পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

থাকিব দিবারাত্রি তৃষ্ণার্ত চাতকের ন্যায় তোমার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিব, দিবসে তোমার অমৃতকথা শ্রবণ করিব, রজনীতে সন্ধ্যা হইতে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত কখন কখন দ্বিপ্রহর হইতে প্রভাত পর্যন্ত তোমার সুপ্ত কান্তি দেখিয়া হৃদয়ের পিপাসা নিবারণ করিব, কেবল এই আশায় আমি তোমার সহিত দিল্লী হইতে সিপ্রাতীরে, সিপ্রাতীর হইতে রাজস্থানে ভ্রমণ করিয়াছি। জগতে কোন্ স্থল আছে, নরকে কোন্ স্থল আছে, যেথায় এই সুখের আশায় অভাগিনী যাইতে পরাঙ্মুখ?”

বত্রিশ

 “নরেন্দ্র! ভালবাসিয়াছি। যে হিন্দুরমণী তোমার প্রণয়ের পাত্রী, তাহাকেও আমি দেখিয়াছি। কিন্তু তুমি কখনও ভালবাসার জন্য দেওয়ানা হও নাই। আমার তাতারদেশে জন্ম, তথাকার সকলেই উগ্রস্বভাব, আমিও বাল্যকাল হইতেই অতিশয় উগ্রস্বভাব ছিলাম। আমি ক্রুদ্ধ হইলে বালকগণও ক্রীড়া পরিত্যাগ করিয়া বালিকার নিকট হইতে দূরে সরিয়া যাইত। একটি যুদ্ধে আমার পিতা হত হয়েন, আমি রুদ্ধ হইয়া বাঁদী অবস্থায় দিল্লীর সম্রাটের নিকট বিক্রীত হইলাম। স্বাধীনতা গেল, কিন্তু উগ্রস্বভাব গেল না। বোধ হয়, ভারতবর্ষের উষ্ণতর সূর্যতাপে আমার শোণিত ক্রমশ উষ্ণতর হইল। প্রাসাদে তাতার-রমণীদিগের কি কাজ, বোধ হয় তুমি জান না। আমরা বেগমদিগের মহল রক্ষা করি, খড়্গ ও ছুরিকা ব্যবহারে আমরা অপটু নহি, বেগমদিগের আদেশে কত শত ভয়ঙ্কর কার্য সম্পাদন করি, তাহা জগৎসাধারণ কি জানিবে? আমি এ সমস্ত ব্যাপারে লিপ্ত হইয়া সকলের অসাধ্য কার্যও সাধন করিতাম। আমার এই গুণের জন্যই সাহেব বেগম আমার এরূপ ক্রোধ সহ্য করিতেন।

 যখন দিল্লী পরিত্যাগ করিয়া আমি তোমার সহিত আসিলাম, আমার স্বভাব কিছুমাত্র কিছুমাত্র অন্যথা হইল না, দেওয়ানা হইয়া তোমার সহিত আসিলাম।

 উদয়পুরের হ্রদে নৌকা করিয়া সন্ধ্যার সময় চন্দ্রলোকে বেড়াইতে যাইতে স্মরণ হয়? তোমাকে সর্বদাই চিন্তিত দেখিতাম, কিন্তু তুমি কি ভাবিতে, স্থির করিতে পারিতাম না। একদিন আমি নৌকায় বসিয়াছিলাম, তুমি আমার স্কন্ধে মস্তক রাখিয়া শুইয়াছিলে ও চন্দ্রের দিকে দেখিতেছিলে, স্মরণ হয়? আমি সমস্ত সময় তোমার চন্দ্রকরোজ্জ্বল মুখের দিকে চাহিয়াছিলাম, তোমার কেশবিন্যাস করিয়া দিয়াছিলাম, তোমার অঙ্গুলি লইয়া খেলা করিতেছিলাম। সহসা তুমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলে, হেম। আর কি তোমাকে এ জীবনে দেখিতে পাইব? আমি বঙ্গভাষা ভাল জানি না, কিন্তু এ কথা বুঝিলাম। আমার মনে সন্দেহ জাগ্রত হইল।

৯৪