পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
১৭৩

তাহার মায়ের কাছে কত কি আবদার করে, তাহার মায়ের গৃহকার্য্যে সাহায্য করে। আগে যে তাহার একটি বাক্যহীন, নিস্তব্ধ, বিষণ্ণ ছায়ার মত ভাব ছিল, তাহা ঘুচিয়া গেছে—এখন তাহার প্রফুল্ল হৃদয়খানি পরিস্ফুট প্রভাতের ন্যায় তাহার সর্ব্বাঙ্গে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে। আগেকার মত সে সঙ্কোচ, সে লজ্জা, সে বিষাদ, সে অভিমান, সেই নীরব ভাব আর নাই। সে এখন আনন্দভরে বিশ্বস্ত ভাবে মায়ের সহিত এত কথা বলে যে আগে হইলে বলিতে লজ্জা করিত, ইচ্ছাই হইত না। মেয়ের এই আনন্দ দেখিয়া মায়ের অসীম স্নেহ উথলিয়া উঠিল। মনের ভিতরে ভিতরে একটা ভাবনা জাগিতেছে বটে—কিন্তু বিভার নিকট আভাসেও সে ভাবনা কখন প্রকাশ করেন নাই। মা হইয়া আবার কোন্ প্রাণে বিভার সেই বিমল প্রশান্ত হাসিটুকু একতিল মলিন করিবেন! এই জন্য মেয়েটি প্রতিদিন চোখের সামনে হাসিয়া খেলিয়া বেড়ায়, মা হাস্য-মুখে অপরিতৃপ্ত নয়নে তাহাই দেখেন।

 মহিষীর মনের ভিতর নাকি একটা ভয়, একটা সন্দেহ বর্ত্তমান ছিল, তারই জন্য আজ কাল করিয়া এ পর্য্যন্ত বিভাকে আর প্রাণ ধরিয়া শ্বশুরালয়ে পাঠাতে পারিতেছেন না। দুই এক সপ্তাহ চলিয়া গেল, উদয়াদিত্যের বিষয়ে সকলেই এক প্রকার নিশ্চিন্ত হইয়াছেন। কেবল, বিভার সম্বন্ধে যে কি করিবেন, মহিষী এখনো তাহার একটা স্থির করিতে পারিতেছেন না। এমন আরো কিছু দিন গেল। যতই বিলম্ব হইতেছে। —ততই বিভার অধীরতা বাড়িতেছে। বিভা মনে করিতেছে—যতই বিলম্ব হইতেছে, ততই সে যেন তাহার স্বামীর নিকট অপরাধী হইতেছে। তিনি যখন ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন—তখন আর কিসের জন্য বিলম্ব করা! একবার তিনি মার্জ্জনা করিয়াছেন, আবার—। কয়েক দিন বিভা আর কিছু বলিল না—অবশেষে একদিন আর থাকিতে পারিল না; মায়ের কাছে গিয়া মায়ের গলা ধরিয়া, মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বিভা কহিল,