কঙ্কাবতী/প্রথম ভাগ/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


চতুর্থ পরিচ্ছেদ

খেতু

তনু রায়ের পাড়ায় একটি দুঃখিনী ব্রাহ্মণী বাস করেন। লোকে তাঁহাকে “খেতুর মা, খেতুর মা” বলিয়া ডাকে। খেতুর মা আজি দুঃখিনী বটে, কিন্তু একসময়ে তাহার অবস্থা ভাল ছিল। তাঁহার স্বামী শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখা-পড়া জানিতেন, কলিকাতায় কর্ম্ম করিতেন, দু'পয়সা উপার্জ্জন করিতেন।

 কিন্তু তিনি অর্থ রাখিতে জানিতেন না। পরদুঃখে তিনি নিতান্ত কাতর হইয়া পড়িতেন ও যথাসাধ্য পরের দুঃখ মোচন করিতেন। অনেক লোককে অন্ন দিতেন ও অনেকগুলি ছেলের তিনি লেখা-পড়ার খরচ দিতেন। এরূপ লোকের হতে পয়সা থাকে না।

 অধিক বয়সে তাহার স্ত্রীর একটি পুত্রসন্তান হয়। ছেলেটির নাম “ক্ষেত্র” রাখেন, সেই জন্য তাহার স্ত্রীকে সকলেই “খেতুর মা” বলে।

 যখন পুত্র হইল, তখন শিবচন্দ্র মনে করিলেন,— “এইবার আমাকে বুঝিয়া খরচ করিতে হইবে। আমার অবর্ত্তমানে স্ত্রী-পুত্র যাহাতে অন্নের জন্য লালায়িত না হয়, আমাকে সে বিলি করিতে হইবে।”

 মানস হইল বটে, কিন্তু কার্য্যে পরিণত হইল না। পৃথিবী অতি দুঃখময়, এ দুঃখ যিনি নিজ দুঃখ বলিয়া ভাবেন, চিরকাল তাঁহাকে দরিদ্র থাকিতে হয়।

 খেতুর যখন চারি বৎসর বয়স, তখন হঠাৎ তাহার পিতার মৃত্যু হইল। স্ত্রী ও শিশুসন্তানটিকে একেবারে পথে দাঁড় করাইয়া গেলেন। খেতুর বাপ অনেকের উপকার করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ এখন বড়লোক হইয়াছেন। কিন্তু এই বিপদের সময় কেহই একবার উঁকি মারিলেন না। কেহই একবার জিজ্ঞাসা করিলেন না যে,— “খেতুর মা! তোমার হবিষ্যের সংস্থান আছে কি না?”

 এই দুঃখের সময় কেবল রামহরি মুখোপাধ্যায় ইহাদের সহায় হইলেন।

 রামহরি ইহাদের জ্ঞাতি, কিন্তু দূর-সম্পর্ক। খেতুর বাপ, তাহার একটি সামান্য চাকরি করিয়া দিয়াছিলেন। দেশে অভিভাবক নাই, সে জন্য কলিকাতায় তাঁহাকে পরিবার লইয়া থাকিতে হইয়াছে। যে কয়টি টাকা পান, তাহাতেই কষ্টে-সৃষ্টে দিনপাত করেন।

 তিনি কোথায় পাইবেন? তবুও যাহা কিছু পারিলেন, বিধবাকে দিলেন ও চাঁদার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরিলেন। খেতুর বাপের খাইয়া যাহারা মানুষ, আজ তাহারা রামহরিকে কতই না ওজারআপত্তি অপমানের কথা বলিয়া দুই-এক টাকা চাঁদা দিল। তাহাতেই খেতুর বাপের তিল-কাঞ্চন করিয়া শ্রাদ্ধ হইল। চাঁদার টাকা হইতে যাহা কিছু বঁচিল, রামহরি তাহা দিয়া খেতুর মা ও খেতুকে দেশে পাঠাইয়া দিলেন।

 দেশে পাঠাইয়া দুঃখিনী বিধবাকে তিনি চাউলের দামটি দিতেন; অধিক আর কিছু দিতে পারিতেন না। ব্রাহ্মণী পৈতা কাটিয়া কোনওমতে কুলান করিতেন। দেশে বান্ধব কেহই ছিল না। নিরঞ্জন কবিরত্ন কেবলমাত্র দেখিতেন-শুনিতেন; বিপদে-আপদে তিনিই বুক দিয়া পড়িতেন।

 খেতুর মা'র এইরূপে কষ্টে দিন কাটিতে লাগিল। ছেলেটি শান্ত সুবোধ, অথচ সাহসী ও বিক্রমশীল হইতে লাগিল। তাহার রূপ-গুণে স্নেহ-মমতায় মা সকল দুঃখ ভুলিতেন। ছেলেটি যখন সাত বৎসরের হইল, তখন রামহরি দেশে আসিলেন।

 খেতুর মাকে তিনি বলিলেন,— “খেতুর এখন লেখা-পড়া শিখিবার সময় হইল, আর ইহাকে এখানে রাখা হইবে না। আমি ইহাকে কলিকাতায় লইয়া যাইতে ইচ্ছা করি। আপনার কি মত?”

 খেতুর মা বলিলেন,— “বাপ রে! তা কি কখন হয়? খেতুকে ছাড়িয়া আমি কি করিয়া থাকিব? নিমিষের নিমিত্তও খেতুকে চক্ষুর আড় করিয়া আমি জীবিত থাকিতে পারিব না। না বাছা! এ প্রাণ থাকিতে আমি খেতুকে কোথাও পাঠাইতে পারিব না।”

 রামহরি বলিলেন, — “দেখুন, এখানে থাকিলে খেতুর লেখাপড়া হইবে না। মথুর চক্রবর্ত্তীর অবস্থা কি ছিল জানেন তো? গাজনের শিবপূজা করিয়া অতি কষ্টে সংসার প্রতিপালন করিত। 'গাজুনে বামুন' বলিয়া সকলে তাঁহাকে ঘৃণা করিত। তাহার ছেলে ষাঁড়েশ্বর আপনার বাসায় দিনকতক রাঁধুনী বামুন থাকে। অল্পবয়স্ক বালক দেখিয়া শিবকাকার দয়া হয়, তিনি তাহাকে স্কুলে দেন। এখন সে উকীল হইয়াছে। এখন সে একজন বড়লোক।”

 খেতুর মা উত্তর করিলেন,— “চুপ কর! কলিকাতায় লেখা-পড়া শিখিয়া যদি ষাড়েশ্বরের মত হয়, তাহা হইলে আমার খেতুর লেখা-পড়া শিখায় কাজ নাই।”

 রামহরি বলিলেন,— “সত্য বটে, ষাড়েশ্বর মদ খায়, আর মুসলমান সহিসের হাতে নানারূপ অখাদ্য মাংসও খায়, আবার এদিকে প্রতিদিন হরি-সঙ্কীর্ত্তন করে। কিন্তু তা বলিয়া কি সকলেই সেইরূপ হয়? পুরুষমানুষে লেখা-পড়া না শিখিলে কি চলে? পুরুষমানুষের যেরূপ বঁচিয়া থাকার প্রার্থনা, বিদ্যাশিক্ষারও সেইরূপ প্রার্থনা।”

 খেতুর মা বলিলেন, — “হাঁ সত্যকথা। পুত্রের যেরূপ বাঁচিবার প্রার্থনা, বিদ্যার প্রার্থনাও তাহার চেয়ে অধিক। যে মাতা-পিতা ছেলেকে বিদ্যাশিক্ষা না দেন, সে মাতা-পিতা ছেলের পরম-শত্রু। তবে বুঝিয়া দেখ, আমার মার প্রাণ, আমি অনাথিনী সহায়হীনা বিধবা। পৃথিবীতে আমার কেহ নাই, এই একরতি ছেলেটিকে লইয়া সংসারে আছি। খেতুকে আমি নিমিষে হারাই। খেলা করিয়া ঘরে আসিতে খেতুর একটু বিলম্ব হইলে, আমি যে কত কি কু ভাবি, তাহা আর কি বলিব? ভাবি, খেতু বুঝি জলে ডুবিল, খেতু বুঝি আগুনে পুড়িল, খেতু বুঝি গাছ হইতে পড়িয়া গেল, খেতুকে বুঝি পাড়ার ছেলেরা মারিল! খেতু যখন ঘুমায়, রাত্রিতে উঠিয়া উঠিয়া আমি খেতুর নাকে হাত দিয়া দেখি,— খেতুর নিশ্বাস পড়িতেছে কি না? ভাবিয়া দেখ দেখি, এ দুধের বাছাকে দূরে পাঠাইতে মার মহাপ্রাণী কি করে? তাই কাঁদি, তাই বলি 'না'।” পুনরায় খেতুর মা বলিলেন,— “রামহরি! খেতু আমার বড় গুণের ছেলে। কেবল দুই বৎসর পাঠশালায় যাইতেছে, ইহার মধ্যেই তালপাতা শেষ করিয়াছে, কলাপাতা ধরিয়াছে।” গুরু মহাশয় বলেন, — “খেতু সকলের চেয়ে ভাল ছেলে।”

 “আর দেখ রামহরি! খেতু আমার অতি সুবোধ ছেলে। খেতুকে আমি যা করিতে বলি, খেতু তাই করে। যেটি মানা করি, সেটি আর খেতু করে না। একদিন দাসেন্দের মেয়ে আসিয়া বলিল,— ‘ওগো তোমার খেতুকে পাড়ার ছেলেরা বড় মারিতেছে।' আমি উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিলাম। দেখিলাম, ছয়জন ছেলে একা খেতুর উপর পড়িয়াছে। খেতুর মনে ভয় নাই, মুখে কান্না নাই। আমি দৌঁড়িয়া গিয়া খেতুকে কোলে লইলাম। খেতু তখন চক্ষু মুছিতে মুছিতে বলিল — ‘মা! আমি উহাদের সাক্ষাতে কাঁদি নাই, পাছে উহারা মনে করে যে, আমি ভয় পাইয়াছি। একা একা আমার সঙ্গে কেহই পারে না! উহারা ছয়জন, আমি একা, তা আমিও মারিয়াছি। আবার যখন একা একা পাইব, তখন আমিও ছয়জনকে খুব মারিব।' আমি বলিলাম,— 'না বাছা! তা করিতে নাই। প্রতিদিন যদি সকলের সঙ্গে মারামারি করিবে, তবে খেলা করিবে কার সঙ্গে?' খেতু আমার কথা শুনিল। কত দিন সে ছেলেদের খেতু একলা পাইয়াছিল, মনে করিলে খুব মারিতে পারিত; কিন্তু আমি মানা করিয়াছিলাম বলিয়া কাহাকেও সে আর মারে নাই।”

 আর একদিন আমি খেতুকে বলিলাম,— “খেতু! তনু রায়ের আঁবগাছে ঢিল মারিও না। তনু রায় খিটখিটে লোক, সে গালি দিবে।” খেতু বলিল,— 'মা। ও-গাছের আঁব বড় মিষ্ট গো! একটি আঁব পাকিয়া টুকটুক করিতেছিল। আমার হাতে একটি টিল ছিল। তাই মনে করিলাম, দেখি, পড়ে কি না?' আমি বলিলাম,— “বাছা! ও গাছের আঁব বড় মিষ্ট হইলে কি হইবে, ও গাছটি তো আর আমাদের নয়? পরের গাছে ঢিল মারিলে, যাদের গাছ, তাহারা রাগ করে; যখন আপনা-আপনি তলায় পড়িবে, তখন কুড়াইয়া খাইও, তাহাতে কেহ কিছু বলিবে না।”

 তাহার পর, আর একদিন খেতু আমাকে আসিয়া বলিল,— মা! জেলেদের গাবগাছে খুব গাব পাকিয়াছে। পাড়ার ছেলেরা সকলে গাছে উঠিয়া গাব খাইতেছিল। আমাকে তাহারা বলিল,— “খেতু! আয় না ভাই! দুরের গাব যে আমরা পাড়িতে পারি না! তা মা আমি গাছে উঠি নাই। গাবগাছটি তো, মা! আর আমাদের নয়, যে উঠিব? আমি তলায় দাঁড়াইয়া রহিলাম। ছেলেরা দুটি-একটি গাব আমাকে ফেলিয়া দিল। মা! সে গাব কত যে গো মিষ্ট, তাহা আর তোমাকে কি বলিব! তোমার জন্য একটি গাব আনিয়াছি, তুমি বরং, মা! খাইয়া দেখ! মা! আমাদের যদি একটি গাবগাছ থাকিত, তাহা হইলে বেশ হইত।” আমি বলিলাম,— 'খেতু! বুড়োমানুষে গাব খায় না, ও গাবটি তুমি খাও। আর পরের গাছে পাকা গাব পাড়িতে কোন দোষ নাই, তার জন্য জেলেরা তোমাকে বকিবে না। কিন্তু গাছের ডগায় গিয়া উঠিও না, সরু ডালে পা দিও না, ডাল ভাঙ্গিয়া পড়িয়া যাইবে। গাবের আঁটি চুষিয়া চুষিয়া ফেলিয়া দিও, আঁটি গিলিও না, গলায় বাধিয়া যাইবে।” গাব খাইতে অনুমতি পাইয়া বাছার যে কত আনন্দ হইল, তাহা আর তোমাকে কি বলিব?

 “দেখ, এ গ্রামে একবার একজন কোথা হইতে সন্দেশ বেচিতে আসিয়াছিল। পাড়ার ছেলেরা তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। তাদের বাপ-মা, যার যেরূপ ক্ষমতা, সন্দেশ কিনিয়া আপনার আপনার ছেলের হাতে দিল। মুখ চূণপানা করিয়া আমার খেতু সেইখানে দাঁড়াইয়াছিল। তাড়াতাড়ি গিয়া আমি খেতুকে কোলে লইলাম, আমার বুক ফাটিয়া যাইল, চক্ষুর জল রাখিতে পারিলাম না। আঁচলে চক্ষু পুছিতে পুছিতে ছেলে নিয়ে বাটী আসিলাম। খেতু নীরব, খেতুর মুখে কথা নাই। তার শিশুমনে সে যে কি ভাবিতেছিল, তাহা বলিতে পারি না। কিছুক্ষণ পরে আমার মুখে হাত দিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল,— ‘মা! তুমি কাঁদা কেন?' আমি বলিলাম,— 'বাছা! আমার ঘরে একদিন সন্দেশ ছড়াছড়ি যাইত, চাকর-বাকরে পর্য্যন্ত খাইয়া আলিয়া যাইত। আজ যে তোমার হাতে একপয়সার সন্দেশ কিনিয়া দিতে পারিলাম না, এ দুঃখ কি আর রাখিতে স্থান আছে? এমন অভাগিনী মা’র পেটেও বাছা তুই জন্মেছিলি?' সাত বৎসরের শিশুর একবার কথা শুনা! খেতু বলিল,— “মা ও সন্দেশ ভাল নয়। দেখিতে পাও নাই, সব পচা? আর মা! তুমি তো জোন? সন্দেশ খাইলে আমার অসুখ করে। সেই যে মা, চৌধুরীদের বাড়ীতে নিমন্ত্রণে গিয়াছিলাম, সেখানে সন্দেশ খাইয়াছিলাম, তার পরদিন আমার কত অসুখ করিয়াছিল! সন্দেশ খাইতে নাই, মুড়ি খাইতে আছে। ঘরে যদি মা! মুড়ি থাকে তো দাও আমি খাই।”

 খেতুর মার মুখে খেতুর কথা আর ফুরায় না।রামহরির নিকট কত যে কি পরিচয় দিলেন, তাহা আর কি বলিব?

 অবশেষে রামহরি বলিলেন, — “খুড়ী মা! ভয় করিও না। আমার নিজের ছেলের চেয়েও আমি খেতুর যত্ন করিব। আমি অনেক খাইয়াছি। তাহার অনুগ্রহে আজ পরিবারবর্গকে একমুঠা অন্ন দিতেছি। আজ তাঁহার ছেলে যে মুর্খ হইয়া থাকিবে, তাহা প্রাণে সহ্য হবে না। খেতু কেমন আছে, কেমন লেখা-পড়া করিতেছে, সে বিষয়ে আমি সর্ব্বদা আপনাকে পত্র লিখিব। আবার, খেতু যখন চিঠি লিখিতে শিখিবে, তখন সে নিজে আপনাকে চিঠি লিখিবে। পূজার সময় ও গ্রীষ্মের ছুটির সময় খেতুকে দেশে পঠাইয়া দিব। বৎসরের মধ্যে দুই-তিন মাস সে আপনার নিকট থাকিবে। আজ আমি এখন যাই। আজ শুক্রবার। বুধবার ভাল দিন। সেই দিন খেতুকে লইয়া কলিকাতায় যাইব।”