কঙ্কাবতী/দ্বিতীয় ভাগ/পরিশেষ

উইকিসংকলন থেকে

পরিশেষ

অতি সুখনিদ্রা! অতি শান্তিদায়িনী নিদ্রা।

 বৈদ্য বলিলেন,— “এই যে নিদ্রাটি দেখিতেছেন, ইহা সুনিদ্রা। বিকারের ঘোর নহে। বিকার কাটিয়া গিয়াছে। নাড়ী পরিষ্কার হইয়াছে। এক্ষণে বাড়ীতে যেন শব্দ হয় না! নিদ্রাটি যেন ভঙ্গ হয় না!”

 বৈদ্য প্রস্থান করিলেন। অঘোর অচৈতন্য হইয়া রোগী নিদ্রা যাইতে লাগিলেন। বাড়ীতে সকলেই চুপি চুপি কথা কহিতে লাগিলেন। বাড়ীতে পিপীলিকার পদশব্দটি পর্যন্ত নাই।

 মাতা কাছে বসিয়া রহিলেন। এক একবার কেবল কন্যার নাসিকার নিকট হাত রাখিয়া দেখিতে লাগিলেন, রীতিমত নিশ্বাস-প্রশ্বাস বহিতেছে কি না?

 আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া, মা আজ বাইশ দিন কন্যার নিকট এইরূপে বসিয়া আছেন। প্রাণসম কন্যাকে লইয়া যমের সহিত তুমুল যুদ্ধ করিতেছেন। প্রবল বিকারের উত্তেজনায় কন্যা যখন উঠিয়া বসেন, মা তখন আস্তে আস্তে পুনরায় তাহাকে শয়ন করান। বিকারের প্রলাপে কন্যা যখন চীৎকার করিয়া উঠেন, মা তখন তাঁহাকে চুপ করিতে বলেন। সুধাময় মা'র বাক্য শুনিয়া বিকারের আগুনও কিছুক্ষণের নিমিত্ত নির্ব্বাণ হয়।

 কন্যা নিদ্রিত! চক্ষু মুদ্রিত করিয়া আছেন। বহুদিন অনাহারে, প্রবল দুরন্ত জ্বরে ঘোরতর বিকারে, দেহ এখন তাঁর শীর্ণ, মুখ এখন মলিন। তবুও তাঁর মধুর রূপ দেখিলে সংসার সুন্দর বলিয়া প্রতীতি হয়। অনিমিষনয়নে মা সেই অপূর্ব্ব রূপরাশি অবলোকন করিতেছেন।

 রাত্রি প্রভাত হইল। বেলা হইল। তবুও রোগীর নিদ্রাভঙ্গ হইল না। মা কাছে বসিয়া রহিলেন। নিঃশব্দে ভগিনী আসিয়া মা'র কাছে বসিলেন।

 রোগীর ওষ্ঠীদ্বয় একবার ঈষৎ নড়িল। অপরিস্ফুট স্বরে কি বলিলেন। শুনিবার নিমিত্ত ভগিনী মস্তক অবনত করিলেন। শুনিতে পাইলেন না, বুঝিতে পারিলেন না।

 আবার ওষ্ঠ নড়িল, রোগী আবার কি বলিলেন। মা এইবার সে কথা বুঝিতে পারিলেন। মা বলিলেন,— “খেতু খেতু করিয়াই বাছা আমার সারা হইলেন, আজ কয়দিন মুখে কেবল ঐ নাম। এখন যদি চারিহাত এক করিতে পারি, তবেই মনের কালি যায়।”

 মা’র সুমধুর কণ্ঠ-স্বর কন্যার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। সম্পূর্ণরূপে জাগরিত হইয়া, ধীরে ধীরে তিনি চক্ষু উন্মীলন করিলেন। বিস্মিতবদনে চারিদিক নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।

 মা বলিলেন,— “বিকার সম্পূর্ণরূপে এখনও কাটে নাই। চক্ষুতে এখনও সুদৃষ্টি হয় নাই। তনু রায় একটু কাছে বসিলেন। স্নেহের সহিত কন্যার গায়-মাথায় একটু হাত বুলাইলেন। তাহার পর বাহিরে চলিয়া গেলেন।

 কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “মা, ভগিনী পিতা সকলেই দেখিতেছি আমার সহিত স্বৰ্গে আসিয়াছেন। পৃথিবীতে পিতার স্নেহ কখনও পাই নাই। আজ স্বর্গে আসিয়া পাইলাম। পৃথিবীতে আমাদের যেরূপ বাড়ী, আমার যেরূপ ঘর ছিল, স্বর্গেও দেখিতেছি সেইরূপ। কিন্তু যাহার সহিত সহমরণ যাইলাম, তিনি কোথায়?

 অনেকক্ষণ কঙ্কাবতী তার প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন। তিনি আসিলেন না। অবশেষে কঙ্কাবতী মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,— “মা, তিনি কোথায়?”

 মা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তিনি কে?”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “সেই যিনি বাঘ হইয়াছিলেন।”

 মা বলিলেন,— “এখনও ঘোর বিকার রহিয়াছে, এখনও প্রলাপ রহিয়াছে!”

 মা'র কথা শুনিয়া কঙ্কাবতী চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। শরীর তাঁহার নিতান্ত দুর্ব্বল, তাহা তিনি বুঝিতে পারিলেন। অল্প অল্প করিয়া তাঁহার পূর্ব্বকথা সব স্মরণপথে আসিতে লাগিল।

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “মা! আমার কি অতিশয় পীড়া হইয়াছিল?”

 মা বলিলেন,— “হাঁ বাছা! আজ বাইশ দিন তুমি শয্যাগত। তোমার কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না। এবার যে তুমি বাঁচিবে, সে আশা ছিল না।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মা! আমি আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিয়াছি। স্বপ্লটি আমার মনে এরূপ গাঁথা রহিয়াছে যে, প্রকৃত ঘটনা বলিয়া আমার বিশ্বাস হইতেছে। এখন আমার মনে নানা কথা আসিতেছে। তাহার ভিতর আবার কোনটি স্বপ্ন, তাহা আমি স্থির করিতে পারিতেছি না। তাই মা তোমাকে গুটিকত কথা জিজ্ঞাসা করি। আচ্ছা মা! জনার্দ্দন চৌধুরীর স্ত্রী-বিয়োগ হইয়াছে, সেকথা সত্য?”

 মা বলিলেন,— “সেকথা সত্য। তাই লইয়াই তো আমাদের যত বিপদ!”

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “মা! বরফ লইয়া কি দলাদলি হইয়াছিল, সেকথা কি সত্য?”

 মা উত্তর করিলেন,— “হাঁ বাছা! সেকথাও সত্য। সেই কথা লইয়া পাড়ার লোকে খেতুর মাকে কত অপমান করিয়াছিল।”

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তিনি এখন কোথায় মা!”

 মা বলিলেন,— “তিনি আসেন এই। সমস্ত দিন এইখানেই থাকেন। আমার চেয়ে তিনি তোমাকে ভালবাসেন। তাঁর হাতে তোমাকে একবার সঁপিয়া দিতে পারিলেই, এখন আমার সকল দুঃখ যায়। কর্ত্তার মত হইয়াছে, সকলের মত হইয়াছে, এখন তুমি ভাল হইলেই হয়।”

 কঙ্কাবতী বুঝিলেন যে, তবে খেতুর মা'র মৃত্যু হয় নাই, সে কথাটি স্বপ্ন।

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করলেন,— “এই দলাদলির পর আমার জ্বর হয়, না মা?”

 মা বলিলেন,— “এই সময় তোমার জ্বর হয় তুমি একেবারে অজ্ঞান অচৈতন্য হইয়া পড়। তোমার ঘোরতর জ্বর-বিকার হয়। আজ বাইশ দিন।

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “তাহার পর, মা, আমি নদীর ঘাটে গিয়া একখানি নৌকার উপর চড়ি, না মা?”

 মা বলিলেন,— “বালাই! তুমি নৌকায় চড়িবে কেন মা? সেই অবধি তুমি শয্যাগত।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “মা! কত যে কি আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিয়াছি, তাহা আর তোমায় কি বলিব; সেসব কথা মনে হইলে, হাসিও পায় কান্নাও পায়। স্বপ্নে দেখিলাম কি মা, যে, গায়ের জ্বালায় আমি নদীর ঘাটে গিয়া জল মাখিতে লাগিলাম। তাহার পর একখানি নৌকাতে চড়িয়া নদীর মাঝখানে যাইলাম। নৌকাখানি আমার ডুবিয়া গেল। মাছেরা আমাকে তাদের রাণী করিল। তাহার পর কিছুদিন গোয়ালিনী মাসীর বাড়ীতে রহিলাম। সেখান হইতে শ্মশানঘাটে যাইলাম। তাহার পর পুনরায় বাড়ী আসিলাম। একবৎসর পরে আমাদের বাটীতে একটি বাঘ আসিল। সেই বাঘের সহিত আমি বনে যাইলাম। তারপর ভূতিনী, ব্যাঙ, মশা কত কি দেখিলাম। তারপর মা আকাশে উঠিলাম, কত কি করিলাম, কত কি দেখিলাম, স্বপ্নটি যেন আমার ঠিক সত্য বলিয়া বোধ হইতেছে। হা মা! সে দলাদলির কি হইল?”

 মা উত্তর করিলেন,— “সে দলাদলি সব মিটিয়া গিয়াছে। যখন তোমার সমূহ পীড়া, যখন তুমি অজ্ঞান অভিভূত হইয়া পড়িয়া আছ, আজ আট-নয় দিনের কথা আমি বলিতেছি, সেই সময় জনার্দ্দন চৌধুরীর একটি পৌত্রের হঠাৎ মৃত্যু হইল। জনার্দ্দন চৌধুরী সেই পৌত্রটিকে অতিশয় ভালবাসিতেন। তিনি শোকে অধীর হইয়া পড়িলেন। সেই সময় গোবৰ্দ্ধন শিরোমণিরও সঙ্কটাপন্ন পীড়া হইল। আর আমাদের বাটীতে তো তোমাকে লইয়া সমূহ বিপদ। জনার্দ্দন চৌধুরীর সুমতি হইল। তিনি রামহরিকে আনিতে পাঠাইলেন। রামহরি সপরিবারে কলিকাতা হইতে দেশে আসিলেন। রামহরির সহিত জনার্দ্দন চৌধুরী অনেকক্ষণ পরামর্শ করিলেন। তাহার পর রামহরি নিরঞ্জনকে ডাকিয়া আনিলেন। রামহরি, নিরঞ্জন, আমাদের কর্ত্তাটি ও খেতু সকলে মিলিয়া জনার্দ্দন চৌধুরীর বাটীতে যাইলেন। জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— 'আমি পাগল হইয়াছিলাম যে, এই বৃ্দ্ধবয়সে 'আমি পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা' করিয়াছিলাম। নিরঞ্জনকে আমি দেশত্যাগী করিয়াছি, খেতু বালক, তাহার প্রতি আমি ঘোরতর অত্যাচার করিয়াছি। সেই অবধি নানাদিকে আমাদের অনিষ্ট ঘটিতেছে। লোকের টাকা আত্মসাৎ করিয়া ষাঁড়েশ্বর কয়েদ হইয়াছে। গোবৰ্দ্ধন শিরোমণি পক্ষাঘাত রোগে মরণাপন্ন হইয়া আছেন। বৃদ্ধবয়সে আমাকে এই দারুণ শোক পাইতে হইল। এঁর কন্যাটিও রক্ষা পাওয়া ভার।' এই কথা বলিয়া তিনি নিরঞ্জনকে অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া তাঁহার ভূমি ফিরিয়া দিলেন। নিরঞ্জন এখন আপনার বাটীতে বাস করিতেছেন। খেতুকে অনেক আশীর্ব্বাদ করিয়া জনার্দ্দন চৌধুরী সান্ত্বনা করিলেন। আমাদের কর্ত্তাটি আর সে মানুষ নাই। এক্ষণে তাঁহার মনে স্নেহ-মায়া, দয়া-ধর্ম্ম হইয়াছে। বিপদে পড়িলে লোকের এইরূপ সুমতি হয়। তোমার দাদাও এখন আর সেরূপ নাই। মাকে যেরূপ আস্থা-ভক্তি করিতে হয়, সুপুত্রের মত তোমার দাদাও এক্ষণে আমাকে আস্থা-ভক্তি করে। তোমার পীড়ার সময় তোমার দাদা অতিশয় কাতর হইয়াছিল। তুমি ভাল হইলে খেতুর সহিত তোমার বিবাহ হইবে। এবার আর একথার অন্যথা হইবে না। তোমার পীড়ার সময় খেতু, খেতুর মা, রামহরি, সীতা প্রভৃতি সকলেই প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়াছেন। এক্ষণে সকল কথা শুনিলে, এখন আর অধিক কথা কহিয়া কাজ নাই। এখনও তুমি অতিশয় দুর্ব্বল। পুনরায় অসুখ হইতে পারে।”

 কঙ্কাবতী অনেক দিন দুর্ব্বল রহিলেন। ভাল হইয়া সারিতে তাঁহার অনেক বিলম্ব হইল। সীতা তাঁহার নিকট আসিয়া সর্ব্বদা বসিতেন। স্বপ্নকথা তিনি সীতার নিকট সমুদয় গল্প করিলেন। সীতা মাকে বলিলেন, বৌদিদি খেতুকে বলিলেন, এইরূপে কঙ্কাবতীর আশ্চর্য্য স্বপ্নকথা পাড়ার স্ত্রী-পুরুষ সকলেই শুনিলেন। স্বপ্নকথা আদ্যোপান্ত শুনিয়া কঙ্কাবতীর উপর সীতার বড় অভিমান হইল।

 সীতা বলিলেন,—"সমুদয় নক্ষত্রগুলি তুমি নিজে পরিলে, আর আপনার পচাজলকে দিলে। আমার জন্য একটিও রাখিলে না। আমাকে তুমি ভালবাস না, তুমি তোমার পচাজলকে ভালবাস। আমি তোমার সহিত কথা কহিব না।”

 কঙ্কাবতী সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিলেন। পূর্বের ন্যায় পুনরায় সবল হইলেন। পীড়া হইতে উঠিয়া তিনি খেতুর সম্মুখে একটু-আধটু বাহির হইতেন। একদিন খেতু কঙ্কাবতীদের বাড়ীতে গিয়াছিলেন। সেইখানে একটি মশা উড়িতেছিল। খেতু সেই মশাটিকে ধরিয়া কঙ্কাবতীকে জিজ্ঞাসা করিলেন,— “দেখ দেখি কঙ্কাবতী! এই মশাটি তো তোমার ‘পচাজল” নয়? আহা! রক্তবতী আজ অনেকদিন তাহার পচাজলকে দেখিতে পায় নাই। তাহার মন কেমন করিতেছে। তাই সে হয়তো তোমাকে খুজিতে আসিয়াছে।”

 লজ্জায় কঙ্কাবতী গিয়া ঘরে লুকাইলেন। সেই অবধি আর খেতুর সম্মুখে বাহির হইতেন না। নিরঞ্জন একদিন খেতুকে বলিলেন,— “খেতু! কঙ্কাবতীর অদ্ভুত স্বপ্নকথা আমি শুনিয়াছি। কি আশ্চর্য্য স্বপ্ন! কিন্তু স্বপ্ন বা বিকারের প্রলাপ বলিয়া তুমি উপহাস করিও না। স্বপ্ন,— কি নয়? তাহাই বুঝিতে পারি না। এই আমাদের জীবন, আমাদের আশা-ভরসা, সুখ-দুঃখ, সকলই স্বপ্লবৎ বলিয়া বোধ হয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই অপূর্ব্ব মায়া কিছুই বুঝিতে পারি না। সামান্য একটি পদার্থের কথাই আমরা ভালরূপ অবগত নাহি। এই দেখ, আমার হাতে এখন যে পুস্তকখানি রহিয়াছে, প্রকৃত ইহা—কি, তাহার কিছুই জানি না। আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা কেবল কতকগুলি গুণ অনুভব হয়। চক্ষু দ্বারা দেখিতে পাই যে, ইহার দৈর্ঘ্য প্রস্থ স্থূলতা ও বর্ণ আছে, ত্বকের দ্বারা জানিতে পারি যে, ইহার কাঠিন্য আছে, নাসিকা দ্বারা ইহার ঘ্রাণ ও জিহ্বার দ্বারা ইহার স্বাদ অনুভব করি। প্রকৃত পুস্তকখানি আমরা দেখিতে পাই না, যাহাকে পুস্তকের গুণ বলি, তাহাই আমরা অনুভব করিতে পারি। কিন্তু সে গুণগুলি পুস্তকের কি আমাদের ইন্দ্রিয়ের? আমাদের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক প্রভৃতি এখন যেভাবে গঠিত, সেইভাবে আমরা গুণাদি অনুভব করি। যদি আমাদের ইন্দ্রিয়সমুদয় অন্যরূপে গঠিত হইত, তাহা হইলে পৃথিবীস্থ সমস্ত পদার্থ আবার অন্যরূপ ধারণ করত। এই পুস্তকের পত্রগুলি এখন শুভ্র ও কৃষ্ণবর্ণ দেখাইতেছে। যদি পাণ্ডুরোগে আক্রান্ত হইয়া, কিঞ্চিৎমাত্র আমার চক্ষুর গঠন পরিবর্ত্তিত হয়, তাহা হইলে এই পুস্তকখানিই আবার আমার চক্ষে পীতবর্ণ দেখাইবে। তাই দেখ, প্রথম তো পুস্তকখানি দেখিতে পাই না, কতকগুলি গুণ কেবল অনুভব করি। আবার বলিতে গেলে, সেই গুণগুলি পুস্তকের নয়, আমাদের ইন্দ্রিয়ের। তবে পুস্তক রহিল কোথা? কোনও বিষয়ের প্রকৃত তত্ত্ব জানিতে না পারিয়া স্বপ্নসৃজিত কাল্পনিক জীবের ন্যায় আমরা সকলেই এই সংসারে যেন বিচরণ করিতেছি। সে জন্য কঙ্কাবতীর স্বপ্নকে আমরা উপহাস করিব কেন? সমুদয় বাহ্যজগৎ যেরূপ আমাদের জাগরিত ইন্দ্রিয়-কল্পিত, কঙ্কাবতীর স্বপ্নজগৎও সেইরূপ কঙ্কাবতীর সুষুপ্ত ইন্দ্রিয়-কল্পিত। দুই জগতে বিশেষ কিছু ইতরবিশেষ নাই। কঙ্কাবতী যাহা দেখিয়াছে, যাহা শুনিয়াছে, যাহা কখনও চিন্তা করিয়াছ, সেই সমুদয় লইয়া একটি স্বপ্নজগৎ নির্ম্মিত হইয়াছিল। স্বপ্নের আদি হইতে অন্ত পর্য্যন্ত সকল স্থানেই কঙ্কাবতী বর্ত্তমান। কঙ্কাবতী দেখিতেছে, কি শুনিতেছে, কি বলিতেছে, কি ভাবিতেছে, তাছাড়া স্বপ্নে আর কিছুই নাই। কঙ্কাবতীর যেরূপ ভ্রম হওয়া সম্ভব, স্থানে স্থানে সেইরূপ ভ্রমও দেখিতে পাই। হাতীদিগের মত মশাদিগের নাক পরিবদ্ধিত হইয়া শুঁড় হয় না। দুই চল বাড়িয়া শুঁড় হয়। অন্য স্থানে, যেমন আকাশে কল্পনাদেবী কঙ্কাবতীর সহিত কিছু ক্রীড়া করিয়াছেন। যাহা হউক, স্বপ্নটি অদ্ভূত বলিয়া মানিতে হইবে। আমি আশ্চর্য্য হই, কঙ্কাবতী সেই মশাদিগের সংস্কৃত শ্লোকটি কি করিয়া রচনা করিল?”

 খেতু হাসিয়া বলিলেন,— “একবার পরিহাসচ্ছলে আমি ঐ বচনটি রচনা করিয়াছিলাম। এ অনেক দিনের কথা। একখানি কাগজে ইহা লিখিয়া রাখিয়াছিলাম। কিছুদিন পরে কাগজখানি ফেলিয়া দিই। কঙ্কাবতী বোধ হয়, সেই কাগজখানি দেখিয়া থাকিবে।”

 কঙ্কাবতী উত্তমরূপে আরোগ্য লাভ করিলে, শুভদিনে শুভলগ্নে খেতু ও কঙ্কাবতীর শুভবিবাহকার্য্য সম্পন্ন হইল। ঘোরতর দুঃখের পর এই কার্য্য সুসম্পন্ন হইল, সে জন্য সপ্তগ্রাম সমাজের লোক সকলেই আনন্দিত হইলেন। বিশেষতঃ জনার্দ্দন চৌধুরী পরম প্রীতিলাভ করিলেন। তাঁহার বৃদ্ধ বয়স ও কফের ধাত, কিন্তু সে জন্য তিনি কিছুমাত্র উপেক্ষা করেন নাই। বিবাহের দিন সমস্ত রাত্রি তিনি তনু রায়ের বাটীতে উপস্থিত ছিলেন। চুপি-চুপি তিনি কলিকাতা হইতে প্রচুর পরিমাণে বরফ আনয়ন করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ-ভোজনের সময় পরিহাসচ্ছলে সকলকে তিনি বলিলেন,— “বর যে একেলা বরখা খাইয়া শরীর সুশীতল করিবে, তাহা হইবে না, আমরাও আমাদের শরীর যৎসামান্য স্নিগ্ধ করিব।”

 দেশের লোক, যাঁহারা কখনও বরফ দেখেন নাই, আজ বরফ দেখিয়া সকলেই চমৎকৃত হইলেন। আগ্রহের সহিত সকলেই সুস্নিগ্ধ বরফ-জল পান করিলেন। বাড়ীতে দেখাইবার জন্য অনেকেই অল্প কাচা বরফ লইয়া গেলেন।

 শূদ্র-ভোজনের সময় গদাধর ঘোষ তিন লোটা বরফজল পান করিলেন। আর প্রায় একসের সেই করাতের মত কর্ত্তনশীল “বরখ” দন্ত দ্বারা চিবাইয়া খাইলেন।

 কঙ্কাবতীর মা যখন কঙ্কাবতীকে খেতুর মার হাতে সঁপিয়া দিয়া বলিলেন, — “দিদি! এই নাও, তোমার কঙ্কাবতী নাও” তখন দুই জনের আহ্লাদ রাখিতে পৃথিবীতে কি আর স্থান হইল? মনের আনন্দে তখন খেতুর মা কি পুত্র ও পুত্রবধূকে বরণ করিয়া ঘরে লন নাই? বরণের সময় লজ্জায় খেতু কি ঘাড় হেঁট করিয়াছিলেন না? কালবৌয়ের মত কঙ্কাবতীর কি তখন একহাত ঘোমটা ছিল না? তা দেখিয়া পাড়ার একটি শিশু ছেলে কি সেই ঘোমটার ভিতর মুখ দিয়া টুঃ দেয় নাই? এসব কথার আর উত্তর দিবার আবশ্যক নাই।

 যে সময় বরণ হইতেছিল, সেই সময় রামহরির স্ত্রী খেতুর বৌ-দিদি কি করিয়াছিলেন, তা জানেন? অতি উত্তম করিয়া খেতুর কানটি তিনি মলিয়া দিয়াছিলেন।

 কান-মলা খাইয়া খেতু কি বলিলেন, তা জানেন? খেতু বলিলেন,— “যাও বৌ-দিদি, ছি!"

 পাড়ার স্ত্রীগণ তখন কি করিবেন, তা শুনিয়াছেন? কমলের স্ত্রী ঠান্‌দিদি বলিলেন,— “শালা ‘বরখ' খায়! ও সীতার মা, ওলো, শালার কান দুইটা একেবারে ছিড়িয়া দে!"

 তাহার পর কি হইল? তাহার পর খেতুর অনেক টাকা হইল। সকলে সুখ-স্বচ্ছন্দে ঘরকন্না করিতে লাগিলেন। খেতুর অনেকগুলি ছেলেপিলে হইল। তনু রায় তাহাদিগের সহিত খেলা করিতে ভালোবাসিতেন। পাড়ার বালক-বালিকারা তাঁর দৌহিত্রদিগকে মারিলে তাহাদের ঠাকুরমার সহিত তনু রায় হাত নাড়িয়া নাড়িয়া ঝগড়া করিতেন।

 তাহার পর? বার বার “তাহার পর তাহার পর” করিলে চলিবে না। দেখিতে দেখিতে পুস্তকখানি বৃহৎ হইয়া পড়িয়াছে। ইহার মূল্য দেয় কে? তাহার ঠিক নাই, কাজেই তাড়াতাড়ি শেষ করিতে বাধ্য হইলাম।

 তাহার পর কি হইল? তাহার পর আমার গল্পটি ফুরাইল। নোটে গাছটির কপালে যাহা লেখা ছিল, তাহাই ঘটিল! সেই ঘটনা লইয়া কত অভিযোগ উপস্থিত।