পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪২
ঘরে-বাইরে

উঠেছে। এমন সময় হঠাৎ পেয়ালাটা ভেঙে মাটির উপর পড়ে গেল। এখন বাঁচি কী করে!

 তাড়াতাড়ি খোঁপা বাঁধতে বসেছিলুম। লজ্জা! লজ্জা! লজ্জা! মেজোরানীর ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি বলে উঠলেন, কী লাে ছােটোরানী, খোঁপাটা যে মাথা ডিঙিয়ে লাফ মারতে চায়, মাথাটা ঠিক আছে তাে?

 সেদিন বাগানে স্বামী আমাকে অনায়াসে বললেন, তােমাকে ছুটি দিলুম। ছুটি কি এতই সহজে দেওয়া যায় কিংবা নেওয়া যায়! ছুটি কি একটা জিনিস! ছুটি যে ফাঁকা। মাছের মতাে আমি যে চিরদিন আদরের জলে সাঁতার দিয়েছি; হঠাৎ আকাশে তুলে ধরে যখন বললে ‘এই তােমার ছুটি’ তখন দেখি, এখানে আমি চলতেও পারি নে, বাঁচতেও পারি নে।

 আজ শােবার ঘরে যখন ঢুকি তখন দেখি শুধু আসবাব, শুধু আলনা, শুধু আয়না, শুধু খাট; এর উপরে সেই সর্বব্যাপী হৃদয়টি নেই। রয়েছে ছুটি, কেবল ছুটি, একটা ফাঁক। ঝরনা একেবারে শুকিয়ে গেল, পাথর আর নুড়িগুলাে বেরিয়ে পড়েছে। আদর নেই, আসবাব।

 এ জগতে সত্য আমার পক্ষে কোথায় কতটুকু টিঁকে আছে সে সম্বন্ধে হঠাৎ যখন এত বড়াে একটা ধাঁধা লাগল তখন আবার দেখা হল সন্দীপের সঙ্গে। প্রাণের সঙ্গে প্রাণের ধাক্কা লেগে সেই আগুন তাে আবার তেমনি করেই জ্বলল। কোথায় মিথ্যে। এ যে ভরপুর সত্য, দুই-কূল-ছাপিয়ে পড়া সত্য। এই-যে মানুষগুলাে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কথা কচ্ছে, হাসছে— ঐ-যে বড়ােরানী মালা জপছেন, মেজোরানী থাকো দাসীকে নিয়ে হাসছেন, পাঁচালির গান গাচ্ছেন— আমার ভিতরকার এই আবির্ভাব যে এই-সমস্তর চেয়ে হাজার গুণে সত্য।

 সন্দীপ বললেন, পঞ্চাশ হাজার চাই। আমার মাতাল মন বলে উঠল, পঞ্চাশ হাজার কিছুই নয়। এনে দেব। কোথায় পাব, কী করে পাব, সেও কী একটা কথা! এই তাে আমি নিজে এক মুহূর্তে কিছু-না থেকে একেবারে সব-কিছুকে যেন ছাড়িয়ে উঠেছি; এমনি করেই এক ইশারায় সব ঘটনা ঘটবে। পারব, পারব, পারব। একটুও সন্দেহ নেই।

 চলে তাে এলুম। তার পর চার দিকে চেয়ে দেখি, টাকা কই? কল্পতরু কোথায়? বাহিরটা মনকে এমন করে লজ্জা দেয় কেন? কিন্তু তবু টাকা এনে দেবই। যেমন করেই হােক, তাতে গ্লানি নেই। যেখানে দীনতা সেখানেই অপরাধ, শক্তিকে কোনাে অপরাধ স্পর্শ করে না। চোরই চুরি করে, বিজয়ী রাজা লুঠ করে নেয়। কোথায় মালখানা, সেখানে কার হাতে টাকা জমা হয়,