পূরবী/পূরবী/তপোভঙ্গ

উইকিসংকলন থেকে

তপােভঙ্গ

যৌবন-বেদনা-রসে উচ্ছল আমার দিনগুলি,
হে কালের অধীশ্বর, অন্য-মনে গিয়েছে কি ভুলি’,
হে ভোলা সন্ন্যাসী?
চঞ্চল চৈত্রের রাতে
কিংশুক-মঞ্জরী সাথে
শূন্যের অকুলে তা’রা অযত্নে গেলে কি সব ভাসি’?

আশ্বিনের বৃষ্টি-হারা শীর্ণ-শুভ্র মেঘের ভেলায়
গেলো বিস্মৃতির ঘাটে স্বেচ্ছাচারী হাওয়ার খেলায়
নির্ম্মম হেলায়?
একদা সে দিনগুলি তোমার পিঙ্গল জটাজালে
শ্বেত রক্ত নীল পীত নানা পুষ্পে বিচিত্র সাজালে,
গেছো কি পাসরি’?
দস্যু তা’রা হেসে হেসে
হে ভিক্ষুক, নিলো শেষে
তোমার ডম্বরু শিঙ্গা, হাতে দিলো মঞ্জিরা, বাঁশরী।

গন্ধ-ভারে আমন্থর বসন্তের উন্মাদন রসে
ভরি’ তব কমণ্ডলু নিমজ্জিল নিবিড় আলসে
মাধুর্য্য-রভসে।

সেদিন তপস্যা তব অকস্মাৎ শূন্যে গেলো ভেসে
শুষ্ক-পত্রে ঘূর্ণ-বেগে গীত-রিক্ত হিম-মরুদেশে,
উত্তরের মুখে।
তব ধ্যান - মন্ত্রটিরে
আনিল বাহির তীরে
পুষ্প-গন্ধে লক্ষ্য-হারা দক্ষিণের বায়ুর কৌতুকে।

সে মন্ত্রে উঠিল মাতি’ সেঁউতি কাঞ্চন করবিকা,
সে মন্ত্রে নবীন-পত্রে জ্বালি’ দিলো অরণ্যবীথিকা
শ্যাম বহ্নিশিখা


বসন্তের বন্যা-স্রোতে সন্ন্যাসের হ’লো অবসান;
জটিল জটার বন্ধে জাহ্নবীর অশ্রু-কলতান
শুনিলে তন্ময়।
সেদিন ঐশ্বর্য্য তব
উন্মোষিল নব নব,
অন্তরে উদ্বেল হ’লো আপনাতে আপন বিস্ময়।

আপনি সন্ধান পেলে আপনার সৌন্দর্য্য উদার,
আনন্দে ধরিলে হাতে জ্যোতির্ম্ময় পাত্রটি সুধার
বিশ্বের ক্ষুধার।

সেদিন, উন্মত্ত তুমি, যে নৃত্যে ফিরিলে বনে বনে
সে নৃত্যের ছন্দে-লয়ে সঙ্গীত রচিনু ক্ষণে ক্ষণে
তব সঙ্গ ধ’রে।
ললাটের চন্দ্রালোকে
নন্দনের স্বপ্ন-চোখে
নিত্য-নূতনের লীলা দেখেছিনু চিত্ত মোর ভ’রে।

দেখেছিনু সুন্দরের অন্তর্লীন হাসির রঙ্গিমা,
দেখেছিনু লজ্জিতের পুলকের কুণ্ঠিত ভঙ্গিমা,
রূপ-তরঙ্গিমা।


সেদিনের পান-পাত্র, আজ তা’র ঘুচালে পূর্ণতা?
মুছিলে, চুম্বন-রাগে চিহ্নিত বঙ্কিম রেখা-লতা
রক্তিম-অঙ্কনে?
অগীত সঙ্গীত-ধার,
অশ্রুর সঞ্চয়-ভার
অযত্নে লুণ্ঠিত সে কি ভগ্নভাণ্ডে তোমার অঙ্গনে?

তোমার তাণ্ডব নৃত্যে চূর্ণ চূর্ণ হ’য়েছে সে ধূলি?
নিঃস্ব কাল-বৈশাখীর নিশ্বাসে কি উঠিছে আকুলি’
লুপ্ত দিনগুলি?

নহে নহে, আছে তা’রা; নিয়েছো তা’দের সংহরিয়া
নিগূঢ় ধ্যানের রাত্রে, নিঃশব্দের মাঝে সম্বরিয়া
রাখো সঙ্গোপনে।
তোমার জটায় হারা
গঙ্গা আজ শান্ত-ধারা,
তোমার ললাটে চন্দ্র গুপ্ত আজি সুপ্তির বন্ধনে।

আবার কি লীলাচ্ছলে অকিঞ্চন সেজেছো বাহিরে।
অন্ধকারে নিঃস্বনিছে যত দূরে দিগন্তে চাহি রে—
“নাহি রে! নাহি রে!”


কালের রাখাল তুমি, সন্ধ্যায় তোমার শিঙ্গা বাজে,
দিন-ধেনু ফিরে আসে স্তব্ধ তব গোষ্ঠগৃহ-মাঝে,
উৎকণ্ঠিত বেগে।
নির্জ্জন প্রান্তর-তলে
আলেয়ার আলো জ্বলে,
বিদ্যুৎ-বহ্নির সর্প হানে ফণা যুগান্তের মেঘে।

চঞ্চল মুহূর্ত্ত যত অন্ধকারে দুঃসহ নৈরাশে
নিবিড় নিবদ্ধ হ’য়ে তপস্যার নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসে
শান্ত হ’য়ে আসে।

জানি জানি, এ তপস্যা দীর্ঘরাত্রি করিছে সন্ধান
চঞ্চলের নৃত্যস্রোতে আবার উন্মত্ত অবসান
দুরন্ত উল্লাসে।
বন্দী যৌবনের দিন
আবার শৃঙ্খল-হীন
বারে বারে বাহিরিবে ব্যগ্র বেগে উচ্চ কলোচ্ছ্বাসে।

বিদ্রোহী নবীন বীর, স্থবিরের শাসন-নাশন,
বারে বারে দেখা দিবে; আমি রচি তা’রি সিংহাসন,
তা’রি সম্ভাষণ।


তপোভঙ্গ দূত আমি মহেন্দ্রের, হে রুদ্র সন্ন্যাসী,
স্বর্গের চক্রান্ত আমি। আমি কবি যুগে যুগে আসি
তব তপোবনে।
দুর্জ্জয়ের জয়-মালা
পূর্ণ করে মোর ডালা,
উদ্দামের উতরোল বাজে মোর ছন্দের ক্রন্দনে।

ব্যথার প্রলাপে মোর গোলাপে গোলাপে জাগে বাণী;
কিশলয়ে কিশলয়ে কৌতুহল-কোলাহল আনি’
মোর গান হানি’।

হে শুষ্ক বল্কলধারী বৈরাগী, ছলনা জানি সব,
সুন্দরের হাতে চাও আনন্দে একান্ত পরাভব
ছদ্ম-রণ-বেশে।
বারে বারে পঞ্চশরে
অগ্নিতেজে দগ্ধ ক’রে
দ্বিগুণ উজ্জ্বল করি’ বারে বারে বাঁচাইবে শেষে।

বারে বারে তা’রি তূণ সম্মোহনে ভরি’ দিব ব’লে
আমি কবি সঙ্গীতের ইন্দ্রজাল নিয়ে আসি চ’লে
মৃত্তিকার কোলে।


জানি জানি, বারম্বার প্রেয়সীর পীড়িত প্রার্থনা
শুনিয়া জাগিতে চাও আচম্বিতে, ওগো অন্য-মনা,
নূতন উৎসাহে।
তাই তুমি ধ্যান-চ্ছলে
বিলীন বিরহ - তলে,
উমারে কাঁদাতে চাও বিচ্ছেদের দীপ্তদুঃখ-দাহে।

ভগ্ন-তপস্যার পরে মিলনের বিচিত্র সে ছবি
দেখি আমি যুগে যুগে, বীণা-তন্ত্রে বাজাই ভৈরবী,
আমি সেই কবি।

আমারে চেনে না তব শ্মশানের বৈরাগ্য-বিলাসী,
দারিদ্র্যের উগ্র দর্পে খলখল ওঠে অট্টহাসি
দেখে মোর সাজ।
হেন কালে মধুমাসে
মিলনের লগ্ন আসে,
উমার কপোলে লাগে স্মিতহাস্য-বিকশিত লাজ।

সেদিন কবিরে ডাকো বিবাহের যাত্রা-পথ-তলে,
পুষ্প-মাল্য-মাঙ্গল্যের সাজি ল’য়ে, সপ্তর্ষির দলে
কবি সঙ্গে চলে।


ভৈরব, সেদিন তব প্রেতসঙ্গীদল রক্ত-আঁখি
দেখে তব শুভ্রতনু রক্তাংশুকে রহিয়াছে ঢাকি’,
প্রাতঃসূর্য্য-রুচি।
অস্থি-মালা গেছে খুলে
মাধবী-বল্লরী মূলে,
ভালে মাখা পুষ্পরেণু, চিতাভস্ম কোথা গেছে মুছি’।

কৌতুকে হাসেন উমা কটাক্ষে লক্ষ্যিয়া কবি পানে;
সে হাস্যে মন্দ্রিল বাঁশি সুন্দরের জয়ধ্বনি - গানে
কবির পরাণে।


(* কার্ত্তিক, ১৩৩০)