পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিমলার আত্মকথা

আজ সকালে অমূল্যর কলকাতা থেকে ফেরবার কথা। বেহারাকে বলে রেখেছি, সে এলেই যেন খবর দেয়। কিন্তু স্থির থাকতে পারছি নে। বাইরের বৈঠকখানায় গিয়ে বসে রইলুম।

 অমূল্যকে যখন আমার গয়না বেচবার জন্যে কলকাতায় পাঠালুম তখন নিজের কথা ছাড়া আর কোনাে কথা বুঝি মনেই ছিল না। এ কথা একবারও আমার বুদ্ধিতে এলই না যে, সে ছেলেমানুষ, অত টাকার গয়না কোথাও বেচতে গেলে সবাই তাকে সন্দেহ করবে। মেয়েমানুষ, আমরা এত অসহায় যে আমাদের নিজের বিপদ অন্যের ঘাড়ে না চাপিয়ে আমাদের যেন উপায় নেই। আমরা মরবার সময় পাঁচজনকে ডুবিয়ে মারি।

 বড়াে অহংকার করে বলেছিলুম, অমূল্যকে বাঁচাব। যে নিজে তলিয়ে যাচ্ছে সে নাকি অন্যকে বাঁচাতে পারে! হায় হায়, আমিই বুঝি ওকে মারলুম! ভাই আমার, আমি তাের এমনি দিদি, যেদিন মনে মনে তাের কপালে ভাইফেঁটা দিলুম সেইদিনই বুঝি যম মনে মনে হাসলে। আমি যে অকল্যাণেরই বােঝা নিয়ে ফিরছি আজ।

 আমার আজ মনে হচ্ছে, মানুষকে এক-এক সময় যেন অমঙ্গলের প্লেগে ধরে। হঠাৎ কোথা হতে তার বীজ এসে পড়ে, আর এক রাত্রেই মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। সেই সময়ে সকল সংসার থেকে খুব দূরে কোথাও তাকে সরিয়ে রাখা যায় না কি? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তার ছোঁয়াচ বড়াে ভয়ানক। সে যে বিপদের মশালের মতো, নিজে পুড়তে থাকে সংসারে আগুন লাগাবার জন্যেই।

 নটা বাজল। আমার কেমন বােধ হচ্ছে, অমূল্য বিপদে পড়েছে, ওকে পুলিসে ধরেছে। আমার গহনার বাক্স নিয়ে থানায় গােলমাল পড়ে গেছে। কার বাক্স ও কোথা থেকে পেলে, তার জবাব তাে শেষকালে আমাকেই দিতে হবে— সমস্ত পৃথিবীর লােকের সামনে কী জবাবটা দেব? মেজোরানী, এতকাল তােমাকে বড়াে অবজ্ঞাই করেছি। তােমার দিন এল। তুমি আজ সমস্ত পৃথিবীর রূপ ধরে শােধ তুলবে। হে ভগবান, এইবার আমাকে বাঁচাও—আমার সমস্ত অহংকার ভাসিয়ে দিয়ে মেজোরানীর পায়ের তলায় পড়ে থাকব।