঽহম্‌, I and my Father are one.

 সোঽহম্‌ মন্ত্র মুখে আউড়িয়ে তুমি দুরাশা করো কর্ম্ম থেকে ছুটি নিতে। সমস্ত পৃথিবী রইল পড়ে, তুমি একা যাবে দায় এড়িয়ে। যে ভীরু চোখ বুজে মনে করে পালিয়েচি সে কি সত্যই পালিয়েচে। সোঽহম্‌ সমস্ত মানুষের সম্মিলিত অভিব্যক্তির মন্ত্র, কেবল এক জনের না। ব্যক্তিগত শক্তিতে নিজে কেউ যতটুকু মুক্ত হচ্চে সেই মুক্তি তার নিরর্থক, যতক্ষণ সে তা সকলকে না দিতে পারে। বুদ্ধদেব আপনার মুক্তিতেই সত্যই যদি মুক্ত হতেন তাহলে একজন মানুষের জন্যেও তিনি কিছুই করতেন না। দীর্ঘজীবন ধরে তাঁর তো কর্ম্মের অন্ত ছিল না। দৈহিক প্রাণ নিয়ে তিনি যদি আজ পর্য্যন্ত বেঁচে থাকতেন তাহলে আজ পর্য্যন্তই তাঁকে কাজ করতে হোত আমাদের সকলের চেয়ে বেশি। কেননা যাঁরা মহাত্মা তাঁরা বিশ্বকর্ম্মা।

 নীহারিকার মহাক্ষেত্রে যেখানে জ্যোতিষ্ক সৃষ্টি হচ্চে সেখানে মাঝে মাঝে এক একটি তারা দেখা যায়; তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সমস্ত নীহারিকার বিরাট অন্তরে সৃষ্টি-হোমহুতাশনের উদ্দীপনা। তেমনি মানুষের ইতিহাসের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে মহাপুরুষদের দেখি। তাঁদের থেকে এই কথাই বুঝি যে সমস্ত মানুষের অন্তরেই কাজ করচে অভিব্যক্তির প্রেরণা। সে ভূমার অভিব্যক্তি। জীবমানব কেবলি তার অহং আবরণ মোচন করে আপনাকে উপলব্ধি করতে চাচ্চে বিশ্বমানবে। বস্তুত সমস্ত পৃথিবীরই অভিব্যক্তি আপন সত্যকে খুঁজচে সেইখানে, এই বিশ্বপৃথিবীর চরম সত্য সেই মহামানবে। পৃথিবীর আরম্ভ কালের লক্ষ লক্ষ যুগের পরে মানুষের সূচনা। সেই সাংখ্যিক তথ্য মনে নিয়ে কালের ও আয়তনের পরিমাণে মানুষের ক্ষুদ্রতা বিচার করে কোনো কোনো পণ্ডিত অভিভূত হয়ে পড়েন। পরিমাণকে অপরিমেয় সত্যের চেয়ে বড়ো করা একটা মোহ মাত্র। যাকে আমরা জড় বলি সেই অব্যক্ত প্রাণ বহু কোটি কোটি বৎসর সুপ্ত ছিল। কিন্তু একটিমাত্র প্রাণকণা যে-দিন এই পৃথিবীতে দেখা দিল সেই দিনই জগতের অভিব্যক্তি তার একটি মহৎ অর্থে এসে পৌঁছল। জড়ের বাহ্যিক সত্তার মধ্যে দেখা দিল একটি আন্তরিক সত্য। প্রাণ আন্তরিক। যেহেতু সেই প্রাণকণা জড়পুঞ্জের তুলনায় দৃশ্যত অতি ক্ষুদ্র এবং যেহেতু সুদীর্ঘকালের একপ্রান্তে তার সদ্য জন্ম তাই তাকে হেয় করবে কে? মুকতার মধ্যে এই যে অর্থ অবারিত হোলো তার থেকে মানুষ বিরাট প্রাণের রূপ দেখলে বললে,

যদিদং কিঞ্চ সর্ব্বং প্রাণ এজতি নিঃসৃতম্‌।

যা-কিছু সমস্তই প্রাণ থেকে নিঃসৃত হয়ে প্রাণে কম্পিত হচ্চে। আমরা জড়কে তথ্যরূপে জানি কেননা সে যে বাইরের। কিন্তু প্রাণকে আমাদের অন্তর থেকে জানি সত্যরূপে। প্রাণের ক্রিয়া অন্তরে অন্তরে—তার সমস্তটাই গতি। তাই চলার একটি মাত্র ভাষা আমাদের কাছে অব্যবহিত, সে আমাদের প্রাণের ভাষা। চলা ব্যাপারকে অন্তর থেকে সত্য করে চিনেচি নিজেরই মধ্যে। বিশ্বে অবিশ্রাম চলার যে উদ্যম তাকে উত্তাপই বলি বিদ্যুৎই বলি সে কেবল একটা কথা মাত্র। যদি বলি এই চলার মধ্যে আছে প্রাণ তাহলে এমন কিছু বলা হয় আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে যার অর্থ আছে। সেই সঙ্গে এও বুঝি আমার প্রাণ যে চলচে সেও ঐ বিশ্বপ্রাণের চলার মধ্যেই। প্রাণগতির এই উদ্যম নিখিলে কোথাও নেই কেবল আকস্মিকভাবে আছে প্রাণীতে, এমন খাপছাড়া কথা আমাদের মন মানতে চায় না যে-মন সমগ্রতার ভূমিকায় সত্যকে শ্রদ্ধা জানায়।

 উপনিষদ বলেচেন,

কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ যদেষ আকাশ আনন্দোন স্যাৎ।

একটা কীটও প্রাণের ইচ্ছা করত কিসের জোরে যদি প্রাণের আনন্দ সমস্ত আকাশে না থাকত। দেশলাইয়ের মুখে একটি শিখা এক মুহূর্ত্তের জন্যেও জ্বলে কী করে যদি সমস্ত আকাশে তার সত্য ব্যাপ্ত না থাকে। প্রাণের মধ্যে সমস্ত সৃষ্টির একটি অন্তরতর অর্থ পাওয়া গেল—সেই অর্থকে বলি ইচ্ছা। জড় মূক হয়ে ছিল, এই ইচ্ছার ভাষা জানাতে পারেনি,—প্রাণ এসে ইচ্ছার বার্ত্তা প্রকাশ করলে। যে-বার্ত্তা গভীরে নিহিত ছিল তাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।

 ছাত্র বহু দিন বহু প্রয়াসে অক্ষর শিখল, বানান শিখল, ব্যাকরণ শিখল, অনেক কাগজে অনেক আঁকা বাঁকা অসম্পূর্ণ নিরর্থক লেখা শিখল, উপকরণ ব্যবহার করল ও বর্জ্জন করল বিস্তর; অবশেষে কবিরূপে যে-মুহূর্ত্তে সে তার প্রথম কবিতাটি লিখতে পেরেচে সেই মুহূর্ত্তে ঐ একটি লেখায় এতদিনকার পুঞ্জ পুঞ্জ বাক্যহীন উপকরণের প্রথম অর্থটুকু দেখা দিল। জগতের বিপুল অভিব্যক্তিতে প্রথম অর্থ দেখলুম প্রাণকণায় তার পরে জন্তুতে, তারপরে মানুষে। বাহির থেকে অন্তরের দিকে একে একে মুক্তির দ্বার খুলে যেতে লাগল। মানুষে এসে যখন ঠেকল তখন যবনিকা উঠতেই জীবকে দেখলুম তার ভূমায়। দেখলুম রহস্যময় যোগের তত্ত্বকে পরম ঐক্যকে। মানুষ বলতে পারলে যাঁরা সত্যকে জানেন তারা

সর্ব্বমেবাবিশন্তি

সকলের মধ্যেই প্রবেশ করেন।

 আলোকেরই মতো মানুষের চৈতন্য মহাবিকিরণের দিকে চলেচে, জ্ঞানে কর্ম্মে ভাবে। সেই প্রসারণের দিকে দেখি তার মহৎকে, দেখি মহামানবকে, দেখি

যশ্চায়মস্মিন্‌ আত্মনি তেজোময়োঽমৃতময়ঃ পুরুষঃ সর্ব্বানুভূঃ,

এবং শুভকামনায় হৃদয়কে সর্ব্বত্র এই ব’লে ব্যাপ্ত করতে পারি:—

সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু, অবেরা হোন্তু, অব্যাপজ্‌ঝা হোন্তু, সুখী অত্তানং পরিহরন্তু। সব্বে সত্তা দুক্‌খা পমুঞ্চন্তু। সব্বে সত্তা মা যথালব্ধসম্পত্তিতো বিগচ্ছন্তু।

 সকল জীব সুখিত হোক, নিঃশত্রু হোক, অবধ্য হোক, সুখী হয়ে কাল হরণ করুক। সকল জীব দুঃখ হতে প্রমুক্ত হোক, সকল জীব যথালব্ধ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হোক।

 সেই সঙ্গে এও বলতে পারি দুঃখ আসে তো আসুক, মৃত্যু হয় তো হোক, ক্ষতি ঘটে তো ঘটুক মানুষ আপন মহিমা থেকে বঞ্চিত না হোক, সমস্ত দেশকালকে ধ্বনিত করে বলতে পারুক

সোঽহম্‌।