পাতা:আত্মপরিচয় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সম্মান

যখন বালক ছিলেম তখন চন্দননগরে আমার প্রথম আসা। সে আমার জীবনের আরেক যুগে। সেদিন লোকের ভিড়ের বাইরে ছিলেম প্রচ্ছন্ন, কোনো ব্যক্তি, কোনো দল আমাকে অভ্যর্থনা করে নি। কেবল আদর পেয়েছিলেম বিশ্ব প্রকৃতির কাছ থেকে। গঙ্গা তখন পূর্ণগৌরবে ছিলেন, তাঁর প্রাণধারায় সংকীর্ণতা ঘটে নি, ছায়া স্নিগ্ধ শ্যামলতায় তাঁর দুই তীরের গ্রামগুলি শান্তি ও সন্তোষের রসে ভরা ছিল।

 তার পূর্বে শিশুকাল থেকে সর্বদাই ছিলেম কলকাতার ইঁটের খাঁচায়। মুক্ত আকাশে অলোকের যে সদাব্রত, তার নানা বাধা-পাওয়া দাক্ষিণ্যের খণ্ড অংশ পৌঁছত আমার ভাগে। আমার অর্ধাশনক্লিষ্ট মন এখানে এসে মুক্তির অমৃত অঞ্জলি ভ’রে পান করেছে। চিরদিন যারা এই শ্যামলার আঁচলে বাঁধা হয়ে থাকত, তারা একে তেমন সম্পূর্ণ দেখে নি। আমি এসেছিলেম যেন দূরের অতিথি, তাই আমার জন্যে ছিল বিশেষ আয়োজন। সেদিন গঙ্গাতীরের পূর্ব দিগন্তে বনরেখার উপরের পথে প্রতিদিন সকালে সোনার আলোয় মাধুর্যের যে ডালি আসত সে আর কারো চোখে তেমন করে পড়ে নি আর সূর্যাস্তের নানা রঙের তুলিতে গঙ্গার জলধারায় রেখায় রেখায় যে লেখন দেখা দিত সে বিশেষ করে আমারই জন্যে।

 সেই অতিথিবৎসলা বিশ্বপ্রকৃতি তাঁর অবারিত আঙিনায় সেদিন যখন বালককে বসালেন, তাকে কানে কানে বললেন, ‘তোমার বাঁশিটি বাজাও।’ বালক সে দাবি মেনেছিল।

 ছেলেমানুষের বাঁশি ছেলেমানুষি সুরে যেখানে বাজত সে আমার মনে আছে। মেরান সাহেবের বাগানবাড়ি বড়ো যত্নে তৈরি, তাতে আড়ম্বর ছিল না কিন্তু সৌন্দর্যের ভঙ্গি ছিল বিচিত্র। তার সর্বোচ্চ

১১৫