পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
৯৩

সুযােগ থেকে বঞ্চিত করাতে ছেলে বাপের উপর খুব রাগ করেছে। সে রেগে পত্নীহীন বুড়াে বাপকে একলা ফেলে রেঙ্গুনে চলে গেল।

 তিনি আমাকে বার বার বলেছেন, দেখে নিখিল, তােমার সম্বন্ধে আমি স্বাধীন, আমার সম্বন্ধে তুমি স্বাধীন, তােমার সঙ্গে আমার এই সম্বন্ধ। কল্যাণের সম্বন্ধকে অর্থের অনুগত করলে পরমার্থের অপমান করা হয়।

 এখন তিনি এখানকার এন্‌ট্রেন্স স্কুলের হেডমাস্টারি করেন। এতদিন তিনি আমাদের বাড়িতে পর্যন্ত থাকতেন না, এই কিছুদিন থেকে আমি প্রায় সন্ধেবেলায় তাঁর বাসায় গিয়ে রাত্রি এগারােটা দুপুর পর্যন্ত নানা কথায় কাটিয়ে আসছিলুম। বােধ হয় ভাবলেন, তাঁর ছােটো ঘর এই ভাদ্র মাসের গুমটে আমার পক্ষে ক্লেশকর, সেইজন্যেই তিনি নিজে আমার এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্চর্য এই, বড়ােমানুষের ’পরেও তাঁর গরিবের মতােই সমান দয়া, বড়ােমানুষের দুঃখকেও তিনি অবজ্ঞা করেন না।

 বাস্তবকে যত একান্ত করে দেখি ততই সে আমাদের পেয়ে বসে— আভাসমাত্রে সত্যকে যখন দেখি তখনই মুক্তির হাওয়া গায়ে লাগে। বিমল আজ আমার জীবনে সেই বাস্তবকেই এত বেশি তীব্র করে তুলেছে যে, সত্য আমার পক্ষে আজ আচ্ছন্ন হবার জো হয়েছে। তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথাও আমার দুঃখের আর সীমা খুঁজে পাচ্ছি নে। তাই আজ আমার এতটুকু ফাঁককে লােকলােকান্তরে ছড়িয়ে দিয়ে শরতের সমস্ত সকাল ধরে গান গাইতে বসেছি—

এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর,
শূন্য মন্দির মাের!

 যখন চন্দ্রনাথবাবুর জীবনের বাতায়ন থেকে সত্যকে দেখতে পাই তখন ও গানের মানে একেবারেই বদলে যায়, তখন—

বিদ্যাপতি কহে কৈসে গােয়াঁয়বি
হরি বিনে দিনরাতিয়া?

 যত দুঃখ, যত ভুল, সব যে ঐ সত্যকে না পেয়ে। সেই সত্যকে জীবনে ভরে না নিয়ে দিন-রাত এমন করে কেমনে কাটবে? আর তাে পারি নে, সত্য, তুমি এবার আমার শূন্য মন্দির ভরে দাও!