পাখীর কথা/প্রথম ভাগ/খাঁচার পাখী

উইকিসংকলন থেকে

খাঁচার পাখী

 পাখী-পোষার ঝোঁক মানুষের বহুকাল হইতেই আছে। জগতের প্রায় সকল স্থানে ইহার স্বল্পাধিক নিদর্শন লক্ষিত হয়। মানব-সমাজেরসূচনা সকল স্তরে ইহার প্রভাব বিদ্যমান; অবস্থা-নির্ব্বিশেষে সকল শ্রেণীর লোককে অল্পবিস্তর এই ঝোঁকের বশবর্ত্তী হইতে দেখা যায়।

 এই বিপুল বিশ্বের কোন-না-কোন ক্ষুদ্র জীবের প্রতি মানবহৃদয়ের কেমন একটা সূক্ষ্ম আকর্ষণ আছে যে মানুষ নানা কার্য্যে লিপ্তপশুপক্ষীর প্রতি মানবের মমতা থাকিলেও, সে এই আকর্ষণ হইতে আপনাকে মুক্ত করতে সমর্থ হয় না। এই আকর্ষণের বলেই, মানুষ, কুকুর, বিড়াল, পারাবত প্রভৃতি প্রাণীকে যত্ন ও প্রীতির সহিত গৃহে পালন করিতে উদ্যত হয়। মানবের শৈশবাবস্থা হইতে ইহার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। গ্রামের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় যে, ছোট-ছোট বালকেরা ঝড়, জল ও রৌদ্রের প্রখরতা উপেক্ষা করিয়া গাছে-গাছে পাখীর নীড় অন্বেষণ করে, এবং শাবক দেখিতে পাইলে অহ্লাদে আটখানা হইয়া উহাকে সাবধানে গৃহে লইয়া যায়। অসহায় পক্ষি-শিশুকে বাঁচাইবার জন্য বালকদিগের চেষ্টা বড়ই আশ্চর্য্যজনক; এবং এরূপ অনেক সময়ে ঘটে যে, ভালবাসা ও যত্নের আধিক্যই শাবকের মৃত্যুর কারণ হইয়া দাঁড়ায়। এই পালন করিবার ও ভালবাসিবার ইচ্ছা বালকের বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে বর্দ্ধিত হয়।

 সৃষ্ট প্রাণিসমূহের মধ্যে পাখীর প্রতি মানুষের পক্ষপাতিত্বের কারণ এই যে, পাখীরা অতি সহজে নেত্রপথবর্ত্তী হইয়া উহাদের উজ্জ্বল বর্ণ এবং মধুর কণ্ঠস্বরের দ্বারাপক্ষীর প্রতি মানুষের পক্ষপাতিত্বের কারণ আমাদের চিত্ত আকর্ষণ করে। পক্ষপুটের উপর নির্ভর করিয়া ইহারা স্বেচ্ছায় যথাতথা উড়িয়া বেড়াইতে সমর্থ। ইহাদের স্বভাবসুলভ চঞ্চল গতি অনায়াসেই ইহাদিগকে শত্রুর আক্রমণ হইতে রক্ষা করিয়া থাকে। অপর জন্তুদিগকে ভয়ে-ভয়ে বিচরণ করিতে হয় বলিয়া উহারা সহজে আমাদের নয়নগোচর হয় না। উহাদের মধ্যে কেহ রাত্রিকালে আপনাকে নিরাপদ মনে করিয়া গহ্বর হইতে বহির্গত হয়; কেহ বা নিবিড় অরণ্যমধ্যে সন্তর্পণে বিচরণ করে; কিছুমাত্র শব্দ হইলেই চকিতনয়নে চারিদিকে নিরীক্ষণ করিতে থাকে। পক্ষিজাতির চাক্‌চিক্যময় ক্ষুদ্র সুকোমল অবয়ব, শ্রবণ-মনোহর মধুরাস্ফুট ধ্বনি, উহাদের অবাধ-ললিত গতি ও অসহায় জীবন অতর্কিতভাবে আমাদের হৃদয়ে এক অনুরাগ-মাখা ভাবের সঞ্চার করে। এই নিমিত্ত পাখীরা চিরযুগ ধরিয়া মানুষের মনে বিশ্বস্ততাপাশে আবদ্ধ। মানবের ক্রিয়াকলাপে, আচারব্যবহারে, গল্পে, কবিতায়, প্রবাদে, ছড়ায় এই ভাবের অভিব্যক্তি যথেষ্ট পরিলক্ষিত হয়।

 পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে যে, পক্ষিপালন-প্রথা পৃথিবীর প্রায় সকল জাতির মধ্যে বিদ্যমান। এই প্রথা এত প্রাচীন যে,পক্ষিপালনপ্রথা সার্ব্বভৌমিক কেহ সম্যক্‌রূপে ইহার উৎপত্তিকাল নিরূপণ করিতে পারেন না। বিহঙ্গ-তত্ত্ববিদ্ ডাক্তার ব্যট্‌লার (Dr. A. G. Butler) বলেন যে, সম্ভবতঃ প্রাগৈতিহাসিক যুগে এই পালন-প্রথার উৎপত্তি হইয়াছিল[১]। হেন্‌রি ওল্‌ডিস্ (Henry Oldys) সাহেব তাঁহার “Cage-bird traffic of the United States” নামক প্রবন্ধে লিখিয়াছেন, “জীবিত পক্ষীকে পিঞ্জরে রাখিয়া পালন-প্রথা জগদ্ব্যাপী; এবং ইহা ঐতিহাসিক যুগের এত পূর্ব্ব হইতে প্রচলিত যে, কবে ইহার উৎপত্তি হইয়াছিল, তাহা বলা যায় না। গ্রীষ্মপ্রধান ও নাতিশীতোষ্ণ দেশবাসীদিগের মধ্যে ইহার প্রচলন দেখা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরস্থিত দ্বীপপুঞ্জের নবাবিষ্কারের সময়েও তথায়গ্রীস ও রোম পক্ষিপালন-প্রথা প্রচলিত ছিল; ইঙ্কাদিগের রাজত্বকালে পেরুদেশবাসিগণ এটিকে তাহাদের অভ্যাসে পরিণত করিয়াছিল * *”[২]। তিনি আরও লিখিয়াছেন যে, “প্রাচীন গ্রীস ও রোমবাসীদিগের নিকট পিঞ্জরপালিত পক্ষী বড়ই আদরের জিনিস ছিল। কথিত আছে যে, ভারতবর্ষীয় কণ্ঠরেখাসমন্বিত শুকপক্ষী মহাবীর আলেক্‌জাণ্ডারের কোন এক সেনাপতি কর্ত্তৃক সর্ব্বপ্রথমে য়ুরোপে নীত হইয়াছিল।বেবিলন ইহার পূর্ব্বেও পশ্চিম-এসিয়ার বিভিন্ন জাতি কর্ত্তৃক জীবিত পক্ষী পালিত হইত; এবং বুলবুল প্রভৃতি মনোমোহকর গায়ক পক্ষী বেবিলনের দোদুল্যমান উদ্যানসমূহের যে সৌন্দর্য্য-বর্দ্ধন করিত, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই”[৩]জেনেসিস্ (Genesis), লেভিটিকস্ (Leviticus) এবং ইসায়া (Isaiah) নামক গ্রন্থসমূহে গৃহপালিত পারাবতের ভূরি ভূরিযুডিয়া উল্লেখ আছে। এই পারাবত-পালন-প্রথার প্রাচীনত্ব নির্দ্দেশ করিতে গিয়া ডারউইন সাহেব তাঁহার ‘Variation of Animals and Plants under Domestication’ নামক গ্রন্থে বলেন, প্রোফেসার লেপ্সিয়স্ (Professor Lepsius) স্পষ্ট ইঙ্গিত করিয়াছেন যে, খৃষ্টপূর্ব্ব তিন সহস্রমিশর বর্ষ পূর্ব্বে পঞ্চম মিশর-বংশের রাজত্বকালে গৃহপালিত পারাবতের সর্ব্বপ্রথম নিদর্শন লিপিবদ্ধ আছে[৪]। ব্যট্‌লার সাহেব তাঁহার প্রসিদ্ধ গ্রন্থের[১] মুখবন্ধে প্রাচীন হিব্রুজাতির পক্ষিপালন সম্বন্ধে হেন্‌রি ওল্‌ডিস্ সাহেবের অভিমত এইরূপে উদ্ধৃত করিয়াছেন—‘ইহা একরূপ অবধারিত হইয়াছে যে, প্রাচীন হিব্রুরা পক্ষিপালক ছিলেন; যেহেতু তাঁহাদের লিখিত পুস্তকাদির মধ্যে অপরিষ্কার পিঞ্জর-পক্ষীর উল্লেখ দেখা যায়।’আর্য্যাবর্ত্ত ভারতবর্ষে যে বহুকাল পূর্ব্বে পারাবত, শুক, সারিকা প্রভৃতি পক্ষী গৃহে পালিত হইত, তাহা আর্য্যদিগের প্রাচীনতম গ্রন্থ হইতে জানিতে পারা যায়। প্রাসঙ্গিক দুই একটি দৃষ্টান্ত প্রদত্ত হইল।

“গৃহে পারাবতা ধন্যাঃ শুকাশ্চ সহসারিকাঃ।
গৃহেষ্বেতে ন পাপায়—”॥ মহাভারত, অনুশাসনপর্ব্ব,
অধ্যায় ১০৪, শ্লোক ১১৪।


‘তাং সারিকা[৫]কন্দুকদর্পণাম্বুজৈঃ
শ্বেতাতপত্রব্যজনস্রগাদিভিঃ।
 ٭ ٭ ٭ ٭ 
বৃষেন্দ্রমারোপ্য বিটঙ্কিতা যযুঃ।”
শ্রীমদ্ভাগবত, ৪র্থ স্কন্ধ, ৪র্থ অধ্যায়, ৫ শ্লোক।


 এই শ্লোক দ্বারা স্পষ্টই প্রতীতি হইতেছে যে, তাৎকালিক স্ত্রীলোকদিগের দর্পণব্যজনাদির ন্যায় সারিকা পক্ষিণীও অত্যাবশ্যক বিলাসের সামগ্রী ছিল। এমন কি, আমরা দেখিতে পাই যে, বৈদিক যুগে সারিকা ও শুক পক্ষী পালিত ও শিক্ষিত হইয়া মানুষের ন্যায় কথা বলিত।

 | | |  | |
 সরস্বত্যৈ শারিঃ শ্যেতা পুরুষবাক্[৬] সরস্বতে শুকঃ শ্যেতঃ
 ¯ ¯ ¯ ¯ ¯
 |
পুরুষবাক্। তৈত্তিরীয়সংহিতা, ৫|৫|১২

 মনুষ্যের ন্যায় কথা বলিতে পারে এমন সাদা রংএর সারি পাখী সরস্বতী দেবীর প্রতি এবং ঐ প্রকার শুক পক্ষী সমুদ্রের প্রতি উৎসর্গ করিতে হইবে।

 বাজসনেয়ী সংহিতায় (২৪|৩৩) ঠিক এইরূপ মনুষ্যবাক্যভাষী শুকসারি পক্ষীর উল্লেখ আছে।

 কৌটিল্য-প্রণীত ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থ হইতে জানিতে পারা যায় যে, মৌর্য্যদিগের রাজত্বকালে এতদ্দেশে পক্ষিপালনপ্রথা যথেষ্ট প্রচলিত ছিল। এমন কি কতিপয় পক্ষী রাজকীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হইত[৭]। উক্ত গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, মৌর্যরাজের অশ্বশালায় ময়ূর, চকোর, শুক, সারিকা প্রভৃতি পক্ষীর নিমিত্ত আসন-ফলক নির্দ্দিষ্ট ছিল[৮]

 শূদ্রক-প্রণীত ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে একটি অনতিবৃহৎ পক্ষিশালার সুচারু বর্ণনা পাওয়া যায়।

 “ইহাপি সপ্তমে প্রকোষ্ঠে সুশ্লিষ্টবিহঙ্গবাটীসুখনিষণ্ণানি অন্যোঽন্য চুম্বনপরাণি সুখমনুভবন্তি পারাবতমিথুনানি, দধিভক্তপূরিতোদরো ব্রাহ্মণ ইব সূক্তং পঠতি পঞ্জরশুকঃ। ইয়মপরা স্বামিসম্মাননা-লব্ধপ্রসরা ইব গৃহদাসী অধিকং কুরকুরায়তে মদনসারিকা। অনেকফলরসাস্বাদ-প্রতুষ্টকণ্ঠা কুম্ভদাসীব কূজতি পরপুষ্টা, আলম্বিতা নাগদন্তেষু পঞ্জরপরম্পরাঃ, যোধ্যন্তে লাবকাঃ, আলপান্তে পঞ্জরকপিঞ্জলাঃ, প্রেষ্যন্তে পঞ্জরকপোতাঃ ইতস্ততো বিবিধমণিচিত্রিত ইবায়ং সহর্ষং নৃত্যন্ রবিকিরণসন্তপ্তং পক্ষোৎক্ষেপৈর্বিধুবতীব প্রাসাদং গৃহময়ূরঃ। ইতঃ পিণ্ডীকৃতা ইব চন্দ্রপাদাঃ পদগতিং শিক্ষয়ন্তীব কামিনীনাং পশ্চাৎ পরিভ্রমন্তি রাজহংসমিথুনানি। এতে অপরে বৃদ্ধমহোত্তরাঃ ইব ইতস্ততঃ সঞ্চরন্তি গৃহসারসাঃ”[৯]

 ‘এখানে এই সপ্তম প্রকোষ্ঠে সুসংযুক্ত একটী পক্ষিশালা রহিয়াছে, যথায় অনেক পারাবতমিথুন পরস্পরকে চুম্বন করিয়া সুখে অবস্থান করিতেছে। পিঞ্জরস্থ শুক দধিভোজন দ্বারা পূর্ণোদর ব্রাহ্মণের সূক্তপাঠের ন্যায় পড়িতেছে, এই মদনসারিকাটী (ময়না) গৃহস্বামীর আদরে লব্ধপ্রভাবা গৃহদাসীর ন্যায় অধিক শব্দ করিতেছে। কুম্ভদাসীর ন্যায় কোকিল পাখী বহু ফলের রস আকণ্ঠ পান করিয়া কূজন করিতেছে। হস্তিদন্তকিলকে পিঞ্জরসমূহ লম্বিত রহিয়াছে, লাবক পক্ষীরা যুদ্ধ করিতেছে। কপিঞ্জল পক্ষিসকল পিঞ্জরের ভিতর আলাপ করিতেছে। কপোতসমূহ ইতস্ততঃ প্রেরিত হইতেছে। গৃহময়ূর সানন্দে নৃত্য করিতে করিতে উহার বিবিধ-মণি-চিত্রিত পক্ষ বিস্তার করিয়া যেন রবিকরোত্তপ্ত প্রাসাদকে বীজন করিতেছে। রাশীকৃত চন্দ্রখণ্ডের ন্যায় অসংখ্য রাজহংসমিথুন যেন স্ত্রীলোকদিগের পদগতি শিক্ষা করতঃ উহাদের পশ্চাৎ পরিভ্রমণ করিতেছে; গৃহ-সারস-সমূহ অতিবৃদ্ধের ন্যায় মৃদুপদে বিচরণ করিতেছে।’

 এই পক্ষিবাটিকার বিবরণ কবি-কল্পিত হইলেও, প্রায় দেড়সহস্র বর্ষ পূর্ব্বে প্রচলিত পক্ষিপালন-প্রথার কতকটা আভাস দেয়, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্ত্তৃক সঙ্কলিত “শ্যৈনিকশাস্ত্র”[১০] গ্রন্থে দেখিতে পাই যে, অন্যূন পাঁচশত বৎসর পূর্ব্বে এতদ্দেশীয় রাজগণ কর্ত্তৃক শ্যেন পক্ষী সমাদৃত হইত। তাঁহারা ঐ পক্ষীর সাহায্যে মৃগয়া করিয়া বড়ই আনন্দানুভব করিতেন। উক্ত গ্রন্থে শ্যেনপক্ষী সম্বন্ধে উপযুক্ত বাসস্থান, পথ্যাপথ্যনির্ণয় প্রভৃতি যাবতীয় বিষয় বিশদভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লিপিবদ্ধ দেখিয়া আমাদের মনে হয়, তাৎকালিক ভারতীয় নৃপতিবৃন্দ যে পক্ষিদালন-ব্যাপারে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। শ্যেন পক্ষীর আবাসস্থান সম্বন্ধে উক্তগ্রন্থে এরূপ লিখিত আছে—

‘উপত্যকা হিমগিরের্যেষাং পরিচয়ং গতাঃ
তেষাং দাবাগ্নিসঙ্কাশো গ্রীষ্মোভবতি দুঃসহঃ।
অতস্তাপোপশমনান্ উপচারান্ প্রযোজয়েৎ
তেষাং প্রাসাদশিখরে সুধাধবলিতোদবে।
যন্ত্রনির্মুক্তপর্য্যন্তপানীয়াসারশীতলে
     
বিবিক্তে বন্ধনং কার্য্যং জালসংরুদ্ধমক্ষিকে
অথবোদ্যানসদ্বেদ্যাং রক্ষিতায়াং সুরক্ষিভিঃ।
সরৎকুল্যাম্বুশীতায়াং নিবিড়াচ্ছিতভূরূহৈঃ
চণ্ডাংশুকরসঞ্চাররহিতায়ামনারতম্।
     
নির্দংশমশকে রম্যে ভূগৃহে বন্ধ ইষ্যতে
স্থানং বিলোচনানন্দজননং ঘ্রাণতর্পণম্।
সমারুতপ্রচারন্তু সাবকাশং প্রকল্পয়েৎ
নৈকত্র বহবঃ স্থাপ্যাঃ দ্বিত্রাঃ স্থাপ্যাঃ পৃথক্‌ পৃথক্।
৫ম পরিচ্ছেদ, ১৬, ২০, ২২, ২৩ শ্লোক।

 ‘যে শ্যেন পক্ষিসমূহ হিমালয় পর্ব্বতের উপত্যকাভূমির আস্বাদ পাইয়াছে, তাহারা কিরূপে দাবাগ্নিসদৃশ গ্রীষ্ম সহ্য করিবে? এজন্য তাহাদিগের তাপনাশক উপচারের ব্যবস্থা করিতে হইবে। যন্ত্রনির্মুক্ত পরিমিত বারিবৃষ্টির দ্বারা সুশীতল সুধাধবলিত প্রাসাদশিখরে উহাদিগকে জালবেষ্টিত মক্ষিকার অগম্য নির্জ্জন স্থানে বন্ধ করিয়া রাখিতে হইবে; অথবা উহাদিগকে উদ্যানস্থ একটি উচ্চ বেদীর মধ্যে রাখিতে হইবে। বেদীটি প্রহরিগণ কর্ত্তৃক রক্ষিত হওয়া চাই এবং উহা স্বচ্ছ কুল্যাম্বুদ্বারা শীতল এবং ঘন উন্নত পাদপসমূহের দ্বারা আচ্ছন্ন থাকিবে। সূর্য্যের তীব্র কিরণ যেন তাহার মধ্যে কখনও প্রবিষ্ট হইতে না পারে। * * * * অথবা যদি উহাদিগকে ভূগৃহে রাখিতে হয়, তাহা হইলে ভূগৃহটী রম্য, প্রশস্ত, সুগন্ধযুক্ত ও বিশুদ্ধ বায়ু-সঞ্চারিত হওয়া আবশ্যক। এরূপ স্থানে অনেকগুলি পক্ষী একত্র রাখিবে না; দুইটি কিংবা তিনটিকে পৃথক্ পৃথক্‌ রাখিবে।’

 পক্ষীদিগের খাদ্যাদি সম্বন্ধে লিখিত আছে—

“বাজাদিকলবিঙ্কাদের্মাংসংনাতিচিরস্থিতম্।
লঘু রুচ্যং প্রদাতব্যং যথা পরিণমেত্তথা
পুষ্ট্যৈ প্রবর্দ্ধয়েদেষাং মাত্রামথ শনৈঃ শনৈঃ।
স্নানার্থং বারিপূর্ণাশ্চ স্থাপয়েৎ কুণ্ডিকাঃ পুরঃ
৫ম পরিচ্ছেদ, ২৪-২৬ শ্লোক।

 ‘কলবিঙ্কাদি পক্ষীর সদ্য অচিরস্থিত মাংস এবং লঘু রুচিকর ও সহজে হজম হয় এরূপ খাদ্য উহাদিগকে প্রদান করিবে। উহাদিগের পুষ্টির জন্য আহারের পরিমাণ ক্রমশঃ বৃদ্ধি করিতে হইবে। স্নানার্থ উহাদের সম্মুখে জলপাত্র রক্ষা করিবে।’

 এমন কি, উক্ত গ্রন্থে শ্যেন পক্ষীর শারীরিক পীড়ানাশক বিবিধ ঔষধের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। পক্ষিপালনাভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই বিদিত আছেন যে, বর্ষাঋতুর অভ্যুদয়ে যখন পক্ষিগণের পুরাতন পক্ষসমূহ পতিত হইয়া ক্রমশঃ নূতন পালক উদ্গত হয়, তখন তাহারা অসুস্থতা-নিবন্ধন নিস্তেজ হইয়া পড়ে। এজন্য যাহাতে অল্প সময়ের মধ্যে সুশৃঙ্খলায় পতত্রিগণের নূতন পক্ষের উদ্গম হয়, এইরূপ প্রণালী অবলম্বন করা আবশ্যক। গ্রন্থকার কুমাউনরাজও যে তৎকালে এই বিষয়ে অনভিজ্ঞ ছিলেন না, তাই আমরা এই শ্লোক হইতে জানিতে পারি—

ঝিল্লীঝঙ্কারবাচালে কালে প্রাবৃষি চাগতে।
তথৈবোপচরেত্তাংস্তু যথা পুষ্টাঃ স্বপক্ষকান্
ত্যক্ত্বা নবান্ প্রপদ্যেরন্ সর্পাস্ত্বমিব দ্রুতম্।
৫ম পরিচ্ছেদ, ৩৪, ৩৫ শ্লোক।

 ভারতীয় মুসলমান নৃপতিগণও পক্ষিপালন-বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন। ‘অ’ইন-ই-অক্‌বরি’ (Ain-i-Akbari) গ্রন্থ হইতে জানিতে পারা যায় যে, খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নানা প্রকার পক্ষী পালিত হইত। সম্রাট্ অক্‌বরের পক্ষিশালা তৎকালে প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছিল। তিনি পার্সিয়া, তুর্কিস্থান ও কাশ্মীর প্রভৃতি সুদূর প্রদেশ হইতে বহুবিধ পক্ষী সঞ্চয় করিয়া পক্ষিশালার শোভা বৃদ্ধি করিতেন[১১]। বিংশতি সহস্রাধিক পারাবত[১২] তাঁহার পক্ষিশালায় বিরাজ করিত। এই নিমিত্ত বিভিন্ন শ্রেণীর পারাবতগণের বাসোপযোগী স্বতন্ত্র গৃহাদি[১২] নির্ম্মিত হইয়াছিল। পালিত শ্যেনপক্ষীগুলির স্বাস্থ্য যাহাতে ভাল থাকে, তদ্বিষয়ে সম্রাট্ সচেষ্ট ছিলেন, এবং এই নিমিত্ত উহাদের খাদ্যাদির নূতন ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ‘অ’ইন-ই-অক্‌বরি’ গ্রন্থে লিখিত আছে—‘কাশ্মীর প্রদেশে এবং সৌখীন ভারতবাসীর পক্ষিশালায় শ্যেনপক্ষিসমূহ সাধারণতঃ প্রতিদিবস একবারমাত্র আহার পাইত; কিন্তু রাজপ্রাসাদস্থ পক্ষীগুলির দুইবার আহারের ব্যবস্থা ছিল[১৩]

 মানবজাতির এই পক্ষিপালনের মূলে যে কেবল হিংসালেশবিহীন স্নেহ-মমতা বিদ্যমান আছে, তাহা নহে; পুরাকাল হইতে দেখা যায় যে, দেশ, কাল এবং পাত্র ভেদে পক্ষিজাতিপক্ষিপালনপ্রথার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ মানুষের খাদ্যরূপে ব্যবহৃত হয়। এই খাদ্য অন্বেষণ ও আহরণ করা বহু ক্লেশ-ও পরিশ্রম-সাপেক্ষ। এই পরিশ্রমের লাঘব করিবার নিমিত্ত উপায়কুশল মানবজাতি কুক্কুট, পারাবত প্রভৃতি কতিপয় জাতীয় বিহঙ্গ গৃহে পালন করিতে আরম্ভ করে; এবং উহাদের অণ্ড ও শাবক খাদ্যরূপে গ্রহণ করে। পক্ষী আহরণ ও শিকার কতিপয় মানবজাতির উপজীবিকা হইয়াছে; এবং কোন কোন জাতি বা সম্প্রদায় পালিত পক্ষীদিগকে কৌতুক প্রদর্শন[১৪] করিতে শিখাইয়া আপনাদিগের উপার্জ্জনের সংস্থান করিয়া লয়। বুলবুল, তিতির এবং কুক্কুটের[১৫] লড়াই ভারতবর্ষে বহুকাল হইতে প্রসিদ্ধ। লড়াইয়ে জয় হইলে পালকের যে কেবল অর্থোপার্জ্জন হয় তাহা নহে, সঙ্গে-সঙ্গে তাঁহার সম্ভ্রমও[১৬] বাড়িয়া যায়। কোন কোন লড়াইয়ে পক্ষীদিগের দৈহিক বলের পরীক্ষা না হইয়া উহাদের স্বরের উচ্চতা এবং মাধুর্য্য পরীক্ষিত হইয়া থাকে। পরীক্ষায় জয়লাভ হইলে পালক যথেষ্ট পুরস্কৃত হয় এবং তাহার পক্ষীর দরও দ্বিগুণ বাড়িয়া যায়। স্বীয় পাখীগুলিকে যুদ্ধোপযোগী করিবার নিমিত্ত পালকদিগকে যে বহু যত্ন ও পরিশ্রম স্বীকার করিতে হয়, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। কোন কোন পক্ষী পালকদিগের নির্দ্দিষ্ট কোন নৈমিত্তিক কার্য্যের সাহায্যার্থ পালিত ও শিক্ষিত হয়। চীনপ্রদেশে আমরা দেখিতে পাই যে, অতি প্রাচীনকাল হইতে তদ্দেশীয় ধীবর-সম্প্রদায় পালিত সমুদ্রকাক বা Cormorant পাখীকে[১৭] মৎস্য ধরিতে সহায়তা করিবার নিমিত্ত শিক্ষা প্রদান করিত। পেচকের সাহায্যে পক্ষিশিকারের সুবিধা বোধে ইতালীদেশবাসী ব্যাধ উহাকে পালন করিয়া থাকে[১৮]। বাজ বা শিক্‌রা পাখীকে পোষ মানাইয়া উহার দ্বারা অপর পক্ষী শিকার করা ভারতবর্ষের ন্যায় য়ুরোপেও প্রচলিত দেখা যায়; এমন কি তথায় ইহা মধ্যযুগের রাজণ্যবৃন্দের মধ্যে একটী ফ্যাশন-এ পরিণত হইয়াছিল। সম্ভবতঃ মানুষের এইরূপ নানা স্বার্থ-সিদ্ধির উপায়স্বরূপ গৃহপালিত পারাবতের অভ্যুত্থান হইয়াছে; সে যেমন আহারসামগ্রীর মধ্যে গণ্য, তেমনই পত্রবাহকরূপে সে মানুষের দৌত্যকর্মে নিয়োজিত হয়[১৯]

 সর্ব্বপ্রথমে মানবজাতির পক্ষিপালন এই প্রকার। কালে আমাদের নয়নরঞ্জন ও চিত্তবিনোদনের নিমিত্ত পাখীরা পিঞ্জরাবদ্ধ হয়। বর্ত্তমান যুগে পাশ্চাত্য জগতে পক্ষিপালনের উদ্দেশ্য অতিশয় উচ্চতর। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বনিরূপণে পক্ষিপালন যে কি পরিমাণে সহায়তা করে, তাহা কেবল প্রাণিতত্ত্ববিৎ পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণই বিদিত আছেন। ইঁহারা বহুবর্ষব্যাপী পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে পক্ষিজাতির প্রাকৃত জীবন সূক্ষ্মরূপেপক্ষিবিজ্ঞানের অভিব্যক্তি নিরীক্ষণ এবং অনুশীলন করিয়া যে সকল তথ্যে উপনীত হইয়াছেন, ঐ তথ্য বা সিদ্ধান্তসমূহ কালক্রমে পরিপুষ্ট ও পরিবর্দ্ধিত হইয়া পক্ষিবিজ্ঞান বা Ornithology নামে অভিহিত হইয়াছে। সরিসৃপবংশ হইতে পক্ষিজাতির উদ্ভব কিনা, উহাদের প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, গতিবিধি, বর্ণ ও বর্ণশাবল্য, শ্রেণীগত পার্থক্য ও স্বভাববৈচিত্র্য, নীড়নির্ম্মাণ ও শাবক প্রতিপালনকুশলতা, উহাদের খাদ্য-সামগ্রী প্রভৃতি যাবতীয় সূক্ষ্মতত্ত্বের গবেষণাই পক্ষিবিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সাধনার্থ পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকগণ কেবলমাত্র বিহঙ্গজাতির প্রাকৃত জীবনের তথ্যালোচনা করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই; তাঁহারা বহুবিধ পাখী খাঁচায় পুষিয়া উহাদের আবদ্ধ জীবনের ধারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লক্ষ্য করিতেছেন। এইরূপে বহু নূতন তথ্যের আবিষ্কার দ্বারা বিজ্ঞানশাস্ত্র আরও সমৃদ্ধিশালী হইয়া উঠিতেছে।

 প্রাচ্যজগতে পক্ষীর আবদ্ধ জীবন লইয়া কতকটা নাড়াচাড়া যে না হইয়াছে তাহা নহে। চীন ও জাপানবাসীদিগের পক্ষিপালন-দক্ষতা অতিশয় আশ্চর্য্যজনক। উহাদের অদ্ভুত বুদ্ধিকৌশলেপক্ষিপালনে জাপানবাসীর প্রচেষ্টা কতিপয় নূতনপ্রকার পক্ষীর আবির্ভাব (বা আবিষ্কার) হইয়াছে; যথা, কুক্কুট জাতীয় বিহঙ্গের মধ্যে জাপানী বেণ্টাম (Bantam)[২০]জগদ্‌বিখ্যাত লম্বপুচ্ছ মোরগ (Longtailed fowls)[২১]; এবং মুনিয়া (munia) জাতীয় ক্ষুদ্র পক্ষীদের ভিতর সাদা জাভাচড়াই (Munia Oryzivora)[২২] এবং বেঙ্গলী (Uroloncha Acuticauda)[২৩]। উহারা পিঞ্জরাবদ্ধ পক্ষীগুলিকে এত অধিক যত্নের সহিত পালন করে যে, তাহারা আপনাদের আবদ্ধ জীবনের ক্লেশ ভুলিয়া গিয়া স্বচ্ছন্দমনে পিঞ্জরমধ্যে কালাতিপাত করিতে থাকে। এমন কি পক্ষিমিথুন খাঁচায় ডিম্ব প্রসব এবং সন্তান উৎপাদন করিয়া আপনাদিগের জীবন আরও সুখময় করিয়া তোলে। জাপানবাসীদিগের বহু চেষ্টার ফলে মুনিয়া (munia) জাতীয় দুইটি ভিন্ন শ্রেণীর বিহঙ্গ হইতে যে ‘বেঙ্গলী’ (Uroloncha Acuticauda) উৎপন্ন হইয়াছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। ডাক্তার ব্যট্‌লার বলেন[২৪]— এই মনোমোহকর ক্ষুদ্র উৎপাদিকাশক্তি-বিশিষ্ট বর্ণসঙ্কর পক্ষী

১। লম্বপুচ্ছ মোরগ।
২। জাপানী বেণ্টাম।
৩। জাপান মুনিয়া
 
৪। বন্য জাভা চড়াই (রামগোরা)
৫। শুভ্রবর্ণের চড়াই (রামগোরা)

জাপানবাসিগণ কর্ত্তৃক উদ্ভূত হইয়াছিল। সম্ভবতঃ বহুশত বৎসর ধরিয়া সাবধানে নিকট-শ্রেণীর পক্ষিমিথুনগুলির নির্ব্বাচনের ও পিঞ্জরে সংস্থাপনের এবং তদবস্থায় সন্তানজননের ফলে বর্ণসঙ্কর পক্ষীগুলি তিনটি সুপরিচিত বর্ণের আকার প্রাপ্ত হইয়াছিল। প্রথম আকার, শ্বেতবর্ণের সহিত লোহিত পিঙ্গলের মিশ্রণ; প্রায়ই মস্তকের দিকে বর্ণসমূহের স্ফূরণ লক্ষিত হয়। * * * দ্বিতীয় আকার, ঐরূপ সাদার সহিত মৃগচর্ম্মবর্ণের সমাবেশ। তৃতীয় প্রকার বিহঙ্গগুলি একেবারেই সাদা[২৫]। এব্রাহেম্‌স্ (Mr. J. Abrahams) সাহেবের অভিমত উদ্ধৃত করিয়া তিনি লিখিয়াছেন[২৬] যে, যথার্থই Striated Finch[২৭] এবং ভারতবর্ষীয় (Indian) Silver-bill[২৮] এই দ্বিপ্রকার পক্ষীর পরস্পর সম্মিলনে বেঙ্গলী (Bengalee) উৎপন্ন হইয়াছে। কারণ, ইহার পৃষ্ঠদেশ ভালরূপে নিরীক্ষণ করিলে Striated Finch-এর পৃষ্ঠদেশস্থ রেখাগুলির সমতা লক্ষিত হয়; উহাদের কণ্ঠস্বরেরও কতকটা সাদৃশ্য উপলব্ধি হইয়া থাকে।

 বন্য জাভাচড়াই (munia oryzivora) স্বভাবতঃ দেখিতে ভস্মবর্ণ। পিঞ্জরাবদ্ধ অবস্থায় উহাদের যে সকল সন্তান হয়, তাহদিগের সহজ ভস্মবর্ণের সহিত প্রায়ই শুভ্রবর্ণের সংমিশ্রণ দেখা যায়। চীন ও জাপানবাসীরা এই মিশ্রিতবর্ণের সন্তানদিগের মধ্যে যাহাদিগের শুভ্রবর্ণের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয় এরূপ পক্ষিমিথুন বাছিয়া লইয়া উহাদিগকে অপর পিঞ্জরে যত্নে রক্ষিত করে। কালে এই পক্ষিমিথুন হইতে যে সকল সন্তান হয় উহাদিগের বর্ণ অধিকতর শুভ্রাকার ধারণ করে। ক্রমশঃ এই প্রণালীতে তুষারশুভ্র বর্ণের জাভাচড়াই উৎপন্ন হইয়াছে। জাপানে এইরূপ প্রবাদ আছে যে, শ্বেতবর্ণ পিঞ্জরে পালিত ও সংরক্ষিত হইত বলিয়া ঐরূপ তুষারশুভ্র-বর্ণের আবির্ভাব হইয়াছে। এ সম্বন্ধে ফ্রাঙ্ক ফিন্ (Frank Finn) সাহেব লিখিয়াছন—“যদিও জাভা-চড়াই জাতি-নির্ব্বিশেষে দেখিতে একরূপই, তথাপি চীন ও জাপান প্রদেশে পিঞ্জর-পালিতাবস্থায়, এতদ্দেশে কেনেরি (Canary) পক্ষীর ন্যায়, আনুক্রমিক সন্তানজননের ফলে উহারা একটি সুপরিচিত বর্ণ-বৈপরীত্য প্রাপ্ত হইয়াছে। ইহাই শুভ্র বর্ণের জাভা চড়াই”[২৯]

 ভারতবর্ষেও পক্ষীর আবদ্ধ জীবন লইয়া এরূপ কিছু কিছু experiment বা পরীক্ষা ও পর্য্যবেক্ষণচেষ্টা দেখা যায়। আবুলফজল্-প্রণীত ‘অ’ইন-ই-অক্‌বরি’ নামক গ্রন্থে লিখিতসম্রাট্ অক্‌বরের কৃতিত্ব আছে যে, সম্রাট অক্‌বর অতিশয় পারাবতপ্রিয় ছিলেন। তিনি নানাজাতীয় পারাবতের সংমিশ্রণে বহু নূতন পারাবতের উদ্ভাবন করিয়াছিলেন। পারাবতমিথুন নির্ব্বাচনকালে তিনি উহাদিগের অঙ্গ-সৌষ্ঠব ও গতিবিধির সামঞ্জস্যের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেন[৩০]

 গ্রন্থকার আবুলফজল্ লিখিয়াছেন যে, পূর্ব্বে ভারতবর্ষে কেহ কখনও এইরূপ সুপ্রণালী অবলম্বন করেন নাই। বাদ্‌শাহ অক্‌বরই পারাবত-জাতির উন্নতিকল্পে সর্ব্বপ্রথম এই নূতন প্রথার প্রবর্ত্তন করিয়াছিলেন[৩১]। ইহার ফলে সম্ভবতঃ আধুনিক লক্কা, লোটন, পরপাঁ প্রভৃতি কতিপয় পারাবতের অভ্যুত্থান। ডারউইন্ সাহেব তাঁহার Variation of animals and plants under domestication নামক গ্রন্থে[৩২] বলেন, “খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে অক্‌বর বাদ্‌শাহের রাজত্বকালে ভারতবর্ষে লক্কা পারাবতের অস্তিত্বের সর্ব্বপ্রথম নিদর্শন পাওয়া যায়। ইহা ‘অ’ইন-ই-অক্‌বরি’ নামক পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে। য়ুরোপে তখনও এই পারাবতের আবির্ভাব হয় নাই।” লক্কা পারাবতের বর্ণনা ‘অ’ইন-ই-অক্‌বরি’ গ্রন্থে এইরূপ দৃষ্ট হয়[৩৩]—“উহার কণ্ঠস্বর শ্রুতিমধুর; এবং যেরূপ স্পর্দ্ধা ও গৌরবভরে সে মাথা তুলিয়া চলে, তাহা বাস্তবিক বিস্ময়জনক।” লোটন পারাবত সম্বন্ধে ডারউইন্ সাহেব[৩৪] লিখিয়াছেন—“দ্বিবিধ লোটন পারাবত ভূতলে ও নভস্তলে আপনাদের অসামান্য উৎপতন ও উল্লম্ফন প্রভৃতি গতিবৈচিত্র্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিত।” ‘অ’ইন-ই-অক্‌বরি’ গ্রন্থে এইরূপ বর্ণিত আছে যে “লোটন পারাবতকে নাড়া দিয়া ভূতলে ছাড়িয়া দিলে উহা আশ্চর্য্যরূপে উল্টাবাজীর সহিত লাফাইতে থাকে।”[৩৫]

 প্রকৃতপক্ষে প্রাচ্য জগতের এই সকল experiment যে বৈজ্ঞানিক তথ্য আবিষ্কারের নিমিত্ত হইয়াছিল, তাহা বলা যায় না; কিন্তু তাহা না হইলেও বিজ্ঞানশাস্ত্র যে ইহার দ্বারা যথেষ্ট লাভবান্ হইয়াছে, তাহা নিঃসন্দেহ। প্রতীচ্য পণ্ডিতগণ বৈজ্ঞানিক তথ্যনিরূপণের নিমিত্ত পক্ষিপালন-ব্যাপারে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখাইয়াছেন। আমরা উহাদিগের কার্য্যকলাপের কিঞ্চিৎ বিবৃতি না করিয়া থাকিতে পরিলাম না।


  1. ১.০ ১.১ Foreign Birds for Cage and Aviary, Part 1, Preface.
  2. “The practice of keeping live birds in confinement is worldwide, and extends so far back in history that the time of its origin is unknown. It exists among the natives of tropical as well as temperate countries, was found in vogue on the islands of the Pacific when they were first discovered, and was habitual with the Peruvians under the Incas***”—Ibid, Preface.
  3. “Caged birds were popular in classic Greece and Rome. The Alexandrian Parrakeet, a ring-necked Parrakeet of India—which is much fancied at the present day, is said to have been first brought to Europe by one of the generals of Alexander the Great. Before this, living birds had been kept by the nations of Western Asia, and the voices of Bulbuls and other attractive singers doubtless added to the charms of the hanging gardens of Babylon”.—Ibid, Preface.
  4. Darwin’s Variation of Animals and Plants under Domestication, Vol. 1, p. 204.
  5. সারিকা—পঠননিরূপিতা পক্ষিণী—ইতি শ্রীধরস্বামী।
  6. শারিঃ শুকস্ত্রী কীদৃশী? ‘শ্যেতা’ অরক্তবর্ণা। পুনশ্চ বিশেষ্যতে ‘পুরুষাবাক্’ পুরুষবৎ বদিতুং সমর্থা।—ইতি সায়ণ। সায়ণ ভুল করিয়াছেন। শারি শুকস্ত্রী নহে, সালিক পাখী; আর শুক টীয়াজাতীয় পাখী। গৃহস্থেরা বরাবর এই দুটি পাখীকে পুষিয়া এমন করিয়া মানুষের বুলি শিখাইয়া আসিতেছে যে সাধারণতঃ ইহারা এক জাতীয় পাখীর স্ত্রীপুরুষ বলিয়া গণ্য হয়। albino সালিক অর্থাৎ শ্যেতা শারি যে পুরুষবাক্ সে সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। কিন্তু albino শুক বা শুক শ্যেত কুত্রাপি দৃষ্ট হয় না। তবে কি Parrot জাতীয় কাকাতুয়াকে বুঝিতে হইবে? বলা বাহুল্য যে সারিকা, শারি, সারি ও সারী একই পাখীর নামান্তর।
  7. অর্থশাস্ত্র, নিশান্তপ্রণিধিঃ, পৃঃ ৪০। Vide also ‘Studies in Ancient Hindu Polity’ by Narendra Nath law, p. 93.
  8. অর্থশাস্ত্র, অশ্বাধ্যক্ষঃ, পৃ, ১৩২।
  9. মৃচ্ছকটিক নাটক (জীবানন্দ সংস্করণ), ৪র্থ অঙ্ক, পৃঃ ১৪৫ ও ১৪৬।
  10. শ্যৈনিকশাস্ত্র নামক গ্রন্থখানি, শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে, কূর্ম্মাচল (কুমাউন) রাজ রুদ্রদেব (চন্দ্রদেব অথবা রুদ্রচন্দ্রদেব) কর্ত্তৃক খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ হইতে ষোড়শ শতাব্দীর অভ্যন্তরে বিরচিত হইয়াছিল। রুদ্রচন্দ্রদেবের নাম কেহ রুদ্রদেব কেহ বা চন্দ্রদেব বলিতেন।
  11. Ain-i-Akbari by Blochmann and Jarrett, Vol. 1, p. 298; Vol. III, p. 121.
  12. ১২.০ ১২.১ Ibid, Vol. I, pp. 300, 301.
  13. Ibid, Vol. I, p. 294.
  14. শিক্ষিত পাখী লইয়া এরূপ কৌতুক-ক্রীড়ার প্রচলন ভারতবর্ষেও দেখা যায়; কারণ তথায় স্থানবিশেষে কৌতুকপ্রিয় যুবকগণ আপনাদের কৌতূহলবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য বুলবুলপক্ষীকে এরূপ শিক্ষা দেয় যে, উহাকে আপনাদের প্রণয়-ভাজন রমণীর নিকট সঙ্কেতপূর্ব্বক ছাড়িয়া দিলেই পক্ষীটি রমণীর ললাটমধ্যস্থ টিপ চঞ্চুপুটের দ্বারা নিপুণভাবে আকর্ষণ করিয়া তাহার প্রভুকে অর্পণ করে। ডাক্তার ব্যট্‌লার সাহেব তাঁহার “Foreign Birds” নামক গ্রন্থে এ বিষয়ের উল্লেখ করিয়াছেন।
  15. দণ্ড্যাচার্য্য-প্রণীত ‘দশকুমারচরিত’ গ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায় যে, গ্রন্থকার প্রাচ্য দেশীয় নারিকেলজাতীয় কুক্কুটের সহিত পশ্চিমদেশবাসী বলাকজাতীয় কুক্কুটের একটী তুমুল যুদ্ধপ্রসঙ্গ বর্ণনায় ক্ষুদ্রকায় বলাক-জাতীয় কুক্কুটের বিজয়ঘোষণা করিয়াছেন (পঞ্চমোচ্ছ্বাস, প্রমতি-চরিত, পৃঃ ২৪৮-৪৯, জীবানন্দ বিদ্যাসাগর সংস্করণ)।
  16. প্রাচীন রোম প্রদেশে দেখা যায় যে, যে ব্যক্তি যুদ্ধকুশল পক্ষীর প্রতি যথোপযুক্ত গৌরব প্রদর্শন না করিতেন, তিনি সাধারণের চক্ষে নিকৃষ্টরূপে পরিগণিত হইয়া এমন কি সময়ে-সময়ে দণ্ডার্হ হইতেন। যুদ্ধে লব্ধপ্রতিষ্ঠ একটি তিতির পক্ষী মিশরের কোন এক নগরপাল কর্ত্তৃক খাদ্যরূপে ক্রীত হওয়ায় সম্রাট্ অগষ্টস্ তাঁহার প্রাণদণ্ডের আজ্ঞা দেন। Vide ‘Birds of Shakespeare’ by E. J. Harting, p. 218. যুদ্ধনিপুণ পক্ষী যখন এরূপ সমাদৃত হয়, তখন তাহার পালক যে অধিকতর সম্মানার্হ হইবেন, তাহা আর বিচিত্র কি?
  17. E. Stanley’s ‘A Familiar History of Birds,’ p. 370.
  18. Ibid, p. 154.
  19. ইতিহাসে পারাবতের পত্রবাহকরূপে নিয়োগের প্রথম উল্লেখ সলোমনের রাজত্বকাল হইতে দেখা যায় (Encyclopædia Britannica, Tenth Ed. Vol, XXXI. p. 770.)

    ভারতবর্ষে মৌর্যরাজের শিকারিগণ কর্ত্তৃক পারাবতের এরূপ ব্যবহার কৌটিল্য-প্রণীত ‘অর্থ-শাস্ত্র’ গ্রন্থে উল্লিখিত আছে। Vide ‘Studies in Ancient Hindu Polity’ Vol. I by Narendra Nath Law, page 30.

  20. জাপানবাসীদিগের বহুবর্ষ ধরিয়া কুক্কুট জাতীয় ভিন্ন-শ্রেণীর পক্ষি-মিথুনগুলির নির্ব্বাচন, যথাযথ সংস্থাপন ও পোষণের ফলে বেণ্টামের আবিষ্কার হইয়াছে। ইহার বৈশিষ্ট্য এই যে, বেণ্টামের পাদদ্বয় অতিশয় ক্ষুদ্র এবং মস্তকের শিখা দীর্ঘ।
  21. লম্বপুচ্ছ মোরগের পুচ্ছদেশ কিরূপে লম্বিত হইল, তদ্বিষয়ে পর্য্যালোচনা করিয়া ক্যনিংহাম্ (Mr. J. T. Cunningham) সাহেব Proceedings of the Zoological Society (1903) তে তাঁহার সিদ্ধান্ত প্রকাশিত করিয়া বলেন যে, উক্ত মোরগের পুচ্ছদেশে নবোদ্গত পতত্রগুলির মনুষ্য কর্ত্তৃক আকর্ষণ বিকর্ষণের ফলে এরূপ লম্বপুচ্ছের আবির্ভাব হইয়াছে। কিন্তু ফ্রাঙ্ক ফিন্ সাহেব এরূপ সিদ্ধান্তে সন্দিহান হইয়া বলেন যে, কেবল কুক্কুট-মিথুনের নির্ব্বাচনের ফলে ইহা সঙ্ঘটিত হইয়াছে; কারণ বিনা হস্তক্ষেপে লম্বপুচ্ছের উদ্গমাধিক্য দৃষ্ট হয়। Vide Ornithological and other Oddities by Frank Finn, page 189.
  22. জাভা প্রদেশ (বা যবদ্বীপ) ইহার অদিম উৎপত্তিস্থান বলিয়া ইহার নাম Java Sparrow। অধুনা পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে ইহা সঞ্চারিত হইয়াছে। উক্ত পক্ষী বঙ্গদেশে ‘রামগোরা’ নামে অভিহিত হয়।
  23. সাধারণতঃ এই পক্ষী ‘জাপান মুনিয়া’ বা জাপানী ‘ম্যানাকিন্’ (manakin) আখ্যা পাইয়া থাকে। ইংল্যাণ্ড প্রদেশে ইহা ‘বেঙ্গলী’ নামে পরিচিত।
  24. Foreign Finches in Captivity by Dr. A. G. Butler, pp. 212-213.
  25. সম্পূর্ণ শুভ্রবর্ণের বেঙ্গলী পক্ষীকে albino বলিয়া ভ্রম হওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা সঙ্গত নহে। এ বিষয়ে উইনার (August F. Wiener) সাহেব এরূপ বলেন—“শুভ্রবর্ণের জাপানী Manakin কখনই সাদা Blackbird এর ন্যায় albino বলিয়া গণ্য হইতে পারে না। ইহার প্রথম কারণ, Manakin পক্ষির চক্ষুর্দ্বয় লোহিত বর্ণের সংশ্রববর্জ্জিত। দ্বিতীয় কারণ, যেমন হরিদ্রাবর্ণের কেনেরী (Canary) পক্ষীর শাবক হরিদ্রারঙের হইয়া থাকে তদ্রূপ শুভ্রবর্ণ জাপানী Manakin এর শাবক শ্বেতবর্ণবিশিষ্ট হইবে, ইহা স্থিরনিশ্চিত।” Canaries and Cage Birds, British and Foreign, p. 385.
  26. Foreign Finches in Captivity by A. G. Butler, p. 213.
  27. বাঙ্গালায় ইহা ‘শকরি’ মুনিয়া নামে পরিচিত; ইহার ল্যাটিন নাম Munia Striata.
  28. এ দেশে ইহা ‘পিদড়ি’ বলিয়া অভিহিত হয়। ইহার ল্যাটিন নাম Uroloncha Malabarica.
  29. “Although Java Sparrows look particularly uniform in appearance, they have produced a well-marked variety, which is cultivated in a tame state in China and Japan as Canaries are with us. This is the white Java Sparrow"—Frank Finn, Garden and Aviary Birds of India, p. 85.
  30. ‘His Majesty thinks equality in gracefulness and performance a necessary condition in coupling and has thus bred choice pigeons’—Ain-i-Akbari, Blochmann, Vol. I, p. 299.
  31. ‘His Majesty, by crossing the breeds, which method was never practised before, has improved them astonishingly’—Ayeen Akbery, Gladwin, vol. 1, part II, p. 211.
  32. Ibid, Vol. I, p. 208.
  33. The Annals and Magazine of Natural History, vol. XIX, (1847), p 104.
  34. Darwin’s Variation, pages 207 & 209.
  35. The Annals and Magazine of Natural History, vol. XIX, p. 104.