পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বস্ত্রের দর করিতে আরম্ভ করিতেছেন। দর করিতে উভয়পক্ষই সমান পটু, কখন কখন এক পয়সার বিভিন্নতার জন্য মহা গণ্ডগোল উপস্থিত হইতেছে। আওরংজীব বলিলেন “—তোমার জিনিস মেকি, তুমি এখানে ঠকাইতে আসিয়াছ।” চতুরা মোগলকন্যা বলিলেন,—তুমি কিরূপ খরিদ্দার। এরূপ কখনও দেখ নাই, ইহার দর তুমি কি জানিবে? তুমি ইহার উপযুক্ত নও, অন্যস্থানে যাও—তোমার যোগ্য দ্রব্য পাইবে।” এইরূপ বহু বাগবিতণ্ডার পর মূল্য অবধারিত হইল। ক্রেতা তখন যেন ভ্রমক্রমে দুই-চারিটি রৌপ্যমুদ্রার স্থানে বিক্রেতাকে সুবর্ণমুদ্রা দিয়া চলিয়া গেলেন।

 অনেকক্ষণ এইরূপ বাজার দেখিয়া নরেন্দ্র জেলেখার আদেশানুসারে “শীশমহলে প্রবেশ করিলেন, তথায় আবার অন্যরূপ অপরূপ দৃশ্য দেখিলেন। সম্রাট ও বেগমদিগের স্নানার্থ এই মহল নির্মিত হইয়াছে। শ্বেত-প্রস্তর-বিনির্মিত শানের উপর দিয়া নির্মল জল প্রবাহিত হইতেছে, শানে অঙ্কিত প্রতিকৃতি দেখিয়া বোধ হয়, যেন জলের নীচের অসংখ্য মৎস্য ক্রীড়া করিতেছে। চতুর্দিক হইতে ফোয়ারার নির্মল জল বেগে উঠিতেছে, আবার মুক্তারাশির ন্যায় প্রস্তরের উপর পতিত হইতেছে, ছাদ হইতে অসংখ্য দীপাবলী লম্বিত রহিয়াছে ও সেই সমস্ত দীপের বিবিধ বর্ণের আলোক ফোয়ারার জলের উপর বড় সুন্দরভাবে প্রতিহত হইতেছে। চতুর্দিক হইতে অসংখ্য দর্পণ রত্নরাজিখচিত হইয়া দেওয়ালে সন্নিবেশিত হইয়াছে, কেন না, স্নানকারিণী চতুর্দিকেই আপনার সুন্দর অনাবৃত অবয়ব দেখিতে পাইবেন। বিলাসপটু সম্রাটগণ বেগমদিগকে লইয়া এই গৃহে স্নান ও জলকেলি করিতে পারিবেন, এইজন্য কত দেশ হইতে অর্থ আনীত হইয়া এই অপূর্ব বিলাসগৃহ বিনির্মিত ও সুশোভিত হইয়াছে।

 নানা দেশ হইতে অনেক মুসলমান ও হিন্দুরমণী অন্য প্রাসাদে সমবেত হইয়াছেন। তাহার মধ্যে অনেকেই শীশমহলের অপূর্ব শোভা দেখিতেছিলেন। জেলেখা তাঁহাদিগের ভিতর দিয়া নরেন্দ্রকে হাত ধরিয়া একপাশে লইয়া গিয়া একটি দর্পণের নিকট আনিল এবং সেই দর্পণের ভিতর একটি ছায়া দেখাইল। চকিত ও নিস্পন্দ হইয়া নরেন্দ্র সেই দর্পণের ভিতর সেই ছায়া দেখিতে লাগিলেন, তথা হইতে আর নয়ন ফিরাইতে পারিলেন না। আলোকে আকৃষ্ট পতঙ্গবৎ নরেন্দ্র সেই ছায়ার দিকে চাহিয়া রহিলেন, অনিমেষলোচনে সেই দর্পণস্থ প্রতিমূর্তির দিকে চাহিয়া বহিলেন। নরেন্দ্রনাথ কি স্বপ্ন দেখিতেছেন? কি উন্মত্ত হইয়াছেন? নরেন্দ্রের শরীর কঁপিতেছে, তাহার হৃদয় সজোরে আঘাত করিতেছে. তাঁহার নয়ন স্পন্দনহীন। ক্রমে সে প্রতিমূর্তি দর্পণ হইতে সরিয়া গেল, সে রমণী অবগুণ্ঠন টানিয়া শীশমহল হইতে বাহির হইলেন, উন্মত্ত নরেন্দ্র তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।

৮৪