পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

থেকে তিনি আহরণ করেন তাঁর নীতিবোধ ও নন্দনের নির্যাস। বাখতিনের মতে নৈতিক সক্রিয়তাকে তত্ত্বগতভাবে উদ্যম বা কৃত্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। উদ্যম-নিষ্পন্ন কর্মের ফল বা পরিণতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন না তিনি, জায়মান নৈতিক কৃত্যের প্রক্রিয়াই তাঁর মতে অভিনিবেশ-যোগ্য। যে-ঘটনাকে সৃষ্টি বা রচনা প্রক্রিয়ায় অনুধাবন করতে পারি, তারই পারিভাষিক নাম উদ্যম বা কৃত্য। তা শারীরিক ক্রিয়া, চিন্তা, উচ্চারণ বা লিখিত বয়ান হতে পারে। উচ্চারণ ও লিখিত বয়ান আসলে অভিন্ন পরিসরের দ্যোতক। সাহিত্যিক পাঠকৃতির প্রণালীবদ্ধ সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় লেখক-সত্তার সক্রিয়তা যেভাবে ব্যক্ত হয়, তা নিবিড়ভাবে অনুশীলন করে বাখতিন এই তাত্ত্বিক ধারণায় পৌঁছেছেন। কল্পনা-প্রতিভা দ্বারা নির্মিত ও বহু উপাদানের সমন্বয়ে রচিত শিল্পকর্মে, বিশেষত আখ্যানে, সাহিত্যিক কীভাবে তাঁর প্রকল্পজাত চরিত্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক এবং নিজের সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ সংগঠিত করেন, তা পরীক্ষা করে সত্তা ও অপরতার বহুরৈখিক সম্পর্ক বিষয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা নিয়ে যাঁর চিন্তাজীবনের সূত্রপাত হয়েছিল, তিনি জীবনাবসানের গোধূলি-বেলায় যখন নির্মিতি-বিজ্ঞান নিয়ে নিবন্ধ রচনা করেন, পরিণতির দ্বিবাচনিক দর্পণে সূচনা-মুহূর্তের ভাববীজগুলি বিশেষ তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে। সারা জীবন ধরে বাখতিন যা ভেবেছেন বা লিখেছেন, তাদের দার্শনিক ও নান্দনিক তাৎপর্য যেন নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়।

 অবশ্যই এর মানে এই নয় যে মধ্যবর্তী দশকগুলিতে বাখতিনের ভাবনায় কোনো নতুন আকল্প দেখা দেয়নি। কিংবা তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত রচনার মূল প্রতিপাদ্য যাচাই করতে গেলে শুধুমাত্র মীমাংসাযোগ্যতার নির্মিতি-বিজ্ঞানকেই ব্যবহার করতে হবে। চিন্তাবিদ হিসেবে যাঁর বহুমাত্রিক হয়ে ওঠার বিবরণ আমাদের বারবার বিস্মিত ও প্রাণিত করে—সমসাময়িক সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে সেই প্রক্রিয়ার নিবিড় দ্বিবাচনিকতা অস্বীকার করার প্রশ্নই ওঠে না। এইজন্যে আলোচকেরা নির্মিতি-বিজ্ঞানকে বাখতিন-অনুশীলনের পক্ষে উপযোগী বহুস্তর-বিন্যস্ত চিন্তাবলয় হিসেবে ভেবে নিয়েছেন। অর্থাৎ বাখতিনের চিন্তাবিশ্বে এই তত্ত্ববীজের উপস্থিতি এমন-এক জটিল ও বিশিষ্ট অবসংগঠন হিসেবে, যার বহুমাত্রিক তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্যে সম্পূর্ণ জীবনও যথেষ্ট নয় যেন। ‘নির্মিতি-বিজ্ঞান’ ও ‘প্রত্যুত্তরযোগ্যতা’—এই দুটি পারিভাষিক শব্দের প্রয়োগ জীবন ও মননের কত দিগন্ত স্পর্শ করে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। অস্তিত্বের নিরবচ্ছিন্ন গ্রন্থনায় আমাদের প্রত্যেকের অনন্য অবস্থান থেকে উৎসারিত হচ্ছে প্রত্যুত্তরের যোগ্যতা ও সম্ভাবনা। যা-কিছু আমাদের অপরতার পরিসর হিসেবে ঘিরে রাখে, অনন্ত অনুপুঙ্খময় সেই জগতের সঙ্গে আমাদের আস্তিত্বিক অনন্যতাকে গ্রথিত করি ঐ প্রত্যুত্তরযোগ্যতা দিয়েই। আর, সম্ভাব্য প্রত্যুত্তরের আকাঙ্ক্ষা দিয়ে। বাখতিনের অন্যতম প্রসিদ্ধ মহাবাক্য হলো, আমরা প্রত্যেকেই ‘without an alibi in existence’।

 অস্তিত্বের বিপুল পরিসরে নিজেদের অনন্য অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্যে চাই উপযোগী দায়িত্ববোধ। কেননা অনন্যতার উপলব্ধি বা পার্থক্যপ্রতীতি সার্থক হতে পারে যদি সৃষ্টিতে পরিব্যাপ্ত অপরতার পরিসর সম্পর্কে সচেতন হই। সত্তা যতক্ষণ নিজেকে অবশিষ্ট জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত না করছে, ততক্ষণ নিজেকে অনন্য বলে বুঝতেও পারবে না। সময়ে ও পরিসরে আমাদের প্রত্যেকের অবস্থান সুনির্দিষ্ট। কিন্তু তার

৫৭