মানুষের ধর্ম্ম/পরিশিষ্ট

উইকিসংকলন থেকে

পরিশিষ্ট

মানব সত্য

 আমাদের জন্মভূমি তিনটি, তিনটিই একত্র জড়িত। প্রথম—পৃথিবী। মানুষের বাসস্থান পৃথিবীর সর্ব্বত্র। শীত-প্রধান তুষারাদ্রি, উত্তপ্ত বালুকাময় মরু, উত্তঙ্গ দুর্গম গিরিশ্রেণী আর এই বাংলার মতো সমতল ভূমি, সর্ব্বত্রই মানুষের স্থিতি। মানুষের বস্তুত বাসস্থান এক। ভিন্ন ভিন্ন জাতির নয়, সমগ্র মানুষ জাতির। মানুষের কাছে পৃথিবীর কোনো অংশ দুর্গম নয়। পৃথিবী তার কাছে হৃদয় অবারিত ক’রে দিয়েচে।

 মানুষের দ্বিতীয় বাসস্থান স্মৃতিলোক। অতীত কাল থেকে পূর্ব্বপুরুষদের কাহিনী নিয়ে কালের নীড় সে তৈরি করেচে। এই কালের নীড় স্মৃতির দ্বারা রচিত গ্রথিত। এ শুধু এক-একটা বিশেষ জাতির কথা নয়, সমস্ত মানুষ জাতির কথা। স্মৃতিলোকে সকল মানুষের মিলন। বিশ্বমানবের বাসস্থান—একদিকে পৃথিবী আর একদিকে সমস্ত মানুষের স্মৃতিলোক। মানুষ জন্মগ্রহণ করে সমস্ত পৃথিবীতে, জন্মগ্রহণ করে নিখিল ইতিহাসে।

 তার তৃতীয় বাসস্থান আত্মিকলোক। সেটাকে বলা যেতে পারে সর্ব্বমানবচিত্তের মহাদেশ। অন্তরে অন্তরে সকল মানুষের যোগের ক্ষেত্র এই চিত্তলোক। কারো চিত্ত হয়ত-বা সঙ্কীর্ণ বেড়া দিয়ে ঘেরা, কারো-বা বিকৃতির দ্বারা বিপরীত। কিন্তু একটি ব্যাপক চিত্ত আছে যা ব্যক্তিগত নয় বিশ্বগত। সেটির পরিচয় অকস্মাৎ পাই। একদিন আহ্বান আসে। অকস্মাৎ মানুষ সত্যের জন্যে প্রাণ দিতে উৎসুক হয়। সাধারণ লোকের মধ্যেও দেখা যায়, যখন সে স্বার্থ ভোলে, যেখানে সে ভালবাসে, নিজের ক্ষতি ক’রে ফেলে। তখন বুঝি—মনের মধ্যে একটা দিক আছে যেটা সর্ব্বমানবের চিত্তের দিকে।

 বিশেষ প্রয়োজনে ঘরের সীমায় খণ্ডাকাশ বদ্ধ কিন্তু মহাকাশের সঙ্গে তার সত্যকার যোগ। ব্যক্তিগত মন আপন বিশেষ প্রয়োজনের সীমায় সঙ্কীর্ণ হলেও তার সত্যকার বিস্তার সর্ব্বমানবচিত্তে। সেইখানকার প্রকাশ আশ্চর্য্যজনক। একজন কেউ জলে পড়ে গেছে আর একজন জলে ঝাঁপ দিলে তাকে বাঁচাবার জন্যে। অন্যের প্রাণরক্ষার জন্যে নিজের প্রাণ সঙ্কটাপন্ন করা। নিজের সত্তাই যার একান্ত সে বলবে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। কিন্তু আপনি বাঁচাকে সব চেয়ে বড় বাঁচা বললে না, এমনও দেখা গেল। তার কারণ সর্ব্বমানবসত্তা পরস্পর যোগযুক্ত।

 আমার জন্ম যে-পরিবারে সে-পরিবারের ধর্ম্মসাধন একটি বিশেষভাবের। উপনিষদ এবং পিতৃদেবের অভিজ্ঞতা, রামমোহন এবং আর আর সাধকদের সাধনাই আমাদের পারিবারিক সাধনা। আমি পিতার কনিষ্ঠ পুত্র। জাতকর্ম্ম থেকে আরম্ভ ক’রে আমার সব সংস্কারই বৈদিক মন্ত্র দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, অবশ্য ব্রাহ্মমতের সঙ্গে মিলিয়ে। আমি ইস্কুল-পালানো ছেলে। যেখানেই গণ্ডী দেওয়া হয়েচে সেখানেই আমি বনিবনাও করতে পারিনি কখনও। যে-অভ্যাস বাইরে থেকে চাপানো তা আমি গ্রহণ করতে অক্ষম। কিন্তু পিতৃদেব সে জন্যে কখনও ভর্ৎসনা করতেন না। তিনি নিজেই স্বাধীনতা অবলম্বন ক’রে পৈতামহিক সংস্কার ত্যাগ করেছিলেন। গভীরতর জীবনতত্ত্ব সম্বন্ধে চিন্তা করার স্বাধীনতা আমারও ছিল। এ কথা স্বীকার করতেই হবে আমার এই স্বাতন্ত্র্যের জন্যে কখনও কখনও তিনি বেদনা পেয়েচেন। কিছু বলেননি।

 বাল্যে উপনিষদের অনেক অংশ বার-বার আবৃত্তি দ্বারা আমার কণ্ঠস্থ ছিল। সব-কিছু গ্রহণ করতে পারিনি সকল মন দিয়ে। শ্রদ্ধা ছিল, শক্তি ছিল না হয়ত। এমন সময় উপনয়ন হ’ল। উপনয়নের সময় গায়ত্রী মন্ত্র দেওয়া হয়েছিল। কেবলমাত্র মুখস্থভাবে না। বারংবার সুস্পষ্ট উচ্চারণ ক’রে আবৃত্তি করেচি এবং পিতার কাছে গায়ত্রী মন্ত্রের ধ্যানের অর্থ পেয়েচি। তখন আমার বয়স বারো বৎসর হবে। এই মন্ত্র চিন্তা করতে করতে মনে হ’ত বিশ্বভুবনের অস্তিত্ব আর আমার অস্তিত্ব একাত্মক। ভূ ভূর্বঃ স্বঃ—এই ভূলোক অন্তরীক্ষ, আমি তারি সঙ্গে অখণ্ড। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি অন্তে যিনি আছেন তিনিই আমাদের মনে চৈতন্য প্রেরণ করচেন। চৈতন্য ও বিশ্ব; বাহিরে ও অন্তরে সৃষ্টির এই দুই ধারা এক ধারায় মিলচে।

 এমনি ক’রে ধ্যানের দ্বারা যাকে উপলব্ধি করচি, তিনি বিশ্বাত্মাতে আমার আত্মাতে চৈতন্যের যোগে যুক্ত। এই রকম চিন্তার আনন্দে আমার মনের মধ্যে একটা জ্যোতি এনে দিলে। এ আমার সুস্পষ্ট মনে আছে।

 যখন বয়স হয়েচে, হয়ত আঠারো কি ঊনিশ হবে বা বিশও হ’তে পারে, তখন চৌরঙ্গীতে ছিলুম দাদার সঙ্গে। এমন দাদা কেউ কখনও পায়নি। তিনি ছিলেন একাধারে বন্ধু ভাই সহযোগী।

 তখন প্রত্যূষে ওঠা প্রথা ছিল। আমার পিতাও খুব প্রত্যূষে উঠতেন। মনে আছে একবার ডালহৌসি পাহাড়ে পিতার সঙ্গে ছিলুম। সেখানে প্রচণ্ড শীত। সেই শীতে ভোরে আলো-হাতে এসে আমাকে শয্যা থেকে উঠিয়ে দিতেন। সেই ভোরে উঠে একদিন চৌরঙ্গীর বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলুম। তখন ওখানে ফ্রি ইস্কুল ব’লে একটা ইস্কুল ছিল। রাস্তাটা পেরিয়েই ইস্কুলের হাতাটা দেখা যেত। সেদিকে চেয়ে দেখলুম গাছের আড়ালে সূর্য্য উঠচে। যেমনি সূর্য্যের আবির্ভাব হ’ল গাছের অন্তরালের থেকে, অমনি মনের পর্দ্দা খুলে গেল। মনে হ’ল মানুষ আজন্ম একটা আবরণ নিয়ে থাকে। সেটাতেই তার স্বাতন্ত্র্য। স্বাতন্ত্র্যের বেড়া লুপ্ত হ’লে সাংসারিক প্রয়োজনের অনেক অসুবিধা। কিন্তু সেদিন সূর্য্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার আবরণ খ’সে পড়ল। মনে হ’ল সত্যকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখলুম। মানুষের অন্তরাত্মাকে দেখলুম। দু-জন মুটে কাঁধে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে চলেচে। তাদের দেখে মনে হ’ল কী অনির্ব্বচনীয় সুন্দর। মনে হ’ল না তারা মুটে। সেদিন তাদের অন্তরাত্মাকে দেখলুম, যেখানে আছে চিরকালের মানুষ।

 সুন্দর কাকে বলি? বাইরে যা অকিঞ্চিৎকর, যখন দেখি তার আন্তরিক অর্থ তখন দেখি সুন্দরকে। একটি গোলাপ ফুল বাছুরের কাছে সুন্দর নয়। মানুষের কাছে সে সুন্দর যে-মানুষ তার কেবল পাপড়ি না বোঁটা না, একটা সমগ্র আন্তরিক সার্থকতা পেয়েচে। পাবনার গ্রামবাসী কবি যখন প্রতিকূল প্রণয়িনীর মানভঞ্জনের জন্যে ‘ট্যাহা দামের মোটরি’ আনার প্রস্তাব করেন তখন মোটরির দাম এক টাকার চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। এই মোটরি বা গোলাপের আন্তরিক অর্থটি যখন দেখতে পাই তখনই সে সুন্দর। সেদিন তাই আশ্চর্য্য হ’য়ে গেলুম। দেখলুম সমস্ত সৃষ্টি অপরূপ। আমার এক বন্ধু ছিল সে সুবুদ্ধির জন্যে বিশেষ বিখ্যাত ছিল না। তার সুবুদ্ধির একটু পরিচয় দিই। একদিন সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আচ্ছা, ঈশ্বরকে দেখেচ?’ আমি বললুম, ‘না, দেখিনি তো।’ সে বললে, ‘আমি দেখেচি।’ জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কী রকম?’ সে উত্তর করলে, ‘কেন? এই যে চোখের কাছে বিজ্‌-বিজ্‌ করচে।’ সে এলে ভাবতুম, বিরক্ত করতে এসেচে। সেদিন তাকেও ভালো লাগল। তাকে নিজেই ডাকলুম। সে দিন মনে হ’ল তার নির্ব্বুদ্ধিতাটা আকস্মিক, সেটা তার চরম ও চিরন্তন সত্য নয়। তাকে ডেকে সেদিন আনন্দ পেলুম। সেদিন সে ‘অমুক’ নয়। আমি যার অন্তর্গত সেও সেই মানবলোকের অন্তর্গত। তখন মনে হ’ল এই মুক্তি। এই অবস্থায় চার দিন ছিলুম। চার দিন জগৎকে সত্যভাবে দেখেচি। তারপর জ্যোতিদা বললেন, ‘দার্জিলিঙ চলো।’ সেখানে গিয়ে আবার পর্দ্দা পড়ে গেল। আবার সেই অকিঞ্চিৎকরতা, সেই প্রাত্যহিকতা। কিন্তু তার পূর্ব্বে কয়দিন সকলের মাঝে যাঁকে দেখা গেল তাঁর সম্বন্ধে আজ পর্য্যন্ত আর সংশয় রইল না। তিনি সেই অখণ্ড মানুষ যিনি মানুষের ভূত-ভবিষ্যতের মধ্যে পরিব্যাপ্ত, যিনি অরূপ, কিন্তু সকল মানুষের রূপের মধ্যে যাঁর অন্তরতম আবির্ভাব।

 সেই সময়ে এই আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা যাকে আধ্যাত্মিক নাম দেওয়া যেতে পারে। ঠিক সেই সময়ে বা তার অব্যবহিত পরে যে-ভাবে আমাকে আবিষ্ট করেছিল, তার স্পষ্ট ছবি দেখা যায় আমার সেই সময়কার কবিতাতে—“প্রভাতসঙ্গীতে”র মধ্যে। তখন স্বতঃই যে-ভাব আপনাকে প্রকাশ করেচে, তাই ধরা পড়েচে প্রভাতসঙ্গীতে। পরবর্ত্তী কালে চিন্তা ক’রে লিখলে তার উপর ততটা নির্ভর করা যেত না। গোড়াতেই ব’লে রাখা ভালে, “প্রভাতসঙ্গীত” থেকে যে কবিতা শোনাবো তা কেবল তখনকার ছবিকে স্পষ্ট দেখাবার জন্যে, কাব্যহিসাবে তার মূল্য অত্যন্ত সামান্য। আমার কাছে এর একমাত্র মূল্য এই যে, তখনকার কালে আমার মনে যে-একটা আনন্দের উচ্ছ্বাস এসেছিল তা এতে ব্যক্ত হয়েচে। তার ভাব অসংলগ্ন, ভাষা কাঁচা, যেন হাৎড়ে হাৎড়ে বলবার চেষ্টা। কিন্তু ‘চেষ্টা’ বললেও ঠিক হবে না, বস্তুত চেষ্টা নেই তাতে, অস্ফুটবাক মন বিনা চেষ্টায় যেমন ক’রে পারে ভাবকে ব্যক্ত করেচে, সাহিত্যের আদর্শ থেকে বিচার করলে স্থান পাওয়ার যোগ্য সে মোটেই নয়।

 যে কবিতাগুলো পড়ব তা একটু কুণ্ঠিতভাবেই শোনাবো, উৎসাহের সঙ্গে নয়। প্রথম দিনেই যা লিখেচি, সেই কবিতাটাই আগে পড়ি। অবশ্য ঠিক প্রথম দিনেরই লেখা কি-না, আমার পক্ষে জোর ক’রে বলা শক্ত। রচনার কাল সম্বন্ধে আমার উপর নির্ভর করা চলে না; আমার কাব্যের ঐতিহাসিক যাঁরা, তাঁরা সে কথা ভালো জানেন। হৃদয় যখন উদ্বেল হ’য়ে উঠেছিল আশ্চর্য্য ভাবোচ্ছ্বাসে, এ হচ্চে তখনকার লেখা। এ’কে এখনকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। আমি বলেচি আমাদের এক দিক ‘অহং’ আর একটা দিক ‘আত্মা’। ‘অহং’ যেন খণ্ডাকাশ, ঘরের মধ্যকার আকাশ, যা নিয়ে বিষয়কর্ম্ম মামলামকদ্দমা, এই সব। সেই আকাশের সঙ্গে যুক্ত মহাকাশ, তা নিয়ে বৈষয়িকতা নেই; সেই আকাশ অসীম, বিশ্বব্যাপী। বিশ্বব্যাপী আকাশে ও খণ্ডাকাশে যে-ভেদ, অহং আর আত্মার মধ্যেও সেই ভেদ। মানবত্ব বলতে যে-বিরাট পুরুষ, তিনি আমার খণ্ডাকাশের মধ্যেও আছেন। আমারই মধ্যে দুটো দিক আছে—এক আমাতেই বদ্ধ, আর এক সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত। এই দুই-ই যুক্ত এবং এই উভয়কে মিলিয়েই আমার পরিপূর্ণ সত্তা। তাই বলেচি, যখন আমরা অহংকে একান্তভাবে আঁকড়ে ধরি, তখন আমরা মানবধর্ম্ম থেকে বিচ্যুত হ’য়ে পড়ি। সেই মহামানব, সেই বিরাটপুরুষ যিনি আমার মধ্যে রয়েচেন, তাঁর সঙ্গে তখন ঘটে বিচ্ছেদ।

“জাগিয়া দেখিনু আমি আঁধারে র’য়েছি আঁধা,
আপনারি মাঝে আমি আপনি র’য়েছি বাঁধা।
র’য়েছি মগন হ’য়ে আপনারি কলস্বরে,
ফিরে আসে প্রতিধ্বনি নিজেরি শ্রবণ পরে!”

এইটেই হচ্চে অহং, আপনাতে আবদ্ধ, অসীম থেকে বিচ্যুত হ’য়ে অন্ধ হ’য়ে থাকে অন্ধকারের মধ্যে। তারই মধ্যে ছিলুম, এটা অনুভব করলুম। সে যেন একটা স্বপ্নদশা।

“গভীর—গভীর গুহা, গভীর আঁধার ঘোর,
গভীর ঘুমন্ত প্রাণ একেলা গাহিছে গান,
মিশিছে স্বপন-গীতি বিজন হৃদয়ে মোর।”

নিদ্রার মধ্যে স্বপ্নের যে লীলা, সত্যের যোগ নেই তার সঙ্গে। অমূলক, মিথ্যা নানা নাম দিই তাকে। অহং-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ যে জীবন, সেটা মিথ্যা। নানা অতিকৃতি দুঃখ ক্ষতি সব জড়িয়ে আছে তাতে। অহং যখন জেগে উঠে আত্মাকে উপলব্ধি করে তখন সে নূতন জীবন লাভ করে। এক সময়ে সেই অহং-এর খেলাঘরের মধ্যে বন্দী ছিলুম। এমনি ক’রে নিজের কাছে নিজের প্রাণ নিয়েই ছিলুম, বৃহৎ সত্যের রূপ দেখিনি।

“আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাত পাখীর গান!
না জানি কেন রে এতদিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ!
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখতে নারি।”

এটা হচ্চে সেদিনকার কথা, যেদিন অন্ধকার থেকে আলো এল বাইরের, অসীমের। সেদিন চেতনা নিজেকে ছাড়িয়ে ভূমার মধ্যে প্রবেশ করল। সেদিন কারার দ্বার খুলে বেরিয়ে পড়বার জন্যে, জীবনের সকল বিচিত্র লীলার সঙ্গে যোগযুক্ত হ’য়ে প্রবাহিত হবার জন্যে অন্তরের মধ্যে তীব্র ব্যাকুলতা। সেই প্রবাহের গতি মহান বিরাট সমুদ্রের দিকে। তাকেই এখন বলেচি বিরাটপুরুষ। সেই যে মহামানব, তারই মধ্যে গিয়ে নদী মিলবে, কিন্তু সকলের মধ্যে দিয়ে। এই যে-ডাক পড়ল, সূর্য্যের আলোতে জেগে মন ব্যাকুল হ’য়ে উঠল, এ আহ্বান কোথা থেকে? এর আকর্ষণ মহাসমুদ্রের দিকে, সমস্ত মানবের ভিতর দিয়ে, সংসারের ভিতর দিয়ে, ভোগ ত্যাগ কিছুই অস্বীকার ক’রে নয়, সমস্ত স্পর্শ নিয়ে শেষে পড়ে এক জায়গায় যেখানে—

“কি জানি কি হ’ল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ,
দূর হ’তে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
সেই সাগরের পানে হৃদয় ছুটিতে চায়,
তারি পদপ্রান্তে গিয়ে জীবন টুটিতে চায়।”

 সেখানে যাওয়ার একটা ব্যাকুলতা অন্তরে জেগেছিল। ‘মানবধর্ম্ম’ সম্বন্ধে যে বক্তৃতা করেচি, সংক্ষেপে এই তার ভূমিকা। এই মহাসমুদ্রকে এখন নাম দিয়েচি মহামানব। সমস্ত মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ বর্ত্তমান নিয়ে তিনি সর্ব্বজনের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সঙ্গে গিয়ে মেলবারই এই ডাক।

 এর দু-চার দিন পরেই লিখেচি ‘প্রভাত উৎসব’। একই কথা, আর একটু স্পষ্ট ক’রে লেখা—

“হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি’!
জগত আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।
ধরায় আছে যত মানুষ শত শত,
আসিছে প্রাণে মোর হাসিছে গলাগলি।”

এই তো সমস্তই মানুষের হৃদয়ের তরঙ্গলীলা। মানুষের মধ্যে স্নেহ প্রেম ভক্তির যে সম্বন্ধ সেটা তো আছেই। তাকে বিশেষ ক’রে দেখা, বড় ভূমিকার মধ্যে দেখা, যার মধ্যে সে তার একটা ঐক্য, একটা তাৎপর্য্য লাভ করে। সেদিন যে-দু-জন মুটের কথা বলেচি, তাদের মধ্যে যে আনন্দ দেখলুম, সে সখ্যের আনন্দ, অর্থাৎ এমন-কিছু যার উৎস সর্ব্বজনীন সর্ব্বকালীন চিত্তের গভীরে। সেইটে দেখেই খুসি হয়েছিলুম। আরো খুসি হয়েছিলুম এই জন্যে যে, যাদের মধ্যে ঐ আনন্দটা দেখলুম, তাদের বরাবর চোখে পড়ে না, তাদের অকিঞ্চিৎকর ব’লেই দেখে এসেচি। যে-মুহূর্ত্তে তাদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রকাশ দেখলুম, অমনি পরম সৌন্দর্য্যকে অনুভব করলুম। মানব সম্বন্ধের যে বিচিত্র রসলীলা, আনন্দ, অনির্ব্বচনীয়তা, তা দেখলুম সেইদিন। সে দেখা বালকের কাঁচা লেখায় আকুবাঁকু ক’রে নিজেকে প্রকাশ করেচে কোনো রকমে, পরিস্ফুট হয়নি। সে সময়ে আভাসে যা অনুভব করেচি, তাই লিখেচি। আমি যে যা-খুসি গেয়েচি, তা নয়। এ গান দু-দণ্ডের নয়, এর অবসান নেই। এর একটা ধারাবাহিকতা আছে, এর অনুবৃত্তি আছে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে। আমার গানের সঙ্গে সকল মানুষের যোগ আছে। গান থামলেও সে যোগ ছিন্ন হয় না।

“কাল গান ফুরাইবে, তা ব’লে গাবে না কেন,
আজ যবে হয়েচে প্রভাত।”

“কিসের হরষ-কোলাহল,
শুধাই তোদের, তোরা বল!
আনন্দ-মাঝারে সব উঠিতেছে ভেসে ভেসে,
আনন্দে হ’তেছে কভু লীন,
চাহিয়া ধরণী পানে নব আনন্দের গানে
মনে পড়ে আর একদিন।”

 এই যে বিরাট আনন্দের মধ্যে সব তরঙ্গিত হচ্চে, তা দেখিনি বহুদিন, সেদিন দেখলুম। মানুষের বিচিত্র সম্বন্ধের মধ্যে একটি আনন্দের রস আছে। সকলের মধ্যে এই যে আনন্দের রস, তাকে নিয়ে মহারসের প্রকাশ। “রসো বৈ সঃ।” রসের খণ্ড খণ্ড প্রকাশের মধ্যে তাকে পাওয়া গিয়েছিল। সেই অনুভূতিকে প্রকাশের জন্যে মরীয়া হ’য়ে উঠেছিলুম, কিন্তু ভালো রকম প্রকাশ করতে পারিনি। যা বলেচি অসম্পূর্ণভাবে বলেচি।

 প্রভাতসঙ্গীতের শেষের কবিতা—

“আজ আমি কথা কহিব না।
আর আমি গান গাহিব না।
হের আজি ভোর-বেলা এসেছে রে মেলা লোক,
ঘিরে আছে চারিদিকে
চেয়ে আছে অনিমিখে,
হেরে মোর হাসি-মুখ ভুলে গেছে দুখ-শোক।
আজ আমি গান গাহিব না।”

 এর থেকে বুঝতে পারা যাবে, মন তখন কীভাবে আবিষ্ট হয়েছিল, কোন্‌ সত্যকে মন স্পর্শ করেছিল। যা-কিছু হচ্চে, সেই মহামানবে মিলচে, আবার ফিরেও আসচে সেখান থেকে প্রতিধ্বনিরূপে নানা রসে সৌন্দর্য্যে মণ্ডিত হ’য়ে। এটা উপলব্ধি হয়েছিল অনুভূতিরূপে, তত্ত্বরূপে নয়। সে সময় বালকের মন এই অনুভূতি দ্বারা যেভাবে আন্দোলিত হয়েছিল, তারই অসম্পূর্ণ প্রকাশ প্রভাতসঙ্গীতের মধ্যে। সেদিন অক্সফোর্ডে যা বলেচি, তা চিন্তা ক’রে বলা। অনুভূতি থেকে উদ্ধার ক’রে অন্য তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে যুক্তির উপর খাড়া ক’রে সেটা বলা। কিন্তু তার আরম্ভ ছিল এখানে। তখন স্পষ্ট দেখেচি, জগতের তুচ্ছতার আবরণ খ’সে গিয়ে সত্য অপরূপ সৌন্দর্য্যে দেখা দিয়েচে। তার মধ্যে তর্কের কিছু নেই, সেই দেখাকে তখন সত্যরূপে জেনেচি। এখনো বাসনা আছে, হয়ত সমস্ত বিশ্বের আনন্দরূপকে কোনো এক শুভ মুহূর্ত্তে আবার তেমনি পরিপূর্ণভাবে কখনও দেখতে পাব। এইটে যে একদিন বাল্যাবস্থায় সুস্পষ্ট দেখেছিলুম, সেইজন্যেই “আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি” উপনিষদের এই বাণী আমার মুখে বার-বার ধ্বনিত হয়েচে। সেদিন দেখেছিলুম, বিশ্ব স্থূল নয়, বিশ্বে এমন কোনো বস্তু নেই যার মধ্যে রসস্পর্শ নেই। যা প্রত্যক্ষ দেখেচি তা নিয়ে তর্ক কেন? স্থূল আবরণের মৃত্যু আছে, অন্তরতম আনন্দময় যে সত্তা, তার মৃত্যু নেই।

 বর্ষার সময় খালটা থাকত জলে পূর্ণ। শুকনোর দিনে লোক চলত তার উপর দিয়ে। এ পারে ছিল একটা হাট, সেখানে বিচিত্র জনতা। দোতলার ঘর থেকে লোকালয়ের লীলা দেখতে ভালো লাগত। পদ্মায় আমার জীবনযাত্রা ছিল জনতা থেকে দূরে। নদীর চর—ধূ-ধূ বালি, স্থানে স্থানে জলকুণ্ড ঘিরে জলচর পাখী। সেখানে যে-সব ছোট গল্প লিখেচি তার মধ্যে আছে পদ্মাতীরের আভাস। সাজাদপুরে যখন আসতুম চোখে পড়ত গ্রাম্য জীবনের চিত্র, পল্লীর বিচিত্র কর্ম্মোদ্যম। তারই প্রকাশ ‘পোষ্টমাষ্টার’ ‘সমাপ্তি’ ‘ছুটি’ প্রভৃতি গল্পে। তাতে লোকালয়ের খণ্ড খণ্ড চলতি দৃশ্যগুলি কল্পনার দ্বারা ভরাট করা হয়েচে।

 সেই সময়কার এক দিনের কথা মনে আছে। ছোট শুকনো পুরানো খালে জল এসেচে। পাঁকের মধ্যে ডিঙিগুলো ছিল অর্দ্ধেক ডোবানো, জল আসতে তাদের ভাসিয়ে তোলা হ’ল। ছেলেগুলো নতুন জলধারার ডাক শুনে মেতে উঠেচে। তার দিনের মধ্যে দশবার ক’রে ঝাঁপিয়ে পড়চে জলে।

 দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে সে দিন দেখছিলুম, সামনের আকাশে নববর্ষার জলভারনত মেঘ, নীচে ছেলেদের মধ্যে দিয়ে প্রাণের তরঙ্গিত কল্লোল। আমার মন সহসা আপন খোলা দুয়ার দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে সুদূরে। অত্যন্ত নিবিড়ভাবে আমার অন্তরে একটা অনুভূতি এল, সামনে দেখতে পেলুম নিত্যকালব্যাপী একটি সর্ব্বানুভূতির অনবচ্ছিন্ন ধারা, নানা প্রাণের বিচিত্র লীলাকে মিলিয়ে নিয়ে একটি অখণ্ড লীলা। নিজের জীবনে যা বোধ করচি, যা ভোগ করচি, চার দিকে ঘরে ঘরে জনে জনে মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে যা-কিছু উপলব্ধি চলেচে, সমস্ত এক হয়েচে একটি বিরাট অভিজ্ঞতার মধ্যে। অভিনয় চলেচে নানা নটকে নিয়ে, সুখদুঃখের নানা খণ্ডপ্রকাশ চলচে তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র জীবযাত্রায়, কিন্তু সমস্তটার ভিতর দিয়ে একটা নাট্যরস প্রকাশ পাচ্চে এক পরম দ্রষ্টার মধ্যে যিনি সর্ব্বানুভূঃ। এত কাল নিজের জীবনে সুখদুঃখের যে-সব অনুভূতি একান্তভাবে আমাকে বিচলিত করেচে, তাকে দেখতে পেলুম দ্রষ্টারূপে এক নিত্য সাক্ষীর পাশে দাঁড়িয়ে।

 এমনি ক’রে আপনা থেকে বিবিক্ত হয়ে সমগ্রের মধ্যে খণ্ডকে স্থাপন করবামাত্র নিজের অস্তিত্বের ভার লাঘব হয়ে গেল। তখন জীবনলীলাকে রসরূপে দেখা গেল কোনো রসিকের সঙ্গে এক হয়ে। আমার সে দিনকার এই বোধটি নিজের কাছে গভীরভাবে আশ্চর্য্য হয়ে ঠেকল।

 একটা মুক্তির আনন্দ পেলুম। স্নানের ঘরে যাবার পথে একবার জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিলুম ক্ষণকাল অবসর যাপনের কৌতুকে। সেই ক্ষণকাল এক মুহূর্ত্তে আমার সামনে বৃহৎ হয়ে উঠল। চোখ দিয়ে জল পড়চে তখন, ইচ্ছে করচে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন ক’রে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করি কাউকে। কে সেই আমার পরম অন্তরঙ্গ সঙ্গী যিনি আমার সমস্ত ক্ষণিককে গ্রহণ করচেন তাঁর নিত্যে। তখনি মনে হ’ল আমার একদিক থেকে বেরিয়ে এসে আর একদিকের পরিচয় পাওয়া গেল। এষোঽস্য পরম আনন্দঃ, আমার মধ্যে এ এবং সে,—এই এ যখন সেই সে-র দিকে এসে দাঁড়ায় তখন তার আনন্দ।

 সে দিন হটাৎ অত্যন্ত নিকটে জেনেছিলুম আপন সত্তার মধ্যে দুটি উপলব্ধির দিক আছে। এক, যাকে বলি আমি, আর তারি সঙ্গে জড়িয়ে মিশিয়ে যা-কিছু, যেমন আমার সংসার, আমার দেশ, আমার ধন জন মান, এই যা-কিছু নিয়ে মারামারি কাটাকাটি ভাবনা-চিন্তা। কিন্তু পরমপুরুষ আছেন সেই সমস্তকে অধিকার ক’রে এবং অতিক্রম ক’রে,—নাটকের স্রষ্টা ও দ্রষ্টা যেমন আছে নাটকের সমস্তটাকে নিয়ে এবং তাকে পেরিয়ে। সত্তার এই দুই দিককে সব সময়ে মিলিয়ে অনুভব করতে পারিনে। একলা আপনাকে বিরাট থেকে বিচ্ছিন্ন ক’রে সুখে দুঃখে আন্দোলিত হই। তার মাত্রা থাকে না, তার বৃহৎ সামঞ্জস্য দেখিনে। কোনো এক সময়ে সহসা দৃষ্টি ফেরে তার দিকে, মুক্তির স্বাদ পাই তখন। যখন অহং আপন ঐকান্তিকতা ভোলে তখন দেখে সত্যকে। আমার এই অনুভূতি কবিতাতে প্রকাশ পেয়েচে জীবনদেবতা শ্রেণীর কাব্যে।

“ওগো অন্তরতম
মিটেছে কি তব সকল তিয়াষ
আসি অন্তরে মম।”

 আমি যে-পরিমাণে পূর্ণ অর্থাৎ বিশ্বভূমীন, সেই পরিমাণে আপন করেচি তাঁকে, ঐক্য হয়েচে তাঁর সঙ্গে। সেই কথা মনে ক’রে বলেছিলুম, তুমি কি খুসি হয়েচ আমার মধ্যে তোমার লীলার প্রকাশ দেখে?

 বিশ্বদেবতা আছেন, তাঁর আসন লোকে লোকে, গ্রহচন্দ্রতারায়। জীবনদেবতা বিশেষভাবে জীবনের আসনে, হৃদয়ে হৃদয়ে তাঁর পীঠস্থান, সকল অনুভূতি সকল অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে। বাউল তাঁকেই বলেচে মনের মানুষ। এই মনের মানুষ, এই সর্ব্বমানুষের জীবনদেবতার কথা বলবার চেষ্টা করেচি Religion of Man বক্তৃতাগুলিতে। সেগুলিকে দর্শনের কোঠায় ফেললে ভুল হবে। তাকে মতবাদের একটা আকার দিতে হয়েচে, কিন্তু বস্তুত সে কবিচিত্তের একটা অভিজ্ঞতা। এই আন্তরিক অভিজ্ঞতা অনেক কাল থেকে ভিতরে ভিতরে আমার মধ্যে প্রবাহিত—তাকে আমার ব্যক্তিগত চিত্তপ্রকৃতির একটা বিশেষত্ব বললে তাই আমাকে মেনে নিতে হবে।

 যিনি সর্ব্বজগদ্‌গত ভূমা তাঁকে উপলব্ধি করবার সাধনায় এমন উপদেশ পাওয়া যায় যে, লোকালয় ত্যাগ করো, গুহাগহ্বরে যাও, নিজের সত্তাসীমাকে বিলুপ্ত ক’রে অসীমে অন্তর্হিত হও। এই সাধনা সম্বন্ধে কোনো কথা বলবার অধিকার আমার নেই। অন্তত আমার মন যে-সাধনাকে স্বীকার করে তার কথাটা হচ্চে এই যে, আপনাকে ত্যাগ না ক’রে আপনার মধ্যেই সেই মহান পুরুষকে উপলব্ধি করবার ক্ষেত্র আছে,—তিনি নিখিল মানবের আত্মা। তাঁকে সম্পূর্ণ উত্তীর্ণ হয়ে কোনো অমানব বা অতিমানব সত্যে উপনীত হওয়ার কথা যদি কেউ বলেন তবে সে-কথা বোঝবার শক্তি আমার নেই। কেননা, আমার বুদ্ধি মানববুদ্ধি, আমার হৃদয় মানবহৃদয়, আমার কল্পনা মানবকল্পনা। তাকে যতই মার্জ্জনা করি, শোধন করি, তা মানবচিত্ত কখনোই ছাড়াতে পারে না। আমরা যাকে বিজ্ঞান বলি তা মানববুদ্ধিতে প্রমাণিত বিজ্ঞান, আমরা যাকে ব্রহ্মানন্দ বলি তাও মানবের চৈতন্যে প্রকাশিত আনন্দ। এই বুদ্ধিতে এই আনন্দে যাঁকে উপলব্ধি করি তিনি ভূমা কিন্তু মানবিক ভূমা। তাঁর বাইরে অন্য কিছু থাকা-না-থাকা মানুষের পক্ষে সমান। মানুষকে বিলুপ্ত ক'রে যদি মানুষের মুক্তি, তবে মানুষ হলুম কেন?

একসময় ব'সে ব'সে প্রাচীন মন্ত্রগুলিকে নিয়ে ঐ আত্মবিলয়ের ভাবেই ধ্যান করেছিলুম। পালাবার ইচ্ছে করেচি, শান্তি পাইনি তা নয়। বিক্ষোভের থেকে সহজেই নিষ্কৃতি পাওয়া যেত। এভাবে দুঃখের সময় সান্ত্বনা পেয়েচি। প্রলোভনের হাত থেকে এমনিভাবে উদ্ধার পেয়েচি। আবার এমন একদিন এল যেদিন সমস্তকে স্বীকার করলুম, সবকে গ্রহণ করলুম। দেখলুম—মানব-নাট্যমঞ্চের মাঝখানে যে-লীলা তার অংশের অংশ আমি। সব জড়িয়ে দেখলুম সকলকে। এই যে দেখা একে ছোট বলব না। এও সত্য। জীবনদেবতার সঙ্গে জীবনকে পৃথক ক'রে দেখলেই দুঃখ, মিলিয়ে দেখলেই মুক্তি।