পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মানুষের উজ্জীবনের উৎসব। এ কেবল বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর যান্ত্রিক প্রবর্তনা নয়; রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের আরোপিত দীর্ঘতম অমারাত্রির পরে এ যেন উজ্জ্বল ভোরের কুসুমিত হয়ে ওঠা। প্রতিটি মানুষ সেখানে নবনির্মাণের হোতা এবং লক্ষ্যস্থল; বিপ্লব যেন মানুষের সমস্ত রুদ্ধ সম্ভাবনাকে মুক্ত করার উৎসব। বৈপ্লবিক পরিসরেরও সীমারেখা নেই কোনো এবং প্রতিটি মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে তা যেহেতু অনবরত পূর্ণ হয়ে ওঠে—প্রত্যেকের স্বাধীনতা সেখানে চূড়ান্ত। অতএব কার্নিভাল রাজনৈতিক অবচেতনায় সম্পৃক্ত, এতে সংশয়ের অবকাশ নেই।

 ত্রিশের দশকে সমগ্রের এই উৎসবে অন্তর্ঘাত করছিল যান্ত্রিক ও মতান্ধ রাষ্ট্রিক আমলাতন্ত্র। বাখতিন নিজেও নির্বাসিত হয়ে লক্ষ করেছিলেন কীভাবে জনসাধারণের উজ্জীবনের স্বপ্ন ও উৎসবের আবহ থেকে সর্বজনীন চেতনা সংকুচিত হয়ে ক্রমশ বিষাদে রূপান্তরিত হচ্ছে। কিন্তু এইজন্যে লোকায়ত সংস্কৃতির শৌর্য ও লাবণ্য সম্পর্কে তাঁর মৌল প্রত্যয় হারিয়ে যায়নি। কার্নিভালের আকল্পে তিনি লোকজীবনের অন্তর্বৃত ভাবাদর্শগত শক্তির উৎস আবিষ্কার করেছেন। সঙ্গে-সঙ্গে এও দেখিয়েছেন, নান্দনিক আকরণ-অন্তর্বস্তু-কৃৎকৌশল-প্রতিবেদনের গ্রন্থনায় ঐ শক্তি কত বিচিত্র ভাবে ব্যক্ত হয়ে থাকে। ফলে শুধু যে সাহিত্য ও শিল্প বদলে যায়, তা-ই নয়; জীবন ও সমাজ আমূল রূপান্তরিত হয়ে যায়। যেমন হির্শকোপ বলেছেন, মার্ক্সীয় সাংস্কৃতিক তত্ত্ব নির্মাণের ক্ষেত্রে বাখতিনের মৌলিক অবদান রয়েছে। তাঁর মতে, বাখতিন একমাত্র তাত্ত্বিক—‘for whom popular culture is the privileged bearer of democratic and progressive values’ (১৯৮৬: ৯২)। জনসমাজের মধ্যে প্রচলিত ও মান্যতাপ্রাপ্ত সংস্কৃতিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন বাখতিন; তাঁর তাত্ত্বিক সন্দর্ভের মৌল ভিত্তিও ওখানে। অন্তর্নাট্য ও বহির্নাট্যের দ্বিবাচনিকতায় উন্মোচিত হলো এই সত্য, কার্নিভালের আশ্রয়ভূমিতে—‘Power was forced out of the wings and onto the stage where it could be displayed, mocked, contested and transformed.’ (তদেব)। ব্যক্তিগত জীবনে যত দুর্যোগই নেমে আসুক, বাখতিন কিন্তু সদ্য অতীত ও সমকালীন ইতিহাসের দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর আস্থা হারাননি। সামাজিক ও বৌদ্ধিক অস্থিরতা ও রূপান্তর, বিভ্রান্তি ও নিরীক্ষা জীবনের প্রতিটি স্তরে ‘দ্রষ্টা চক্ষু’র প্রয়োজনকে অনিবার্য করে তুলছিল। সত্যভ্রম ও সত্যকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বীক্ষণের দর্পণে যথার্থভাবে প্রতিফলিত করার উপায় খুঁজছিলেন বাখতিন। কার্নিভালের মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন বহুস্তরান্বিত ইতিহাসের প্রতিবেদনে ইতিবাচক ও গঠনমূলক অন্তর্ঘাত ঘটানোর উপযোগী আয়ুধ। একদিকে প্রকরণবাদী নন্দনের প্রচ্ছায়া এবং অন্যদিকে আধুনিকতাবাদের জায়মান চিহ্নায়কগুলির ইশারা—এই দুইয়ের মধ্য দিয়ে নিজের পথ তাঁকে তৈরি করে নিতে হলো। এই পথ কার্যত লোকায়ত অনুষঙ্গের পুনর্নির্মাণে গড়ে উঠেছে।

 প্যারডি, শ্রুতিসাহিত্যের শৈলী, প্রকল্পনা, প্রহসন, তির্যক বাচন এবং দ্যুতিময় হাসি প্রকৃতপক্ষে লোকায়ত বিনির্মাণের বিশিষ্ট ধরন হিসেবে কার্নিভালকে প্রতিবাদী ভাবাদর্শের আকর করে তুলেছে। এই বিনির্মাণ হলো দ্বিবাচনিকতার প্রায়োগিক দর্শন যার উপযোগিতা ও তাৎপর্য ইতিহাসের প্রেক্ষিতে রচিত হয়। প্রাগুক্ত ধরনগুলির মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘active discursive intervention conditioned by precise social and

৮৪