পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 রমণী রাজপুত বেশধারিণী। নরেন্দ্র ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিবার জন্য ক্রমে নিকটে আসিলেন, তথাপি রমণীর অনাবৃত বাহু ভিন্ন আর কিছু দেখিতে পাইলেন না, মুখমণ্ডল অবগুণ্ঠনের ভিতর দিয়া দেখা যায় না।

 নরেন্দ্রেরও নারীবেশ, একবার ইচ্ছা হইল, রমণীর নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করেন কিন্তু নরেন্দ্রের কণ্ঠরোধ হইল। একবার ইচ্ছা হইল, রমণীর হস্তে আপন হস্ত স্থাপন করেন, কিন্তু তাঁহার হস্ত উঠিল না, হৃদয় সজোরে আঘাত করিতে লাগিল। অচিরাৎ সেই রমণী ও তাঁহার রাজপুত সঙ্গিনীগণ বাজার পরিত্যাগ করিলেন নরেন্দ্রও পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। অনেক ঘর, অনেক দ্বার, অনেক পুষ্পোদ্যান ও প্রাসাদ অতিক্রম করিয়া বাহিরে উপস্থিত হইলেন। তথায় অনেক শিবিকা ছিল, রাজপুত কামিনীগণ নিজ নিজ শিবিকায় আরোহণ করিলেন! যে রমণীর দিকে নরেন্দ্র দেখিতেছিলেন তিনিও শিবিকায় আরোহণ কবিবার উপক্রম করিলেন। বোধ হইল, যেন তিনি যমুনা নদী ও আগ্রার রাজপ্রাসাদ পুর্বে দেখেন নাই, কেন না, শিবিকায় আরোহণ করিবার পূর্বে একবার প্রাসাদ ও নদীর দিকে স্থির দৃষ্টি করিয়া দেখিতে লাগিলেন। যমুনার বায়ুতে তাঁহার অবগুণ্ঠন নড়িতে লাগিল, নরেন্দ্র তীব্রদৃষ্টি করিতে লাগিলেন, তাঁহ হৃদয় স্ফীত হইতে লাগিল। কিন্তু সে অবগুণ্ঠন উড়িয়া গেল না, নরেন্দ্র মুখ দেখিতে পাইলেন না। অচিরাৎ শিবিকাযোগে সে রাজপুতবেশ ধারিণী চলিয়া গেলেন।

 এ কি হেমলতা?—সেই গঠন, চলন, সেই বাহু। দর্পণে সেই মধুমাখা মুখখানি প্রতিফলিত হইয়াছিল। কিন্তু হেমলতা আগ্রার বেগমমহলে কেন? রাজপুত কি জন্য? নরেন্দ্রনাথ! প্রেমান্ধ হইয়া কাহাকে হেমলতা মনে করিতেছ? নরেন্দ্রনাথ! কেন দেশে দেশে সেই ছায়ার অনুধাবন করিতেছ?

আটাশ

 বীরনগরের জমিদারের প্রকাণ্ড অট্টালিকার পার্শ্বে সুন্দর ও প্রশস্ত উপবন দিয়া নদীতীরে আসা যাইত। সেই উপবনে বাল্যকালে নরেন্দ্রনাথ ও হেমলতা দৌড়াদৌড়ি করিত, সেই নদীতীরে বালক বালিকার সঙ্গে খেলা করিত, হাসিত কাঁদিত আবার উচ্চহাস্যে উপবন আমোদিত করিত। আজি সেদিন পরিবর্তিত হইয়াছে, নরেন্দ্রনাথ শান্তিশূন্য-হৃদয়ে দেশে দেশে বেড়াইতেছেন, শ্রীশচন্দ্র শ্বশুরের সম্প্রতি মৃত্যু হওয়ায় জমিদার হইয়াছেন, হেমলতা আজি বালিকা নহেন, নব জমিদারের গৃহিণী।

 সায়ংকালে সেই উপবন দিয়া দুইটি রমণী ঘাটে যাইতেছিলেন। একজন হেমলতা অপরজন শ্রীশচন্দ্রের বিধবী ভগিনী।

৮৫