বিচিত্র গল্প (দ্বিতীয় ভাগ)/একটি ক্ষুদ্র ও পুরাতন গল্প

উইকিসংকলন থেকে

একটি ক্ষুদ্র পুরাতন গল্প।

গল্প বলিতে হইবে? কিন্তু আর পারি না। এখন এই পরিশ্রান্ত অক্ষম ব্যক্তিটিকে ছুটি দিতে হইবে।

 এ পদ আমাকে কে দিল বলা কঠিন। ক্রমে ক্রমে একে একে তোমরা পাঁচজন আসিয়া আমার চারিদিকে কখন্ জড় হইলে, এবং কেন যে তোমরা আমাকে এত অনুগ্রহ করিলে এবং আমার কাছে এত প্রত্যাশা করিলে, তাহা বলা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। অবশ্যই সে তোমাদের নিজগুণে; শুভদৃষ্টক্রমে আমার প্রতি সহসা তোমাদের অনুগ্রহ উদয় হইয়াছিল। এবং যাহাতে সে অনুগ্রহ রক্ষা হয় সাধ্যমত আমার সে চেষ্টার ত্রুটি নাই।

 কিন্তু পাঁচজনের অব্যক্ত অনির্দ্দিষ্ট সম্মতিক্রমে যে কার্য্যভার আমার প্রতি অর্পিত হইয়া পড়িয়াছে আমি তাহার যোগ্য নহি। ক্ষমতা আছে কি না আছে তাহা লইয়া বিনয় বা অহঙ্কার করিতে চাহি না; কিন্তু প্রধান কারণ এই যে, বিধাতা আমাকে নির্জ্জনচর জীবরূপেই গঠিত করিয়াছিলেন, খ্যাতি যশ জনতার উপযোগী করিয়া আমার গাত্রে কঠিন চর্ম্মাবরণ দিয়া দেন নাই; তাঁহার এই বিধান ছিল যে, যদি তুমি আত্মরক্ষা করিতে চাও ত একটু নিরালার মধ্যে বাস করিয়ো।

 চিত্তও সেই নিরালা বাসস্থানটুকুর জন্য সর্ব্বদাই উৎকণ্ঠিত হইয়া আছে। কিন্তু পিতামহ অদৃষ্ট পরিহাস করিয়াই হৌক্‌ অথবা ভুল বুঝিয়াই হৌক, আমাকে একটি বিপুল জনসমাজের মধ্যে উত্তীর্ণ করিয়া এক্ষণে মুখে কাপড় দিয়া হাস্য করিতেছেন, আমি তাঁহার সেই হাস্যে যোগ দিবার চেষ্টা করিতেছি কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারিতেছি না।

 পলায়ন করাও আমার কর্ত্তব্য বলিয়া মনে হয় না। সৈন্যদলের মধ্যে এমন অনেক ব্যক্তি আছে যাহারা স্বভাবতই যুদ্ধের অপেক্ষা শান্তির মধ্যেই অধিকতর স্ফূর্ত্তি পাইতে পারিত কিন্তু যখন সে নিজের এবং পরের ভ্রমক্রমে যুদ্ধ ক্ষেত্রের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে তখন হঠাৎ দল ভাঙ্গিয়া পলায়ন করা তাহাকে শোভা পায় না। অদৃষ্ট সুবিবেচনা পূর্ব্বক প্রাণীগণকে যথাযগ্য কর্ম্মে নিয়োগ করেন না, কিন্তু তথাপি নিযুক্ত কার্য্য দৃঢ় নিষ্ঠার সহিত সম্পন্ন করা মানুষের কর্তব্য।

 তোমরা আবশ্যক বোধ করিলে আমার নিকট আসিয়া থাক, এবং সম্মান দেখাইতেও ত্রুটি কর না। আবশ্যক অতীত হইয়া গেলে সেবকাধমের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়া কিছু আত্মগৌরব অনুভব করিবারও চেষ্টা করিয়া থাক। পৃথিবীতে সাধারণতঃ ইহাই স্বাভাবিক এবং এই কারণেই “সাধারণ” নামক একটি অকৃতজ্ঞ অব্যবস্থিতচিত্ত রাজাকে তাহার অনুচরবর্গ সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে না। কিন্তু অনুগ্রহ নিগ্রহের দিকে তাকাইলে সকল সময় কাজ করা হইয়া উঠে না। নিরপেক্ষ হইয়া কাজ না করিলে কাজের গৌরব আর থাকে না।

 অতএব, যদি কিছু শুনিতে ইচ্ছা করিয়া আসিয়া থাক ত কিছু শুনাইব। শ্রান্তি মানিব না এবং উৎসাহেরও প্রত্যাশা করিব না।

 আজ কিন্তু অতি ক্ষুদ্র এবং পৃথিবীর অত্যন্ত পুরাতন একটি গল্প মনে পড়িতেছে; মনোহর না হইলেও সংক্ষেপবশতঃ শুনিতে ধৈর্য্যচ্যুতি না হইবার সম্ভাবনা।

 পৃথিবীতে একটি মহানদীর তীরে একটি মহারণ্য ছিল। সেই অরণ্যে এবং সেই নদীতীরে একটি কাঠঠোকরা এবং একটি কাদাখোঁচা পক্ষী বাস করিত।

 ধরাতলে কীট যখন সুলভ ছিল তখন ক্ষুধা নিবৃত্তিপুর্ব্বক সন্তুষ্টচিত্তে উভয়ে ধরাধামের যশঃকীর্ত্তন করিয়া পুষ্ট কলেবরে বিচরণ করিত।

 কালক্রমে দৈবযোগে পৃথিবীতে কীট দুষ্প্রাপ্য হইয়া উঠিল।

 তখন নদীতীরস্থ কাদাখোঁচা শাখাসীন কাঠঠোকরাকে কহিল, “ভাই কাঠঠোকরা, বাহির হইতে অনেকের নিকট এই পৃথিবী নবীন শ্যামল সুন্দর বলিয়া মনে হয় কিন্তু আমি বলিতেছি ইহা আদ্যোপান্ত জীর্ণ।”

 শাখাসীন কাঠঠোকরা নদীতটস্থ কাদাখোঁচাকে কহিল, “ভাই কাদাখোঁচা, অনেকে এই অরণ্যকে সতেজ শোভন বলিয়া বিশ্বাস করে কিন্তু আমি বলিতেছি ইহা একেবারে অন্তঃসারবিহীন।”—

 তখন উভয়ে মিলিয়া তাহাই প্রমাণ করিয়া দিতে কৃতসঙ্কল্প হইল। কাদাখোঁচা নদীতীরে লম্ফ দিয়া পৃথিবীর কোমল কর্দ্দমে অনবরতই চঞ্চু বিদ্ধ করিয়া বসুন্ধরার জীর্ণতা নির্দ্দেশ করিতে লাগিল এবং কাঠঠোকরা বনস্পতির কঠিন শাখায় বাশ্বার চঞ্চু আঘাত করিয়া অরণ্যের অন্তঃশূন্যতা প্রচার করিতে প্রবৃত্ত হইল।

 বিধিবিড়ম্বনায় উক্ত দুই অধ্যবসায়ী পক্ষী সঙ্গীতবিদ্যায় বঞ্চিত। অতএব কোকিল যখন ধরাতলে নব নব বসন্ত সমাগম পঞ্চমম্বরে ঘোষণা করিতে লাগিল, এবং শ্যাম যখন অরণ্যে নব নব প্রভাতোদয় কীর্ত্তন করিতে নিযুক্ত রহিল, তথন এই দুই ক্ষুধিত অসন্তুষ্ট মূক পক্ষী অশ্রান্ত উৎসাহে আপন প্রতিজ্ঞা পালন করিতে লাগিল।

 এ গল্প তোমাদের ভাল লাগিল না? ভাল লাগিবার কথা নহে। কিন্তু ইহার সর্ব্বাপেক্ষা মহৎগুণ এই যে, পাঁচ সাত পারাগ্রাফেই সম্পূর্ণ।

 এ গল্পটা যে পুরাতন তাহাও তোমাদের মনে হইতেছে না? তাহার কারণ পৃথিবীর ভাগ্যদোষে এ গল্প অতি পুরাতন হইয়াও চিরকাল নুতন রহিয়া গেল। বহুদিন হইতেই অকৃতজ্ঞ কাঠঠোকরা পৃথিবীর দৃঢ় কঠিন অমর মহত্ত্বের উপর ঠক্ঠক্ শব্দে চক্ষুপাত করিতেছে এবং কাদাখোঁচা পৃথিবীর সরস উৰ্বর কোমলত্বের মধ্যে খচখচ শব্দে চঞ্চ বিদ্ধ করিতেছে আজও তাহার শেষ হইল না, মনের আক্ষেপ এখনও রহিয়া গেল।

 গল্পটার মধ্যে সুখদুঃখের কথা কি আছে জিজ্ঞাসা করিতেছ? ইহার মধ্যে দুঃখের কথাও আছে সুখের কথাও আছে। দুঃখের কথা এই যে, পৃথিবী যতই উদার এবং অরণ্য যতই মহৎ হউক্ ক্ষুদ্র চঞ্চু আপনার উপযুক্ত খাদ্য না পাইবামাত্র তাহাদিগকে আঘাত করিয়া আসিতেছে। এবং সুখের বিষয় এই যে, তথাপি শত সহস্র বৎসর পৃথিবী নবীন এবং অরণ্য শ্যামল রহিয়াছে। যদি কেহ মরে ত সে ঐ দুটি বিদ্বেষবিষজর্জর হতভাগ্য বিহঙ্গ, এবং জগতে কেহ সে সংবাদ জানিতেও পায় না।

 তােমরা এ গল্পের মধ্যে মাথামুণ্ডু অর্থ কি আছে কিছু বুঝিতে পার নাই? তাৎপর্য বিশেষ কিছুই জটিল নহে, হয় ত কিঞ্চিৎ বয়স প্রাপ্ত হইলেই বুঝিতে পারিবে।

 যাহাই হউক্ সৰ্বসুদ্ধ জিনিষটি তােমাদের উপযুক্ত হয় নাই? তাহার ত কোন সন্দেহমাত্র নাই।


সমাপ্ত।