গল্প-দশক/ঠাকুর্দ্দা

উইকিসংকলন থেকে


ঠাকুর্দ্দা।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

নয়নজোড়ের জমিদারের এককালে বাবু বলিয়া বিশেষ বিখ্যাত ছিলেন। তখনকার কালের বাবুয়ানার আদর্শ বড় সহজ ছিল না। এখন যেমন রাজা রায়বাহাদুর খেতাব অর্জ্জন করিতে অনেককে খানা নাচ ঘোড়দৌড় এবং সেলাম সুপারিসের শ্রাদ্ধ করিতে হয়, তখনও সাধারণের নিকট হইতে বাবু উপাধি লাভ করিতে বিস্তর দুঃসাধ্য তপশ্চরণ করিতে হইত।

 আমাদের নয়নজোড়ের বাবুরা পাড় ছিঁড়িয়া ফেলিয়া ঢাকাই কাপড় পরিতেন, কারণ পাড়ের কর্কশতায় তাঁহাদের সুকোমল বাবুয়ানা ব্যথিত হইত। তাঁহারা লক্ষ টাকা দিয়া বিড়ালশাবকের বিবাহ দিতেন এবং কথিত আছে, একবার কোন উৎসব উপলক্ষে রাত্রিকে দিন করিবার প্রতিজ্ঞা করিয়া অসংখ্য দীপ জ্বালাইয়া সূর্য্যকিরণের অনুকরণে তাঁহারা সাঁচ্চা রূপার জরি উপর হইতে বর্ষণ করাইয়াছিলেন।

 ইহা হইতেই সকলে বুঝিবেন সেকালে বাবুদের বাবুয়ানা বংশানুক্রমে স্থায়ী হইতে পারিত না। বহু-বর্ত্তিকা-বিশিষ্ট প্রদীপের মত নিজের তৈল নিজে অল্পকালে ধুমধামেই নিঃশেষ করিয়া দিত।  আমাদের কৈলাসচন্দ্র রায় চৌধুরী সেই প্রখ্যাতযশ নয়নজোড়ের একটি নির্ব্বাপিত বাবু। ইনি যখন জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন তৈল তখন প্রদীপের তলদেশে আসিয়া ঠেকিয়াছিল;—ইহার পিতার মৃত্যু হইলে পর নয়নজোড়ের বাবুয়ানা গোটাকতক অসাধারণ শ্রাদ্ধশান্তিতে অন্তিম দীপ্তি প্রকাশ করিয়া হঠাৎ নিবিয়া গেল। সমস্ত বিষয় আশয় ঋণের দায়ে বিক্রয় হইল—যে অল্প অবশিষ্ট রহিল তাহাতে পূর্ব্বপুরুষের খ্যাতি রক্ষা করা অসম্ভব।

 সেই জন্য নয়নজোড় ত্যাগ করিয়া পুত্রকে সঙ্গে লইয়া কৈলাস বাবু কলিকাতায় আসিয়া বাস করিলেন—পুত্রটিও একটি কন্যামাত্র রাখিয়া এই হতগৌরব সংসার পরিত্যাগ করিয়া পরলোকে গমন করিলেন।

 আমরা তাঁহার কলিকাতার প্রতিবেশী। আমাদের ইতিহাসটা তাঁহাদের হইতে সম্পূর্ণ বিপরীত। আমার পিতা নিজের চেষ্টায় ধন উপার্জ্জন করিয়াছিলেন। তিনি কখনও হাঁটুর নিম্নে কাপড় পরিতেন না, কড়াক্রান্তির হিসাব রাখিতেন, এবং বাবু উপাধি লাভের জন্য তাঁহার লালসা ছিল না। সে জন্য আমি তাঁহার একমাত্র পুত্র তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞ আছি। আমি যে লেখা পড়া শিখিয়াছি এবং নিজের প্রাণ ও মান রক্ষার উপযোগী যথেষ্ট অর্থ বিনা চেষ্টায় প্রাপ্ত হইয়াছি, ইহাই আমি পরম গৌরবের বিষয় বলিয়া জ্ঞান করি—শূন্য ভাণ্ডারে পৈতৃক বাবুয়ানার উজ্জ্বল ইতিহাসের অপেক্ষা লোহার সিন্দুকের মধ্যে পৈতৃক কোম্পানির কাগজ আমার নিকট অনেক বেশী মূল্যবান বলিয়া মনে হয়।

 বোধ করি সেই কারণেই, কৈলাসবাবু তাঁহাদের পূর্ব্বগৌরবের ফেল্‌-করা ব্যাঙ্কের উপর যখন দেদার লম্বাচৌড়া চেক্ চালাইতেন তখন তাহা আমার এত অসহ্য ঠেকিত। আমার মনে হইত, আমার পিতা স্বহস্তে অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছেন বলিয়া কৈলাসবাবু বুঝি মনে মনে আমাদের প্রতি অবজ্ঞা অনুভব করিতেছেন। আমি রাগ করিতাম এবং ভাবিতাম অবজ্ঞার যোগ্য কে? যে লোক সমস্ত জীবন কঠোর ত্যাগস্বীকার করিয়া, নানা প্রলোভন অতিক্রম করিয়া, লোকমুখের তুচ্ছ খ্যাতি অবহেলা করিয়া, অশ্রান্ত এবং সতর্ক বুদ্ধিকৌশলে সমস্ত প্রতিকূল বাধা প্রতিহত করিয়া সমস্ত অনুকূল অবসরগুলিকে আপনার আয়ত্তগত করিয়া একটি একটি রৌপ্যের স্তরে সম্পদের একটি সমুচ্চ পিরামি্ড্‌ একাকী স্বহস্তে নির্মাণ করিয়া গিয়াছেন, তিনি হাঁটুর নীচে কাপড় পরিতেন না বলিয়া যে কম লোক ছিলেন তাহা নয়!

 তখন বয়স অল্প ছিল সেই জন্য এইরূপ তর্ক করিতাম রাগ করিতাম—এখন বয়স বেশী হইয়াছে এখন মনে করি, ক্ষতি কি! আমার ত বিপুল বিষয় আছে, আমার কিসের অভাব? যাহার কিছু নাই, সে যদি অহঙ্কার করিয়া সুখী হয়, তাহাতে আমার ত শিকি পয়সার লোকসান নাই, বরং সে বেচারার সান্ত্বনা আছে।

 ইহাও দেখা গিয়াছে আমি ব্যতীত আর কেহ কৈলাস বাবুর উপর রাগ করিত না। কারণ, এত বড় নিরীহ লোক সচরাচর দেখা যায় না। ক্রিয়াকর্ম্মে সুখে দুঃখে প্রতিবেশীদের সহিত তাঁহার সম্পূর্ণ যোগ ছিল। ছেলে হইতে বৃদ্ধ পর্য্যন্ত সকলকেই দেখা হইবামাত্র তিনি হাসিমুখে প্রিয় সম্ভাষণ করিতেন—যেখানে যাহার যে কেহ আছে সকলেরই কুশলসংবাদ জিজ্ঞাসা করিয়া হবে তাঁহার শিষ্টতা বিরাম লাভ করিত। এই জন্য কাহারও সহিত তাঁহার দেখা হইলে একটা সুদীর্ঘ প্রশ্নোত্তরমালার সৃষ্টি হইত; ভাল ত? শশি ভাল আছে? আমাদের বড় বাবু ভাল আছেন? মধুর ছেলেটির জ্বর হয়েছিল শুনে ছিলুম সে এখন ভাল আছে ত? হরিচরণ বাবুকে অনেককাল দেখিনি তাঁর অসুখ বিসুখ কিছু হয় নি? তোমাদের রাখালের খবর কি? বাড়ির এঁয়ারা সকলে ভাল আছেন? ইত্যাদি।

 লোকটি ভারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কাপড় চোপড় অধিক ছিল না, কিন্তু মেরজাইটি চাদরটি জামাটি, এমন কি, বিছানায় পাতিবার একটি পুরাতন র‍্যাপার, বালিশের ওয়াড়, একটি ক্ষুদ্র সতরঞ্চ সমস্ত স্বহস্তে রৌদ্রে দিয়া ঝাড়িয়া দড়িতে খাটাইয়া ভাঁজ করিয়া আলনায় তুলিয়া পরিপাটি করিয়া রাখিতেন। যখন তাঁহাকে দেখা যাইত তখনি মনে হইত যেন তিনি সুসজ্জিত প্রস্তুত হইয়া আছেন। অল্পস্বল্প সামান্য আস্‌বাবেও তাঁহার ঘরদ্বার সমুজ্জ্বল হইয়া থাকিত। মনে হইত যেন তাঁহার আরও অনেক আছে।

 ভৃত্যাভাবে অনেক সময় ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া তিনি নিজের হস্তে অতিশয় পরিপাটি করিয়া ধুতি কোঁচাইতেন এবং চাদর ও জামার আস্তিন বহুযত্নে ও পরিশ্রমে “গিলে” করিয়া রাখিতেন। তাঁহার বড় বড় জমিদারী ও বহুমূল্যের বিষয়সম্পত্তি লোপ পাইয়াছে, কিন্তু একটি বহুমূল্য গোলাপপাশ, আতরদান, একটি সোনার রেকাবী, একটি রূপার আল্‌বোলা, একটি বহুমূল্য শাল ও সেকেলে জামাযোড়া ও পাগড়ী দারিদ্র্যের গ্রাস হইতে বহুচেষ্টায় তিনি রক্ষা করিয়াছিলেন। কোন একটা উপলক্ষ উপস্থিত হইলে এই গুলি বাহির হইত এবং নয়নজোড়ের জগদ্বিখ্যাত বাবুদের গৌরব রক্ষা হইত।

 এদিকে কৈলাসবাবু মাটির মানুষ হইলেও কথায় যে অহঙ্কার করিতেন সেটা যেন পূর্ব্বপুরুষদের প্রতি কর্ত্তব্য বোধে করিতেন; সকল লোকেই তাহাতে প্রশ্রয় দিত এবং বিশেষ আমোদ বোধ করিত।

 পাড়ার লোকে তাঁহাকে ঠাকুর্দ্দামশাই বলিত এবং তাঁহার ওখানে সর্ব্বদা বিস্তর লোক সমাগম হইত; কিন্তু দৈন্যাবস্থায় পাছে তাঁহার তামাকের খরচটা গুরুতর হইয়া উঠে এই জন্য প্রায়ই পাড়ার কেহ না কেহ দুই এক সের তামাক কিনিয়া লইয়া গিয়া তাঁহাকে বলিত, ঠাকুর্দ্দামশায় একবার পরীক্ষা করিয়া দেখ দেখি, ভাল গয়ার তামাক পাওয়া গেছে।

 ঠাকুর্দ্দামশায় দুই এক টান টানিয়া বলিতেন, বেশ ভাই, বেশ তামাক। অমনি সেই উপলক্ষে ষাট পঁয়ষট্টি টাকা ভরির তামাকের গল্প পাড়িতেন; এবং জিজ্ঞাসা করিতেন সে তামাক কাহারও আস্বাদ করিয়া দেখিবার ইচ্ছা আছে কি না?

 সকলেই জানিত যে যদি কেহ ইচ্ছা প্রকাশ করে তবে নিশ্চয় চাবির সন্ধান পাওয়া যাইবে না অথবা অনেক অন্বেষণের পর প্রকাশ পাইবে যে পুরাতন ভৃত্য গণেশ বেটা কোথায় যে কি রাখে তাহার আর ঠিকানা নাই—গণেশও বিনা প্রতিবাদে সমস্ত অপবাদ স্বীকার করিয়া লইবে। এই জন্য সকলেই একবাক্যে বলিত, ঠাকুর্দ্দামশায় কাজ নেই, সে তামাক আমাদের সহ্য হবে না, আমাদের এই ভাল।

 শুনিয়া ঠাকুর্দ্দা দ্বিরুক্তি না করিয়া ঈষৎ হাস্য করিতেন। সকলে বিদায় লইবার কালে বৃদ্ধ হঠাৎ বলিয়া উঠিতেন, সে যেন হল, তোমরা কবে আমার এখানে খাবে বলদেখি ভাই?

 অমনি সকলে বলিত, সে একটা দিন ঠিক করে দেখা যাবে।

 ঠাকুর্দ্দা মহাশয় বলিতেন, সেই ভাল, একটু বৃষ্টি পড়ুক, ঠাণ্ডা হোক্‌, নইলে এ গরমে গুরু ভোজনটা কিছু নয়।

 যখন বৃষ্টি পড়িত তখন ঠাকুর্দ্দাকে কেহ তাঁহার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করাইয়া দিত না—বরঞ্চ কথা উঠিলে সকলে বলিত, এই বৃষ্টি বাদলটা না ছাড়লে সুবিধে হচ্ছে না। ক্ষুদ্র বাসাবাড়িতে বাস করাটা তাঁহার পক্ষে ভাল দেখাইতেছে না এবং কষ্টও হইতেছে এ কথা তাঁহার বন্ধুবান্ধব সকলেই তাঁহার সমক্ষে স্বীকার করিত, অথচ কলিকাতায় কিনিবার উপযুক্ত বাড়ি খুঁজিয়া পাওয়া যে কত কঠিন, সে বিষয়েও কাহারও সন্দেহ ছিল না—এমন কি আজ ছয় সাত বৎসর সন্ধান করিয়া ভাড়া লইবার মত একটা বড় বাড়ি পাড়ার কেহ দেখিতে পাইল না— অবশেষে ঠাকুর্দ্দা মশাই বলিতেন, “তা হোক্‌ ভাই, তোমাদের কাছাকাছি আছি এই আমার সুখ, নয়নজোড়ে বড় বাড়ি ত পড়েই আছে কিন্তু সেখানে কি মন টেঁকে?”

 আমার বিশ্বাস, ঠাকুর্দ্দাও জানিতেন যে, সকলে তাঁহার অবস্থা জানে, এবং যখন তিনি ভূতপূর্ব্ব নয়নজোড়কে বর্ত্তমান বলিয়া ভান করিতেন এবং অন্য সকলেও তাহাতে যোগ দিত তখন তিনি মনে মনে বুঝিতেন যে, পরস্পরের এই ছলনা কেবল পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্দ্যবশতঃ।

 কিন্তু আমার বিষম বিরক্তি বোধ হইত। অল্প বয়সে পরের নিরীহ গর্ব্বও দমন করিতে ইচ্ছা করে এবং সহস্র গুরুতর অপরাধের তুলনায় নির্ব্বুদ্ধিতাই সর্বাপেক্ষা অসহ্য বোধ হয়। কৈলাস বাবু ঠিক নির্ব্বোধ ছিলেন না, কাজে কর্ম্মে তাঁহার সহায়তা এবং পরামর্শ সকলেই প্রার্থনীয় জ্ঞান করিত। কিন্তু নয়নজোড়ের গৌরব প্রকাশ সম্বন্ধে তাঁহার কিছুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান ছিল না! সকলে তাঁহাকে ভালবাসিয়া এবং আমোদ করিয়া তাঁহার কোন অসম্ভব কথাতেই প্রতিবাদ করিত না বলিয়া তিনি আপনার কথার পরিমাণ রক্ষা করিতে পারিতেন না। অন্য লোকেও যখন আমোদ করিয়া অথবা তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য নয়নজোড়ের কীর্ত্তি কলাপ সম্বন্ধে বিপরীত মাত্রায় অত্যুক্তি প্রয়োগ করিত, তিনি অকাতরে সমস্ত গ্রহণ করিতেন এবং স্বপ্নেও সন্দেহ করিতেন না যে, অন্য কেহ এ সকল কথা লেশমাত্র অবিশ্বাস করিতে পারে।

 আমার এক এক সময় ইচ্ছা করিত, বৃদ্ধ এই যে মিথ্যা দুর্গ অবলম্বন করিয়া বাস করিতেছে এবং মনে করিতেছে ইহা চিরস্থায়ী, এই দুর্গটি দুই তোপে সর্ব্বসমক্ষে উড়াইয়া দিই। একটা পাখীকে সুবিধামত ডালের উপর বসিয়া থাকিতে দেখিলেই শিকারীর ইচ্ছা করে তাহাকে গুলি বসাইয়া দিতে, পাহাড়ের গায়ে একটা প্রস্তর পতনোম্মুখ থাকিতে দেখিলেই বালকের ইচ্ছা করে এক লাথি মারিয়া তাহাকে গড়াইয়া ফেলিতে—যে জিনিষটা প্রতি মুহূর্ত্তে পড়ি পড়ি করিতেছে অথচ কোন একটা কিছুতে সংলগ্ন হইয়া আছে, তাহাকে ফেলিয়া দিলেই তবে যেন তাহার সম্পূর্ণতা সাধন এবং দর্শকের মনের তৃপ্তিলাভ হয়। কৈলাস বাবুর মিথ্যাগুলি এতই সরল, তাহার ভিত্তি এতই দুর্ব্বল, তাহা ঠিক সত্য বন্দুকের লক্ষ্যের সাম্‌নে এমনি বুক ফুলাইয়া নৃত্য করিত যে, তাহাকে মুহূর্ত্তের মধ্যে বিনাশ করিবার জন্য একটি আবেগ উপস্থিত হইত—কেবল নিতান্ত আলস্যবশতঃ এবং সর্ব্বজনসম্মত প্রথার অনুসরণ করিয়া সে কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতাম না।


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

নিজের অতীত মনোভাব বিশ্লেষণ করিয়া যতটা মনে পড়ে তাহাতে মনে হয়, কৈলাস বাবুর প্রতি আমার আন্তরিক বিদ্বেষের আর একটি গূঢ় কারণ ছিল। তাহা একটু বিবৃত করিয়া বলা আবশ্যক।

 আমি বড়মানুষের ছেলে হইয়াও যথাকালে এম্‌, এ, পাস্‌ করিয়াছি, যৌবন সত্ত্বেও কোন প্রকার কুসংসর্গ কুৎসিত আমোদে যোগ দিই নাই, এবং অভিভাবকের মৃত্যুর পরে স্বয়ং কর্ত্তা হইয়াও আমার স্বভাবের কোন প্রকার বিকৃতি উপস্থিত হয় নাই। তাহা ছাড়া চেহারাটা এমন যে, তাহাকে আমি নিজ মুখে সুশ্রী বলিলে অহঙ্কার হইতে পারে কিন্তু মিথ্যাবাদ হয় না।

 অতএব বাঙ্গলা দেশে ঘট্‌কালির হাটে আমার দাম যে অত্যন্ত বেশী তাহাতে আর সন্দেহ নাই-এই হাটে আমার সেই দাম আমি পুরা আদায় করিয়া লইব, এইরূপ দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম। ধনী পিতার পরম রূপবতী একমাত্র বিদূষী কন্যা আমার কল্পনায় আদর্শরূপে বিরাজ করিতেছিল।

 দশ হাজার বিশ হাজার টাকা পণের প্রস্তাব করিয়া দেশ বিদেশ হইতে আমার সম্বন্ধ আসিতে লাগিল। আমি অবিচলিতচিত্তে নিক্তি ধরিয়া তাহাদের যোগ্যতাযোগ্যতা ওজন করিয়া লইতেছিলাম, কোনটাই আমার সমযোগ্য বোধ হয় নাই। অবশেষে ভবভূতির ন্যায় আমার ধারণা হইয়াছিল যে,—

কি জানি জন্মিতে পারে মম সমতুল,
অসীম সময় আছে, বসুধা বিপুল।

কিন্তু বর্ত্তমান কালে এবং ক্ষুদ্র বঙ্গদেশে সেই অসম্ভব দুর্লভ পদার্থ জন্মিয়াছে কি না সন্দেহ।

 কন্যাদায়গ্রস্তগণ প্রতিনিয়ত নানা ছলে আমার স্তবস্তুতি এবং বিবিধোপচারে আমার পূজা করিতে লাগিল। কন্যা পছন্দ হউক বা না হউক, এই পূজা আমার মন্দ লাগিল না। ভাল ছেলে বলিয়া, কন্যার পিতৃগণের এই পূজা আমার উচিতপ্রাপ্য স্থির করিয়াছিলাম। শাস্ত্রে পড়া যায়, দেবতা বর দিন্ আর না দিন্‌, যথাবিধি পূজা না পাইলে বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া উঠেন। নিয়মিত পূজা পাইয়া আমারও মনে সেইরূপ অত্যুচ্চ দেবভাব জন্মিয়াছিল।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, ঠাকুর্দ্দা মশায়ের একটি পৌত্রী ছিল। তাহাকে অনেকবার দেখিয়াছি কিন্তু কখনও রূপবতী বলিয়া ভ্রম হয় নাই। সুতরাং তাহাকে বিবাহ করিবার কল্পনাও আমার মনে উদিত হয় নাই। কিন্তু ইহা ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম যে, কৈলাস বাবু, লোকমারফৎ অথবা স্বয়ং পৌত্রীটিকে অর্ঘ্য দিবার মানসে আমার পূজার বোধন করিতে আসিবেন, কারণ, আমি ভাল ছেলে। কিন্তু তিনি তাহা করিলেন না।

 শুনিতে পাইলাম, আমার কোন বন্ধুকে তিনি বলিয়াছিলেন, নয়নজোড়ের বাবুরা কখনও কোন বিষয়ে অগ্রসর হইয়া কাহারও নিকটে প্রার্থনা করে নাই—কন্যা যদি চিরকুমারী হইয়া থাকে তথাপি সে কুলপ্রথা তিনি ভঙ্গ করিতে পারিবেন না।

 শুনিয়া আমার বড় রাগ হইল। সে রাগ অনেক দিন পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে ছিল—কেবল ভাল ছেলে বলিয়াই চুপচাপ করিয়াছিলাম।

 যেমন বজ্রের সঙ্গে বিদ্যুৎ থাকে, তেমনি আমার চরিত্রে রাগের সঙ্গে সঙ্গে একটা কৌতুকপ্রিয়তা জড়িত ছিল। বৃদ্ধকে শুদ্ধমাত্র নিপীড়ন করা আমার দ্বারা সম্ভব হইত না—কিন্তু একদিন হঠাৎ এমন একটা কৌতুকাবহ প্ল্যান্ মাথায় উদয় হইল, যে, সেটা কাজে খাটাইবার প্রলোভন সম্বরণ করিতে পারিলাম না।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি, বৃদ্ধকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য নানা লোকে নানা মিথ্যা কথার সৃজন করিত। পাড়ার একজন পেন্সনভোগী ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট্‌ প্রায় বলিতেন, ঠাকুর্দ্দা, ছোটলাটের সঙ্গে যখনি দেখা হয় তিনি নয়নজোড়ের বাবুদের খবর না নিয়ে ছাড়েন না—সাহেব বলেন, বাঙ্গলাদেশে, বর্দ্ধমানের রাজা এবং নয়নজোড়ের বাবু, এই দুটি মাত্র যথার্থ বনেদী বংশ আছে।

 ঠাকুর্দ্দা ভারি খুসি হইতেন—এবং ভূতপূর্ব্ব ডেপুটি বাবুর সহিত সাক্ষাৎ হইলে অন্যান্য কুশলসংবাদের সহিত জিজ্ঞাসা করিতেন—ছোটলাট সাহেব ভাল আছেন? তাঁর মেমসাহেব ভাল আছেন? তাঁর পুত্রকন্যারা সকলেই ভাল আছেন? সাহেবের সহিত শীঘ্র একদিন সাক্ষাৎ করিতে যাইবেন এমন ইচ্ছাও প্রকাশ করিতেন। কিন্তু ভূতপূর্ব্ব ডেপুটি নিশ্চয় জানিতেন, নয়নজোড়ের বিখ্যাত চৌঘুড়ি প্রস্তুত হইয়া দ্বারে আসিতে আসিতে বিস্তর ছোট লাট এবং বড় লাট বদল হইয়া যাইবে!

 আমি একদিন প্রাতঃকালে গিয়া কৈলাস বাবুকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া চুপি চুপি বলিলাম-ঠাকুর্দ্দা, কাল লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণরের লেভিতে গিয়েছিলুম। তিনি নয়নজোড়ের বাবুদের কথা পাড়াতে আমি বল্লুম নয়নজোড়ের কৈলাস বাবু কলকাতাতেই আছেন—শুনে ছোটলাট এতদিন দেখা কর্‌তে আসেন নি বলে ভারি দুঃখিত হলেন—বলে দিলেন আজই দুপুর বেলা তিনি গোপনে তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আস্‌বেন।

 আর কেহ হইলে কথাটার অসম্ভব বুঝিতে পারিত এবং আর কাহারও সম্বন্ধে হইলে কৈলাস বাবুও এ কথায় হাস্য করিতেন—কিন্তু নিজের সম্বন্ধীয় বলিয়া এ সংবাদ তাঁহার লেশমাত্র অবিশ্বাস্য বোধ হইল না। শুনিয়া যেমন খুসি হইলেন তেমনি অস্থির হইয়া উঠিলেন—কোথায় বসাইতে হইবে, কি করিতে হইবে, কেমন করিয়া অভ্যর্থনা করিবেন—কি উপায়ে নয়নজোড়ের গৌরব রক্ষিত হইবে কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না। তাহা ছাড়া, তিনি ইংরাজি জানেন না, কথা চালাইবেন কি করিয়া সেও এক সমস্যা।

 আমি বলিলাম সে জন্য ভাবনা নাই, তাঁহার সঙ্গে এক জন করিয়া দোভাষী থাকে; কিন্তু ছোটলাট সাহেবের বিশেষ ইচ্ছা, আর কেহ যেন উপস্থিত না থাকে।

 মধ্যাহ্ন পাড়ার অধিকাংশ লোক যখন আপিসে গিয়াছে এবং অবশিষ্ট অংশ দ্বার রুদ্ধ করিয়া নিদ্রামগ্ন তখন কৈলাস বাবুর বাসার সম্মুখে এক জুড়ি আসিয়া দাঁড়াইল।

 তক্‌মা-পরা চাপ্‌রাসি তাঁহাকে খবর দিল ছোটলাট সাহেব আয়া! ঠাকুর্দ্দা প্রাচীনকাল-প্রচলিত শুভ্র জামাযোড়া এবং পাগ্‌ড়ি পরিয়া প্রস্তুত হইয়াছিলেন তাঁহার পুরাতন ভৃত্য গণেশটিকেও তাহার নিজের ধুতি চাদর জামা পরাইয়া ঠিক ঠাক করিয়া রাখিয়াছিলেন। ছোটলাটের আগমনসংবাদ শুনিয়াই হাঁপাইতে হাঁপাইতে কাঁপিতে কাঁপিতে ছুটিয়া দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইলেন—এবং সন্নতদেহে বারম্বার সেলাম করিতে করিতে ইংরাজবেশধারী আমার এক প্রিয়বয়স্যকে ঘরে লইয়া গেলেন।

 সেখানে চৌকির উপরে তাঁহার একমাত্র বহুমূল্য শালটি পাতিয়া রাখিয়াছিলেন তাহারই উপর কৃত্রিম ছোটলাটকে বসাইয়া উর্দ্দুভাষায় এক অতি বিনীত সুদীর্ঘ বক্তৃতা পাঠ করিলেন, এবং নজরের স্বরূপে স্বর্ণ রেকাবীতে তাঁহাদের বহুকষ্টরক্ষিত কুলক্রমাগত এক আস্‌রফির মালা ধরিলেন। প্রাচীন ভৃত্য গণেশ গোলাপপাশ এবং আতরদান লইয়া উপস্থিত ছিল।

 কৈলাস বাবু বারম্বার আক্ষেপ করিতে লাগিলেন যে, তাঁহাদের নয়নজাড়ের বাড়িতে হজুর বাহাদুরের পদধূলি পড়িলে তাঁহাদের যথাসাধ্য যথোচিত আতিথ্যের আয়োজন করিতে পারিতেন—কলিকাতায় তিনি প্রবাসী—এখানে তিনি জলহীন মীনের ন্যায় সর্ব্ব বিষয়েই অক্ষম—ইত্যাদি।

 আমার বন্ধু দীর্ঘ হ্যাট্‌ সমেত অত্যন্ত গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িতে লাগিলেন। ইংরাজ কায়দা-অনুসারে এরূপ স্থলে মাথায় টুপি না থাকিবার কথা কিন্তু আমার বন্ধু ধরা পড়িবার ভয়ে যথাসম্ভব আচ্ছন্ন থাকিবার চেষ্টায় টুপি খোলেন নাই। কৈলাসবাবু এবং তাঁহার গর্ব্বান্ধ প্রাচীন ভৃত্যটি ছাড়া আর সকলেই মুহূর্ত্তের মধ্যেই বাঙ্গালীর এই ছদ্মবেশ ধরিতে পারিত।

 দশমিনিট কাল ঘাড় নাড়িয়া আমার বন্ধু গাত্রোত্থান করিলেন এবং পূর্ব্বশিক্ষামত চাপ্‌রাসিগণ সোনার রেকাবীসুদ্ধ আসরফির মালা, চৌকি হইতে সেই শাল, এবং ভৃত্যের হাত হইতে গোলাপপাশ এবং আতরদান সংগ্রহ করিয়া ছদ্মবেশীর গাড়িতে তুলিয়া দিল—কৈলাস বাবু বুঝিলেন ইহাই ছোটলাটের প্রথা। আমি গোপনে এক পাশের ঘরে লুকাইয়া দেখিতেছিলাম এবং রুদ্ধ হাস্যবেগে আমার পঞ্জর বিদীর্ণ হইবার উপক্রম হইতেছিল।

 অবশেষে কিছুতে আর থাকিতে না পারিয়া ছুটিয়া কিঞ্চিৎদূরবর্ত্তী এক ঘরের মধ্যে গিয়া প্রকাশ করিলাম—এবং সেখানে হাসির উচ্ছ্বাস উন্মুক্ত করিয়া দিয়া হঠাৎ দেখি, একটি বালিকা তক্তপোষের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছে।

 আমাকে হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করিয়া হাসিতে দেখিয়া সে তৎক্ষণাৎ তক্তা ছাড়িয়া দাঁড়াইল—এবং অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে রোষের গর্জ্জন আনিয়া আমার মুখের উপর সজল বিপুল কৃষ্ণচক্ষের সুতীক্ষ্ণ বিদ্যুৎ বর্ষণ করিয়া কহিল—“আমার দাদামশায় তোমাদের কি করেছেন—কেন তোমরা তাঁকে ঠকাতে এসেচ—কেন এসেচ তোমরা”—অবশেষে আর কোন কথা জুটিল না—বাক্‌রুদ্ধ হইয়া মুখে কাপড় দিয়া কঁদিয়া উঠিল।

 কোথায় গেল আমার হাস্যাবেগ! আমি যে কাজটি করিয়াছি তাহার মধ্যে কৌতুক ছাড়া আর যে কিছু ছিল এতক্ষণ তাহা আমার মাথায় আসে নাই—হঠাৎ দেখিলাম অত্যন্ত কোমল স্থানে অত্যন্ত কঠিন আঘাত করিয়াছি; হঠাৎ আমার কৃত কার্য্যের বীভৎস নিষ্ঠুরতা আমার সম্মুখে দেদীপ্যমান হইয়া উঠিল—লজ্জায় এবং অনুতাপে পদাহত কুক্কুরের ন্যায় ঘর হইতে নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেলাম। বৃদ্ধ আমার কাছে কি দোষ করিয়াছিল? তাহার নিরীহ অহঙ্কার ত কখন কোন প্রাণীকে আঘাত করে নাই। আমার অহঙ্কার কেন এমন হিংস্রমুর্ত্তি ধারণ করিল?

 তাহা ছাড়া আর একটি বিষয়ে আজ হঠাৎ দৃষ্টি খুলিয়া গেল। এতদিন আমি কুসুমমণিকে, কোন অবিবাহিত পাত্রের প্রসন্ন দৃষ্টিপাতের প্রতীক্ষায় সংরক্ষিত পণ্য-পদার্থের মত দেখিতাম—ভাবিতাম, আমি পছন্দ করি নাই বলিয়া ও পড়িয়া আছে, দৈবাৎ যাহার পছন্দ হইবে ও তাহারই হইবে। আজ দেখিলাম এই গৃহকোণে, ঐ বালিকামূর্ত্তির অন্তরালে একটি মানব হৃদয় আছে। তাহার নিজের সুখ দুঃখ অনুরাগ বিরাগ লইয়া একটি অন্তঃকরণ একদিকে অজ্ঞেয় অতীত আর একদিকে অভাবনীয় ভবিষ্যৎ নামক দুই অনন্ত রহস্যরাজ্যের দিকে পূর্ব্বে পশ্চিমে প্রসারিত হইয়া রহিয়াছে। যে মানুষের মধ্যে হৃদয় আছে সে কি কেবল পণের টাকা এবং নাক চোখের পরিমাণ মাপিয়া পছন্দ করিয়া লইবার যোগ্য?

 সমস্ত রাত্রি নিদ্রা হইল না। পরদিন প্রত্যুষে বৃদ্ধের সমস্ত অপহৃত বহুমূল্য দ্রব্যগুলি লইয়া চোরের ন্যায় চুপি চুপি ঠাকুর্দ্দার বাসায় গিয়া প্রবেশ করিলাম-ইচ্ছা ছিল কাহাকেও কিছু না বলিয়া গোপনে চাকরের হাতে সমস্ত দিয়া আসিব।

 চাকরকে দেখিতে না পাইয়া ইতস্ততঃ করিতেছি এমন সময় অদূরবর্ত্তী ঘরে বৃদ্ধের সহিত বালিকার কথোপকথন শুনিতে পাইলাম। বালিকা সুমিষ্ট সস্নেহ স্বরে জিজ্ঞাসা করিতেছিল, দাদা মশায়, কাল লাট সাহেব তোমাকে কি বল্লেন? ঠাকুর্দ্দা অত্যন্ত হর্ষিত চিত্তে লাট সাহেবের মুখে প্রাচীন নয়নজোড় বংশের বিস্তর কাল্পনিক গুণানুবাদ বসাইতেছিলেন। বালিকা তাহাই শুনিয়া মহোৎসাহ প্রকাশ করিতেছিল।

 বৃদ্ধ অভিভাবকের প্রতি মাতৃহৃদয়া এই ক্ষুদ্র বালিকার সকরুণ ছলনায় আমার দুই চক্ষে জল ছল্‌ ছল্‌ করিয়া আসিল। অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম—অবশেষে ঠাকুর্দ্দা তাঁহার কাহিনী সমাপন করিয়া চলিয়া আসিলে আমার প্রতারণার বমালগুলি লইয়া বালিকার নিকট উপস্থিত হইলাম এবং নিঃশব্দে তাহার সম্মুখে সমস্ত রাখিয়া বাহিরে চলিয়া আসিলাম।

 বর্ত্তমান কালের প্রথানুসারে অন্যদিন বৃদ্ধকে দেখিয়া কোন প্রকার অভিবাদন করিতাম না—আজ তাঁহাকে প্রণাম করিলাম। বৃদ্ধ নিশ্চয় মনে ভাবিলেন, গতকল্য ছোট লাট তাঁহার বাড়িতে আসাতেই সহসা তাঁহার প্রতি আমার ভক্তির উদ্রেক হইয়াছে। তিনি পুলকিত হইয়া শতমুখে ছোটলাটের গল্প বানাইয়া বলিতে লাগিলেন—আমিও কোন প্রতিবাদ না করিয়া তাহাতে যোগ দিলাম। বাহিরের অন্য লোক যাহারা শুনিল তাহারা এ কথাটাকে আদ্যোপান্ত গল্প বলিয়া স্থির করিল, এবং সকৌতুকে বৃদ্ধের সহিত সকল কথায় সায় দিয়া গেল।

 সকলে উঠিয়া গেলে আমি অত্যন্ত সলজ্জ মুখে দীনভাবে বৃদ্ধের নিকট একটি প্রস্তাব করিলাম। বলিলাম, যদিও নয়নজোড়ের বাবুদের সহিত আমাদের বংশমর্যাদার তুলনাই হইতে পারে না তথাপি—

 প্রস্তাবটা শেষ হইবামাত্র বৃদ্ধ আমাকে বক্ষে আলিঙ্গন করিয়া ধরিলেন, এবং আনন্দবেগে বলিয়া উঠিলেন—আমি গরীব—আমার যে এমন সৌভাগ্য হবে তা আমি জানতুম ভাই—আমার কুসুম অনেক পুণ্য করেছে তাই তুমি আজ ধরা দিলে! বলিতে বলিতে বৃদ্ধের চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল।

 বৃদ্ধ, আজ এই প্রথম, তাঁহার মহিমান্বিত পূর্ব্বপুরুষদের প্রতি কর্ত্তব্য বিস্মৃত হইয়া স্বীকার করিলেন যে, তিনি গরীব, স্বীকার করিলেন যে, আমাকে লাভ করিয়া নয়নজোড় বংশের গৌরব হানি হয় নাই। আমি যখন বৃদ্ধকে অপদস্থ করিবার জন্য চক্রান্ত করিতেছিলাম তখন বৃদ্ধ আমাকে পরম সৎপাত্র জানিয়া একান্তমনে কামনা করিতেছিলেন।