পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

থাকি, যোদ্ধার নিকট ভিক্ষা করিতে যোদ্ধার কোন অপমান নাই। নরেন্দ্র, আমি তোমাকে জানি, তুমিও আমাকে শীঘ্র জানিবে, আমার নিকট একটি ভিক্ষা গ্রহণ করিতে কোনও অপমান নাই। তিন দিবসের মধ্যে আমাদের আবার সাক্ষাৎ হইবে সেদিন আমিও তোমার নিকট একটি ভিক্ষা প্রার্থনা করিব। আমার নাম শৈলেশ্বর।”

 এই বলিয়া গোস্বামী সহসা অন্ধকারে অদৃশ্য হইলেন। নরেন্দ্র বিস্মিত হইয়া চাহিয়া রহিলেন।

বাইশ

 রাজস্থানে নূতন নূতন দেশ ও নূতন নূতন আচার ব্যবহার দেখিয়া নরেন্দ্রনাথের হৃদয় কিছুদিন শান্ত হইয়াছিল, কিন্তু প্রস্তরে যে অঙ্ক খোদিত হয় তাহা একেবারে বিলুপ্ত হয় না। বঙ্গদেশ হইতে উদয়পুর শত শত ক্রোশ অন্তর, কত নদ-নদী, পর্বত, মরুভূমি পার হইয়া নরেন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের প্রান্ত হইতে প্রান্ত পর্যন্ত আসিয়াছেন। তথাপি প্রাতঃকালে যখন পূর্ব দিকের আকাশে রক্তিমচ্ছটা অবলোকন করিতেন, তখন সেই পূর্বদেশবাসিনী বালিকা নরেন্দ্রনাথের হৃদয়ে জাগরিত হইত। রজনীতে যখন নরেন্দ্রনাথ একাকী ছাদের উপর অন্ধকারে বিচরণ করিতেন, বোধ হইত যেন, সেই প্রণয়প্রতিমা তাহার জ্যোতিতে নরেন্দ্রনাথের উপর প্রেমদৃষ্টি করিতেছে। কোথায় বীরনগরের বাটী, কোথায় কলনাদিনী ভাগীরথী, আর কোথায় নরেন্দ্রনাথ? কিন্তু স্বদেশ হইতে পলায়ন করিলে কি চিন্তা হইতে পলায়ন করা যায়? মৃত্যুর আগে আর একবার সেই হেমলতাকে দেখিবেন, প্রাতঃকালে সায়ংকালে নিশীথে তিনি যে চিন্তা করেন, হেমলতাকে একবার সেই সমস্ত কথা বলিবেন, নরেন্দ্রনাথের কেবল এই ইচ্ছা। মৃত্যুর আগে কি আর একবার দেখা হইবে না? নরেন্দ্রনাথ দেওয়ানের নিকট শুনিলেন, ভগবান একলিঙ্গের মন্দিরের কোন এক গোস্বামী ভবিষ্যৎ বলিতে পারেন; নরেন্দ্রনাথ একদিন সেই মন্দিরে যাত্রা করিলেন।

 রজনী এক প্রহরের পর নরেন্দ্র মন্দিরের নিকট উপস্থিত হইলেন, মন্দিরের যে শোভা দেখিলেন, তাহাতে তিনি বিস্মিত হইলেন। মন্দির একটি উপত্যকায় নির্মিত, তাহার চারিদিকে যতদূর দেখা যায়, কেবল অন্ধকারময় পর্বতরাশি অন্ধকার আকাশের সহিত মিশ্রিত হইয়াছে, চারিদিকে যেন প্রকৃতি অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর দিয়া রুদ্রের উপযুক্ত গৃহ নির্মাণ করিয়াছেন।

 রজনী দ্বিপ্রহরের সময় নরেন্দ্র সেই প্রকাণ্ড মন্দিরে প্রবেশ করিলেন। সারি সারি শ্বেতপ্রস্তর-বিনির্মিত সুন্দর স্তম্ভের মধ্য দিয়া সেই বিস্তীর্ণ প্রস্তরালয়ে প্রবেশ করিলেন। সম্মুখে মহাদেবের ষণ্ড ও নন্দীর পিত্তল প্রতিমূর্তি রহিয়াছে, ভিতরে শুভ্র-প্রকোষ্ঠ ও

৬৩