ব্যবহারকারী:Subrata Roy/শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত/আদিলীলা/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে


বন্দে গুরূনীশভক্তা-
নীশমীশাবতারকান্‌।
তৎপ্রকাশাংশ্চ তচ্ছক্তীঃ
কৃষ্ণচৈতন্যসংজ্ঞকম্‌॥ ১

অন্বয়ঃ।- গুরূন্‌ (গুরুগণকে), ঈশভক্তান্‌ (ঈশ্বরের ভক্তগণকে, শ্রীবাসাদিকে), ঈশাবতারকান্‌ (ঈশ্বরের অবতারগণকে, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যাদিকে), তৎপ্রকাশান্‌ (ঈশ্বরের প্রকাশগণকে, শ্রীপাদ নিত্যানন্দাদিকে), তচ্ছক্তীঃ (ঈশ্বরের শক্তিসমূহকে, শ্রীগদাধরাদিকে), কৃষ্ণচৈতন্য-সংজ্ঞকম্‌ ঈশং চ বন্দে (ও শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য-নামক ঈশ্বরকে বন্দনা করি)।

অনুবাদ।- আমি শ্রীরূপসনাতনপ্রমূখ শিক্ষাগুরু ও দীক্ষাগুরুদের বন্দনা করি। বন্দনা করি তাঁদের, - শ্রীবাস প্রভৃতি যাঁরা ঈশ্বরের ভক্ত, অদ্বৈত প্রভৃতি যাঁরা ঈশ্বরের অবতার, নিত্যানন্দ প্রভৃতি যাঁরা ঈশ্বরের প্রকাশ, গদাধর প্রভৃতি যাঁরা ঈশ্বরের শক্তি এবং বন্দনা করি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যকে যিনি স্বয়ং ঈশ্বর॥ ১ ॥

মন্তব্য।- প্রথম শ্লোক হইতে চতুর্দ্দশ শ্লোক পর্য্যন্ত গ্রন্থকারের স্বীয়গ্রন্থের মঙ্গলাচরণ। ইহার পরে সপ্তদশ শ্লোকের শেষে গ্রন্থকার নিজেই বাঙ্গালা পয়ারে তাহা বলিয়াছেন। মঙ্গলাচরণের শ্লোকগুলির মধ্যে কতকগুলি গ্রন্থকারের নিজকৃত। ৪ সংখ্যক শ্লোকটি শ্রীরূপ গোস্বামীর "বিদগ্ধমাধব" নাটক হইতে গৃহীত। ৫ হইতে ১১ সংখ্যক শ্লোকগুলি শ্রীরূপ দামোদর গোস্বামীর করচা হইতে গৃহীত। ঐ করচা এক প্রকার সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ। ১২ হইতে ১৭ সংখ্যক শ্লোকও গ্রন্থকারের নিজের রচিত।

বন্দে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য-
নিত্যানন্দৌ সহোদিতৌ।
গৌড়োদয়ে পুষ্পবন্তৌ
চিত্রৌ শন্দৌ তমোনুদৌ॥ ২

অন্বয়ঃ।- গৌড়োদয়ে (গৌড়দেশরূপ উদয়াচলে) সহোদিতৌ (একই কালে সমূদিত) পুষ্পবন্তৌ (সূর্য্য ও চন্দ্রকে) চিত্রৌ (আশ্চর্য্য) শন্দৌ (কল্যাণপ্রদ) তমোনুদৌ (অজ্ঞানান্ধকার-নাশক) শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য- নিত্যানন্দৌ) বন্দে (শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ও নিত্যানন্দকে বন্দনা করি)

অনুবাদ।- গৌড়দেশে একই কালে আবির্ভূত হয়েছেন শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দ। উদয়গিরিতে একই কালে উদিত সূর্য্য-চন্দ্রের মতনই আশ্চর্য্য এঁদের আবির্ভাব। সূর্য্য-চন্দ্রের মতনই এঁরা কল্যাণকে এনেছেন, অন্ধকারকে নাশ করেছেন॥ ২॥

যদদ্বৈতং ব্রহ্মোপনিষদি
তদপ্যস্য তনুভা,
য আত্মান্তর্য্যামী পুরুষ ইতি
সোহস্যাংশবিভবঃ।
ষড়ৈশ্বর্য্যৈঃ পূর্ণো য ইহ
ভগবান্‌ স স্বয়ময়ং,
ন চৈতন্যাৎ কৃষ্ণাজ্জগতি
পরতত্ত্বং পরমিহ॥ ৩

অন্বয়ঃ।- উপনিষদি (উপনিষদে) যৎ অদ্বৈতং ব্রহ্ম (যাহা অদ্বিতীয় ব্রহ্ম) তদপি (তিনিও, সেই ব্রহ্মও) অস্য তনুভা (শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের অঙ্গজ্যোতি), আত্মান্তর্য্যামী যঃ পুরুষঃ (যে পুরুষ অন্তর্য্যামী আত্মা) ইতি সঃ অস্য অংশবিভবঃ (তিনি ইঁহার অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের অংশরূপ বিভূতি), ইহ ষঃ ষড়ৈশ্বর্য্যৈঃ পূর্ণঃ ভগবান, অয়ং সঃ স্বয়ম্‌ (ষড়ৈশ্বর্য্যপূর্ণ যিনি ভগবান্‌ ইনিই স্বয়ং তিনি), ইহ জগতি চৈতন্যাৎ কৃষ্ণাৎ পরং (শ্রেষ্ঠতর) পরতত্ত্বং ন (এই‌ জগতে চৈতন্যরূপী কৃষ্ণ হইতে আর শ্রেষ্ঠতত্ত্ব নাই)।

অনুবাদ।- উপনিষদে যিনি অদ্বৈত ব্রহ্ম তিনি এঁরই অঙ্গকান্তি। যোগশাস্ত্রে যিনি অন্তর্য্যামী আত্মা তিনি এঁরই আংশিক বিভূতি। এমন কি ষড়ৈশ্বর্য্যময় ভগবান্‌ যিনি তিনিও এঁরই স্বরূপ। সুতরাং কৃষ্ণস্বরূপ চৈতন্য থেকে পরম তত্ত্ব আর কিছু নেই।॥ ৩॥

শ্রীবিদগ্ধমাধবে (১।২)-
অনর্পিতচরীং চিরাৎ করুণয়াবতীর্ণঃ কলৌ
সমর্পয়িতুমুন্নতোজ্জলরসাং স্বভক্তিশ্রিয়ম্‌।
হরিঃ পুরটসুন্দরদ্যুতিকদম্বসন্দীপিতঃ
সদা হৃদয়কন্দরে স্ফুরতু বঃ শচীনন্দনঃ॥ ৪

অন্বয়ঃ।- চিরাৎ অনর্পিতচরীম্‌ (কোনকালে যাহা প্রদত্ত হয় নাই) উন্নতোজ্জ্বলরসাম্‌ (যাহাতে শৃঙ্গারাখ্য মধুর রস পরিপূর্ণভাবে বর্ত্তমান) স্বভক্তিশ্রিয়ং (নিজের প্রেম-সম্পদ্‌) সমর্পয়িতুং (প্রদান করিবার জন্য) কলৌ করুণয়া অবতীর্ণঃ পুরট-সুন্দরদ্যুতিকদম্বসন্দীপিতঃ (স্বর্ণবর্ণ দ্যুতিঃপুঞ্জ দ্বারা উজ্জলীকৃত) শচীনন্দনঃ হরিঃ (শচীনন্দনরূপী শ্রীহরি) বঃ হৃদয়কন্দরে সদা স্ফুরতু (আপনাদের হৃদয়রূপ গুহায় সর্ব্বদা স্ফুরিত হউন)।

অনুবাদ।- যা ছিল চির-অনর্পিত অর্থাৎ কোনোকালে যা কাউকে দেওয়া হয়নি সেই উজ্জল অর্থাৎ মধুর রসে রসাল নিজস্ব প্রেমসম্পদ বিলিয়ে দেবার জন্য করুণাবশতঃই তিনি কলিযুগে অবতীর্ণ হয়েছেন। স্বর্ণপুঞ্জের মতন উজ্জল তার দেহকান্তি। সেই শচীনন্দন হরি তোমাদের হৃদয়কন্দরে সর্ব্বদা দীপ্তি পেতে থাকুন॥ ৪॥

শ্রীস্বরূপগোস্বামিকরচায়াং-
রাধা কৃষ্ণপ্রণয়বিকৃতিহর্লাদিনীশক্তিরস্মা-
দেকাত্মানাবপি ভুবি পুরা দেহভেদং গতৌ তৌ
চৈতন্যাখ্যং প্রকটমধুনা তদ্দ্বয়ঞ্চৈক্যমাপ্তং
রাধাভাবদ্যুতিসুবলিতং নৌমিক কৃষ্ণস্বরূপম্‌॥ ৫

অন্বয়ঃ।- কৃষ্ণপ্রণয়বিকৃতিঃ (কৃষ্ণপ্রণয়ের বিকৃতি অর্থাৎ বিশেষরূপ প্রকাশ) হলাদিনীশক্তিঃ রাধা (আনন্দদায়িনী শক্তি শ্রীরাধিকা), অস্মাৎ তৌ একাত্মানৌ অপি ভুবি পুরা দেহভেদং গতৌ (এই হেতু একাত্ম হইয়াও তাঁহারা অনাদিকাল হইতে ভূ-বৃন্দাবনে দেহভেদ ধারণ করিয়াছিলেন), অধুনা চ তদ্দুয়ম্‌ ঐক্যম আপ্তং (সম্প্রতি সেই দুই একত্ব প্রাপ্ত হইয়া) রাধাভাবদ্যুতিসুবলিতং (রাধার ভাব ও অঙ্গকান্তির দ্বারা সুশোভিত) চৈতন্যাখ্যং প্রকটং কৃষ্ণস্বরূপং নৌমি (যিনি চৈতন্য নামে প্রকাশিত বা অবতীর্ণ হইয়াছেন অথচ স্বরূপতঃ যিনি কৃষ্ণ তাঁহাকে প্রণাম করি)।

অনুবাদ।- রাধা স্বরূপত কৃষ্ণপ্রেমই, তিনি কৃষ্ণের হলাদিনী শক্তি। রাধা ও কৃষ্ণের সত্তা ভিন্ন নয়, কিন্তু লীলার জন্যই তাঁরা ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এখন আবার তাঁরা চৈতন্যের মধ্যেই এক হয়েছেন, প্রকট হয়েছেন চৈতন্যরূপে। রাধার গৌরকান্তি ও কৃষ্ণপ্রেম নিয়ে যে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন - সেই চৈতন্যকে নমস্কার করি। ॥ ৫॥

শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা
কীদৃশো বানয়ৈবা-
স্বাদ্যো যেনাদ্ভূতমধুরিমা
কীদৃশো বা মদীয়ঃ।
সৌখ্যং চাস্যা মদনুভবতঃ
কীদৃশং বেতি লোভাৎ
তদ্ভাবাঢ্যঃ সমজনি শচী-
গর্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ॥ ৬

অন্বয়ঃ।- শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা বা কীদৃশঃ (শ্রীরাধার প্রণয়ের মহিমা কিরূপ), যেন অনয়া এব আস্বাদ্যঃ মদীয়ঃ অদ্ভূতমধুরিমা বা কীদৃশঃ (সেই প্রেমের দ্বারা আমার যে অদ্ভূত মাধুর্য্য তিনি আস্বাদ করেন তাহাই বা কিরূপ) মদনুভবতঃ অস্যাঃ সৌখ্যং বা কীদৃশম্‌ (আমাকে অনুভব করিয়া বা আস্বাদন করিয়া ইঁহার যে সুখ হয় তাহাই বা কিরূপ) ইতি লোভাৎ তদ্ভাবাঢ্যঃ সন্‌ হরীন্দুঃ শচীগর্ভসিন্ধৌ সমজনি (এই লোভ হইতে তাঁহার অর্থাৎ শ্রীরাধার ভাবযুক্তা হইয়া হরিরূপ চন্দ্র শচীগর্ভসিন্ধুতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন)।

অনুবাদ।- চন্দ্র যেমন সমুদ্র থেকে উঠেছিলেন, শ্রীচৈতন্যচন্দ্রও তেমনি শচীর সন্তান হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণই শ্রীরাধার ভাবযুক্ত হয়ে চৈতন্যরূপে জন্ম নিয়েছেন তিনটি সাধ পূরণের জন্য - প্রথম সাধ, - রাধাপ্রেমের মহিমা কতখানি তা তিনি জানবেন, দ্বিতীয় সাধ, - সেই প্রেমের আলোকপাতে শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্য্যের চমৎকারিতা কতখানি তা তিনি জানবেন, তৃতীয় সাধ - সেই চমৎকারিতা অনুভব করে রাধার আনন্দ কতখানি তাও তিনি জানবেন। ॥৬॥

সঙ্কর্ষণঃ কারণতোয়শায়ী
গর্ভোদশায়ী চ পয়োব্বিশায়ী।
শেষশ্চ যস্যাংশকলাঃ স নিত্যা-
নন্দাখ্যরামঃ শরণং মমাস্তু॥ ৭

মন্তব্য।- এই শ্লোক হইতে আরম্ভ করিয়া পাচটী শ্লোকে শ্রীনিত্যানন্দপ্রভুর তত্ত্ব বিবৃত হইয়াছে। এই লীলার পঞ্চম পরিচ্ছেদে গ্রন্থকার নিজেই ইহার সারার্থ প্রদান করিয়াছেন।

অন্বয়ঃ।- সঙ্কর্ষণঃ (মহাসঙ্কর্ষণ) কারণতোয়শায়ী (কারণবারিশায়ী) গর্ভোদশায়ী (ব্রহ্মাণ্ডন্তরজলশায়ী) পয়োব্ধিশায়ী চ (ক্ষীরসমুদ্রশায়ী) শেষঃ চ (এবং অনন্তদেব) [এতে (ইহারা সকলে) যস্য অংশকলাঃ (যাহার অংশ ও অংশাংশ)* স নিত্যানন্দাখ্যরামঃ মম শরণম্‌ অস্তু (সেই নিত্যানন্দাখ্যরাম আমার আশ্রয় হউন)।

  • অংশের অংশকে কলা বলা হয়।

অনুবাদ।- আমি নিত্যানন্দরূপী বলরামের শরণগ্রহণ করি। এঁরই অংশ বা কলা কারণসলিলশায় সঙ্কর্ষণ, গর্ভোদশায়ী বিরাট্‌, ক্ষারোদশায়ী বিষ্ণু ও অনন্তদেব॥ ৭॥

মায়াতীতে ব্যাপিবৈকুণ্ঠলোকে
পূর্ণৈশ্বর্য্যে শ্রীচতুর্ব্যূহমধ্যে।
রূপং যস্যোদ্ভাতি সঙ্কর্ষণাখ্যং
তং শ্রীনিত্যানন্দরামং প্রপদ্যে॥ ৮

অন্বয়ঃ।- মায়াতীতে ব্যাপিবৈকুণ্ঠলোকে (মায়াতীত সর্ব্বব্যাপক বৈকুণ্ঠলোকে) পূর্ণৈশ্বর্য্যে শ্রীচতুর্ব্যূহমধ্যে (ষড়ৈশ্বর্য্যপরিপূর্ণ শ্রীবাসুদেব সঙ্কর্ষণ প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ এই চতুর্ব্য্যহের মধ্যে) যস্য সঙ্কর্ষণাখ্যং রূপম্‌ উদ্ভাতি (যাঁহার সঙ্কর্ষণাখ্য রূপ প্রকাশ পাইতেছে) তং শ্রীনিত্যানন্দরামং প্রপদ্যে (সেই শ্রীনিত্যানন্দ রামকে আমি আশ্রয় করি)।

অনুবাদ।- আমি বলরামরূপী নিত্যানন্দের শরণ গ্রহণ করি। বলরাম সঙ্কর্ষণরূপে বৈকুণ্ঠের চতুর্ব্যূহের মধ্যে বিরাজিত আছেন। এই চত্যুর্ব্যূহ অর্থাৎ বাসুদেব, সঙ্কর্ষণ, প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ ষড়ৈশ্বর্য্যপূর্ণ। সর্ব্বব্যাপী ও মায়াতীত বৈকুণ্ঠেই এঁরা নিত্য বিরাজমান আছেন॥ ৮॥

মায়াভর্ত্তাজাণ্ডসংঘাশ্রয়াঙ্গঃ
শেতে সাক্ষাৎ কারণাম্ভোধিমধ্যে।
যস্যৈকাংশঃ শ্রীপুমানাদিদেব-
স্তং শ্রীনিত্যানন্দরামং প্রপদ্যে॥ ৯

অন্বয়ঃ।- অজাণ্ডসংঘাশ্রয়াঙ্গঃ সাক্ষাৎ মায়াভর্ত্তা (যাঁহার অঙ্গ নিখিল ব্রহ্মাণ্ডসমূহের আশ্রয়, যিনি মায়ার সাক্ষাৎ অধীশ্বর), [যঃ] কারণাম্ভোধিমধ্যে শেতে (যিনি কারণসমুদ্রে শয়ন করিয়া আছেন) [সঃ] আদিদেবঃ শ্রীপুমান যস্য একাংশঃ (সেই আদিদেব মহাবিষ্ণু যাঁহার একাংশ) তং শ্রীনিত্যানন্দরামং প্রপদ্যে (সেই শ্রীনিত্যানন্দ-নামক রামের আমি শরণ গ্রহণ করিতেছি)।

অনুবাদ।- আমি বলরামরূপী নিত্যানন্দের শরণ গ্রহণ করি। এঁরই অংশ আদিদেব প্রথম পুরুষ মহাবিষ্ণু মায়ার অধীশ এবং তাঁর দেহ থেকে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি হয়েছে। তিনি কারণ সাগরে শায়িত থাকেন। ॥ ৯ ॥

যস্যাংশাংশঃ শ্রীল-গর্ভোদশায়ী
যন্নাভ্যব্জং লোক্‌সংঘাতনালম্‌।
লোকস্রষ্টুঃ সূতিকাধাম ধাতু-
স্তং শ্রীনিত্যানন্দরামং প্রপদ্যে॥ ১০

অন্বয়ঃ।- লোকসংঘাতনালং (লোকসমূহের আশ্রয়স্থান) ষন্যাজ্যব্জং (যাহার নাভিপদ্ম) লোকস্রষ্টুঃ ধাতুঃ সূতিকাধাম (লোকস্রষ্টা বিধাতার জন্মস্থান) [সঃ] শ্রীলগর্দ্ভোদশায়ী যস্য অংশাংশঃ (সেই গর্ভোদকশায়ী যাঁহার অংশেরও অংশ) তং শ্রীনিত্যান্‌ন্দরামং প্রপদ্যে (আমি সেই শ্রীনিত্যানন্দনামক শ্রীবলরামের শরণ গ্রহণ করিলাম)।

অনুবাদ।- আমি বলরামরূপী নিত্যানন্দের শরণ গ্রহণ করি। এঁরই অংশের অংশ গর্ভোদশায়ী সহস্রশীর্ষ বিরাট্‌ পুরুষ, যাঁর নাভিপদ্ম প্রজাপতি ব্রহ্মার জন্মস্থান এবং ঐ পদ্মের নালেই চতুর্দ্দশ ভুবনের সৃষ্টি।॥ ১০॥

যস্যাংশাংশাংশঃ পরাত্মাখিলানাং
পোষ্টা বিষ্ণুর্ভাতি দুগ্ধাব্ধিশায়ী।
ক্ষৌণীভর্ত্তা যৎকলা সোহপ্যনন্ত-
স্তং শ্রীনিত্যানন্দরামং প্রপদ্যে॥ ১১

অন্বয়ঃ।- যস্য অংশাংশাংশঃ (যাঁহার অংশের অংশের অংশ) অখিলানাং (সমস্ত ব্যষ্টিজীবের) পরাত্মা (অন্তর্য্যামী পরমাত্মা) পোষ্টা (পলায়িতা) দুগ্ধাব্ধিশায়ী (ক্ষীরসমুদ্রে শয়নকারী) বিষ্ণুর্ভাতি (বিষ্ণুরূপে বিরাজিত) ক্ষৌণীভর্ত্তা সঃ অপি অনন্তঃ যৎকলা (পৃথিবীর পালনকর্ত্তা বা ধারণকর্ত্তা সেই অনন্তদেব যাঁহার অংশেরও অংশ) তং শ্রীনিত্যানন্দরামং প্রপদ্যে (সেই শ্রীনিত্যানন্দনাম শ্রীবলরামের শরণ গ্রহণ করিতেছি)।

অনুবাদ।- আমি নিত্যানন্দরূপী বলরামের শরণ গ্রহণ করি। ক্ষীরসাগরশায়ী বিষ্ণু যিনি নিখিল-বিশ্বের পালক ও চালক তিনি এঁর অংশের অংশেরও অংশ মাত্র। আর অনন্তনাগ যিনি পৃথিবীধারণ করে আছেন তিনিও এঁরই কলা বা আবেশ-অবতার॥ ১১ ॥

মন্তব্য।- পরবর্তী দুই শ্লোকে শ্রীল অদ্বৈত আচার্য্যপ্রভুর তত্ত্ব কথিত হইতেছে।

মহাবিষ্ণুর্জগৎকর্ত্তা মায়য়া যঃ সৃজত্যদঃ।
তস্যাবার এবায়মদ্বৈতাচার্য্য ঈশ্বরঃ॥ ১২

অন্বয়ঃ।- জগৎকর্ত্তা (জগতের সৃষ্টিকর্ত্তা) যঃ মহাবিষ্ণুঃ মায়য়া (যে মহাবিষ্ণু মায়ার দ্বারা) অদঃ (বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড) সৃজতি (সৃষ্টি করেন) অয়ম্‌ অদ্বৈতাচার্য্যঃ ঈশ্বরঃ তস্য এব অবতারঃ (এই ঈশ্বর অদ্বৈতাচার্য্য তাঁহারই অবতার)।

অনুবাদ।- জগতের কর্ত্তা মহাবিষ্ণু যিনি মায়ার সাহায্যে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বরস্বরূপ এই অদ্বৈতাচার্য্য তাঁহারই অবতার॥ ১২ ॥

অদ্বৈতং হরিণাদ্বৈতা-
দাচার্য্যং ভক্তিশংসনাৎ।
ভক্তাবতারমীশন্ত-
মদ্বৈতাচার্য্যমাশ্রয়ে॥ ১৩

অন্বয়ঃ।- হরিণা অদ্বৈতাৎ অদ্বৈতৎ (শ্রীহরির সহিত অভিন্নত্ব হেতু যিনি অদ্বৈত) ভক্তিশংসনাৎ আচার্য্যং (ভক্তি-উপদেশ করিবার জন্য যিনি আচার্য্য) ভক্তাবতারম্‌ ঈশং তম্‌ অদ্বৈতাচার্য্যম্‌ আশ্রয়ে (ভক্তরূপে অবতীর্ণ হইলেও সেই ঈশ্বর অদ্বৈত আচার্য্যকে আশ্রয় করি)।

অনুবাদ।- আমি ভক্তাবতার ও ঈশ্বরস্বরূপ অদ্বৈতাচার্য্যের আশ্রয়গ্রহণ করি। ইনি আর হরি অভিন্ন বলেই এর নাম অদ্বৈত। ভক্তি-শিক্ষা দিয়েছেন ব'লেই ইনি আচার্য্য ॥ ১৩ ॥

পঞ্চতত্ত্বাত্মকং কৃষ্ণং
ভক্তরূপস্বরূপকম্‌।
ভক্তাবতারং ভক্তাখ্যং
নমামি ভক্তশক্তিকম্‌॥ ১৪

অন্বয়ঃ।- ভক্তরূপস্বরূপকং (ভক্তরূপ স্বয়ং শ্রীচৈতন্য, ভক্তস্বরূপ শ্রীনিত্যানন্দ) ভক্তাবতারং (ভক্তাবতার শ্রীঅদ্বৈত) ভক্তাখ্যং (ভক্ত নামক শ্রীবাসাদি) ভক্তশক্তিকং (ভক্তশক্তি শ্রীগদাধরাদি) পঞ্চতত্ত্বাত্মকং কৃষ্ণং নমামি (এই পঞ্চতত্ত্বাত্মক) শ্রীকৃষ্ণকে - শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচন্দ্রকে প্রণাম করি)।

অনুবাদ।- আমি শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করি। শ্রীচৈতন্য, নিত্যানন্দ, অদ্বৈতাচার্য্য, গদাধরপণ্ডিত ও শ্রীবাসাদি পঞ্চতত্ত্বের স্বরূপভূত ইনি শ্রীচৈতন্যে ভক্তরূপে, নিত্যানন্দে ভক্ত-স্বরূপে, অদ্বৈতাচার্য্যে ভক্তাবতাররূপে, গদাধরে ভক্তশক্তিরূপে এবং শ্রীবাসাদিতে ভক্তনামধারী রূপে বিরাজিত আছেন। ॥ ১৪ ॥

মন্তব্য।- শ্রীল কবিকর্ণপূরের "শ্রীগৌরগণোদ্দেশদীপিকা" গ্রন্থে বলা হইয়াছে - পূর্বে শ্রীকৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হইবার সময়ে তিনি যেরূপ পঞ্চতত্ত্বরূপে প্রকাশ পাইয়াছিলেন, এখন শ্রীগৌরাঙ্গ অবতারেও তিনি সেইরূপ পঞ্চতত্ত্বরূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন। মনে হয় শ্রীল কবিকর্ণপূর হইতেই পঞ্চতত্ত্বসিদ্ধান্তের প্রচার হইয়াছে।

জয়তাং সুরতৌ পঙ্গো-
র্মম মন্দমতের্গতী।
মৎসর্ব্বস্ব-পদাম্ভোজৌ
রাধামদমোহনৌ॥ ১৫

অন্বয়ঃ।- পঙ্গোঃ মন্দমতেঃ মম (গতি-শক্তিহীন এবং মন্দমতি আমার) গতি (একমাত্র গতি) মৎসর্ব্বস্বপদাম্ভোজৌ (যাঁহাদিগের পাদপদ্মই আমার সর্ব্বস্ব) সুরতৌ (কৃপালু) রাধামদমোহনৌ জয়তাম্‌ (সেই শ্রীরাধামদনমোহনের জয় হউক)।

অনুবাদ।- ভক্তের প্রতি কৃপালু শ্রীরাধামদনমোহন জয়লাভ করুন। আমি মন্দমতি ও পঙ্গু কিন্তু তাঁদের চরণকমলই আমার সর্ব্বস্ব ও পরম শরণ॥ ১৫ ॥

দীব্যদ্বৃন্দারণ্যকল্পদ্রুমাধঃ
শ্রীমদ্‌রত্নাগার-সিংহাসনস্থৌ
শ্রীমদ্‌রাধা-শ্রীল-গোবিন্দদেবৌ
প্রেষ্ঠালীভিঃ সেব্যমানৌ স্মরামি॥ ১৬

অন্বয়ঃ।- দীব্যদ্বৃন্দারণ্য-কল্পদ্রুমাধঃ (পরম-শোভাময় শ্রীবৃন্দাবনে কল্পবৃক্ষের নিম্নদেশে) শ্রীমদ্‌রত্নাগারসিংহাসনস্থৌ (পরমসুন্দর রত্নমন্দিরমধ্যস্থ সিংহাসনে আসীন) প্রেষ্ঠালীভিঃ সেব্যমানৌ (প্রিয় সখীগণকর্ত্তৃক পরিসেবিত) শ্রীমদ্‌রাধা-শ্রীল-গোবিন্দদেবৌ স্মরামি (শ্রীমদ্রাধাগোবিন্দদেবকে স্মরণ করিতেছি)।

অনুবাদ।- শ্রীরাধা ও শ্রীগোবিন্দদেবকে আমি স্মরণ করি। দীপ্তিমান্‌ বৃন্দারণ্যে কল্পতরুর নীচে রত্মমন্দিরের রত্মসিংহাসনে আসীন তাঁরা প্রিয়সখীবেষ্টিত হয়ে বিরাজিত আছেন॥ ১৬ ॥

শ্রীমান্‌রাসরসারম্ভী
বংশীবটতটস্থিতঃ।
কর্ষন্‌ বেণুস্বনৈর্গোপী-
র্গোপীনাথঃ শ্রিয়েহস্তু নঃ॥ ১৭

অন্বয়ঃ।- বংশীবটতটস্থিতঃ (বংশীতটের মূলদেশে অবস্থিত) বেণুস্বনৈঃ গোপীঃ কর্ষন্‌ (বেণুধ্বনিদ্বারা কান্তাভাববতী গোপীদিগের আকর্ষণকারী) রাসরসারম্ভী শ্রীমান্‌ গোপীনাথঃ (রাসরসপ্রবর্ত্তক সেই গোপীনাথ) নঃ শ্রিয়ে অস্তু (আমাদের কুশল বিধান করুন)।

অনুবাদ।- গোপীনাথ আমাদের মঙ্গল করুন। রাসলীলায় অভিলাষী হয়ে পরমসুন্দর ইনিই (যমুনা-তটে) বংশীবটের তলে বেণু বাজিয়ে গোপীদের আকর্ষণ করেছিলেন॥ ১৭ ॥

জয় জয় শ্রীচৈতন্য! জয় নিত্যানন্দ!
জয়াদ্বৈতচন্দ্র! জয় গৌরভক্তবৃন্দ!
এই তিন ঠাকুর গৌড়িয়াকে (২)
করিয়াছেন আত্মসাথ (৩)।
এ তিনের চরণ বন্দো তিন
মোর নাথ॥
গ্রন্থের আরম্ভে করি মঙ্গলাচরণ।
গুরু বৈষ্ণব ভগবান্‌ - তিনের স্মরণ॥
তিনের স্মরণে হয় বিঘ্ন বিনাশন।
অনায়াসে হয় নিজ বাঞ্ছিত পূরণ॥
সে মঙ্গলাচরণ হয় ত্রিবিধ প্রকার।
বস্তু-নির্দ্দেশ, আশীর্ব্বাদ আর নমস্কার (৪)॥
আদি দুই শ্লোকে ইষ্টদেবে নমস্কার।
সামান্য-বিশেষরূপে দুইত প্রকার॥

(১) শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত গ্রন্থ। সুতরাং সংস্কৃত শ্লোকের পর প্রকৃত গ্রন্থারম্ভে ইহাই সর্ব্বপ্রথম বাঙ্গালা ভাষার শুভসূচনা - জয় জয় শ্রীচৈতন্য ইত্যাদি। এটা সাধারণ মঙ্গলাচর। কোনও কোনও পুঁথিতে এই পয়ার দুইটী দেখা যায় না। টীকাকারগণ পরবর্ত্তী পয়ারের এই তিন ঠাকুর অর্থে পূর্ব্বের তিন শ্লোকোক্ত গ্রন্থকারসেবিত মদনমোহন, গোবিন্দ ও গোপীনাথ অর্থ ধরিয়াছেন।

(২) গৌড়িয়াকে - গৌড়দেশবাসী বৈষ্ণবগণকে।

(৩) আত্মসাথ - নিজত্বে অঙ্গীকার অর্থাৎ আপনার বলিয়া সেবাকার্য্যে গ্রহণ।

(৪) "আশীর্নমস্ক্রিয়াবাস্তুনির্দ্দেশো বাপি তন্মুখম্‌।" বস্তুনির্দ্দেশ - গ্রন্থে বর্ণনীয় বিষয়ের উল্লেখ।

তৃতীয় শ্লোকেতে করি বস্তুর নির্দ্দেশ।
যাহা হৈতে জানি পরতত্ত্বের উদ্দেশ॥
চতুর্থ শ্লোকেতে করি জগতে আশীর্ব্বাদ।
সর্ব্বত্র মাগিয়ে কৃষ্ণচৈতন্য-প্রসাদ॥
সেই শ্লোকে কহি বাহ্য-অবতার-কারণ (১)।
পঞ্চ-ষষ্ঠ শ্লোকে কহি মূল প্রয়োজন॥
এই ছয় শ্লোকে কহি চৈতন্যের তত্ত্ব।
আর পঞ্চ শ্লোকে নিত্যানন্দের মহত্ত্ব॥
আর দুই শ্লোকেতে অদ্বৈত তত্ত্বাখ্যান।
আর এক শ্লোকে পঞ্চতত্ত্বের ব্যাখ্যান॥
এই চৌদ্দ শ্লোকে করি মঙ্গলাচরণ।
তহি মধ্যে কহি সব বস্তু-নিরূপণ॥
সব শ্রোতা বৈষ্ণবেরে করি নমস্কার।
এই সব শ্লোকের করি অর্থ বিচার॥
সকল বৈষ্ণব শুন করি এক মন।
চৈতন্য-কৃষ্ণের শাস্ত্রমত নিরূপণ॥ (২)
কৃষ্ণ গুরুদ্বয় (৩) ভক্ত অবতার প্রকাশ (৪)।
শক্তি এই ছয়রূপে করেন বিলাস॥
এই ছয় তত্ত্বের করি চরণ বন্দন।
প্রথমে সামান্যে করি মঙ্গলাচরণ॥

(১) বাহ্যাবতার-কারণ - অবতীর্ণ হইবার বাহিরের কারণ - অবতার গ্রহণের একটী কারণ অধর্ম্মের অভ্যুত্থান নিবারণ ও ধর্ম্মসংস্থাপন। এইটী বাহ্যকারণ। আর অবতারীর নিজ উদ্দেশ্যসাধন মূলকারণ বা অন্তরঙ্গ কারণ। রসাস্বাদনই ঐ মূলকারণ, তাহার নানাবিধ বৈচিত্র্যই উহার চমৎকারিত্বের হেতু। উহার দ্বারাই রসিক ও ভাবুকগণ আকৃষ্ট হন।

(২) অর্থাৎ চৈতন্য মহাপ্রভু যে শ্রীকৃষ্ণ, তাহা শাস্ত্রমতে নির্ণয়।

(৩) গুরুদ্বয় - দীক্ষাগুরু ও শিক্ষাগুরু।

(৪) শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ংরূপে, গুরুতত্ত্বরূপে, শক্তিতত্ত্বরূপে, ভক্তরূপে, অবতাররূপে এবং প্রকাশতত্ত্বরূপে বিলাস অর্থাৎ লীলা করিয়া থাকেন।

তথাহি।
বন্দে গুরূনীশভক্তানিত্যাদি॥

অনুবাদ।- প্রথম শ্লোক ব্যাখ্যায় দ্রষ্টব্য।

মন্ত্রগুরু আর যত শিক্ষাগুরুগণ।
তাঁ সবার আগে করি চরণ বন্দন॥
শ্রীরূপ সনাতন ভট্ট রঘুনাথ।
শ্রীজীব গোপাল-ভট্ট দাস রঘুনাথ॥
এই ছয় গুরু শিক্ষাগুরু যে আমার।
ইহা সভার পদ-আগে করি নমস্কার (৫)॥
ভগবানের ভক্ত যত শ্রীবাস প্রধান (৬)।
তাঁ সভার পাদপদ্মে সহস্র প্রণাম॥
অদ্বৈত আচার্য্য প্রভুর অংশ-অবতার।
তাঁর পাদপদ্মে কোটি প্রণতি আমার॥
নিত্যানন্দরায় প্রভুর স্বরূপ প্রকাশ।
তাঁর পাদপদ্ম বন্দোঁ, মুঞি যাঁর দাস॥
গদাধর পণ্ডিতাদি প্রভুর নিজশক্তি।
তাঁ সবার চরণে মোর সহস্র প্রণতি॥
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য-প্রভু স্বয়ং ভগবান্‌।
তাঁহার পদারবিন্দে অনন্ত প্রণাম॥
সাবরণে (৭) প্রভুরে করিয়া নমস্কার।
এই ছয় তেহোঁ যৈছে - করি সে বিচার (৮)॥
যদ্যপি আমার গুরু চৈতন্যের দাস।
তথাপি জানিয়ে আমি তাঁহার প্রকাশ (৯)॥
গুরু কৃষ্ণরূপ হন শাস্ত্রের প্রমাণে।
গুরুরূপে কৃষ্ণ কৃপা করেন ভক্তগণে॥

(৫) আমি ইঁহাদের চরণ-স্পর্শের অযোগ্য, এই নিমিত্ত চরণের অগ্রে নমস্কার করি।

(৬) শ্রীবাস (পূর্ব্বলীলার নারদ) ভগবানের প্রধান ভক্ত, গৌর-ভক্তবৃন্দের মধ্যে শ্রীবাস সকলের শ্রেষ্ঠ।

(৭) সাবরণে-আবরণের সহিত অর্থাৎ পার্ষদগণের সহিত।

(৮) সাক্ষাৎ সম্বন্ধে না হইলেও তিনিই যে উক্ত ছয়রূপে বিলাস করেন তাহার বিচার করিতেছি।

(৯) যদ্যপি আমার গুরু (গ্রন্থকারের দীক্ষাগুরু) মহাপ্রভুর সেবকরূপে গণ্য হইতেছেন, তথাপি তিনি আমার গুরু, এবং গুরুতেই যখন ভগবানের প্রকাশ দেখা যায়, তখন আমি তাঁহাকে মহাপ্রভুর প্রকাশ বলিয়াই জ্ঞান করি।

তথাহি শ্রীমদ্ভাগবতে ১১।১৮।২৭
আচার্য্যং মাং বিজানীয়ান্নাবমন্যেত কর্হিচিৎ।
ন মর্ত্ত্যবুদ্ধ্যাসূয়েত সর্ব্বদেবময়ো গুরুঃ॥ ১৯

অন্বয়ঃ।- [শ্রীভগবান্‌ উদ্ধবকে উপদেশ দিতেছেন।] আচার্য্যং মাং বিজানীয়াৎ (আচার্য্যকে আমারই স্বরূপ বলিয়া জানিবে)। কর্হিচিৎ ন অবমন্যেত (কখনও তাঁহাকে অবমাননা করিবে না)। মর্ত্ত্যবুদ্ধ্যা ন অসূয়েত (মানুষ ভাবিয়া কখনও তাঁহার দোষ দর্শন করিবে না)। গুরুঃ সর্ব্বদেবময়ঃ (কারণ শ্রীগুরুদেব সর্ব্বদেবময়)।

অনুবাদ।- আচার্যকে আমার স্বরূপ ব'লে জেনো। কখনও তাঁর অবমাননা ক'র না। তিনি সাধারণ মানব - এই জ্ঞানে তাঁকে কখনও তাচ্ছিল্য ক'র না, কেননা সমস্ত দেবতাই গুরুতে আছেন॥ ১৯ ॥

শিক্ষাগুরুকে ত' জানি - কৃষ্ণের স্বরূপ।
অন্তর্য্যামী ভক্তশ্রেষ্ঠ (১) এই দুই রূপ॥</poem>

(১) শ্রীকৃষ্ণ বাহিরে ভক্তশ্রেষ্ঠরূপে শিক্ষা প্রদান করিয়া অন্তরে অন্তর্য্যামিরূপে ঐ বিষয়ে অনুভব করাইয়া দেন। সুতরাং তিনি উক্ত দুইরূপে শিক্ষাগুরু হইয়া থাকেন।

তথাহি শ্রীমদ্ভাগবতে - ১১।২৯।৬
নৈবোপযন্ত্যপচিতিং কবয়স্তবেশ
ব্রহ্মায়ুষাপি কৃতমৃদ্ধমুদঃ স্মরন্তঃ।
যোহন্তর্বহিন্তনুভৃতামশুভং বিধুন্ব -
ন্নাচার্য্যচৈত্যবপুষা স্বগতিং ব্যনক্তি॥ ২০

অন্বয়ঃ।- [উদ্ধব শ্রীভগবান্‌কে কহিলেন] হে ঈশ (হে ভগবান) ষঃ (যে তুমি) আচার্য্যচৈত্যবপুষ (বাহিরে গুরুরূপে উপদেশাদি দ্বারা এবং অন্তরে অন্তর্য্যামিরূপে সাধু প্রবৃত্তি দ্বারা) তনুভৃতাং (দেহধারী মানবগণের) অশুভং বিধুন্বন্‌ (ভক্তির প্রতিবন্ধক সমস্ত বাধাকে দূরীভূত করিয়া) স্বগতিং ব্যনক্তি (নিজরূপ বা নিজ বিষয়ক অনুভব প্রকাশ কর) কবয়ঃ (তত্ত্বজ্ঞ বিদ্বান্‌গণ) ব্রহ্মায়ুষাপি (ব্রহ্মার সমান পরমায়ু প্রাপ্ত হইয়াও) তব (সেই তোমার) অপচিতিম্‌ (উপকারের প্রত্যুপকারপূর্ব্বক অঋণী) ন উপযান্তি (হইতে পারেন না) কৃতং (তোমার কৃত উপকার - অশুভ নাশ ও অনুভব প্রকাশ) স্মরন্তঃ (স্মরণ করিয়া) ঋদ্ধমুদঃ (তাঁহারা পরমানন্দে মত্ত হন)।

অনুবাদ।- হে প্রভু, বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরা ব্রহ্মার পরমায়ু পেলেও তোমার ঋণশোধ করতে পারবেন না। তুমি অন্তর্য্যামী রূপে মানবকে শুভ প্রবৃত্তি দাও ও গুরুরূপে বিষয়বাসনারূপ অশুভ থেকে নিবৃত্ত কর। এইভাবে সমস্ত অকল্যাণ দূর করে তাঁদের ভক্তিনির্ম্মল-চিত্তে আপনাকে প্রকাশ কর। তাই তাঁরা তোমার দয়া স্মরণ ক'রে পরমানন্দে বিভোর হয়ে থাকেন॥ ২০ ॥

শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায়াম্‌ ১০।১০
তেষাং সততযুক্তানাং
ভজতাং প্রীতি-পূর্ব্বকম্‌।
দদামি বুদ্ধিযোগং তং
যেন মামুপযান্তি তে॥ ২১

অন্বয়ঃ।- [শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে কহিতেছেনঃ-] সততযুক্তানাং (যাহাদের চিত্ত সর্ব্বদা আমাতে আসক্ত) প্রীতিপূর্ব্বকং ভজতাং তেষাং (এবং যাঁহারা প্রীতিভরে আমাকে ভজন করিয়া থাকেন তাঁহাদিগকে) তং বুদ্ধিযোগং দদামি (সেই বুদ্ধিরূপ যোগ বা উপায় প্রদান করিয়া থাকি) যেন তে মাম উপযান্তি (যাহাদ্বারা তাঁহারা আমাকে লাভ করেন)।

অনুবাদ।- আপন চিত্ত যারা নিঃশেষে আমাকেই দিয়েছে, প্রেমভরে যারা আমারই ভজনা ক'রে থাকে, তাদের আমি নির্ম্মলপ্রজ্ঞা দান করি এবং সেই প্রজ্ঞার দ্বারাই তারা আমাকে লাভ করে॥ ২১ ॥

যথা ব্রহ্মণে ভগবান্‌
স্বয়মুপদিশ্যানুভাবিতবান্‌।

(ভগবান্‌ ব্রহ্মাকে স্বয়ং উপদেশ প্রদান করিয়া যেমন অনুভব করাইয়াছিলেন)।

তথাহি
শ্রীমদ্ভাগবতে ২।৯।৩০-৩১
জ্ঞানং পরমগুহ্যং মে যদ্বিজ্ঞানসমন্বিতম্‌।
সরহস্যং তদঙ্গঞ্চু গৃহাণ গদিতং ময়া॥ ২২
যাবানহং যথা ভাবো যদ্রূপগুণকর্ম্মকঃ।
তথৈব তত্ত্ববিজ্ঞানমস্তু তে মদনুগ্রহাৎ॥ ২৩

অন্বয়ঃ।- [শ্রীভগবান ব্রহ্মাকে বলিতেছেনঃ-] পরমগুহ্যং (পরম গোপনীয়) বিজ্ঞানসমন্বিতম্‌ (অনুভবযুক্ত) যৎ মে জ্ঞানং ময়া গদিতং (মদ্বিষয়ক যে তত্ত্বজ্ঞান মৎকর্ত্তৃক কথিত হইতেছে) সরহস্যং ভক্তি-সমন্বিতং (তাহা প্রেমভক্তিরূপ রহস্যের সহিত) তদঙ্গঞ্চু (শ্রবণাদি ভক্তিরূপ সহায়ক সহ) গৃহাণ (গ্রহণ কর)। অহং যাবান্‌ (আমি স্বরূপতঃ যাদৃশ) যথাভাবঃ (যল্পক্ষণযুক্ত) যদ্রূপগুণকর্ম্মকঃ (যাদৃশ রূপ গুণ ও লীলা বিশিষ্ট) তথৈব তত্ত্ববিজ্ঞানং মদনুগ্রহাৎ তে অস্তু (আমার অনুগ্রহে তোমার সেই যাথার্থ্যানুভব হউক)।

অনুবাদ।- পরমগোপনীয় আমার সম্বন্ধীয় যে জ্ঞান পরমপ্রজ্ঞাস্বরূপ এবং রহস্যময় - এখন অঙ্গ-সহিত সেই তত্ত্ব আমি বলি তুমি শ্রবণ কর। আমার স্বরূপ কি, আমার স্বভাব কি, আমার রূপ গুণ কর্ম্মই বা কি এই সব তত্ত্বের নির্ম্মল প্রজ্ঞা অর্থাৎ বোধ আমার অনুগ্রহে তুমি লাভ কর॥ ২২।২৩ ॥

শ্রীমদ্ভাগবতে ২।৯।৩২
অহমেবাসমেবাগ্রে
নান্যৎ যৎ সদসৎ পরম্‌।
পশ্চাদহং যদেতচ্চ
যোহবশিষ্যেত সোহস্ম্যহম্‌॥ ২৪

অন্বয়ঃ।- অহম্‌ এব অগ্রে এব আসম্‌ (আমিই সৃষ্টির পূর্ব্বেও ছিলাম) অন্যৎ যৎ সদসৎ পরম্‌ (অন্য স্থুল সূক্ষ্ম বা ইহার কারণ অর্থাৎ প্রকৃতি) ন [আসীৎ (ইহা সৃষ্টির অবস্থাতেও আমি আছি)] অহম্‌ এতচ্চ যৎ (যঃ) [প্রলয়ে]; অবশিষ্যেত (ইহার পরে অর্থাৎ প্রলয়েও যাহা অবশিষ্ট থাকে) সঃ অহম অস্মি (সেও আমি)।

অনুবাদ।- সৃষ্টির পূর্ব্বেও আমিই বর্ত্তমান ছিলাম, প্রকৃতি বা প্রকৃতির বিকার কিছুই ছিল না। প্রলয়ে আমি থাকি, স্থিতিতেও আমি থাকি। সৃষ্টি যার থেকে হয়, স্থিতি যার দ্বারা হয়ে থাকে এবং যাতে সব কিছুর লয় ঘটে সেই আমিই চিরন্তন সত্য ও নিত্য॥ ২৪ ॥

শ্রীমদ্ভাগবতে ২।৯।৩৩
ঋতেহর্থং যৎ প্রতীয়েত
ন প্রতীয়েত চাত্মনি।
তদ্বিদ্যাদাত্মনো মায়াং
যথাভাসো যথা তমঃ॥ ২৫

অন্বয়ঃ।- অর্থম্‌ (পরমার্থ বস্তু আমি) ঋতে (বিনা) যৎ প্রতীয়েত (যাহার প্রতীতি হয়) আত্মনি (নিজের মধ্যে স্বতঃ) চ ন প্রতীয়েত (যাহার প্রতীতি ঘটে না) তৎ আত্মনঃ (তাহাই আমার) মায়াং বিদ্যাৎ (মায়া বলিয়া জানিবে) যথা আভা সঃ যথা তমঃ (দৃষ্টান্ত - যেরূপ প্রতিচ্ছায়া বা অন্ধকার)।

অনুবাদ।- আত্মজ্ঞান না হ'লে যার প্রতীতি হয় এবং আত্মজ্ঞান হ'লে যা প্রতীতি হয় না সেই আমার মায়া। যেমন বিম্ব না থাকলে প্রতিবিম্বের প্রতীতি হয় না, যেমন অন্ধকারকেও দৃষ্টির আলোক দিয়েই দেখতে হয় তেমনি আমার মায়াও পরমার্থ-প্রতীতি থেকে ভিন্ন হ'য়েও পরমার্থের আশ্রয় ভিন্ন প্রতীত হয় না॥ ২৫ ॥

শ্রীমদ্ভাগবতে ২।৯।৩৪
যথা মহান্তি ভূতানি ভূতেষুচ্চাবচেষ্বনু।
প্রবিষ্টান্যপ্রবিষ্টানি তথা তেষু নতেষ্বহম্‌॥ ২৬

অন্বয়ঃ।- যথা মহান্তি ভূতানি (যেরূপ ক্ষিতি, অপ্‌, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম - এই পঞ্চ মহাভূত) উচ্চাবচেষু ভূতেষু (সর্ব্ববিধ প্রাণীতেই) অপ্রবিষ্টানি (অপ্রবিষ্ট অর্থাৎ বহিস্থিত) অনুপ্রবিষ্টানি (মধ্যে প্রবিষ্ট) তথা (তদ্রুপ) অহম্‌ (আমি) তেষু (তাহাদের মধ্যে আমিও বটে) ন তেষু (তাহাদের মধ্যে নাইও বটে)।

অনুবাদ।- যেমন পঞ্চমহাভূত সমস্ত প্রাণীতে একই সময়ে অনুপ্রবিষ্ট ও অপ্রবিষ্ট, তেমনি আমিও একই সময়ে লোকময় হ'য়েও লোকাতীত॥ ২৬ ॥

শ্রীমদ্ভাগবতে ২।৯।৩৫
এতাবদেব জিজ্ঞাস্যং
তত্ত্বজিজ্ঞাসুনাত্মনঃ।
অন্বয়-ব্যতিরেকাভ্যাং
যৎ স্যাৎ সর্ব্বত্র সর্ব্বদা॥ ২৭

অন্বয়ঃ।- অন্বয়-ব্যতিরেকাভ্যাং (বিধি এবং নিষেধ দ্বারা) যৎ (যাহা) সর্ব্বদা (সকল সময়ে) সর্ব্বত্র (সকল স্থানে) স্যাৎ (বিদ্যমান রহিয়াছে) এতাবৎ (তদ্বিষয়) এবং আত্মনঃ (এই আমার) তত্ত্বজিজ্ঞাসুনা (তত্ত্বজ্ঞানলাভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিগণের দ্বারা) জিজ্ঞাস্যং (জিজ্ঞাসার যোগ্য)।

অনুবাদ।- যার উপস্থিতি সর্ব্বদা ও সর্ব্বত্র সকলের অবস্থিতির কারণ এবং যার অনুপস্থিতি সকলের অনবস্থিতির কারণ সেই পরমতত্ত্বই তত্ত্বজিজ্ঞাসু ব্যক্তির জিজ্ঞাসার যোগ্য॥ ২৭ ॥

শ্রীবিল্বমঙ্গলস্য শ্রীকৃষ্ণাকর্ণামৃতে ১মঃ শ্লোকঃ
চিন্তামণির্জয়তি সোমগিরির্গুরুর্মে
শিক্ষাগুরুশ্চ ভগবান্‌ শিখিপিঞ্ছমৌলিঃ।
যৎপাদকল্পতরুপল্লবশেখরেষু
লীলাস্বয়ংবররসং লভতে জয়শ্রীঃ॥ ২৮

অন্বয়ঃ।- চিন্তামণিঃ মে সোমগিরিঃ গুরুঃ জয়তি (চিন্তামণি স্বরূপ আমার গুরু সোমগিরি জয়লাভ করুন)। জয়শ্রীঃ (শ্রীরাধা) যৎপাদকল্পতরুপল্লবশেখরেষু (যাঁহার পদকল্পতরুর পল্লবাগ্রে) লীলাস্বয়ংবররসং লভতে (স্বয়ম্বররসলীলা অর্থাৎ উজ্জল রসলীলারূপ সুখ লাভ করেন) স শিখিপিঞ্ছমৌলিঃ ভগবান্‌ শিক্ষাগুরুশ্চ জয়তি (শিক্ষাগুরুরূপ সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জয় হউক যাঁহার চূড়া শিখিপাখাশোভিত)।

অনুবাদ।- আমার গুরু সোমগিরি চিন্তামণিস্বরূপ, তিনি জয়লাভ করুন। জয়লাভ করুন আমার শিক্ষাগুরু শিখিপুচ্ছধারী স্বয়ং ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ, যাঁর পদযুগল কল্পতরুর সঙ্গে তুলনীয় এবং যাঁর পল্লবতুল্য অঙ্গুলির অগ্রভাগে শ্রীমতী রাধিকা মধুর লীলারস আস্বাদন ক'রে থাকেন॥ ২৮ ॥

জীবে সাক্ষাৎ নাহি তাতে গুরু চৈত্ত্যরূপে (১)
শিক্ষাগুরু হন কৃষ্ণ মহান্তস্বরূপে (২)॥

(১) শ্রীকৃষ্ণ চৈত্ত্যরূপে অর্থাৎ চিত্তের অধিষ্ঠাতা অন্তর্য্যামী গুরুরূপে সাধারণ জীবের চক্ষুর গোচর হন না, সেই জন্য তিনি মহান্তস্বরূপে শিক্ষাগুরু হন। ইহাও সাধারণ নিয়ম, যেহেতু শুদ্ধচিত্ত ভক্তিনিষ্ঠ জীবে অন্তর্য্যামিরূপেও শ্রীকৃষ্ণ উপদেশ দিয়া থাকেন।

(২) মহান্তস্বরূপে - ভক্তশ্রেষ্ঠরূপে।

শ্রীমদ্ভাগবতে (১১।২৬।২৬)
ততো দুঃসঙ্গমুৎসৃজ্য
সৎসু সজ্জেত বুদ্ধিমান্‌।
সন্ত এবাস্য ছিন্দন্তি
মনোব্যাসঙ্গমুক্তিভিঃ॥ ২৯

অন্বয়ঃ।- [শ্রীভগবান উদ্ধবকে বলিতেছেন] ততঃ (সেই হেতু) বুদ্ধিমান্‌ (বুদ্ধিমান ব্যক্তি) দুঃসঙ্গম্‌ (দুঃসঙ্গকে) উৎসৃজ্য (পরিত্যাগ করিয়া) সৎসু সজ্জেত (সৎসঙ্গে আসক্ত হইবেন)। সন্ত এবাস্য (সাধুগণই ইহার) মনোব্যাসঙ্গম্‌ (মনের বিশেষ আসক্তি) উক্তিভিঃ (ভক্তিবিষয়ক উপদেশ বাক্য দ্বারা) ছিন্দন্তি (ছেদন করেন)।

অনুবাদ।- যিনি বুদ্ধিমান্‌ তিনি অসৎসঙ্গ ত্যাগ ক'রে সৎসঙ্গ করবেন, কারণ সাধুজনেরাই সদুপদেশ দিয়ে মনের আসক্তিকে ছিন্ন করেন॥ ২৯ ॥

শ্রীমদ্ভাগবতে ৩।২৫।২২
সতাং প্রসঙ্গান্মম বীর্য্যসংবিদো
ভবন্তি হৃৎকর্ণরসায়নাঃ কথাঃ।
তজ্জোষণাদাশ্বপবর্গবর্ত্মনি
শ্রদ্ধারতির্ভক্তিরনুক্রমিষ্যতি॥ ৩০

অন্বয়ঃ।- [শ্রীকপিলদেব স্বীয় মাতা দেবহুতিকে বলিতেছেন] মম বীর্য্যসংবিদঃ (আমার মহিমাপ্রকাশক) হৃৎকর্ণরসায়নাঃ কথাঃ (হৃদয় ও কর্ণের তৃপ্তিজনক কথা) সতাং প্রসঙ্গাৎ ভবন্তি (সাধুদিগের প্রকৃষ্ট সঙ্গ হইতে হইয়া থাকে)। তজ্জোষণাৎ (সেই কথার সেবা বা আস্বাদনের দ্বারা) অপবর্গবর্ত্মনি (মুক্তির পথ স্বরূপ ভগবানে) আশু শ্রদ্ধা রতিঃ ভক্তিঃ (শীঘ্র শ্রদ্ধা অনুরাগ ও প্রেমভক্তি) অনুক্রমিষ্যতি (ক্রমে ক্রমে জন্মিয়া থাকে)।

অনুবাদ।- সাধুরা একত্র মিলিত হ'লে আমার মাহাত্ম্য কীর্ত্তন ক'রে থাকেন। সাধুদের সঙ্গে থেকে সেই সব হৃদয়রঞ্জন শ্রুতিমধুর কথা শ্রবণ ক'রে অচিরেই মুক্তির পথ স্বরূপ ভগবানের প্রতি ক্রমশঃ মনে শ্রদ্ধা, অনুরাগ ও প্রেম-ভক্তির উদয় হয়॥ ৩০ ॥

ঈশ্বর-স্বরূপ ভক্ত তাঁর অধিষ্ঠান।
ভক্তের হৃদয়ে কৃষ্ণের সতত বিশ্রাম॥ (৩)

(৩) শ্রীভগবান্‌ ভক্তের হৃদয়ে সতত অবস্থান করেন বলিয়া আধার ও আধেয়ের একত্ব হেতু ভক্ত ভগবৎস্বরূপ।

শ্রীমদ্ভাগবতে (৯।৪।৬০)
সাধবো হৃদয়ং মহ্যং
সাধূনাং হৃদয়ন্ত্বহম্‌।
মদন্যত্তে ন জানন্তি
নাহং তেভ্যো মনাগপি॥ ৩১

অন্বয়ঃ।- [শ্রীভগবান্‌ দুর্ব্বাসাকে বলিতেছেন] সাধবঃ মহ্যং হৃদয়ং (সাধুগণই আমার প্রাণতুল্য প্রিয়) অহন্তু সাধূনাং হৃদয়ম্ (আমিও সাধুদিগের হৃদয় স্বরূপ) তে মদন্যং ন জানন্তি (তাঁহারা আমাকে ছাড়া জানেন না) অহং তেভ্যঃ মনাক্‌ অপি (আমিও তাঁহাদিগকে ছাড়া কিছুমাত্র) [ন জানে] (জানি না)।

অনুবাদ।- সাধুরা আমার প্রাণ, আমিও সাধুগণের প্রাণ। তাঁরাও আমাকে ছাড়া কিছু জানেন না, আমিও তাঁদের ছাড়া কিছু জানি না॥ ৩১ ॥

শ্রীমদ্ভাগবতে ১।১৩।১০
ভবদ্বিধা ভাগবতা-
স্তীর্থীভূতাঃ স্বয়ং প্রভো।
তীর্থীকুর্ব্বন্তি তীর্থানি
স্বান্তঃস্থেন গদাভৃতা॥ ৩২

অন্বয়ঃ।- [যুধিষ্ঠির বিদুরকে বলিলেন] - হে প্রভো ভবদ্বিধাঃ ভাগবতাঃ (হে প্রভো আপনার ন্যায় ভগবদ্ভক্ত সকল) স্বয়ং তীর্থীভূতাঃ (স্বয়ং তীর্থস্বরূপ) স্বান্তঃস্থেন গদাভৃতা (আপনার অন্তরে স্থিত গদাধরের দ্বারা) তীর্থানি তীথাকুর্ব্বন্তি (তীর্থসমূহকে তীর্থরূপে পরিণত করেন)।

অনুবাদ।- হে প্রভু, আপনার মতন ভক্তজন স্বয়ং তীর্থস্বরূপ। আপনার অন্তরে স্বয়ং ভগবান্‌ অধিষ্ঠিত আছেন সুতরাং তীর্থকেও আপনি নূতন করে তীর্থ করেন॥ ৩২ ॥

সেই ভক্তগণ হয় দ্বিবিধ প্রকার।
পারিষদগণ এক সাধকগণ আর॥ (১)

(১) পারিষদ - ব্রজে নিত্যস্ধি শ্রীদামাদি ও নবদ্বীপে শ্রীবাসাদি। সাধক - শ্রীবিল্বমঙ্গল জয়দেবাদি।

ঈশ্বরের অবতার এ তিন প্রকার-
অংশ-অবতার (২) আর গুণাবতার (৩)॥
শক্ত্যাবেশ (৪) অবতার তৃতীয় এমত।
অংশ অবতার পুরুষ মৎস্যাদিক যত॥
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব তিন গুণাবতারে গণি।
শক্ত্যাবেশে সনকাদি পৃথু ব্যাসমুনি॥
দুইরূপে হয়ে ভগবানের প্রকাশ-
একে ত প্রকাশ হয় আরে ত বিলাস॥
একই বিগ্রহ (৫) যদি হয় বহুরূপ।
আকারে ত ভেদ নাহি একই স্বরূপ॥
মহিষী বিবাহে যৈছে, যৈছে কৈল রাস।
ইহাকে কহিয়ে কৃষ্ণের মুখ্য প্রকাশ॥
শ্রীমদ্ভাগবতে (১।৬৯।২)
চিত্রং বতৈতদেকেন বপুষা যুগপৎ পৃথক্।
গৃহেষু দ্ব্যষ্টসাহস্রং স্ত্রিয় এক উদাবহৎ॥ ৩৩

অন্বয়ঃ।- এতৎ বত চিত্রম্‌ (ইহা বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয় যে) একঃ (একাকী শ্রীভগবান্‌) একেন বপুষা (একই দেহের দ্বারা) যুগপৎ (একই সময়ে) পৃথক্‌ গৃহেষু (পৃথক্‌ পৃথক্‌ গৃহে অবস্থিত হইয়া) দ্ব্যষ্টসাহস্রং স্ত্রিয়ঃ (ষোল হাজার স্ত্রীকে) উদাবহৎ (বিবাহ করিয়াছিলেন)।

অনুবাদ।- একাকী শ্রীকৃষ্ণ ষোড়শসহস্র রমণীকে পৃথক্‌ পৃথক্‌ গৃহে একই কালে বিবাহ করেছিলেন - এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার॥ ৩৩ ॥

শ্রীমদ্ভাগবতে ১০।৩৩।৩
রাসোৎসবঃ সংপ্রবৃত্তো
গোপীমণ্ডল-মণ্ডিতঃ।
যোগেশ্বরেণ কৃষ্ণেন
তাসাং মধ্যে দ্বয়োর্দ্বয়োঃ॥
প্রবিষ্টেন গৃহীতানাং
কণ্ঠে স্বনিকটং স্ত্রিয়ঃ।
যং মন্যেরন্‌-॥ ৩৪

অন্বয়ঃ।- [শ্রীশুকদেব পরীক্ষিৎকে কহিলেন] - কণ্ঠে গৃহীতানাং তাসাং (কণ্ঠদেশে আলিঙ্গিত সেই গোপীদিগের) দ্বয়োর্দ্বয়োঃ মধ্যে প্রবিষ্টেন (দুই দুইজনের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া) যোগেশ্বরেণ কৃষ্ণেন (যোগশ্বর কৃষ্ণের দ্বারা) গোপীমণ্ডলমণ্ডিতঃ (গোপীমণ্ডলে শোভিত) রাসোৎসবঃ সংপ্রবৃত্তঃ (রাসোৎসব আরম্ভ হইয়াছিল) স্ত্রিয়ঃ যং স্বনিকটং মন্যেরন্‌ (গোপীগণ যে কৃষ্ণকে তাহাদিগের নিজ নিজ নিকটে মনে করিয়াছিলেন)।

অনুবাদ।- গোপীমণ্ডল শোভিত রাসলীলা আরম্ভ হ'ল। যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের কণ্ঠালিঙ্গন ক'রে প্রতি দুজন গোপীর মধ্যবর্ত্তী হলেন। প্রত্যেক গোপী মনে করলেন যে শ্রীকৃষ্ণ তাঁরই নিকটে আছেন॥ ৩৪ ॥

তথাহি লঘুভাগবতামৃতে পূর্ব্বখণ্ডে (১।২১)
অনেকত্র প্রকটতা রূপস্যৈকস্য যৈকদা।
সর্ব্বথা তৎস্বরূপৈব স প্রকাশ ইতীর্য্যতে॥ ৩৫

অন্বয়ঃ।- একস্য (একই) রূপস্য (রূপের) একদা (একই কালে) অনেকত্র (অনেক স্থানে) যা প্রকটতা (যে আবির্ভাব) সর্ব্বথা তৎস্বরূপা এব (তাহা সকল প্রকারেই সেই মূলরূপের তুল্যই) সঃ প্রকাশঃ ইতীর্য্যতে (তাহাকে প্রকাশ বলা হয়)।

অনুবাদ।- একই সময়ে অনেক স্থানে একটি বিগ্রহের যে স্ব-স্বরূপে একাধিক আবির্ভাব - তাকেই প্রকাশ বলে॥ ৩৫

একই বিগ্রহ কিন্তু আকারে হয় আন।
অনেক প্রকাশ হয় বিলাস তার নাম।
শ্রীলঘুভাগবতামৃতে বিলাস-লক্ষণম্‌।
স্বরূপমন্যাকারং যৎ
তস্য ভাতি বিলাসতঃ।
প্রায়েণাত্মসমং শক্ত্যা
স বিলাস ইতীর্য্যতে॥ ৩৬

অন্বয়ঃ।- তস্য (সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের) যৎ স্বরূপং (যে স্বরূপ) বিলাসতঃ (বিলাস বা লীলাবশতঃ) (অন্যাকারং) ভিন্নাকৃতি ভাতি (প্রকাশ পায়) শক্ত্যা প্রায়েণ আত্মসমং (কিন্তু শক্তিতে তাহা প্রায় শ্রীকৃষ্ণের সমান) স বিলাস ইতি ঈর্য্যতে (তাহাকে বিলাস বলিয়া থাকে)।

অনুবাদ।- শক্তিপ্রকাশে প্রায় সদৃশ থেকেও বিলাসের জন্য ভিন্ন আকৃতিতে প্রতিভাত হয় - শ্রীকৃষ্ণের যে স্বরূপ - তাকেই বিলাস বলে॥ ৩৬

যৈছে বলদেব পরব্যোমে নারায়ণ।
যৈছে বাসুদেব প্রদ্যুম্নাদি সঙ্কর্ষণ॥
ঈশ্বরের শক্তি (১) হয় এ তিন প্রকার।
এক লক্ষ্মীগণ, পুরে মহিষীগণ আর (২)॥
ব্রজে গোপীগণ আর সভাতে প্রধান।
ব্রজেন্দ্রনন্দন যাতে স্বয়ং ভগবান্‌॥
স্বয়ংরূপ কৃষ্ণের কায়ব্যূহ তাঁর সম (৩)।
ভ্ক্ত-সহিতে হয় তাহার আবরণ॥

(১) 'ঈশ্বরের' - কৃষ্ণের পাঠান্তর। শক্তি - হলাদিনীশক্তি।

(২) বৈকুণ্ঠপুরে লক্ষ্মীগণ ও দ্বারকাপুরে রুক্মিণী প্রভৃতি মহিষীগণ।

(৩) যাতে (যে প্রাধান্য হেতু) ব্রজেন্দ্রনন্দন স্বয়ং ভগবান্‌ (অর্থাৎ সর্ব্বপ্রধান) সেই প্রাধান্য হেতুই ব্রজগোপীগণও সর্ব্বপ্রধান, কারণ তাঁহারা শ্রীকৃষ্ণের সমান। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ংরূপ অর্থাৎ অন্যনিরপেক্ষভাবে তাহার রূপ প্রকট হয়। সুতরাং তিনি প্রধান, কিন্তু তাহা হইতেই বলদেব প্রভৃতি বিলাস-মূর্ত্তি সকলের প্রকাশ হওয়াতে বিলাস-মূর্ত্তি সকল অপ্রধান। শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের সমান সুতরাং স্বয়ংরূপ; আর লক্ষ্মী ও রুক্মিণী প্রভৃতি তাঁহারই বিলাস-মূ্র্ত্তি সুতরাং শ্রীরাধাই প্রধান। ব্রজগোপীগণ শ্রীরাধার দ্বিতীয় দেহস্বরূপ বলিয়া তাঁহারাও প্রধান।

ভক্ত আদি ক্রমে কৈল সভার বন্দ।
এ সভার বন্দন সর্ব্ব শুভের কারণ॥
প্রথম শ্লোকে কহি সামান্য মঙ্গলাচরণ।
দ্বিতীয় শ্লোকেতে করি বিশেষ বন্দন॥
বন্দে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য-
নিত্যানন্দৌ সহোদিতৌ
গৌড়োদয়ে পুষ্পবন্তৌ
চিত্রৌ শন্দৌ তমোনুদৌ

অনুবাদ।- ১ম পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় শ্লোকে এর অনুবাদ দ্রষ্টব্য।

ব্রজে যে বিহরে পূর্ব্বে কৃষ্ণ বলরাম।
কোটিসূর্য্য-চন্দ্র জিনি দোঁহার নিজধাম (১)
সেই দুই জগেতরে হইয়া সদয়।
গৌড়দেশে পূর্ব্ব-শৈলে করিল উদয়॥
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য আর প্রভু নিত্যানন্দ।
যাহার প্রকাশে সর্ব্ব জগত আনন্দ॥
সূর্য্য চন্দ্র হরে যৈছে সব অন্ধকার।
বস্তু প্রকাশিয়া করে ধর্ম্মের প্রচার॥
এই মত দুই ভাই জীবের অজ্ঞান।
তমোনাশ করি কৈল তত্ত্ব-বস্তু দান॥
অজ্ঞান তমের নাম কহিয়ে কৈতব।
ধর্ম্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ-বাঞ্ছা-আদি সব॥

(১) নিজধাম - নিজের তেজ বা প্রভাব।

তথাহি শ্রীমদ্ভাগবতে ১।১।২
ধর্ম্মঃ প্রোজ্ঝিতকৈতবোহত্র পরমো
নির্ম্মৎসরাণাং সতাং
বেদ্যং বাস্তবমত্র বস্তু শিবদং
তাপত্রয়ন্মূলনম্‌।
শ্রীমদ্ভাগবতে মহামুনিকৃতে
কিংবা পরৈরীশ্বরঃ
সদ্যো হৃদ্যবরুধ্যতেহত্র কৃতিভিঃ
শুশ্রূষুভিস্তৎক্ষণাৎ॥ ৩৮

অন্বয়ঃ।- মহামুনিকৃতে অত্র শ্রীমদ্ভাগবতে (মহামুনিকৃত এই শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থে) নির্ম্মৎসরাণাৎ সতাং (নির্ম্মৎসর সাধুদিগের) প্রোজ্‌ঝিত-কৈতবঃ (কৈতবশুন্য) পরমঃ ধর্ম্মঃ (সর্ব্বোৎকৃষ্ট ধর্ম্ম) শিবদৎ (মঙ্গলপ্রদ, পরম সুখপ্রদ) তাপত্রয়োন্মূলনং (তাপত্রয়-নাশক) বাস্তবং (পরমার্থভূত) বস্তু অত্র বেদম্‌ (প্রকৃত তত্ত্ব ইহাতেই জ্ঞাতব্য)। পরৈঃ (অন্য শাস্ত্রদ্বারা) ঈশ্বরঃ হৃদি কিংবা সদ্যঃ (ঈশ্বর হৃদয়ে কি তৎক্ষণাৎ অথবা কিছু বিলম্বে) অবরুধ্যতে (অবরুদ্ধ হয়েন)? অত্র শুশ্রূষুভিঃ (কিন্তু ইহাতে শ্রবণাভিলাষী) কৃতিভিঃ তৎক্ষণাৎ (পূণ্যাত্মাদিগের হৃদয়ে তৎক্ষণাৎ অবরুদ্ধ হয়েন)।

অনুবাদ।- মহামুনি ব্যাসদেব শ্রীমদ্‌ভাগবতের রচয়িতা। ঈশ্বরের আরাধনারূপ পরম ধর্ম্মই এতে নিরূপিত হয়েছে। সর্ব্বপ্রাণীর পরম কল্যাণকামী আসক্তি-বেদ্বষ-শূন্য সাধুজনেরা এই ধর্ম্মকেই গ্রহণ করেছেন, কারণ যে ধর্ম্ম ফললাভের আশায় আচরিত, এমন কি মুক্তির জন্যও যে ধর্ম্ম গৃহীত হয় সে ধর্ম্ম ধর্ম্মের ছল মাত্র। ত্রি-তাপনাশক এই ধর্ম্ম শুভদ এবং পরমার্থ-ভূত বস্তু। অন্য কোন ধর্ম্মাচরণ দ্বারা কি ঈশ্বরকে তৎক্ষণাৎ লাভ করা যায়? যাঁরা শ্রীমদ্‌ভাগবতের পরম ধর্ম্ম শোনবার জন্যেও উৎসুক তাঁরাও তৎক্ষণাৎ ঈশ্বরকে লাভ করেন॥ ৩৮॥

তার মধ্যে মোক্ষ বাঞ্ছা কৈতব প্রধান।
যাহা হৈতে কৃষ্ণভক্তি হয় অন্তর্দ্ধান (২)॥
ব্যাখ্যাতঞ্চ শ্রীধরস্বামি-চরণৈঃ -
উজ্ঝিত-কৈতবঃ ফলানুসন্ধান-রহিতঃ
প্রশব্দেন মোক্ষাভিসন্ধিরপি নিরস্তঃ॥

শ্রীধরস্বামী ব্যাখ্যা করেছেন - উজ্ঝিতকৈতব অর্থাৎ ফলের অনুসন্ধান-হীন, প্রোজ্ঝিত-শব্দের 'প্র' - এই উপসর্গের দ্বারা মোক্ষলাভের ইচ্ছাকেও নির্ধারণ করা হয়েছে।

(২) জীব শ্রীকৃষ্ণের নিত্যদাস; সুতরাং তাঁহার দাসত্ব ভিন্ন নিজের সুখের জন্য অন যাহা কিছু সকলই কৈতব অর্থাৎ কপট। মানব ফললাভের আশায় ধর্ম্মাদির অনুষ্ঠান করে সুতরাং ধর্ম্মাদি কৈতব। তবে ধর্ম্মাদির অনুষ্ঠানে হৃদয়ে ভক্তির উদ্রেকও হইতে পারে। কিন্তু মুক্তিকামী ব্যক্তির হৃদয়ে কখনও ভক্তির স্থান নাই, কারণ 'সোহহম্‌' অর্থাৎ আমি সেই ব্রহ্ম এই ভাব মনে আসিলেই মন হইতে সেব্য-সেবকভাব অর্থাৎ ভক্তি দূর হয়, সুতরাং মোক্ষলাভের ইচ্ছা কৈতব-প্রধান।

কৃষ্ণভক্তির বাধক যত শুভাশুভ কর্ম্ম।
সেহ এক জীবের অজ্ঞান-তমো ধর্ম্ম
যাহার প্রসাদে এই তম হয় নাশ।
তমোনাশ করি করে তত্ত্বের প্রকাশ
তত্ত্ববস্তু - কৃষ্ণ, কৃষ্ণ-ভক্তি, প্রেমরূপ।
নাম সংকীর্ত্তন - সবার আনন্দ স্বরূপ
সূর্য্য চন্দ্র বাহিরের তম সে বিনাশে।
দুই ভাই হৃদয়ের ক্ষালি অন্ধকার।
দুই ভাগবত-সঙ্গে করান সাক্ষাৎকার
এক ভাগবত বড় - ভাগবত-শাস্ত্র
দুই ভাগবত-দ্বারা দিয়া ভক্তিরস।
তাহার হৃদয়ে তাহার প্রেমে হয় বশ (১)
এক অদ্ভুত সমকালে দোঁহার প্রকাশ।
আর অদ্ভুত চিত্ত-গুহার তমো করে নাশ
এই চন্দ্র সূর্য্য দুই পরম সদয়।
জগতের ভাগ্যে গৌড়ে করিলা উদয়
সেই দুই প্রভুর করি চরণ বন্দন।
যাহা হৈতে বিঘ্ননাশ অভীষ্ট পূরণ॥
এই দু শ্লোকে কৈল মঙ্গল বন্দ।
তৃতীয় শ্লোকের অর্থ শুন সর্ব্বজন॥
বক্তব্য বাহুল্য, গ্রন্থ বিস্তারের ডরে।
বিস্তারি না বর্ণি, সারার্থ কহি অল্পাক্ষরে॥
অনাদিব্যবহারসিদ্ধপ্রাচীনৈঃ স্বশাস্ত্রে উক্তঞ্চ
মিতঞ্চ সারঞ্চ বচো হি বাগ্মিতা ইতি॥ ৩৯

অন্বয়ঃ।- মিতং (বর্ণবাহুল্যরহি) সারং (প্রকৃতার্থব্যঞ্জক) বচো হি (বচনই) বাগ্মিতা (বাকপটুতা) ইত্যুচ্যতে (রূপে উক্ত হয়)।

অনুবাদ।- বাগ্মিতা বলতে বোঝায় পরিমিত ও সার বচনবিন্যাস॥ ৩৯ ॥

শুনিলে খণ্ডিবে চিত্তের অজ্ঞানাদি দোষ (২)।
কৃষ্ণে গাঢ় প্রেম হবে - পাইবে সন্তোষ॥
শ্রীচৈতন্য-নিত্যানন্দ-অদ্বৈত-মহত্ত্ব।
তাঁর ভক্ত ভক্তি-নাম-প্রেমরসতত্ত্ব॥
ভিন্ন ভিন্ন লিখিয়াছি করিয়া বিচার।
শুনিলে জানিবে সব বস্তু-তত্ত্বসার॥
শ্রীরূপ রঘুনাথ পদে যার আশ।
চৈতন্যচরিতামৃত কহে কৃষ্ণদাস॥

ইতি শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে আদিলীলায়াং গুর্ব্বাদিবন্দন-
মঙ্গলাচরণং নাম প্রথমঃ পরিচ্ছেদঃ।

(২) অজ্ঞানাদি - অজ্ঞান, বিপর্য্যাস, ভেদ, ভয় ও শোক এই পাঁচটি অজ্ঞান - স্বরূপের অপ্রকাশ। বিপর্য্যাস - দেহাদিতে অহংবুদ্ধি। ভেদ - ভোগেচ্ছা। ভয় - ভোগপ্রতিঘাত। শোক - ভোগনাশ। ভোগনাশে আমি 'মরিলাম' এই বুদ্ধির নাম শোক। দোষ - মোহ তন্দ্রাদি আঠার প্রকার।