কঙ্কাবতী/দ্বিতীয় ভাগ/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

খর্ব্বুর

দীর্ঘশুণ্ড মশা বলিলেন,— “রক্তবতী এক্ষণে মনুষ্য-শাবকটি তোমার। ইহাকে লইয়া তুমি যাহা ইচ্ছা হয় কর।”

 রক্তবতী বলিলেন,— “পিতা! ইনি আমার ভগিনী। ইহার সহিত আমি পচাজল পাতাইয়াছি। আমার পচাজল বিপদে পড়িয়াছে। পচাজলের পতিকে নাকেশ্বরী খাইয়াছে। কাঁদিয়া কাঁদিয়া পচাজল আমার সারা হইয়া গেল। যাহাতে আমার পচাজল আপনার পতি পায়, বাবা, তুমি তাঁহাই কর।”

 কি করিয়া কঙ্কাবতীর পতিকে নাকেশ্বরী খাইয়াছে, মশা আদ্যোপোন্ত সমুদয় বিবরণ শুনিতে ইচ্ছা করিলেন। আগাগোড়া সকল কথা কঙ্কাবতী তাঁহাকে বলিলেন।

 ভাবিয়া-চিন্তিয়া মশা শেষে বলিলেন,— “তুমি আমার রক্তবতীর পচাজল, সে নিমিত্ত তোমার প্রতি আমার স্নেহের উদয় হইয়াছে। তোমাকে আমরা কেহ আর খাইব না। স্নেহের সহিত তোমাকে আমরা প্রতিপালন করিব। যাহাতে তুমি তোমার পতি পাও, সেজন্যও যথাসাধ্য চেষ্টা করিব। আমার তালুকে খর্ব্বর মহারাজ বলিয়া একটি মনুষ্য আছে। শুনিয়াছি, সে নানারূপ ঔষধ নানারূপ মন্ত্র-তন্ত্র জানে। আকাশে বৃষ্টি না হইলে, মন্ত্র পড়িয়া মেঘে সে ছিদ্র করিয়া দিতে পারে। শিলা-বৃষ্টি পড়-পড় হইলে সে নিবারণ করিতে পারে। বৃদ্ধ স্ত্রী দেখিলেই সে বলিতে পারে,— এ ডাইনী কি ডাইনী নয়। তাহাকে দেখিবামাত্র ভূতগণ পলায়ন করে। তাহার মত গুণী মনুষ্য পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নাই। নাকেশ্বরীর হাত হইতে তোমার পতিকে সে-ই উদ্ধার করিতে পরিবে।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “তবে মহাশয় আর বিলম্ব করিবেন না। চলুন, এখনি তাঁহার নিকট

যাই। মহাময়! স্বামী-শোকে শরীর আমার প্রতিনিয়তই দগ্ধ হইতেছে, সংসার আমি শূন্য দেখিতেছি। তাঁহার প্রাণরক্ষা হইবে, কেবল এই প্রত্যাশায় জীবিত আছি। তা না হইলে, কোন কালে এ পাপ প্রাণ বিসৰ্জ্জন দিতাম।”

 মশা বলিলেন,— “অধিক রাত্রি হইয়াছে, তুমি পরিশ্রান্ত হইয়াছ। আমার তালুক নিতান্ত নিকট নয়। তবে রও! আমার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ডাকিতে পাঠাই। তাহার পিঠে চড়িয়া আমরা সকলে এখনি খর্ব্বুর মহারাজের নিকট গমন করিব।”

 মশা এই বলিয়া আপনার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে ডাকিতে পাঠাইলেন। কিছুক্ষণ বিলম্বে মশার ছোটভাই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মশানীগণ তাঁহাকে 'হাতি-ঠাকুর-পো, হাতি-ঠাকুর-পো' বলিয়া অনেক সমাদর ও নানারূপ পরিহাস করিতে লাগিলেন।

 রক্তবতী তাঁহাকে বলিলেন,— “কাকা! আমি একটি মানুষের ছানা পাইয়াছি। তাহার সঙ্গে আমি পচাজল পাতাইয়াছি। আমি পচাজলকে বড় ভালবাসি, আমার পচাজলও আমাকে বড় ভালবাসে।”

 কঙ্কাবতী আশ্চর্য্য হইলেন! মশার ছোটভাই, হাতী! প্রকাণ্ড হস্তী! বনের সকলে তাঁহাকে 'হাতি-ঠাকুর-পো' বলিয়া ডাকে।

 রক্তবতীর পিতা হস্তীকে বলিলেন,— “ভায়া! আমি বড় বিপদে পড়িয়াছি। রক্তবতী একটি মানুষের মেয়ের সহিত পচাজল পাতাইয়াছে। মেয়েটির পতিকে নাকেশ্বৱী খাইয়াছে। মেয়েটি পথে পথে কাঁদিয়া বেড়াইতেছে! রক্তবতীর দয়ার শরীর। রক্তবতী তাঁহার দুঃখে বড় দুঃখী! আমি তাই মনে করিয়াছি, যদি কোনও মতে পারি তো তাহার স্বামীকে উদ্ধার করিয়া দিই। খর্ব্বুর মহারাজের দ্বারাই এ কার্য্য সাধিত হইতে। তাই আমার ইচ্ছা যে, এখনি খর্ব্বুরের নিকট যাই। কিন্তু মানুষের মেয়েটি পথ হাঁটিয়া ও কাঁদিয়া কাঁদিয়া অতিশয় শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে। এত পথ সে চলিতে পারিবে না। এখন ভায়া, তুমি যদি কৃপা কর, তবেই হয়। আমাদিগকে যদি পিঠে করিয়া লইয়া যাও তো বড় উপকার হয়।”

 হাতি-ঠাকুর-পো সে কথায় সম্মত হইলেন। কঙ্কাবতী মশানীদের নমস্কার করিয়া তাঁহাদিগের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।

 রক্তবতীর গলা ধরিয়া কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ভাই পচাজল, তুমি আমার অনেক উপকার করিলে। তোমার দয়া তোমার ভালবাসা, কখনও ভুলিতে পারিব না। যদি ভাই পতি পাই, তবে পুনরায় দেখা হইবে। তা না হইলে, ভাই, এ জনমের মত তোমার পচাজল এই বিদায় হইল!”

 রক্তবতীর চক্ষু ছলছল করিয়া আসিল, রক্তবতীর চক্ষু হইতে অশ্রুবিন্দু ফোঁটায় ফোঁটায় ভূতলে পতিত হইতে লাগিল।

 মশা ও কঙ্কাবতী দুইজনে হাতীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। হাতি-ঠাকুর-পো মৃদুমন্দ গতিতে চলিতে লাগিলেন। যাইতে যাইতে সমস্ত রাত্রি গত হইয়া গেল। অতি প্রত্যুষে খর্ব্বুরের বাটীতে গিয়া সকলে উপস্থিত হইলেন। তাহারা দেখিলেন যে, খর্ব্বুর শয্যা হইতে উঠিয়াছেন। অতি বিষণ্ন-বদনে আপনার দ্বারদেশে বসিয়া আছেন। একটু একটু তখনও অন্ধকার রহিয়াছে। আকাশে কৃষ্ণপক্ষীয় প্রতিপদের চন্দ্র তখনও অস্ত যান নাই। খর্ব্বুরের বিষণ্ন-মূর্ত্তি দেখিয়া আকাশের চাঁদ অতি প্রসন্ন-মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছেন। চাঁদের মুখে আর হাসি ধরে না। চাঁদের হাসি দেখিয়া খর্ব্বুরের রাগ হইতেছে। খর্ব্বুর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন,— “এই চাঁদের একদিন আমি দণ্ড করিব। চাঁদকে যদি উচিত মত দণ্ড না দিতে পারি, তাহা হইলে, খর্ব্বুরের গুণজ্ঞান, তুকতাক মন্ত্র-তন্ত্র, শিকড়-মাকড়, সবই বৃথা।”

 মশা, কঙ্কাবতী ও হস্তী গিয়া খর্ব্বুরের দ্বারে উপস্থিত হইলেন। মশাকে দেখিয়া খর্ব্বুর

শশব্যস্ত হইয়া উঠিলেন।

 হাতযোড় করিয়া খর্ব্বুর বলিলেন,— “মহাশয়! আজি প্রাতঃকালে কি মনে করিয়া? প্রতিদিন তো সন্ধ্যার সময় আপনার শুভাগমন হয়। আজ দিনের বেলা কেন? ঘরে কুটুম্বসাক্ষাৎ আসিয়াছেন না কি? তাই কনিষ্ঠকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন যে, তাহার পিঠে বোঝাই দিয়া প্রচুর পরিমাণে রক্ত লইয়া যাইবেন?”

 মশা উত্তর করিলেন,— “না, তা নয়! সেজন্য আমি আসি নাই; কি জন্য আসিয়াছি, তাহা বলিতেছি। আপাততঃ জিজ্ঞাসা করি, তুমি বিষণ্নমুখে বসিয়া আছ কেন? এরূপ বিষণ্ন-বদনে থাকা তো উচিত নয়! মনোদুঃখে থাকিতে তোমাদিগকে আমি বারবার নিষেধ করিয়াছি। মনের সুখে না থাকিলে, শরীরে রক্ত হয় না, সে রক্ত সুস্বাদু হয় না। মনের সুখে যদি তোমরা না থাকিবে, পুষ্টকর তেজস্কর দ্রব্যসামগ্রী যদি আহার না করিবে, তবে তোমাদের রক্তহীন দেহে বসিয়া আমাদের ফল কি? তোমরা সব যদি নিয়ত এরূপ অন্যায় কার্য্য করবে, তবে আমরা পরিবারবর্গকে কি করিয়া প্রতিপালন করিব? তোমাদের মনে কি একটু ত্রাস হয় না যে, আমাদের গায়ে বসিয়া মশাপ্রভু যদি সুচারুরূপে রক্তপান করিতে না পান, তাহা হইলে, তিনি আমাদিগের উপর রাগ করিবেন?”

 খর্ব্বুর বলিলেন,— “প্রভু! শীর্ণ হইয়া যাইতেছি সত্য। আমার শরীরে ভালরূপ সুস্বাদু রক্ত না পাইলে, মহাশয় যে রাগ করবেন, তাহাও জানি। কিন্তু কি করিব, স্ত্রীর তাড়নায় আমার এই দশা ঘটিয়াছে।”

 মশা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কেন? কি হইয়াছে? তোমার স্ত্রী তোমার প্রতি কিরূপ অত্যাচার করেন?”

 খর্ব্বুর উত্তর করিলেন,— “প্রভু! আমাদের স্ত্রী-পুরুষে সর্ব্বদা বিবাদ হয়। দিনের মধ্যে দুইতিন বার মারামারি পর্যন্ত হইয়া থাকে। কিন্তু দুঃখের কথা আর মহাশয়কে কি বলিব! আমি হইলাম, তিন হাত লম্বা, আমার স্ত্রী হইলেন, সাত হাত লম্বা। যখন আমাদের মারামারি হয়, তখন আমার স্ত্রী নাগরা জুতা লইয়া ঠনঠন করিয়া আমার মস্তকে প্রহার করেন। আমি ততদূর নাগাল পাই না; আমি যা মারি, তা কেবল তাঁর পিঠে পড়ে। স্ত্রীর প্রহারের চোটে অবিলম্বেই আমি কাতর হইয়া পড়ি, আমার প্রহারে স্ত্রীর কিন্তু কিছুই হয় না; সুতরাং স্ত্রী নিকটে আমি সর্ব্বদাই হারিয়া যাই। এক মার খাইয়া, তাতে মনঃক্লেশে শরীর আমার শীর্ণ হইয়া যাইতেছে, দেহে আমার রক্ত নাই। সেজন্য মহাশয় রাগ করিতে পারেন, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি কি করিব? আমার অপরাধ নাই।”

 মশা বলিলেন,— “বটে! আচ্ছা, তুমি এক কর্ম্ম কর। আজ হাতী ভায়ার পিঠে চড়িয়া তুমি স্ত্রীর সহিত মারামারি কর।”

 এই বলিয়া মশা খর্ব্বুরকে হাতীটি দিলেন। খর্ব্বুর হাতীর পিঠে চড়িয়া বাড়ীর ভিতর গিয়া স্ত্রীর সহিত বিবাদ করিতে লাগিলেন। কথায় কথায় ক্রমে মারামারি আরম্ভ হইল। খর্ব্বুর আজ হাতীর উপর বসিয়া মনের সুখে ঠনঠন করিয়া স্ত্রীর মাথায় নাগরা জুতা মারিতে লাগিলেন। আজ স্ত্রী যাহা মারেন, খর্ব্বুরের গায়ে কেবল সামান্যভাবে লাগে। যখন তুমুল যুদ্ধ বাঁধিয়া উঠিল, মশার তখন আর আনন্দের পরিসীমা রহিল না। মশার হাত নাই যে, হাততালি দিবেন, নখ নাই যে নখে-নখে ঘর্ষণ করবেন! তাই তিনি কখনও এক পা তুলিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন, কখনও দুই পা তুলিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন ও গুনগুন করিয়া “নারদ নারদ” বলিতে লাগিলেন। অবিলম্বেই আজ খর্ব্বুরের স্ত্রীকে পরাভব মানিতে হইল। খর্ব্বুরের মন আজ আনন্দে পরিপূর্ণ হইল। খর্ব্বুরের ধমনী ও শিরায় প্রবলবেগে আজ শোণিত সঞ্চালিত হইতে লাগিল। মশা, সেই রক্ত একটু চাকিয়া দেখিলেন, দেখিয়া বলিলেন,— “যাঃ! অতি সুমিষ্ট, অতি সুস্বাদু!”

 মশা মহাশয়কে খর্ব্বুর শত শত ধন্যবাদ দিলেন ও কি জন্য তাঁহাদের শুভাগমন হইয়াছে, সে কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। কঙ্কাবতী ও নাকেশ্বরীর বিবরণ মশা মহাশয় আদ্যোপান্ত তাহাকে শুনাইলেন। সমস্ত বিবরণ শুনিয়া খর্ব্বুর বলিলেন,— “আপনাদের কোনও চিন্তা নাই। নাকেশ্বরীর হাত হইতে আমি ইহার পতিকে উদ্ধার করিয়া দিব। ভূত, প্রেতিনী, ডাকিনী, সকলেই আমাকে ভয় করে। চলুন, আমাকে সেই নাকেশ্বরীর ঘরে লইয়া চলুন, দেখি সে কেমন নাকেশ্বৱী!”

 মশা বলিলেন,— “এবার চল! কিন্তু তোমাদের চলাচলি সব শেষ হইল। বড় সব জাহাজে চড়িয়া, কোথায় রেঙ্গুন, কোথায় বিলাত, এখানে ওখানে সেখানে যাইতে আরম্ভ করিয়াছে! বড় সব রেলগাড়ী করিয়া এ-দেশ ও-দেশ করিতেছ! রও, এবারকার শাস্ত্র একবার জারি হইতে দাও, তাহা হইলে টের পাবে।”

 খর্ব্বুর জিজ্ঞাসা করিলেন,— “এবার শাস্ত্রে আমাদের গমনাগমন একেবারেই নিষিদ্ধ হইল না কি? গাছগাছড়া আনিতে যাইতেও পাইব না?”

 মশা উত্তর করিলেন,— “না! এখানকার শাস্ত্রে লেখা আছে যে, ঘর হইতে তোমরা আর একেবারেই বাহির হইতে পরিবে না। সকলকে অন্ধকূপ খনন করিতে হইবে, চক্ষে ঠুলি দিয়া সকলকে সেই অন্ধকূপে বসিয়া থাকিতে হইবে। অন্ধকূপ হইতে বাহির হইলে, কি চক্ষুর ঠুলিটি খুলিলে, পাপ হইবে, জাতি যাইবে, আর 'এক-ঘোরে’ হইয়া থাকিতে হইবে। যেমন-তেমন পাপ নয়, সেই যারে বলে পাতক। কেবল পাতক নয়, যারে বলে মহাপাতক। শুধু মহাপাতক নয়, সেই যারে বলে অতি মহাপাতক। কেন। বড় যে সব জাহাজ চড়া, রেল চড়া, লেখাপড়া শেখা, মশারি করা! এইবার?”

 খর্ব্বুর বলিলেন,— “আপনারা মহাপ্রভু! যেরূপ শাস্ত্র করিয়া দিবেন, আমাদিগকে মানিতে হইবে। আপনারা আমাদিগের হর্ত্তা-কর্ত্তা-বিধাতা। আপনারা সব করিতে পারেন।”

 মশা, কঙ্কাবতী ও খর্ব্বুর হন্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া বনাভিমুখে যাত্রা করিলেন। প্রায় দুই প্রহরের সময় পর্ব্বতের নিকট উপস্থিত হইলেন।