পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভাবাদর্শগত অবস্থান এবং তাঁর উচ্চারণের প্রকৃত তাৎপর্য ও নিহিত শক্তি অনুধাবন করা সম্ভব হলো সময় ও পরিসরের ভিন্ন পর্যায়ক্রমে গিয়ে। অর্থাৎ বাখতিনের মৃত্য-পরবর্তী বিশ্বে—প্রতীচ্যে এবং প্রাচ্যে, আধুনিকোত্তর এবং উপনিবেশোত্তর সমাজে—ভাবাদর্শগত অবস্থান অনুযায়ী তাঁর ভাবনা গৃহীত, পরীক্ষিত ও পুনরুদ্ভাসিত হচ্ছে। তেমনি আমাদের নজরে পড়ছে, বাখতিনের জীবৎকালে স্বদেশে তিনি কিন্তু ঈপ্সিত মাত্রায় গহীত হননি কেননা তাঁর রচনা প্রকাশিত হওয়াই কঠিন ছিল। এমনকি, দীর্ঘকাল সোভিয়েত সমাজে তিনি প্রত্যাখ্যাত অপর হিসেবে নির্বাসিত, কার্যত মৃত, হয়েই ছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার বিশেষ অবস্থানের বিচারে ধনবাদী প্রতীচ্যের যে-সমস্ত দেশ ছিল বহুদূরবর্তী অপর তাদের মধ্যেই নবজন্ম ঘটল বাখতিনের। তাঁর রচনা অনূদিত, প্রকাশিত, ব্যাখ্যাত হওয়ার পরে নতুন তাৎপর্যে পুনরাবিষ্কৃত হলো। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যাঁদের তিক্ত অনীহা সর্বজনবিদিত, তাঁরা বাখতিনের উচ্চারণে নিজেদের অভিপ্রায় অনুযায়ী অন্তর্ঘাতের প্রতিসন্দর্ভ খুঁজে পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলেন। দ্বিবাচনিকতার প্রতিবেদন তাঁদের কাছে কার্যত ট্রয় যুদ্ধের কাঠের ঘোড়া বলে বিবেচিত হলো।

 তার মানে, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার সমর্থকদের কাছে বাখতিনের তত্ত্ববিশ্ব সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রতিস্পর্ধী আয়ুধের যোগানদার। এঁরা এই দাবি পেশ করলেন যে মহান তাত্ত্বিকের স্বদেশে স্বকালে যেসব উচ্চারণ পিঞ্জরাবদ্ধ ছিল—তাঁরা তাদের মুক্তি দিয়েছেন। তাঁরা এই সহজ সত্য মনে রাখলেন না (কিংবা, বলা ভালো, রাখতে চাইলেন না) যে বহুবিধ দ্বিবাচনিকতায় সমৃদ্ধ সোভিয়েত ইতিহাসের নির্যাস অর্থাৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন সত্যের উদ্ভাসন অসম্ভব। এ ধরনের চিন্তা করার অর্থ বাখতিনের যুক্তিশৃঙ্খলাকে নস্যাৎ করে দেওয়া। কোনো বাচনের আয়ুষ্কাল উচ্চারণের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার ওপর নির্ভরশীল, একথা যিনি ভাবতেন, তাঁকে ইতিহাস-নির্ধারিত অবস্থান বিশ্লেষণ করেই বুঝতে হবে। প্রতিটি পর্যায়ে বাচনের তাৎপর্য উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ, পরীক্ষিত, সম্প্রসারিত হয়েছে। এই ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মেডভেভেভ ও ভোলোশিনোভের নামে প্রচলিত রচনাকেও বাখতিনের বহুস্বরিক ভাববিশ্বের ফসল বলে গ্রহণ করছি। তাছাড়া, ধনবাদী প্রতীচ্যে সোভিয়েত ইতিহাস যতটা একবাচনিক ভাবে অবিশ্লেষনাত্মক ভঙ্গিতে গৃহীত হয়ে থাকে, তাকে মেনে না-নিয়ে বরং সমাজতন্ত্রের অন্তর্বর্তী দ্বিবাচনিক পরিসরকে পুনঃপাঠ করা উচিত। বাখতিনের উচ্চাবচতাময় জীবনের বিচিত্র সন্দর্ভ তো ঐ দ্বিবাচনিকতার প্রমাণ। অন্যভাবে বলা যায়, সময় ও পরিসরের বিশিষ্ট পর্যায়ক্রমেই বাখতিন-মেডভেভেভ-ভোলোশিনোভের সমান্তরাল উদ্ভব সম্ভবপর। এই পর্যায়ক্রমকেই প্রথম বুঝতে হবে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করার মতো; নইলে বাখতিনের ভাববিশ্ব-সঞ্চালক ‘mutuality of differences’ এর তাৎপর্য হারিয়ে যাবে আমাদের বিশ্লেষণ থেকে। তাঁর অভিপ্রেত প্রতিবেদন থেকে আমরা ইতিহাসের সামীপ্যের বদলে কেবলই আবিষ্কার করব মিথ্যা আত্মতার অন্তর্ঘাত। তাই বাখতিনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত থেকে আধুনিকোত্তর বা উপনিবেশোত্তর জগতের অধিবাসী হিসেবে, আমরা যত দূরবর্তী অপর হই না কেন—ইতিহাসের নির্দিষ্টতাকে বুঝতে হবে সবচেয়ে বেশি সম্ভাব্য পূর্ণতায়।

৭০