কঙ্কাবতী/দ্বিতীয় ভাগ/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


চতুৰ্দশ পরিচ্ছেদ

মশা প্রভু

তিন সতীনে পুনরায় ঘোরতর বিবাদ বাধিল। রক্তবতী চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। মশার ঘরে কোলাহলের রোল উঠিল। এমন সময় মশা বাড়ী আসিলেন। ঘরে কলহ-কচকচির কোলাহল শুনিয়া, মশার সর্বশরীর জ্বলিয়া গেল।

 মশা বলিলেন,— “এ যন্ত্রণা আর আমার সহ্য হয় না। তোমাদের ঝগড়ার জ্বালায়, আমাদের ঘরের কাছে গাছের ডালে কাক-চিল বসিতে পারে না। যেখানে এরূপ বিবাদ হয়, সেখানে লক্ষ্মী থাকেন না, তালুকে মনুষ্যাদিগের শরীরে শোণিত শুষ্ক হইয়া যায়; ইচ্ছা হয় যে, গলায় দড়ি দিয়া মরি, কি বিষ খাইয়া মরি, কি বিষ খাইয়া মরি! আত্মহত্যা করিয়া আমাকে মরিতে হইবে। এই সেদিন ধর্ম্মে ধর্ম্মে আমার প্রাণটি হইয়াছে। আমি একজন আফিমখোরের গায়ে বসিয়াছিলাম। তাহার রক্ত কি তিক্ত! একশুঁড় রক্ত সব ফেলিয়া দিলাম। বারবার কুলকুচা করিয়া তবে প্রাণ রক্ষা হইল। মনে কঁরলাম,— অপঘাত মৃত্যুতে মরিব! তাই এত কাণ্ড করিয়া প্রাণ বাঁচাইলাম। কিন্তু তোমাদের জ্বালায় এত জ্বালাতন হইয়াছি যে, বাঁচিতে আর আমার তিলমাত্র সাধ নাই!”

 এইরূপে মশা স্ত্রীগণকে অনেক ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন। অবশেষে তাহার রাগ পড়িলে, তিনি একটু সুস্থির হইলে, রক্তবতী গিয়া তাঁহার কোলে বসিলেন।

 রক্তবতী বলিলেন,— “বাবা! আমার পচাজল আসিয়াছে।”

 মশা জিজ্ঞাসা করিলেন— “সে আবার কে? পচাজল আবার কি?”

 রক্তবতীর মা উত্তর করিলেন,— “ওগো! একটি মানুষের কন্যা! সন্ধ্যা হইতে এখানে বসিয়া আছে। রক্তবতী তাহার সহিত পচাজল পাতাইয়াছে। আহা! বালিকা এখানে আসিয়া পর্যন্ত কেবল কাঁদিতেছে। বলে, “আমি পতিহারা সতী! পতিকে নাকেশ্বরী খাইয়াছে। আমি লোকালয়ে যাইব, সেখান হইতে বৈদ্য আনিয়া আমার পতিকে ভাল করিব।' আমি তাকে বলিলাম,— 'বাছা! একটু অপেক্ষা কর। কর্ত্তাটি বাড়ী আসুন, তাহার সহিত পরামর্শ করিয়া তোমার একটা উপায় করা যাইবে। তুমি যখন রক্তবতীর পচাজল হইয়াছ, তখন তোমার দুঃখমোচন করিতে আমরা যথাসাধ্য যত্ন করিব!' রক্তবতীর পচাজল হইবে, রক্তবতী পচাজলকে লইয়া সাধ-আহ্লাদ করিবে, তোমার আর দুইটি রাণীর প্রাণে সহিবে কেন? তাদের আবার ঐ মানুষের ছানাটিকে পুষিতে সাধ হইল। সেই কথা লইয়া আমাকে তারা যা-না-তাই

বলিলেন। তা, আমার আর এখানে থাকিয়া আবশ্যক নাই, তুমি আমাকে বাপের বাড়ী পাঠাইয়া দাও। দিয়া, দুই রাণী নিয়ে সুখে-স্বচ্ছন্দে ঘরকন্না কর। আমি তোমার কণ্টক হইয়াছি, আমি এখান হইতে যাই।”

 মশা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “সে মানুষের কন্যাটি কোথায়?”

 রক্তবতীর মা বলিলেন,— “ঐ বাহিরে বসিয়া আছে।”

 রক্তবতী বলিলেন,— “বাবা! তুমি আমার সঙ্গে এস। আমার পচাজল কোথায়, আমি এখনি দেখাইয়া দিব।”

 মশা ও রক্তবতী দুইজনে উড়িলেন। বিষন্নবদনে, অশ্রুপুরিতনয়নে, যেখানে কঙ্কাবতী বসিয়াছিলেন, গুনগুন করিয়া দুইজনে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 রক্তবতী বলিলেন,— “পচাজল। এই দেখ, বাবা আসিয়াছেন।”

 কঙ্কাবতী সসন্ত্রমে গাত্রোত্থান করিয়া মশাকে নমস্কার করিলেন। কঙ্কাবতীকে ভাল করিয়া দেখিতে পাইবেন বলিয়া, মশা গিয়া একটি ঘাসের ডগার উপর বসিলেন। তাহার পাশে আর একটি ঘাসের ডগার উপর রক্তবতী বসিলেন। মশার সম্মুখে হাতযোড় করিয়া কঙ্কাবতী দণ্ডায়মান রহিলেন।

 অতি বিনীতভাবে কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মহাশয়! বিপন্ন অনাথা বালিকা আমি। জনশূন্য এই গহন কাননে আমি একাকিনী, আমি পতিহারা সতী। আমি দুঃখিনী কঙ্কাবতী। প্রাণসম পতি আমার ভূতিনীর হস্তগত হইয়াছেন। আমার পতিকে উদ্ধার করিয়া দিন। আমি আপনার শরণ লইলাম।”

 মশা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তুমি কাহার সম্পত্তি।

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “মহাশয়! পূর্ব্বে আমি পিতার সম্পত্তি ছিলাম। বাল্যকালে বিক্রয়ের অধিকার পিতার থাকে। অন্ধ, আতুর, বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্ত—যাহাকে ইচ্ছা তাহাকেই তিনি দান-বিক্রয় করিতে পারেন। জ্ঞান না হইতে হইতে মাতাপিতা আপন আপন বালিকাদিগকে দান-বিক্রয় করিয়া নিশ্চিন্ত হন। আমাদের মধ্যে এই রীতি প্রচলিত। আমার পিতা, তিন সহস্ৰ স্বর্ণমুদ্রা লইয়া, আমাকে আমার পতির নিকট বিক্রয় করিয়াছেন। এক্ষণে আমি আমার পতির সম্পত্তি, যে পতিকে হারাইয়া অনাথা হইয়া আজ আমি বনে বনে কাঁদিয়া বেড়াইতেছি। পূর্ব্বে পিতার সম্পত্তি ছিলাম, এক্ষণে আমি আমার পতির সম্পত্তি!”

 মশা বলিলেন,— “উহু! সে কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি না। তুমি কোন মশার সম্পত্তি?”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন— “কোন মশার সম্পত্তি। সে কথা ত’ আমি কিছু জানি না। কৈ? আমি তো কোন মশার সম্পত্তি নই!”

 মশা বলিলেন,— “রক্তবতী! তোমার পচাজল দেখিতেছি পাগলিনী, উন্মত্তা; ইহার কোনও জ্ঞান নাই। সঠিক সত্য সত্য কথার উত্তর না পাইলে তোমার পচাজলের কি করিয়া আমি উপকার করি?”

 রক্তবতী বলিলেন,— “ভাই পচাজল বাবা যে কথা জিজ্ঞাসা করেন, সত্য সত্য তাহার উত্তর দাও।”

 মশা বলিলেন,— “শুন, মনুষ্য-শাবক। এই ভারতে যত নর-নারী দেখিতে পাও, ইহারা সকলেই মশাদিগের সম্পত্তি। যে মশা মহাশয় তোমার অধিকারী, তাহার নিকট হইতে বোধ হয়, তুমি পলাইয়া আসিয়াছ। সেই ভয়ে তুমি আমার নিকট সত্যকথা বলিতেছ না, আমার নিকট কথা গোপন করিতেছ! তোমার ভয় নাই, তুমি সত্য সত্য আমার কথার উত্তর দাও। আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি,— তুমি কোন মশার সম্পত্তি, কোন মশা তোমার গায়ে উপবিষ্ট হইয়া রক্তপান করেন? তাহার নাম কি? তাহার নিবাস কোথায়? তাঁহার কয় স্ত্রী? কয় পুত্র? কয় কন্যা? পৌত্র-দৌহিত্র আছে কি না? তাহার জ্ঞাতি-বন্ধুদিগের তোমার উপর কোনও অধিকার আছে কি না? তাহারা তোমাকে এজেমালিতে রাখিয়াছেন, কি তোমার হস্তপদাদি বণ্টন করিয়া লইয়াছেন? যদি তুমি বণ্টিত হইয়া থাক, তাহা হইলে সে বিভাগের কাগজ কোথায়? মধ্যস্থ দ্বারা তুমি বণ্টিত হইয়াছ, কি আদালত হইতে আমীন আসিয়া তোমাকে বিভাগ করিয়া দিয়াছে? এইসব কথার তুমি আমাকে সঠিক উত্তর দাও! কারণ, আমি তোমাকে কিনিয়া লইবার বাসনা করি। আমার তালুকে অনেক মানুষ আছে, মানুষের অভাব নাই। আমার সম্পত্তি নরনারীগণের দেহে যা রক্ত আছে, তাহাই খায় কে? তবে তুমি রক্তবতীর সহিত 'পচাজল' পাতাইয়াছ, সেইজন্য তোমাকে আমি একবারে কিনিয়া লইতে বাসনা করি। তাহা যদি না করি, তাহা হইলে তোমার অধিকারী মশাগণ আমার নামে আদালতে অভিযোগ উপস্থিত করিতে পারেন। তোমাকে এখান হইতে তাঁহারা পুনরায় লইয়া যাইতে পারেন। আমার রক্তবতী তাহা হইলে কাঁদিবে। আমি আর একটি কথা বলি, এরূপ করিয়া এক গ্রাম হইতে আর এক গ্রামে ভারতবাসীদিগের যাওয়া উচিত নয়। ভারতবাসীদিগের উচিত, আপন আপন গ্রামে বসিয়া থাকা। তাহা করিলে, মশাদিগের মধ্যে সম্পত্তি লইয়া আর বিবাদ হয় না। মশাগণ আপনি আপনি সম্পত্তি সুখে-স্বচ্ছন্দে সম্ভোগ করিতে পারেন! শীঘ্রই আমরা ইহার একটা উপায় করিব। এক্ষণে আমার কথার উত্তর দাও! এখন বল, তোমার মশা-প্রভুর নাম কি?”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “মহাশয়! আমি মৃত্যু সত্য বলিতেছি, আমার মশা-প্রভুর নাম আমি জানি না। মনুষ্যেরা যে মশাদিগের সম্পত্তি, তাহাও আমি জানিতাম না। মশাদিগের মধ্যে যে মানুষেরা বিতরিত, বিক্রীত, ও বণ্টিত হইয়া থাকে, তাহাও আমি জানিতাম না। মশাদিগের যে আবার নাম থাকে, তাহাও আমি জানি না। তা আমি কি করিয়া বলি যে, আমি কোন মশার সম্পত্তি।”

 ক্রোধে মশা প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। রাগে তাঁহার নয়ন আরক্ত হইয়া উঠিল। মশা বলিলেন,— “না, তুমি কিছুই জান না! তুমি কচি খুকীটি! গায়ে কখনও মশা বসিতে দেখ নাই! সে মশাগুলিকে তুমি চেন না! তাহাদের তুমি নাম জান না! তুমি ন্যাকা। পতিহারা সতী হইয়া কেবল পথে পথে কাঁদিতে জান!”

 মশার এইরূপ তাড়নায় কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিলেন। কঙ্কাবতীর পানে চাহিয়া, রক্তবতী চক্ষু টিপিলেন। সে চক্ষু টিপুনীর অর্থ এই যে,— “পচাজল! তুমি কঁদিও না। বাবা বড় রাগী মশা! একে রাগিয়াছেন, তাতে তুমি কাঁদিলে আরও রাগিয়া যাইবেন। চুপ কর, বাবার রাগ এখনি যাইবে।”

 রক্তবতী যা বলিলেন, তাই হইল। কঙ্কাবতীর কান্না দেখিয়া মশা আরও রাগিয়া উঠিলেন। মশা বলিলেন,— “এ কোথাকার প্যানপেনে মেয়েটা র্য্যা। ভ্যানোর ভ্যানের করিয়া কাঁদে দেখ। আচ্ছা। যেসব কথা এতক্ষণ ধরিয়া জিজ্ঞাসা-পড়া করিলাম, তার তুমি কিছুই জান না, বলিলে! এখন একথাটার উত্তর দিতে পরিবে কি না? ভাল এই যেসব মানুষ হইয়াছে, এই যে কোটি কোটি মানুষ ভারতে রহিয়াছে, এসব মানুষ কেন? কিসের জন্য সৃজিত হইয়াছে? একথার এখন আমাকে উত্তর দাও।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মানুষ কেন, কিসের জন্য সৃজিত হইয়াছে? তা, আমি জানি না।”


 মশা বলিলেন,— “এ? মেয়েটা নিতান্ত বোকা! একেবারে বদ্ধ পাগল! কিছু জানে না! এই ভারতের মানুষগুলো বড় বোকা! কাণ্ডজ্ঞান-বিবর্জ্জিত। রক্তবতী শিশু বটে, কিন্তু এর চেয়ে আমার রক্তবতীর লক্ষগুণে বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। তুমি বল তো মা, রক্তবতী, ভারতের মানুষ কিসের জন্য সৃজিত হইয়াছে?”

 রক্তবতী বলিলেন,— “কেন বাবা! আমরা খাব বলিয়া তাই হইয়াছে।”

 মশা বলিলেন,— “এখন শুনিলে? ভারতের মানুষ কিসের জন্য হইয়াছে তা বলিলে?”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন,— “আজ্ঞা হাঁ, এখন বুঝিলাম। মশারা আহার করিবেন বলিয়া তাই মানুষের সৃজন হইয়াছে।”

 “আমার পচাজল মানুষের ছানা বই তো নয়! মানুষদের বুদ্ধিশুদ্ধি নাই, তা সকল মশাই জানে। নির্ব্বোধ মশাকে সকলে মানুষ বলিয়া গালি দেয়। সকলে বলে, 'অমুক মশা ত’ মশা নয়—ওটা মানুষ। তা আমাদের মত পচাজলের বোধ-শোধ কেমন করিয়া হইবে। আমার পচাজলকে বাবা, তুমি আর বকিও না!”

 মশা ভাবিলেন,— “সত্যকথা! মানুষের ছানাটাকে আর কোনও কথা জিজ্ঞাসা করা বৃথা। আমাকে নিজেই সকল সন্ধান লাইতে হইবে।”

 মশা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “বলি হাঁগো মেয়ে! এখন তোমার বাড়ী কোন গ্রামে বল দেখি? তা' বলিতে পরিবে তো?”

 কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন যে, তাঁহাদের গ্রামের নাম কুসুমঘাটী। মশা তৎক্ষণাৎ আপন অনুচরদিগকে কুসুমঘাটী পাঠাইলেন ও কঙ্কাবতীর প্রভুগণকে ডাকিয়া আনিতে আদেশ করিলেন! দূতগণ কুসুমঘাটীতে উপস্থিত হইয়া, অনেক সন্ধানের পর জানিতে পারিলেন যে, কঙ্কাবতীর অধিকারী তিনটি মশা। তাঁহাদের নাম, গজগণ্ড, বৃহৎমুণ্ড ও বিবৃততুণ্ড। রক্তবতীর পিতার নাম দীর্ঘশুণ্ড। দূতগণ শুনিলেন যে, কঙ্কাবতীর অধিকারিগণের বাস আকাশমুখ নামক শালবৃক্ষ। সেইখানে যাইয়া কঙ্কাবতীর অধিকারিগণকে সকল কথা তাঁহারা বলিলেন। তাঁহারা দূতগণের সহিত আসিয়া অবিলম্বে দীর্ঘশুণ্ডের নিকট উপস্থিত হইলেন। অনেক বাদানুবাদ, অনেক দর কষাকষির পর, তিন ছটাক নররক্ত দিয়া, কঙ্কাবতীকে দীর্ঘশুণ্ড কিনিয়া লইলেন! কঙ্কাবতীকে ক্রয় করিয়া তিনি কন্যাকে বলিলেন,— “রক্তবতী! এই নাও, তোমার পচাজল নাও! এ মানুষের ছানাটি এখন আমাদের নিজস্ব, ইহা এখন আমাদের সম্পত্তি।”

 দীর্ঘগুণ্ড, তাহার পর, গজগণ্ড, বৃহৎমুণ্ড, বিবৃততুণ্ড প্রভৃতি মশাগণকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন,— “মহোদয়গণ! আমি দেখিতেছি, আমাদের ঘোর বিপদ উপস্থিত। ভারতবাসীগণের রক্তপান করিয়া পৃথিবীর যাবতীয় মশা এতদিন সুখে-স্বচ্ছন্দে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছিলেন। ভারতের তিনদিকে কালাপানি, একদিকে অত্যুচ্চ পর্ব্বতশ্রেণী। জীবজন্তুগণকে লোকে যেরূপ বেড়া দিয়া রাখে, ভারতবাসীগণকে এতদিন আমরা সেইরূপ আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলাম। ভারতের লোক ভারতে থাকিয়া এতদিন আমাদিগের সেবা করিতেছিল, বিনীতভাবে শোণিত-দান করিয়া আমাদের দেহ পরিপোষণ করিতেছিল। এক্ষণে কেহ কেহ মহাসাগর ও মহা পর্ব্বত উল্লঙ্ঘন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। এরূপ কার্য্য করিয়া রক্ত হইতে বঞ্চিত করিলে যে তাহাদের মহাপাতক হয়, তাহা আপনারা সকলেই জানেন। যেমন করিয়া হউক, ভারতবাসীগণকে সে দুষ্ক্রিয়া হইতে নিবৃত্ত করি। তাহার পর আবার, ভারতবাসীদিগের এক গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে গমনাগমন সুদীর্ঘকাল কিছু অধিক হইয়াছে। এই দেখুন, আজ সন্ধ্যাবেলা কুসুমঘাটী হইতে একটি শাবক আমার দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। সে মনুষ্য-শাবকটি আপনাদের সম্পত্তি আপনার সম্পত্তি পলাইবে, কাল আমার সম্পত্তি পলাইবে। এই প্রকারে মনুষ্যেরা যদি এক গ্রাম হইতে অপর গ্রামে যায়, তাহা হইলে সম্পত্তি লইয়া আমাদের মধ্যে মহা গোলযোগ উপস্থিত হইবে। তাহার পর আবার বুঝিয়া দেখুন, দেশভ্রমণের কি ফল! দেশভ্রমণ করিলে মনুষ্যেরা নানা নূতন বিষয় শিক্ষা করিতে পারে, মনুষ্যদিগের জ্ঞানের উদয় হয়। দেশভ্রমণ করিয়া ভারতবাসীদিগের যদি চক্ষু উন্মীলিত হয়, তাহা হইলে, মনুষ্যগণ আর আমাদের বশতাপন্ন হইয়া থাকিবে না। আবার বাণিজ্যাদি ক্রিয়া দ্বারা ক্রমে তাহারা ধনবান হইয়া উঠিবে। তখন মশারি প্রভৃতি নানা উপায় করিয়া, রক্তপান হইতে আমাদিগকে বঞ্চিত করিবে। অতএব, যাহাতে ভারতবাসীরা বিদেশে গমনাগমন না করিতে পারে, যাহাতে এক গ্রামের লোক অপর গ্রামে যাইতে না পায়, এরূপ উপায় সত্ত্বর আমাদিগকে করিতে হইবে।”

 দীর্ঘশুণ্ডের বক্তৃতা শুনিয়া সকলেই তাঁহাকে ধন্য ধন্য করিতে লাগিলেন। সকলেই বুলিলেন, দীর্ঘশুণ্ড অতি বিচক্ষণ মশা, দীর্ঘশুণ্ডের অতি দূর-দৃষ্টি, এরূপ বিজ্ঞ বুদ্ধিমান মশা পৃথিবীতে আর নাই। ভারতবাসীরা যাহাতে ভবিষ্যতে এক গ্রাম হইতে অন্য গ্রামে যাইতে না পারে, এরূপ উপায় করা অবশ্য-কর্ত্তব্য, তাহা সকলেই স্বীকার করিলেন। মশাগণ অনেক অনুধাবনা— অনেক বিবেচনা করিয়া অবশেষে স্থির করিলেন যে, পণ্ডিতদিগকে আহ্বান করিয়া একটি ভাল বিধি প্রচলিত করিতে হইবে, তবে লোকে সে বিধি প্রতিপালন করিবে; তা না হইলে লোকে মানিবে না। এইরূপ পরামর্শ করিয়া সমাগত মশাবৃন্দ ভারতের মহামহা পণ্ডিতদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলেন। পণ্ডিতগণ উপস্থিত হইলে, দীর্ঘশুণ্ড তাহাদিগকে মশাকুল-অনুমোদিত শাস্ত্রীয় বচন বাহির করিতে অনুরোধ করিলেন যে, এ কলিকালে ভারতবাসীদিগের পক্ষে গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে গমন করা একেবারে নিষিদ্ধ। গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে গমন করিলে অতি মহাপাতক হয়। সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত নাই। তবে কলিকালে ভারতবাসীগণ করিবে কি? কলিকালের ভারতবাসীদিগের নিমিত্ত এই বিধি আছে—

সদা কৃতাঞ্জলিপুটা ব্যংশুকাঃ পিহিতেক্ষণাঃ।
ঘোরান্ধতমসে কূপে সন্তু ভারতবাসিনঃ॥
পিবস্তু রুধিরষ্ণৈষাং যাবান্তো মশকা ভুবি।
অদ্যপ্রভৃতি বৈ লোকে বিধিরোষ প্রবর্ত্তিতঃ।

 ইহার স্থূল অর্থ এই যে,— কলিকালে ভারতবাসীগণ চক্ষে ঠুলি দিয়া, হাতযোড় করিয়া, অন্ধকূপের ভিতর বসিয়া থাকিবে, আর পৃথিবীর যাবতীয় মশা আসিয়া তাহাদিগের রক্ত শোষণ করিবে।

 এইরূপ মনের মত ব্যবস্থা পাইয়া মশাগণ পরম পরিতোষ লাভ করিলেন। পণ্ডিতগণ যথাবিধি বিদায় গ্রহণ করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। অন্যান্য মশাগণও আপনি আপন দেশে প্রতিগমন করিলেন।