কঙ্কাবতী/দ্বিতীয় ভাগ/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


সপ্তম পরিচ্ছেদ

নক্ষত্রদের বৌ

খোক্কোশের বাচ্ছা ধরিয়া আকাশে উঠিবার কথা নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী বসিয়া বসিয়া শুনিল। তাহারা দুইজনে পরামর্শ করিতে লাগিল যে,— “যদি এই কাজটি নিবারণ করিতে পাৱা যায়, তাহা হইলে খর্ব্বুর আর আমাদের দোষ দিতে পারবে না, অথচ খাদ্যটিও আমাদের হাতছাড়া হইবে না।”

 মাসী বলিল,— “বৃদ্ধ হইয়াছি। এখন পৃথিবীর অর্দ্ধেক দ্রব্যে অরুচি। এইরূপ কোমল রসাল মাংস খাইতে এখন সাধ হয়। যদি ভাগ্যক্রমে একটি মিলিল, তাও বুঝি যায়!"

 নাকেশ্বরী বলিল,— “মাসি, তুমি এক কর্ম্ম কর! তোমার ঝুড়িতে বসিয়া তুমি গিয়া আকাশে উঠ। সমস্ত আকাশ তুমি একেবারে চুণখাম করিয়া দাও। ভাল করিয়া দেখিয়া-শুনিয়া চূণখাম করিবে, কোথাও যেন একটু ফাঁক না রহিয়া যায়! তুমি তোমার চশমা নাকে দিয়া যাও, তাহা হইলে ভাল করিয়া দেখিতে পাইবে। চুণখাম করিয়া দিলে ঠুড়ি আর আকাশের ভিতর যাইতে পথ পাইবে না, চাঁদও দেখিতে পাইবে না, চাঁদের মূল-শিকড়ও কাটিয়া আনিতে পরিবে না।”

 দুইজনে এইরূপ পরামর্শ করিয়া মাসী গিয়া ঝুড়িতে বসিল। বুড়ি হু-হু শব্দে আকাশে উঠিল। সমস্ত আকাশে নাকেশ্বরীর মাসী চুণখাম করিয়া দিল।

 অট্টালিকা হইতে বাহির হইবার সময়ে মশা দেখিলেন যে, সেখানে একটি ঢাক পড়িয়া রহিয়াছে। মশা সেই ঢাকটি সঙ্গে লইলেন। বাহিরে আসিয়া কঙ্কাবতী ও মশা, হন্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। যে বনে খোক্কোশের বাচ্ছা হইয়াছে, সেই বনে সকলে চলিলেন। সন্ধ্যার পর খোক্কোশের গর্ত্তের নিকট উপস্থিত হইলেন।

 একবার আকাশপানে চাহিয়া মশা বলিলেন,— “কি হইল? আজি দ্বিতীয়ার রাত্রি, চাঁদ এখনও উঠিলেন না কেন? মেঘ করে নাই, তবে নক্ষত্র সব কোথায় গেল? আকাশ এরূপ শুভ্রবর্ণ ধারণ করিল কেন?”

 ধাড়ী-খোক্কোশ আপনার বাচ্ছা চৌকি দিয়া গর্ত্তে বসিয়া আছে! একে রাত্রি, তাতে নিবিড় অন্ধকার বন। দূর হইতে ধাড়ী-খোক্কোশ কঙ্কাবতীর গন্ধ পাইল।

ভয়ঙ্কর চীৎকার করিয়া ধাড়ী-খোক্কোশ বলিল,— “হাউ মাউ খাঁউরে, মনুষ্যের গন্ধ পাঁউরে! কেরা তোরা, এদিকে আসিস?”

 মশা, চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তুই কে?”

 খোক্কোশ বলিল,— “আমি আবার কে! আমি খোক্কোশ!”

 মশা বলিলেন,— “আমরা আবার কে! আমরা ঘোক্কোশ।”

 এই উত্তর শুনিয়া খোক্কোশের ভয় হইল। খোক্কোশ বলিল,— “বাপ রে! তবে তো তোরা কম নয়? ক, খ, গ, ঘ, আমি খ-য়ে তোরা ঘ-য়ে, আমার চেয়ে তোরা দুই পৈঠা উঁচু! আচ্ছা, কেমন তোরা ঘোক্কোশ, একবার কাস দেখি, শুনি?”

 মশা তখন সেই ঢাকটি ঢং-চং করিয়া বাজাইলেন। সেই শব্দ শুনিয়া খোক্কোশ বলিল,— “ওরে বাপ রে! তোদের কাসির কি শব্দ! শুনলে ভয় হয়, কানে তালা লাগে! তোরা ঘোক্কোশ বটে!”

 খোক্কোশ। কিন্তু সন্দিগ্ধচিত্ত। এরূপ অকাট্য প্রমাণ পাইয়াও তবু তাহার মনে সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল না। তাই সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল,— “আচ্ছা তোরা কেমন ঘোক্কোশ, তোদের

মাথার একগাছা চুল ফেলিয়া দে দেখি?”

 এই কথা বলিতে, মশা হাতীর কাছিগাছটি ফেলিয়া দিলেন। খোক্কোশ তাহা হাতে করিয়া দেখিতে লাগিল। অনেকক্ষণ দেখিয়া শেষে বলিল,— “ওরে বাপ রে! এই কি তোদের মাথার চুল! তোদের চুল যখন এতবড়, এত মোটা, তখন তোরা না জানি কতবড়, কত মোটা। তোদের সঙ্গে পারা ভার!"

 তবুও কিন্তু খোক্কোশের মনে সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল না। ভাবিয়া-চিন্তিয়া খোক্কোশ পুনরায় বলিল,— “আচ্ছা, তোরা যদি ঘোক্কোশ, তবে তোদের মাথার একটা উকুন ফেলিয়া দে দেখি?”

 মশা বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! শীঘ্র হাতীর পিঠ হইতে নামো।”

 তাহার পর মশা হাতীকে বলিলেন,— “হাতী ভায়া! এইবার!”

 এই কথা বলিয়া মশা, হাতীটিকে ধরিয়া, খোক্কোশের গর্ত্তে ফেলিয়া দিলেন। গর্ত্তে পড়িয়া হাতী শুড় দিয়া খোক্কোশের বাচ্ছাটিকে ধরিলেন। খোক্কোশের বাচ্ছা ‘চ্যা-চ্যা’ শব্দে ডাকিয়া, স্বৰ্গ মর্ত্ত্য পাতাল তোলপাড় করিয়া ফেলিল। শুড় বিশিষ্ট পর্ব্বতাকার উকুন দেখিয়া, ত্রাসে খোক্কোশের প্রাণ উড়িয়া গেল। খোক্কোশ ভাবিল,— “তোদের মাথার উকুন আসিয়া তো আমার বাচ্ছাটিকে ধরিল, ঘোক্কোশেরা নিজে আসিয়া আমাকে না ধরে!” এই মনে করিয়া খোক্কোশ বাচ্ছা ফেলিয়া উড়িয়া পলাইল।

 মশা ও কঙ্কাবতী তখন সেই গর্ত্তের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 মশা বলিলেন,— “কঙ্কাবতী। তুমি এখন ইহার পৃষ্ঠে আরোহণ কর। খোক্কোশ-শাবকের পিঠে চড়িয়া তুমি এখন আকাশে গিয়া উঠ, চাঁদের শিকড় লইয়া পুনরায় এইখানে আসিবে। তোমার প্রতীক্ষায় এইখানে আমরা বসিয়া রহিলাম। তুমি আসিলে, আমরা খোক্কোশের বাচ্ছাটিকে ফিরিয়া দিব। কারণ, এখনও এ স্তন্যপান করে, অতি শিশু; ইহাকে লইয়া আমরা কি করিব? যাহা হউক, তুমি এখন আকাশের দোর্দণ্ড সিপাহীর হাত হইতে রক্ষা পাইলে হয়। শুনিয়াছি, সে অতি ভয়ঙ্কর দোর্দণ্ড-প্রতাপান্বিত সিপাহী। সাবধানে আকাশে উঠিবে।”

 আকাশপানে চাহিয়া মশা পুনরায় বলিলেন,— “কঙ্কাবতী! আমার কিছু আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে। আজ দ্বিতীয়ার রাত্রি, চাঁদ উঠিবার সময় অনেকক্ষণ উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু চাঁদও দেখিতে পাই না, নক্ষত্রও দেখিতে পাই না। অথচ মেঘ করে নাই। কালো মেঘে না ঢাকিয়া, সমস্ত আকাশ বরং শুভ্রবর্ণ হইয়াছে; ইহার অর্থ আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। ইহার কারণ কি? আকাশে উঠিলে হয়তো তুমি বুঝিতে পরিবে। অতি সাবধানে আপনার কার্য্য উদ্ধার করিবে।”

 কঙ্কাবতী খোক্কোশ-শাবকের পিঠে চড়িয়া আকাশের দিকে তাহাকে পরিচালিত করিলেন, দ্রুতবেগে খোক্কোশ-শাবক উড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতী অবিলম্বে আকাশের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন।

 আকাশের কাছে গিয়া কঙ্কাবতী দুয়ে সমুদয় আকাশে চূণখাম করা। কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “এ কি প্রকার কথা। পর এরূপ চুণখাম করিয়া কে দিলো?”

 আকাশের উপর উঠিতে কঙ্কাবতী আর পথ পান না। যেদিকে যান, সেইদিকেই দেখেন চুন-খাম। আকাশের একধার হইতে অন্য ধারা পর্যন্ত ঘুরিয়া বেড়াইলেন, পথ কিছুতেই পাইলেন না! সব চূণখাম। কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “ঘোর বিপদ! আকাশের উপর এখন উঠি কি করিয়া?”

 হতাশ হইয়া, আকাশের চারিধারে কঙ্কাবতী পথ খুঁজিতে লাগিলেন। অনেক অন্বেষণ করিয়া, সহসা একস্থানে একটি সামান্য ছিদ্র দেখিতে পাইলেন। সেই ছিদ্রটি দিয়া নক্ষত্রদের বৌ উঁকি মারিতেছিল। কঙ্কাবতী সেই ছিদ্রটির নিকট যাইলেন। কঙ্কাবতীকে দেখিয়া নক্ষত্রদের বৌ একবার লুকাইল, পুনরায় আবার ভয়ে ভয়ে উঁকি মারিতে লাগিল।

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ওগো নক্ষত্রদের বৌ! তোমার কোন ভয় নাই! আমিও মেয়েমানুষ, আমাকে দেখিয়া আবার লজ্জা কেন বাছা!”

 নক্ষত্রদের বৌ উত্তর করিল,— “কে গা মেয়েটি তুমি? তোমার কথাগুলি বড় মিষ্ট! অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতেছি, তুমি চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ। তাই মনে করিলাম, তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, কি তুমি খুজিতেছি? কিন্তু হাজার হউক, আমি বৌমানুষ, সহসা কি কাহারও সঙ্গে কথা কহিতে পারি? তাতে রাত্রিকাল! একটু আস্তে কথা কও, বাছা! আমার ছেলেপিলেরা সব শুয়েছে, এখনি জাগিয়া উঠিবে, কাচা ঘুম ভাঙ্গিলে কাঁদিয়া জ্বালাতন করিবে।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ওগো! নক্ষত্রদের বৌ। আমার নাম কঙ্কাবতী! আমি পতিহারা সতী! আমি বড় অভাগিনী। আকাশের ভিতর যাইবার নিমিত্ত পথ অন্বেষণ করিতেছি। তা আজ এ কি হইয়াছে, বাছা, পথ কেন পাই না? একবার আকাশের ভিতর উঠিতে পারিলে আমার পতির প্রাণরক্ষা হয়। বাছা! তুমি যদি পথটি বলিয়া দাও, তো আমার বড় উপকার হয়।”

 নক্ষত্রদের বৌ উত্তর করিল, “পথ আর বাছা, তুমি কি করিয়া পাইবে? এই সন্ধ্যাবেলা এক বেটী ভূতিনী-বুড়ী আসিয়া আকাশের উপর সব চূণখাম করিয়া দিয়াছে। ও যাই হউক, আমি চুপি চুপি তোমাকে আকাশের খিড়কি-দ্বারটি খুলিয়া দিই। সেই পথ দিয়া তুমি আকাশের ভিতর প্রবেশ কর।”

 এই কথা বলিয়া, নক্ষত্রদের বৌ চুপি চুপি আকাশের খিড়কি-দ্বারটি খুলিয়া দিল। সেই পথ দিয়া কঙ্কাবতী আকাশের উপর উঠিলেন।