পাতা:ছেলেবেলা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 গঙ্গার ধারের প্রথম যে বাসা আমার মনে পড়ে, ছোটো সে দোতলা বাড়ি। নতুন বর্ষা নেমেছে। মেঘের ছায়া ভেসে চলেছে স্রোতের উপর ঢেউ খেলিয়ে; মেঘের ছায়া কালো হয়ে ঘনিয়ে রয়েছে ও পারে বনের মাথায়। অনেকবার এইরকম দিনে নিজে গান তৈরি করেছি, সেদিন তা হল না। বিদ্যাপতির পদটি জেগে উঠল আমার মনে—

এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর,
শূন্য মন্দির মোর।

নিজের সুর দিয়ে ঢালাই করে রাগিণীর ছাপ মেরে তাকে নিজের করে নিলুম। গঙ্গার ধারে সেই সুর দিয়ে মিনে করা এই বাদলদিন আজও রয়ে গেছে আমার বাগানের সিন্ধুকটাতে। মনে পড়ে— থেকে থেকে বাতাসের ঝাপটা লাগছে গাছগুলোর মাথার উপর, ঝুটোপুটি বেধে গেছে ডালে-পালায়, ডিঙি নৌকাগুলো সাদা পাল তুলে হাওয়ার মুখে ঝুঁকে পড়ে ছুটেছে, ঢেউগুলো ঝাঁপ দিয়ে দিয়ে ঝপ্ ঝপ্ শব্দে পড়ছে ঘাটের উপর। বউঠাকরুন ফিরে এলেন, গান শোনালুম তাঁকে ভালো লাগল বলেন নি, চুপ করে শুনলেন। তখন আমার বয়স হবে যোলো কি সতেরো। যা-তা তর্ক নিয়ে কথা কাটাকাটি তখনো চলে, কিন্তু ঝাঁজ কমে গিয়েছে।

 তার কিছু দিন পরে বাসা বদল করা হল মোরান-সাহেবের বাগানে। সেটা রাজবাড়ি বললেই হয়। রঙিন কাঁচের জানলা-দেওয়া উঁচু-নিচু ঘর; মার্বল পাথরে বাঁধা মেজে; ধাপে ধাপে গঙ্গার উপর থেকেই উঠেছে লম্বা বারান্দায়। ঐখানে রাত জাগবার ঘোর লাগত আমার মনে; সেই সাবরমতী নদীর ধারের পায়চারির সঙ্গে

৬৩