কঙ্কাবতী/প্রথম ভাগ/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

ষাঁড়েশ্বর

একবার পূজার ছুটির কিছু পূর্ব্বে, কলিকাতার পথে, খেতুর সহিত ষাঁড়েশ্বরের সাক্ষাৎ হইল।

 ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,— “খেতু, বাড়ী যাইবে কবে? আমি গাড়ী ঠিক করিয়াছি, যদি ইচ্ছা কর তো আমার গাড়ীতে তুমি যাইতে পার!”

 খেতু উত্তর করিলেন,— “আমার এখনও কলেজের ছুটি হয় নাই। কবে যাইব, তাহার এখনও ঠিক নাই।”

 ষাঁড়েশ্বর জিজ্ঞাসা করিলেন,— “খেতু! তোমার হাতে ও কি?”

 খেতু উত্তর করিলেন,— “এ একটি সিংহাসন। মা প্রতিদিন মাটির শিব গড়িয়া পূজা করেন, তাই মা’র জন্য একটি পাথরের শিব কিনিয়াছি। সেই শিবের জন্য এই সিংহাসন।”

 ষাঁড়েশ্বর জিজ্ঞাসা করিলেন, “শিবটি তোমার কাছে আছে? কৈ দেখি?”

 খেতু শিবটি পকেট হইতে বাহির করিয়া ষাঁড়েশ্বরের হাতে দিলেন।

 ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,— “শিবটি পকেটে রাখিয়াছিলে? খুব ভক্তি তো তোমাৱ?”

 খেতু উত্তর করিলেন,— “শিবের তো এখনও পূজা হয় নাই। তাতে আর দোষ কি?”

 ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,— “তাই বলিতেছি!”

 এই কথা বলিয়া ষাঁড়েশ্বর শিবটি পুনরায় খেতুর হাতে দিলেন।

 এ-কথায় সে-কথায় যাইতে যাইতে, ষাঁড়েশ্বর বলিলেন, —"এই যে, পাদ্‌রী সাহেবের বাড়ী! পাদ্‌রী সাহেবের সঙ্গে তোমার তো আলাপ আছে! এস না? একবার দেখা করিয়া যাই!"

 ষাঁড়েশ্বর ও খেতু, দুই জনে পাদ্‌রি সাহেবের নিকট যাইলেন।

 পাদ্‌রি সাহেবের সহিত নানারূপ কথাবার্ত্তার পর, ষাঁড়েশ্বর বলিলেন, —"আর শুনিয়াছেন, মহাশয়? মা পূজা করিবেন বলিয়া খেতু একটি পাথরের শিব কিনিয়াছেন। সেই শিবটি খেতুর পকেটে রহিয়াছে।”

 পাদ্‌রি সাহেব বলিলনে,— “অ্যা! সে কি কথা! ছি ছি, খেতু! তুমি এমন কাজ করিবে, তা আমি স্বপ্নেও জানিতাম না। তোমাদের জন্য যে আমরা এত স্কুল করিলাম, সে সব বৃথা হইল। বড় একজন লেখক লিখিয়াছেন যে, এই বাঙ্গালীজাতি মিথ্যাবাদী, ফেরেবী, জালিয়াত, ভীরু, দাসের জাতি।”

 খেতু বলিলেন,— “আহা! কি মধুর ধর্ম্মের কথা আজ শুনিলাম! সর্ব্বশরীর শীতল হইয়া গেল। ইচ্ছা করে, এখনি খৃষ্টান হই। যদি ঘরে জল থাকে তো নিয়ে আসুন, আর বিলম্ব করেন কেন? আমার মাথায় দিন, দিয়া আমাকে খৃষ্টান করুন। বাঙ্গালীদের উপর চারিদিক্‌ হইতে যেরূপ আপনারা সকলে মিলিয়া সুধা বর্ষণ করিতেছেন, তাতে বাঙ্গালীদের মন খৃষ্টীয় ধর্ম্মামৃতরসে একেবারে ভিজিয়া গিয়াছে। দেখেন কি আর? এই সব পটপট করিয়া খৃষ্টান হয় আর কি? আবার আমেরিকার কালা-খৃষ্টানদিগের উপর আপনাদের যেরূপ ভ্রাতৃভাব, তা যখন লোকে শুনিবে, আর আফ্রিকার নিরস্ত্র কালা-আদমিদিগের প্রতি আপনাদের যেরূপ দয়া-মায়া, তা যখন লোকে জানিবে, তখন এ-দেশের জনপ্রাণীও আর বাকি থাকিবে না, সব খৃষ্টান হইয়া যাইবে। এখন সেলাম।”

 এই কথা বলিয়া খেতু সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন। ষাঁড়েশ্বরও হাসিতে হাসিতে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিলেন।

 পথে খেতু ষাঁড়েশ্বরকে জিজ্ঞাসা করিলেন,— “শুনিতে পাই, আপনি প্রতিদিন হরি-সঙ্কীর্ত্তন করেন। তবে পাদ্‌রি সাহেবের নিকট আমাকে ওরূপ উপহাস করিলেন কেন?”

 ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,— “উপহাস আর তোমাকে কি করিলাম? সে যাহা হউক, সন্ধ্যা হইয়াছে, আমার হরি-সঙ্কীর্ত্তনের সময় হইল। এস না, একটু দেখিবে? দেখিলেও পুণ্য আছে।”

 ষাঁড়েশ্বরের বাসা নিকট ছিল। খেতু ও ষাড়েশ্বর দুই জনে সেইখানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। খেতু দেখিলেন যে, ষাঁড়েশ্বরের দালানে হরি-সঙ্কীর্ত্তন আরম্ভ হইয়াছে। কিন্তু ষাঁড়েশ্বর সেখানে না যাইয়া বরাবর উপরের বৈঠকখানায় যাইলেন। খেতুকে সেইখানে বসিতে বলিয়া ষাঁড়েশ্বর বাটীর ভিতর গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ষাঁড়েশ্বর ফিরিয়া আসিলেন ও খেতুকে বলিলেন,— “খেতু! চল, অন্য ঘরে যাই।”

 খেতু অন্য ঘরে গিয়া দেখিলেন যে, ষাঁড়েশ্বরের আর দুইটি বন্ধু সেখানে বসিয়া আছেন। সেখানে খানা খাইবার সব আয়োজন হইতেছে।

 নীচে হরি-সঙ্কীর্ত্তন চলিতেছে। ষাঁড়েশ্বর হিন্দুধর্ম্মের ও হিন্দুসমাজের একজন চাঁই।

 অল্পক্ষণ পরে খানা খাওয়া আরম্ভ হইল। দুই জন মুসলমান পরিবেশন করিতে লাগিল। খেতু বলিলেন,— “আপনারা তবে আহারাদি করুন, আমি এখন যাই।”

 ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,— “না না, একটু থাক না, দেখ না, দেখিলেও পুণ্য আছে। এখন যা আমরা খাইতেছি, ইহা মাংসের ঝোল, ইহার নাম সুপ; একটু সূপ খাইবে?”

 খেতু বললেন,— “এসব দ্রব্য আমি কখনও খাই নাই, আমার প্রবৃত্তি হয় না। আপনারা আহার করুন?”

 আবার কিছুক্ষণ পরে ষাঁড়েশ্বর বললেন,— “খেতু! এখন যা খাইতেছি, ইহা ভেটকি মাছ। মাছ খাইতে দোষ কি? একটু খাও না?”

 খেতু বলিলেন,— “মহাশয়! আমাকে অনুরোধ করিবেন না। আপনারা আহার করুন। আমি বসিয়া থাকি।”

 ষাঁড়েশ্বর বলিলেন,— “তবে না হয়, এই একটু খাও। ইহা অতি উত্তম ব্রাণ্ডি। পাদুরি সাহেবের কথায় মনে তোমার ক্লেশ হইয়া থাকিবে, একটু খাইলেই এখনি সব ভাল হইয়া যাইবে।”

 খেতু বলিলেন,— “মহাশয়! যোড়হাত করিয়া বলি, আমাকে অনুরোধ করিবেন না। অনুমতি করুন, আমি বাড়ী যাই।”

 ষাঁড়েশ্বরের একটি বন্ধু বলিলেন,— “তবে না হয় একটু হ্যাম মুরগী খাও। এ হ্যাম— বিলাতি শূকরের মাংস। ইহা বিলাত হইতে আসিয়াছে। অভক্ষ্য, গ্রাম্য শূকর। বিলাতী শূকর খাইতে কোনও দোষ নাই। আর এ মুরগীও মহা-কুক্কুট, রামপাখী-বিশেষ। হগসাহেবের বাজার হইতে কেনা, যে-সে মুরগী নয়।”

 ষাঁড়েশ্বরের অপর বন্ধু বলিলেন,— “এইবার ভি—র কটলেট আসিয়াছে। খেতুবাবু নিশ্চয় এইবার একটু খাইবেন।”

 খানসামা এবার কি দ্রব্য আনিয়াছিল, সেকথা আর শুনিয়া কাজ নাই। নীচে হরি-সঙ্কীর্ত্তনের ধুম। তাঁহাই শ্রবণ করিয়া সকলে প্রাণ পরিতুষ্ট করুন।

 কিয়ৎক্ষণ পরে দুই বন্ধুতে চুপি চুপি কি পরামর্শ করিলেন। তখন এক বন্ধু উঠিয়া গিয়া খেতুকে ধরিলেন, অপরজন খেতুর মুখে ব্র্যাণ্ডি ঢালিয়া দিতে চেষ্টা করিলেন। ষাঁড়েশ্বর বসিয়া বসিয়া হাসিতে লাগিলেন।

 খেতুর শরীরে বিলক্ষণ বল ছিল। এক এক ধাক্কায় দুই জনকেই ভূতলশালী করিলেন। তাহার পর মেজটি উল্টাইয়া ফেলিলেন। কাচের বাসন, কাচের গেলাস, সম্মুখে যাহা কিছু পাইলেন, আছাড় মারিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন। এইরূপ দক্ষযজ্ঞ করিয়া সেখান হইতে খেতু প্রস্থান করিলেন।