পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কার্নিভাল: লোকায়তের প্রত্যাঘাত

সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ও স্বভাব আধিপত্যবাদের দীর্ঘায়ত প্রশ্রয়ে এত দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত যে এদের আস্তিত্বিক সংগঠনে প্রচ্ছন্ন লোকায়ত উপাদান সম্পর্কে প্রায় কেউই অবহিত থাকে না। সাংস্কৃতিক রাজনীতির অভিঘাত কীভাবে সত্য ও মিথ্যার সংজ্ঞা পালটে দেয়, এ বিষয়ে অসচেতনতা প্রায় সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন নয় যে আধুনিক যুগেই সরকারি সন্দর্ভ প্রাধান্য বিস্তার করেছে। প্রাক্-আধুনিক সময়পর্বের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবেদনেও সরকারি অবস্থানই একাত্তিক মান্যতা পেয়েছে। তা ঘটেছে লোকায়ত জীবনের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে পুরোপুরি নিরাকৃত করে। তবু ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে প্রাতিষ্ঠানিক একাধিপত্যের অচলায়তন ভেঙে দিয়ে প্রান্তিক অস্তিত্বের উপস্থিতি তির্যকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বাখতিন যখন লোকায়ত জীবনে জনপ্রিয় কৌতুকের বিস্মৃত পরম্পরা নিয়ে কথা বলেন, দ্বিবাচনিক অপর পরিসরের অনস্বীকার্য প্রতিস্রোত সম্পর্কে তাঁর প্রত্যয় ব্যক্ত হয়। Rabelais and his world ও Problems of Dostoevsky’s Poetics—এই দুটি বইতে বাখতিন তাঁর বিখ্যাত কার্নিভাল-ভাবনা উপস্থাপিত করেছেন। যোল শতকের বিখ্যাত সাহিত্যিক রাবেলের রচনায় তিনি খুঁজে পেয়েছেন সন্দর্ভের বিকল্প একটি ধরন যা সরকারি ভাবাদর্শ ও উপস্থাপনা রীতির বিরোধিতা করে। এমনকী ডস্টয়েভস্কির মতো বহুস্বরিক সন্দর্ভ রচয়িতার পাঠকৃতিতেও তিনি দূরবর্তী কার্নিভাল-অতীতের অবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। জনপ্রিয় ইতিহাসের উপকরণ হিসেবে কার্নিভাল যখন বয়ানের পাঠতন্তুতে রূপান্তরিত হয়, তাতে যুগপৎ ধরা পড়ে বিকল্প চিন্তন-অভিজ্ঞতা-অনুভূতির চিহ্নায়ন প্রকরণ। জুলিয়া ক্রিস্তেভার মতে কার্নিভাল শুধু চিহ্নায়ক নয়, তা চিহ্নায়িতও বটে। তা-ই কোনো পাঠকৃতিতে যুগপৎ উপস্থাপনার বিষয় ও পদ্ধতি।

 কোনো পাঠকৃতির চিত্রকল্প, ভাষা ও কথাবস্তুর মধ্যে কার্নিভালের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। একে বলা যেতে পারে মঞ্চ-ছাড়া দৃশ্যসজ্জা; এতে যোগ দেয় যে সে যুগপৎ অভিনেতা ও দর্শক। প্রান্তিক লোক-উপাদান কীভাবে পাঠতন্তুতে রূপান্তরিত হবে, তার কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই এবং তা সরাসরিও ঘটে না। মান্য বয়ানে পৌঁছানোর পথে বেশ কিছু অন্তর্বর্তী স্তর পেরিয়ে যেতে হয় বলে প্রাকরণিক ও শৈলীগত রূপান্তর অন্তর্বস্তুর তাৎপর্যেও যথেষ্ট স্বরান্তর ঘটিয়ে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে কার্নিভালের যে-ভূমিকা থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক বয়ানের প্রচ্ছায়ায় তার অনেকখানি বদলে যায়। আধিপত্যবাদী প্রতাপের দৃশ্য ও অদৃশ্য বিচ্ছুরণের বিরুদ্ধে যাদের প্রতিবাদী ভূমিকা ছিল সমান্তরাল অপরতার প্রকৃত অভিজ্ঞান, তা প্রাগুক্ত রূপান্তরের ফলে অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে না। তবু শিলাস্তরে নিহিত আদিমযুগের ভূতাত্ত্বিক অবশেষের মতো সাহিত্যিক প্রতিবেদনেও প্রচ্ছন্ন থাকে বিগত কালের সাংস্কৃতিক উপাদান, যা প্রতিস্রোতপন্থী লোকায়ত জীবনের ইশারা বয়ে আনে। বাখতিন দেখিয়েছেন, মধ্যযুগে সাধারণ মানুষের জীবনে কার্নিভাল অনেক বেশি প্রকট ছিল। কেননা তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে ছিল দ্বৈততা। একদিকে রাষ্ট্র ও ধর্মতন্ত্রের কর্তৃত্ব খচিত সরকারি বয়ান, সামন্ততান্ত্রিক বিধি প্রণোদিত কৃত্যের

৮৭