পাখীর কথা/প্রথম ভাগ/পাখী-পোষা (২)

উইকিসংকলন থেকে

পাখী-পোষা

(২)

 পক্ষিপালকের কৃত্রিম গৃহমধ্যে বিভিন্ন-জাতীয়, ভিন্নরুচি, বহুবিধ বিহঙ্গ সুচারুরূপে একত্র সংরক্ষিত হইলেই যে তাঁহার কর্ত্তব্য নিঃশেষে সম্পন্ন হইল, এরূপ মনে করিলে চলিবে না। রক্ষিত পক্ষী বা পক্ষিমিথুনগুলিকে সযত্নে পালনপক্ষিগৃহে বিহঙ্গমিথুনের দাম্পত্যলীলা করিয়া না হয় কিছু দিন বাঁচাইয়া রাখা গেল; কিন্তু যাহাতে পক্ষিভবনে অসঙ্কোচে উহারা নীড়নির্ম্মাণ, অণ্ডপ্রসব, শাবকোৎপাদন এবং সন্তান-প্রতিপালনরূপ গার্হস্থ্য ব্যাপারে লিপ্ত হইতে পারে পালক যদি তাহার বিধি ব্যবস্থা না করেন, তবে তাঁহার এত সাধের পালন-ক্রিয়া অসম্পূর্ণ থাকিয়া গেল। সমবেত পক্ষিগণ যদি কিয়ৎকাল জীবিত থাকিয়া জীবনাবসানকালে আপনাদিগের স্থান অধিকার করিবার জন্য কতকগুলি শাবক রাখিয়া না যাইতে পারিল, তাহা হইলে পালকের এত যত্ন, এত ক্লেশ-স্বীকার কি নিমিত্ত? আবার কি তিনি নূতন করিয়া পক্ষিমিথুন সংগ্রহ করিয়া নূতন উদ্যমে তাহাদিগের ঘরকন্না সাজাইতে থাকিবেন? তাহাদিগের নয়নাভিরাম লাস্যলীলা তাঁহার হৃদয়ের উপর রেখাপাত করিতে না করিতেই হয়’ত তাহাদেরও জীবনলীলা ফুরাইয়া আসিবে। এ’ত গেল একদিক্‌কার কথা। এত কষ্ট করিয়া যে পালক পক্ষী নির্ব্বাচন করিলেন, তাহার সুজননপ্রণালী পর্য্যবেক্ষণ করিবার সুবিধা যদি তাঁহার না থাকে, তবে পক্ষিজীবনের Scientific Study অসম্পূর্ণ রহিয়া যায়। অতএব কি উপায়ে কৃত্রিম পক্ষিগৃহমধ্যে পক্ষিমিথুনের শাবকোৎপাদন সম্ভাবিত হইতে পারে, এই নূতন সমস্যার সমাধান করিতে পারিলে পালক প্রকৃতির যে গোপন রহস্য উদ্ঘাটিত করিতে সমর্থ হইবেন, তাহাতে তাঁহার আনন্দ ও বিস্ময়ের অন্ত থাকিবে না। পক্ষিজাতির বিচিত্র যৌনসম্মিলন আলোচনা করিলে দেখা যায় যে, প্রকৃতির লীলকুঞ্জে পুংপক্ষী স্বশ্রেণীস্থ পক্ষিণীকেই যে বাছিয়া লয় তাহা নহে; অনেক সময়ে সে আপন জাতির অন্তর্গত, কিন্তু ভিন্ন শ্রেণীর পক্ষিণীর সহিত স্বেচ্ছায় মিলিত হইয়া থাকে। বিহগ-দম্পতির পরস্পর শ্রেণীভেদ সত্ত্বেও এই প্রকার মিলন উভয়ের আকারগত সৌসাদৃশ্য থাকিলেই যে সঙ্ঘটিত হয় এরূপ নহে; অনেক সময়ে উভয়ের অবয়ব বা আয়তনের পার্থক্যে কিছুই আসে যায় না। একদিকে যেরূপ তুল্যাবয়ব এবং সমান-আয়তন বুলবুল জাতীয় বিহঙ্গগণের বিবিধ শ্রেণীর মধ্যে এরূপ অসবর্ণ বিবাহ প্রায়ই লক্ষিত হয়, তদ্রূপ আবার গ্রাউস্ (grouse) জাতীয় ভূচর বিহঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পক্ষিমিথুনের আকার-বৈষম্য সত্ত্বেও উভয়ের মিলন অবাধে নিষ্পন্ন হইয়া থাকে। শ্রেণীবহুল হংসজাতির (Duck family) মধ্যে এই বিধিই সচরাচর দৃষ্ট হয়।অসবর্ণ মিলন এই নিমিত্ত বোধ হয় যে, য়ুরোপীয় পক্ষিপালকগণ বর্ণসঙ্কর পক্ষীর উদ্ভাবনকল্পে তাহাদিগের কৃত্রিম গৃহমধ্যে আবদ্ধাবস্থায় পক্ষিমিথুনের একত্র সংরক্ষণ কালে উভয়ের আকার, আয়তন বা বর্ণের সামঞ্জস্যের প্রতি অল্পই দৃষ্টিপাত করেন। বাস্তবিক বনে জঙ্গলে বর্ণসঙ্কর পক্ষী অতিশয় বিরল হইলেও যে উহা সর্ব্বদা উৎপন্ন হইতেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। মিঃ ফ্রাঙ্ক ফিন্ লিখিয়াছেন—“Wild hybrids are indeed rare; but they are of much more frequent occurrence than is generally supposed.”

 এই বর্ণসঙ্কর তাহার পিতৃকুল ও মাতৃকুল হইতে কোন কোন বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র; অনেক স্থলে ইহা বন্ধ্যাত্বও প্রাপ্ত হইয়া থাকে। অতিশয় ক্ষুদ্রাবয়ব স্বাধীন বিহঙ্গগণের মধ্যে কিন্তু বর্ণসঙ্কর আদৌ দেখা যায় না বলিলেও চলে; যদিও ইহারা য়ুরোপীয় পালকগণের কৃত্রিম গৃহমধ্যে বিজাতীয় পক্ষিণীর সহবাস করিতে বাধ্য হইয়া অনেক সময়ে একটা নূতন জাতির সৃষ্টি করে। যথাক্রমে আমরা পক্ষিজীবনের এই এই রহস্য-যবনিকা উদ্ঘাটিত করিতে প্রয়াস পাইব।

 বিহঙ্গতত্ত্ববিদ্ মনীষিগণ আপনাদিগের পর্য্যবেক্ষণের ফলে সাব্যস্ত করিয়াছেন যে, পক্ষিগণের প্রকৃতি ও জাতিগত পার্থক্য অনুসারে উহাদিগের জননকালের (Breeding time) বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হয়; অর্থাৎ যদিও বসন্ত ঋতু কতকগুলি বিহঙ্গের নির্দ্দিষ্ট শাবকজননকাল, গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালেও কতিপয় পক্ষী নীড়নির্ম্মাণশাবকোৎপাদন ও ঋতুবিচার ও সন্তানোৎপাদনাদি ব্যাপারে প্রবৃত্ত হয়। হেমন্ত ও শীত ঋতুতে গৃধ্র প্রভৃতি কতিপয় পাখী আবার ঐরূপ কার্য্যে ব্রতী হইয়া থাকে। পালকগণের কৃত্রিম পক্ষিগৃহে এই নিয়মের ব্যতিক্রম মাঝে-মাঝে পরিলক্ষিত হয়। এমন কতক প্রকার বিহঙ্গ দেখা যায়, যাহাদের সন্তান-জননকালের কোনরূপ বাঁধাবাঁধি নাই; তাহারা ঋতুনির্ব্বেশেষে শাবকোৎপাদনাদি গার্হস্থ্য ব্যাপারের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। পক্ষিজাতির এই যৌনসম্মিলনকালে পুংপক্ষিগণের নৃত্যগীত, অঙ্গলাবণ্যভঙ্গিমা, তীব্র মধুর কণ্ঠস্বর প্রভৃতি গুণরাশির বিকাশ-প্রাচুর্য্য দেখিয়া সহজে অনুমান করা যায় যে, এই সকল বৈভব-বিস্তারের গূঢ় অভিপ্রায় কেবলমাত্র মনোমত সঙ্গিণীর চিত্তাকর্ষণ করা; গৃহরক্ষিত আবদ্ধ পাখীগুলির মধ্যে কিন্তু উক্ত প্রকার বৈভববিস্তার সত্ত্বেও “জোর যার মুলুক তার” এই প্রাচীন নীতি অনেক সময় বলবতী হইয়া থাকে। সম্ভবতঃ ইহার কারণ এই যে, অল্পপরিসর পক্ষিভবনে অবরুদ্ধ কোনও এক পুংপক্ষী স্বীয় বৈভব-বিস্তার সাহায্যে মনোমত পক্ষিণীর চিত্ত হরণ করিতে সমর্থ হইলেও, স্বজাতীয় অপর এক অধিক বলশালী পক্ষী প্রতিদ্বন্দ্বিরূপে উপস্থিত হইয়া উভয়ের মিলনসুখে বাধা প্রদান করে। নিরাপদ স্থানে উড়িয়া গিয়া স্বেচ্ছায় উভয়ের মিলিত হইবার সুযোগ না থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী বলশালী পক্ষীটি পক্ষিণীকে স্বায়ত্ত করিয়া থাকে। সহজে উপলব্ধি করিতে পারা যায় যে, যদি পক্ষিভবনে উক্ত পক্ষিণীর সঙ্গাভিলাষী পুংপক্ষিগণের সংখ্যা অধিক থাকে, তাহা হইলে উহাদিগের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিভাব জাগিয়া উঠিয়া তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়; ফলে হীনবল পক্ষিগণের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠে; এবং কলহ অধিককাল স্থায়ী হইলে যে-পক্ষিণীকে লইয়া বিবাদের সূত্রপাত, তাহার মনোমত পতিলাভ, উভয়ের মিলন এবং গার্হস্থ্য জীবনলীলার পরিদর্শন পক্ষিপালকের পক্ষে ত দূরের কথা, এমন কি অপর জাতীয় একত্র সংরক্ষিত বিহঙ্গদম্পতিগুলির সুখময় জীবনলীলা পর্য্যবেক্ষণের সুযোগও তাঁহার ঘটিয়া উঠিবে না। এই নিমিত্ত যাহাতে পক্ষিগণের মধ্যে কোনরূপ বাদ বিসংবাদ না হয়, তন্নিমিত্ত কোন এক বিশিষ্ট শ্রেণীর এক জোড়া পক্ষীকেই (একটি পুং অপরটি স্ত্রী) ভিন্ন-ভিন্ন শ্রেণীর এক এক জোড়া পাখীর সহিত গৃহমধ্যে একত্র রাখা সঙ্গত; নতুবা যদি একই শ্রেণীর পুংপক্ষী দুইটি এবং স্ত্রীপক্ষী একটি একত্র রক্ষিত হয়, তাহাদিগের মধ্যে উক্তরূপ কলহ নিশ্চয়ই ঘটিয়া উঠিবে। বস্তুতঃ একত্র সংরক্ষণের নিমিত্ত নির্ব্বাচিত সকল পাখীগুলিই তুল্যাবয়ব এবং সমপ্রকৃতি হওয়া আবশ্যক। প্রত্যেক পক্ষিমিথুন সুস্থ ও সবল হওয়া চাই। শুধু স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেই চলিবে না; সঙ্গে-সঙ্গে বয়স, বংশানুক্রম, জ্ঞাতিত্ব, বর্ণ এবং কণ্ঠস্বরের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া উহাদিগকে নির্ব্বাচন করিতে হইবে। জনক জননীর সুনির্ব্বাচনের উপরই শাবকগণের ভাবী শুভাশুভ অনেকটা নির্ভর করে। উভয়ের বয়সের খুব বেশী পার্থক্য থাকা ভাল নহে[১]। একটা প্রৌঢ় অথবা বৃদ্ধ, অপরটা অপরিপক্ক বয়সের হইলে, শুভ ফল পাওয়া যাইবে না। ভাল রকম করিয়া জানা আবশ্যক যে, উভয়েই সুস্থ ও সদ্‌গুণসম্পন্ন পিতৃপিতামহের কুলে উৎপন্ন; অত্যন্ত-নিকট জ্ঞাতি-সম্পর্কীয় দাম্পত্যে সুসন্তানের আশা করা যায় না,—এই সাধারণ জৈব সত্য (biological fact) পক্ষিজগতেও সম্পূর্ণরূপে প্রকটিত হইতে দেখা যায়[২]

 এস্থলে প্রশ্ন: উঠিতে পারে যে, উল্লিখিত বিষয়গুলির প্রতি পুঙ্খানুপুরূপে লক্ষ্য রাখিয়া কিরূপে প্রত্যেক পক্ষিমিথুন সুনির্ব্বাচিত হইতে পারে। কারণ, পক্ষী সংগ্রহ করিতে হইলে পালককে পক্ষিব্যবসায়িগণের নিকট হইতে পাখী ক্রয় করিতে হইবে; পক্ষিব্যবসায়িগণ হয় ত অনেক সময়ে নিজেই বনভূমি হইতে পক্ষী ধৃত করিয়া থাকে, অথবা শিকারীদের নিকট হইতে ক্রয় করিয়া নিজ নিজ দোকানে অধিক লাভে পুনর্বিক্রয়ের নিমিত্ত সাজাইয়াপক্ষিমিথুন নির্ব্বাচনের উপায় রাখে। তাহারা পাখীগুলির ইতিবৃত্ত আদৌ অবগত নহে; ইহারা যখন নিজেরাই অজ্ঞ, তখন ক্রেতাদিগকে কেমন করিয়া পক্ষিমিথুনের বয়স, বংশ, জ্ঞাতিত্ব প্রভৃতির দোষগুণ জানাইয়া দিবে? বাস্তবিক এরূপ স্থলে কোন ইতিহাস পাওয়া না গেলেও পক্ষিমিথুন নির্ব্বাচনকালে পালক উভয়ের শারীরিক সুস্থতা, বর্ণ এবং কণ্ঠস্বরের প্রতি লক্ষ্য রাখিতে ভুলিবেন না। স্মরণ রাখিতে হইবে যে এই সদ্যোধৃত বন্য পাখীগুলি অত্যন্ত সজীব; ইহাদিগের সহিত খাঁচার পাখীর যৌনসম্পর্ক সুফলদায়ক হইবারই কথা। পালকের অজ্ঞাতসারে জ্ঞাতিসম্পর্ক সত্ত্বেও দাম্পত্যসম্বন্ধ স্থাপিত হইলে, এক্ষেত্রে কিছু আসে যায় না। য়ুরোপে কিন্তু সদ্যোধৃত বন্য বিহঙ্গ ছাড়া পিঞ্জরজাত পক্ষী সর্ব্বত্র ক্রয় করিতে পারা যায়; বিক্রেতৃগণও উহাদিগের ধারাবাহিক ইতিহাস গ্রাহকগণকে জানাইয়া থাকে। সেই ইতিহাস আদৌ উপেক্ষণীয় নহে। পক্ষিভবনের পরিসর বুঝিয়া কয় জোড়া পাখী উহার মধ্যে স্বচ্ছন্দভাবে রাখা যায়, তাহার বিচার করিয়া দেখিতে হইবে;—কারণ মনে রাখা উচিত যে, এস্থলে পালকের উদ্দেশ্য শুধু দর্শকবৃন্দের মনোরঞ্জনে পর্য্যবসিত নহে; তাহা হইলে অনেক জোড়া পাখী হয়’ ত সেই aviary মধ্যে রাখা চলিত, তাহাতে তাহাদিগের স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা না থাকিতেও পারিত। কিন্তু পালকের এখন প্রধান লক্ষ্য এই যে, কেমন করিয়া তিনি সর্ব্বতোভাবে পক্ষিজননব্যাপারে অনুকূল ব্যবস্থা করিতে পারেন। এই নিমিত্ত নির্জ্জন স্থানের একান্ত প্রয়োজন; লোকচক্ষুর অন্তরাল হওয়া আবশ্যক, তদ্রূপ অপর পক্ষীর উপদ্রব-বর্জ্জিত হওয়া চাই। পাখীগুলির সংখ্যা কমাইয়া না দিলে আশানুরূপরক্ষিত পক্ষীগুলির সংখ্যার হ্রাস বৃদ্ধি করণ ফল পাওয়া অসম্ভব। অনেক পক্ষিমিথুন এরূপ আছে, যাহাদিগকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র স্থানে না রাখিলে উহাদিগের সন্তানজনন-প্রয়াস মোটেই দৃষ্ট হয় না। কতক পক্ষী আবার এরূপ আছে, যাহারা মিথুনাবস্থায় উগ্রমূর্ত্তি ধারণ করে; এবং নায়ক-নায়িকার মধ্যে এরূপ গোলযোগ উপস্থিত হয়, যাহার দ্বারা অপর মিথুনগণের সন্তানজনন-প্রয়াসে বাধা জন্মে। ফিঞ্চ্ জাতীয় “ক্রস্‌বিল” (crossbill) পক্ষী স্বভাবতঃ এই ধরণের। পক্ষিভবনে এক এক শ্রেণীর এক এক জোড়া পাখী রাখিবার কথা আমরা বলিয়াছি, কিন্তু অনেক সময়ে এক শ্রেণীর দুই কিংবা তিন জোড়া পাখী অবাধে একত্র রাখা যায়; তাহাতে তাহাদিগের নীড়-নির্ম্মাণের অসঙ্কোচ উদ্যমে কোনও বাধা উপস্থিত হয় না। কোন্ স্থলে এরূপ রাখা সঙ্গত, তাহা পাখীগুলির প্রকৃতি এবং পালকের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। কতিপয় পক্ষী আছে, যাহারা স্বশ্রেণীর পক্ষিমিথুনের সহিত রক্ষিত হইলে কখনই শাবকজননে প্রয়াসী হয় না; কিন্তু যদি তাহাদিগকে অপর জাতীয় বিহগদম্পতির সহিত রাখা যায়, তাহা হইলে তাহাদিগের শাবকজনন-প্রয়াসে কোনও বাধা লক্ষিত হয় না। পালকের পক্ষিভবনস্থ “কঠিন চঞ্চু” Zebra finch পক্ষী দুই, তিন বা বহু জোড়া একত্র সংরক্ষিত হইলেও অবাধে সন্তানজননাদি গার্হস্থ্যক্রিয়া নিষ্পন্ন করিয়া থাকে; কিন্তু জাভা চড়াই বা রামগোরা পক্ষী ঐ প্রকারে রক্ষিত হইলে সুফল লাভের আদৌ সম্ভাবনা নাই। এই জাতীয় এক জোড়া পাখীই এই নিমিত্ত অপর জাতীয় পক্ষিমিথুনগুলির সহিত একত্র রাখা বিধেয়।

 পক্ষিগৃহমধ্যে একত্র সংরক্ষিত বিহগমিথুনগুলির অবিমৃষ্ট নির্ব্বাচনের ফলে উহাদিগের নীড়-নির্ম্মাণাদি ব্যাপারে যে সকল অন্তরায় উপস্থিত হইতে পারে, তাহার একরূপ আভাস দিলাম। এখন আর দুইটি জিনিসের উল্লেখ আবশ্যক, যেগুলির অভাবে পক্ষিদম্পতির আপন আপন ঘরকন্না সাজাইবার পক্ষে বিশেষ বিঘ্ন ঘটিবে। প্রথমতঃ aviary মধ্যে প্রত্যেক পক্ষিমিথুনের নীড়-নির্ম্মাণের অনুকূল স্থান থাকা চাই।পক্ষিগৃহে নীড়-নির্ম্মাণের স্থান নির্ণয় ও উপকরণ সংগ্রহ দ্বিতীয়তঃ বাসা-প্রস্তুত-করণের অত্যাবশ্যক উপকরণগুলি উহাদিগের আয়ত্তের ভিতর রাখিতে হইবে। বাসা-প্রস্তুত-ব্যাপারে পাখীদিগের প্রকৃতি বাস্তবিকই বিচিত্র; কারণ একই জাতির অন্তর্গত বিহঙ্গগণের মধ্যে শ্রেণীভেদে যেরূপ উহাদিগের নীড়-প্রস্তুত-প্রণালীর পার্থক্য লক্ষিত হয়, তদ্রূপ নীড় রাখিবার অনুকূল স্থান নির্ব্বাচনেও প্রত্যেক শ্রেণীর পতত্রিমিথুনের একটা বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। মোটামুটি সকলেই প্রায় দেখিয়াছেন যে, কোন কোন পাখী বৃক্ষশাখায় নীড় বিলম্বিত করিয়া দেয়, এমন কি অনেক সময়ে মনে হয় যেন পাতার গায়ে পিপীলিকার বাসা জমাট হইয়া ঝুলিতেছে; কেহ বা বৃক্ষশাখার ঘন পত্রান্তরালে নীড়টি সযত্নে রক্ষিত করে; কেহ বা তরুকোটরে গৃহস্থালী করিতে ভালবাসে; আবার কেহ কেহ অসঙ্কোচে মাতা বসুন্ধরার অঙ্কে আশ্রয় লইয়া দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করিতে চেষ্টা করে। পুরাতন অট্টালিকার ভগ্ন প্রাচীরের কোন ফাঁকের মধ্যে পাখীর বাসা অনেকেই দেখিয়া থাকিবেন; কিন্তু খোলা মাঠের উপর অনুচ্চ মাটির ঢিবিতে পাখীর বালা দেখিয়াছেন কি? উজ্জ্বল দিবাকরোদ্ভাসিত তালগাছের শিরোদেশে দোদুল্যমান নীড়ের প্রতি পথিকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় না কি? পাখীর এই অত্যন্ত বিচিত্র স্বভাবের বিরুদ্ধাচরণ না করিয়া মানুষকে তাহার বাসা-নির্ম্মাণের জন্য অনুকূল আশ্রয়ের ব্যবস্থা করিয়া দিতে হইবে। এই নিমিত্ত পক্ষি-গৃহমধ্যে শাখাপ্রশাখাসমন্বিত বিটপীর, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝোপের, স্থানে স্থানে অনুচ্চ মাটির ঢিবির এবং প্রাচীর-গাত্রে নাতিগভীর গর্ত্তসমূহের আবশ্যকতা সহজেই উপলব্ধি করা যাইবে। অনেক সময়ে দেখা গিয়াছে যে, যদি নানা রকমের কৃত্রিম নীড়াধার গৃহের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে সন্নিবেশিত করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে অনেক পক্ষী উহাদিগকে আশ্রয় করিয়া আপন আপন বাসা তৈয়ার করিয়া থাকে। এই প্রকার যে সমস্ত নীড়াধার সচরাচর ব্যবহার করিয়া সহজেই সুফল পাওয়া যায়, তাহাদিগের কয়েকটি চিত্র প্রদর্শিত হইল।

 ১নং চিত্রে পাঠক দেখিতে পাইবেন যে, শুষ্ক ঝুনো নারিকেলে কেমন সুন্দর নীড়াধার প্রস্তুত করা হইয়াছে। নারিকেলটিকে প্রথমতঃ চিরিয়া দুইভাগে বিভক্ত করিতে হইবে; তৎপরে অভ্যন্তরস্থ কঠিন মালা বাহির করিয়া ফেলিয়া পুনরায় নারিকেল-ছোবড়ার দুটি অংশ লৌহের সূক্ষ্ম

১। নারিকেলের নীড়াধার
[পৃঃ ৫২

৩। গাছের গুঁড়ির নীড়াধার
২। বাক্সের নীড়াধার
[পৃঃ ৫৩

তারযোগে একত্র সংবদ্ধ করিয়া উহার একপ্রান্তে একটি ছিদ্র রাখিতে হইবে। এই প্রকার ছোব্‌ড়ায় বাসা রচনা করিতে রামগোরা (জাভাচড়াই) এবং টিয়া জাতীয় কতিপয় পক্ষী পছন্দ করে। অনেক সময়ে নারিকেলটি চিরিয়া আভ্যন্তরীণ মালাটি নিষ্কাসিত করিবার প্রয়োজনও হয় না; কেবল নারিকেলের এক প্রান্তে ছিদ্র করিয়া মালার ভিতরের শাঁস বাহির করিয়া ফেলিয়া শুকাইয়া লইলেই, অনেক পক্ষিমিথুন অসঙ্কোচে উহাতে আশ্রয় লইয়া থাকে। কখন কখন আবার সমস্ত ছোব্‌ড়াটা বাদ দিয়া শুধু মালটার ঊর্দ্ধদেশে একটি ছিদ্র করিয়া দিলেই, ইহা মুনিয়া এবং ফিঞ্চ জাতীয় ক্ষুদ্র পক্ষিগণের নীড় রচনার পক্ষে বিশেষ উপযোগী হয়; অবশ্য মালার অভ্যন্তরস্থ শাঁস নিষ্কাসিত করিয়া দিয়া মালাটিকে শুকাইয়া লওয়া কর্ত্তব্য। মালাটির অর্দ্ধাংশ আবার বাটির মত চিৎ করিয়া এক অপ্রশস্ত তক্তায় উত্তমরূপে সংলগ্ন করিলেই Canary পক্ষীর নীড়-রচনার পক্ষে বড়ই অনুকূল হইয়া থাকে।

 ২ নম্বর চিত্রে নানাপ্রকার বাক্সের সাহায্যে নীড়াধার-নির্ম্মাণ-কৌশল প্রদর্শিত হইল। সাধারণতঃ চুরটের বাক্সে খুব অল্প খরচে অতি সহজে এই নীড়াধারগুলি তৈয়ার করিতে পারা যায়। অপেক্ষাকৃত গভীর কাঠের বাক্সে সালিক জাতীয় পক্ষী বাস করিতে খুব পছন্দ করে। ছোট ছোট বাক্স মুনিয়াজাতীয় ক্ষুদ্রকায় পক্ষীদিগের কুলায়-সঙ্কলনের বড়ই অনুকূল।

 ৩ নম্বর চিত্রে দেখিতে পাইবেন যে, গাছের গুঁড়ির সাহায্যে কিরূপ নীড়াধার প্রস্তুত হইতে পারে। যে সকল পক্ষী মুক্ত ও স্বাধীন অবস্থায় তরুকোটরে বাসা নির্ম্মাণ করিতে ভালবাসে, তাহাদিগের জন্য পক্ষিগৃহ-মধ্যে স্থাপিত ঈষদুচ্চ গাছের গুঁড়ির গায়ে একটা নাতিগভীর গহ্বর করিয়া দেওয়া হয়।

 পাঠক-পাঠিকাদিগকে বিশেষ করিয়া বলিতে চাহি যে, উপরে বর্ণিত নারিকেলমালা অথবা কাঠের বাক্সগুলি পক্ষীর নীড়ের আধারমাত্র, উহাদিগের মধ্যে খড়কুটা প্রভৃতি উপকরণ সাহায্যে পাখীরা আপন-আপন বাসা তৈয়ার করিয়া থাকে। কোন কোন স্থানে নীড়াধারই নীড়রূপে ব্যবহৃত হয়। পায়রা জাতীয় অনেক পাখী নীড়াধারের মেজের উপরে স্ব স্ব ডিম্ব রক্ষা করিতে সঙ্কোচ বোধ করে না।

 অতঃপর নীড়-রচনার নিমিত্ত পাখীদিগের আবশ্যকমত উপকরণাদি যোগাইয়া দিয়া পক্ষিপালককে ইহাদিগের আপন আপন ঘরকন্না সাজাইবার নিমিত্ত অনেক সময়ে সাহায্য করিতে হইবে। শুধু খড়কুটা, শুষ্ক ঘাস, পাট বা পশমের টুক্‌রা, তুলা প্রভৃতি উপাদানগুলি গৃহমধ্যে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত করিয়া রাখিলেই চলিবে না; নীড়াধারগুলির মধ্যে ইহাদিগের কিছু কিছু সজ্জিত করিয়া দিলে পাখীর বাসা করা সহজ হইয়া যায়। অনেক পক্ষী আছে যাহাদিগের বাসা-রচনায় এত ভুলভ্রান্তি দেখা যায় যে, পালক যদি সেগুলি যত্নসহকারে খড়কুটা সাজাইয়া পরিমার্জ্জিত করিয়া না দেন, তাহা হইলে ডিম্বের অনিষ্ট বশতঃ শাবকোৎপত্তির ব্যাঘাত ঘটিতে পারে। এইখানে একটি কূট সমস্যা আসিয়া পড়ে। যদি নীড়-নির্ম্মাণ সম্বন্ধে বিহঙ্গজাতির প্রকৃতি-প্রদত্ত সহজ-সংস্কার মানিয়া লইতে হয়, তাহা হইলে নিজ নিজ উপযোগী বাসা-রচনায় কখনই তাহাদের ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনা হওয়া উচিত নহে। তবে কেন অনুকূল ব্যবস্থা সত্ত্বেও কেনেরি (canary) পক্ষী বাসা করিতে বিষম ভুল করিয়া বসে? এই ভুল-ভ্রান্তির জন্য তাহার আবদ্ধ অবস্থাই যে দায়ী, তাহা নহে। তাহাদের অপটুতা স্বাধীন অবস্থাতেও বড় বেশী চোখে পড়ে। পাখীদিগের বিচার-বুদ্ধি (Reason) আছে কি না, অথবা কেবলমাত্র সহজসংস্কার তাহাদিগকে পরিচালিত করে, এই প্রশ্ন পাশ্চাত্য বিহঙ্গ-তত্ত্ববিদ্ পণ্ডিত-মণ্ডলীবিচারবুদ্ধি না সহজসংস্কার? বিশেষভাবে আলোচনা করিতেছেন। একদল অবশ্যই Instinct ব্যতীত অন্য কিছুই মানেন না এবং মানিতেও সহজে প্রস্তুত নহেন। ইঁহাদিগের বিশ্বাস যে, পক্ষিশাবক নীড় নির্ম্মাণ করিবার ক্ষমতা লইয়াই জন্মগ্রহণ করে; সময় আসিলে তাহারা তাহাদিগের সেই পুরুষ-পরম্পরাগত ক্ষমতার পরিচয় দিয়া থাকে। পক্ষিতত্ত্ববিদ্ চার্লস ডিক্সন্ (Charles Dixon) বলেন—একটু ভাবিয়া দেখিলেই বুঝা যাইবে এই মত সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, যদিও প্রায় সমস্ত পক্ষিপালক এই মত পোষণ করেন। আল্‌ফ্রেড রসেল্ ওয়ালেস্ (Alfred Russel Wallace) প্রমুখ একদল প্রাণিতত্ত্ববিদ্ প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, Reason কে স্বীকার করিয়া লইলে, পাখীর বাসা তৈয়ার করা ব্যাপারটা সন্তোষজনকরূপে ব্যাখ্যাত হইতে পারে। ইঁহাদিগের আলোচনার ধারা এইরূপ:—

 (ক) পাখীর Instinct অর্থাৎ সহজসংস্কার পুরুষপরম্পরাগত অভ্যাস মাত্র।

 (খ) এই Instinct কখনই পক্ষিশাবকের প্রথম কুলায়-রচনা-ক্রিয়ার একমাত্র কার্য্যকরী শক্তি বলিয়া মানিয়া লওয়া যায় না।[৩]

 (গ) যদি তাহা হইত, তাহা হইলে যে পক্ষিশাবক অপর পক্ষীর বাসায় রক্ষিত ডিম্ব হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া ক্রমশঃ বাড়িয়া উঠে, সেও কালক্রমে স্বজাতীয় পক্ষিগণের বাসার অনুরূপ নীড় (অর্থাৎ তাহারা যে সকল উপকরণের সাহায্যে যে প্রকার বাসা তৈয়ারি করিয়া থাকে, সেই সকল মালমস্‌লা লইয়া ঠিক সেইরকম বাসা) অনায়াসে রচনা করিতে পারিত।

 (ঘ) পূর্ব্বপুরুষার্জ্জিত ক্ষমতার উত্তরাধিকারসূত্রে পক্ষিজাতি যদি এত বড় একটা জটিল কার্য্য করিতে সমর্থ হয়, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হইবে যে, তাহারা স্বশ্রেণীর উপযোগী বাসা-নির্ম্মাণ-ব্যাপারে মানবজাতি অপেক্ষা অনেক অংশে শ্রেষ্ঠ; কারণ মানুষকে যদি নিজের tribe অথবা raceএর অনুরূপ গৃহ নির্ম্মাণ করিতে হয়, তাহা হইলে সে না দেখিয়া, শুনিয়া বা শিখিয়া কখনই তাহা করিতে পারিবে না!

 (ঙ) সহজসংস্কাৱজাত পাখীর বাসা চিরকালই এবং সর্ব্বত্রই সম্পূর্ণভাবে এক ধরণের হইত।

 (চ) কিন্তু তাহা হয় না; সাধারণতঃ বাসা রচনার দ্বারা পাখীরা নীড় রচনার স্থান নির্ব্বাচন-নিপুণতার যে পরিচয় দিয়া থাকে, অনেক সময়ে তার ব্যতিক্রম ঘটিতে দেখা যায়। কালপরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে নূতন জায়গায় নূতন পরিবেষ্টনীর মধ্যে রচিত নীড় পক্ষিজীবনের পক্ষে কোন বিষয়েই হানিকর হয় না।[৪]

 (ছ) অনেক পক্ষীর নীড়রচনার অভ্যাস’ত পরিবর্ত্তিত হয়ই, কোন কোন স্থলে আবার বাসার আকৃতি ও ধাঁজ সম্পূর্ণ বদলাইয়া যায়।[৫]

 (জ) সঙ্গে সঙ্গে কুলায়-রচনার মামুলী উপকরণগুলির পরিবর্ত্তনও সময়ে সময়ে লক্ষিত হয়; অর্থাৎ সচরাচর ভিয় ভিন্ন শ্রেণীর পাখীদিগের নীড় প্রস্তুতের নিমিত্ত আবহমান কাল হইতে যে সমস্ত মালমসলা নির্দ্দিষ্টরূপে ব্যবহৃত হইতে দেখা গিয়াছে, সেই মামুলী মালমসলার পরিবর্ত্তে নূতন উপকরণের সাহায্যে রচিত পাখীর বাসা অনেক সময়ে দৃষ্ট হয়। এই সমস্ত পরিবর্ত্তন পরম্পরাগত অভ্যাসের সম্পূর্ণ বিরোধী। বেশ বুঝিতে পারা যায় যে, পরিবর্ত্তনশীল পারিপার্শ্বিক অবস্থার সহিত মিলাইয়া জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিবার নিমিত্ত পাখীকে বুদ্ধিবৃত্তি পরিচালনা করিতে হয়। অতএব কেমন করিয়া পাখী তাহার প্রথম বাসা রচনা করে, এই প্রশ্নের সদুত্তর Instinct বা সহজ-সংস্কারের নিকট হইতে পাওয়া যাইবে না। এই শ্রেণীর পক্ষিতত্ত্ববিদ্ বলেন যে, পাখীর প্রবল অনুকরণ-প্রিয়তা, তাহার স্মৃতিশক্তি, বিচারশক্তি এবং বংশপরম্পরাগত অভ্যাস, এই সমস্ত মিলিয়া তাহাকে নীড়-রচনায় প্রণোদিত করে। মানুষের মত পাখীরও reason অথবা বিচারশক্তি আছে, যদিও অপেক্ষাকৃত ন্যূন পরিমাণে। আবদ্ধ অবস্থায় সকল পক্ষী স্বশ্রেণীর উপযোগী নীড় প্রস্তুত করিতে পারে না। অনেক সময়ে দেখা যায় যে, কেনেরি (canary) পক্ষী বাসা রচনা করিতে গিয়া সমস্ত উপকরণগুলিকে নাড়িয়া চাড়িয়া এলোমেলোভাবে স্তূপীকৃত করিয়া রাখে মাত্র; অবশ্য তাহার উপর ডিম্বগুলি রাখা যাইতে পারে, কিন্তু মোটের উপর সেটাকে কিছুতেই পাখীর বাসা বলা যায় না। অধিক স্থলে ডিম্বের অনিষ্টও ঘটিতে দেখা যায়; হয় ইহা বাসা হইতে পড়িয়া যায়, অথবা উপযুক্ত আশ্রয় অভাবে ক্রমাগত নড়িয়া চড়িয়া ইহাতে আঘাত লাগিয়া থাকে। এই জন্যই পক্ষিপালক পক্ষিগৃহমধ্যে শুধু যে উপকরণগুলি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত:করিয়া নিশ্চিন্ত থাকিবেন তাহা নহে; অনেক সময়ে তাঁহাকে স্বহস্তে সেই খড়কুটাগুলি সেই শ্রেণীর পক্ষিকুলায়ের অনুকরণে সাজাইয়া দিতে হইবে। তখন সামান্য চেষ্টায় আবদ্ধ পক্ষিমিথুন উপযুক্ত বাসা প্রস্তুত করিয়া ফেলিবে। পাশ্চাত্য-পক্ষিপালক কেনেরি পক্ষীর বাসা তৈয়ার করিবার জন্য এক প্রকার কাঠের ছাঁচ (mould) প্রস্তুত করিয়াছেন। উহাকে উত্তপ্ত করিয়া খড়কুটাগুলি উহার গাত্রে চারিপার্শ্বে কিছুক্ষণ চাপিয়া ধরিলেই কেনেরি পক্ষীর বাস সহজেই নির্ম্মিত হইয়া যায়; তখন তপ্ত কাষ্ঠখণ্ডটাকে বাহির করিয়া লইতে হইবে। এস্থলে মানুষের সাহায্য ব্যতীত পাখী যে তাহার বাসা রচনা করিতে পারিল না, তাহার সমস্ত চেষ্টা যে কেবলমাত্র খড়কুটার স্তূপে পরিণত হইল, ইহার প্রধান কারণ এই যে, এই কৃত্রিম গৃহমধ্যে সে অনুকরণ করিবার কিছুই পাইল না। শুধু Instinct বা সহজসংস্কারের বশবর্ত্তী হইয়া যদি সে নীড়নির্ম্মাণে সম্যক্‌রূপ সফলপ্রযত্ন হইত, তাহা হইলে এই ঘনবিন্যস্ত উপকরণস্তূপের উপর অযত্নরক্ষিত ডিম্বগুলি পালকের দৃষ্টিপথে পতিত হইত না; পালককে সেই ডিম্ব-রক্ষার জন্য সযত্নবিন্যস্ত খড়কুটায় বাসা তৈয়ার করিয়া দিতে হইত না।

 স্বাধীন অবস্থায় পাখীরা অনুকরণ করিবার অনেক সুবিধা পায়। অতি শৈশবে পক্ষিশাবক তাহার বাসাটিকে ভাল করিয়া দেখিবার যথেষ্ট অবসর পায়;—আবার এক বৎসর দেড়বৎসর পরে যখন সে নিজের বাসা নির্ম্মাণ করিতে যায়, তখন প্রায়ই সে তাহার জন্মস্থানে[৬] প্রত্যাবর্ত্তন করে এবং তথায় হয়’ত সে পরিত্যক্ত নীড়গুলি দেখিবার সুযোগ পাইয়া অনুকূল পরিবেষ্টনীর মধ্যে ঐ সমস্ত নীড়ের অনুকরণে বাসা প্রস্তুত করে। প্রায়ই সে স্বশ্রেণীর অধিক-বয়স্ক পাখীকে বাসা নির্ম্মাণ করিতে দেখে এবং তাহার অভিজ্ঞতা হইতে অবশ্যই কিছু জ্ঞানলাভ করে। কোন কোন পাখীর এমন অভ্যাস যে, তাহারা দল বাঁধিয়া বাসা তৈয়ার করে; এ অবস্থায় অবশ্যই বয়স ও অভিজ্ঞতার তারতম্য সত্ত্বেও সকলেই প্রয়োজনোপযোগী বাসা সুচারুরূপে নির্ম্মাণ করিতে সমর্থ হয়। পক্ষিমিথুনের মধ্যে বয়সের খুব তারতম্য থাকিলে অপেক্ষাকৃত অধিক-বয়স্ক অভিজ্ঞ পক্ষীটি তাহার স্বল্পবয়স্ক অনভিজ্ঞ সঙ্গীটির যত কিছু ত্রুটি পরিমার্জ্জিত করিয়া লইতে পারে।



  1. ইজা টুইড্ (Isa Tweed) তাঁহার গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে, কেনেরি (Canary) পক্ষিমিথুন হইতে সুসন্তানের আশা করিতে হইলে উভয়ের বয়সের প্রতি লক্ষ্য রাখিতে হইবে। পক্ষী-পক্ষিণীর মধ্যে এক বৎসরের তারতম্য থাকিলেই যথেষ্ট হইল; পুংপক্ষীটি দুই বা তিন বৎসরের এবং পক্ষিণীটি এক বা দুই বৎসরের, অথবা পক্ষিণীটি দুই কিংবা তিন বৎসর বয়সের এবং পক্ষীটি এক বা দুই বৎসরের হইলে সুসন্তানের সম্ভাবনা অধিক। যদিও দশ বর্ষ বয়স পর্যন্ত কেনেরি (Canary) পক্ষীকে সন্তানোৎপাদন করিতে দেখা গিয়াছে, কিন্তু প্রায়ই ষষ্ঠ বৎসরের পর আর সুসন্তানের আশা করা যায় না।—Canary Keeping in India, p. 53.
  2. পক্ষিগণের মধ্যে জ্ঞাতি-সম্পর্কীয় দাম্পত্য ক্রমাগত এবং বংশপরম্পরায় চলিয়া আসিতে থাকিলে, সন্তান দুর্ব্বল, খর্ব্বাকৃতি এবং অনেক সময়ে বন্ধ্যাত্বদোষযুক্ত হইয়া পড়ে। পিতৃপিতামহের দোষগুলি ইহাদিগের মধ্যে অধিকতর প্রকট হইয়া উঠে এবং দৌর্ব্বল্যপ্রযুক্ত উহাদের সহজেই ব্যাধিগ্রস্ত হইয়া পড়িবার সম্ভাবনা থাকে। ইজা টুইড্ (Isa Tweed) তাঁহার গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে, কোনও এক কেনেরি (Canary) দম্পতির মধ্যে কোন প্রকার জ্ঞাতি-সম্পর্ক না থাকিলেও, উহাদের সন্তানসন্ততির মধ্যে অন্তর্জননে বা inbreedingএ বাধা দেওয়া উচিত; তবে বংশমধ্যে অত্যন্ত স্বল্পমাত্রায় promiscuity চলিতে পারে। কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে, কি পরিমাণে চলিতে পারে তাহার তিনি এইরূপ আভাস দিয়াছেন:—“If the parent birds are not in the least related, then the father may be mated with the daughter and the son with the mother, uncle with niece, and nephew with aunt and also cousin with cousin. But this can be done only once. The progeny of such matings cannot do so mated again. On no account should brother and sister be mated,”—Canary Keeping in India, page 54.

    Aviary-জাত শ্যামা পক্ষীর মধ্যে ভাই ভগিনীর দাম্পত্য-সম্বন্ধ স্থাপিত হইলে কি অনিষ্ট হইতে পারে, এই প্রশ্ন মিঃ লো (Mr. Geo. E. Low) বিগত ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের Avicultural magazineএ উত্থাপিত করায় পক্ষিতত্ত্ববিদ্ ডাক্তার ব্যট্‌লার (A. G. Butler) উত্তর দেন যে, যতদূর সম্ভব জ্ঞাতিসম্পর্কীয় যৌন-সম্বন্ধ বর্জ্জনীয়, যেহেতু এরূপস্থলে সন্ততিবর্গের রুগ্ন ও দুর্ব্বল হইবার সম্ভাবনা অধিক; কিন্তু তিনি স্বীকার করিলেন যে, স্বাধীন বন্য বিহঙ্গগণের মধ্যে প্রায়ই জাতিসম্পর্কীয় দাম্পত্য স্থাপিত হইয়া সন্তান উৎপন্ন হইয়া থাকে। উক্ত প্রশ্নের দ্বিতীয় উত্তর উল্লিখিত imagazineএর April সংখ্যায় Tavistockএর marquis মহোদয় কর্ত্তৃক প্রদত্ত হইল। তিনি বলিলেন যে, জ্ঞাতিসম্পর্কীয় দাম্পত্য হেতু বিপদের আশঙ্কা অনেক সময়ে অতিরঞ্জিত হইয়া থাকে; স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া একবার পক্ষিমিথুন সুনির্ব্বাচিত হইলে উহাদিগের সন্তানসন্ততির মধ্যে পরস্পর জ্ঞাতিসম্পর্ক সত্ত্বেও দাম্পত্য-সম্বন্ধ স্থাপিত হইলে তিন চার পুরুষ ধরিয়া বিপদের আশঙ্কা নাই বলিলেও চলে। কিন্তু পক্ষিমিথুনের মধ্যে কোন প্রকার দোষ বর্ত্তমান থাকিলে, সন্তানে উহা অধিকমাত্রায় স্পষ্টরূপে সঞ্চারিত হইবার সম্ভাবনা। তিনি আরও লিখিয়াছেন যে, এই প্রকার অত্যন্ত নিকট জ্ঞাতি-সম্পর্কীয় দাম্পত্য সারসবিহঙ্গগণের (cranes) মধ্যে এত অধিক প্রচলিত দেখা যায় যে, ইহা একরূপ উহাদের অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে। সহজ অবস্থায় এক জোড়া সারস পক্ষী প্রায় দুটি সন্তান উৎপাদন করিয়া থাকে—একটী পুং অপরটি স্ত্রী; এই দুইটি পক্ষিশাবক বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া পরস্পর আজীবন মিলিত হইয়া থাকে। তবে উহাদের মধ্যে হঠাৎ যদি একটির মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে অপরটিকে আর এক বিহঙ্গের সহিত কদাচিৎ মিলিত হইতে দেখা যায়।

  3. তরুণবয়স্ক পক্ষিমিথুনের সর্ব্বপ্রথম নীড়রচনার চেষ্টা যে অনেক সময়ে খড়কুটার কদাকার স্তূপে পরিণত হয়, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে; এমন কি দুইবার, তিনবার চেষ্টা করিয়াও নীড়গুলি উহাদের মনোমত হয় নাই বলিয়া অসম্পূর্ণ অবস্থায় উহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া পক্ষিমিথুনকে অপর স্থানে নূতন উদ্যমে নীড়রচনায় ব্রতী হইতে দেখা যায়। অনভিজ্ঞতাই যে এক্ষেত্রে নিষ্ফলতার হেতু, তাহা নিম্নলিখিত দৃষ্টান্ত হইতে জানা যায়;—অতি শৈশবে এক জোড়া chaffinch পক্ষীকে New Zealandএ লইয়া গিয়া মুক্ত করিয়া দেওয়া হইয়াছিল; তথায় এই জাতীয় পাখী আদৌ ছিল না। ইংলণ্ডই ইহাদিগের একমাত্র বাসস্থান। জ্ঞাতিবিহীন এই নূতন দেশে নূতন পরিবেষ্টনীর মধ্যে পক্ষীমিথুনকে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে হইয়াছিল। ইংলণ্ডবাসী জ্ঞাতিবর্গের অনুকরণে নীড় রচনা করিবার অভিজ্ঞতা ইহাদের তখন জন্মায় নাই। কাজে-কাজেই ইহাদিগের নীড়-রচনার সময় আগত হইলে New Zealand দেশীয় একপ্রকার পক্ষীর অনুকরণে বাসা করিয়াছিল মাত্র।—Vide Seebohm’s British Birds, Vol. II., p. 102.

    সহজ-সংস্কার অথবা Instinct এক্ষেত্রে কিন্তু উহাদিগের স্বজাতিবর্গের অনুরূপ নীড়নির্ম্মাণে সাহায্য প্রদান করিল না; New Zealand দেশীয় পক্ষীর বাসার অনুকরণ করিয়া তাহারা যতটুকু অভিজ্ঞতা লাভ করিতে পারিয়াছিল, তাহাতেই তাহাদের নীড়রচনার কার্য্য সম্পাদিত হইল। Instinct যদি একমাত্র কার্য্যকরী শক্তি হইত, তাহা হইলে অনভিজ্ঞ বিহগদম্পতির সর্ব্বপ্রথম নীড় তাহার পরবর্ত্তী নীড়গুলির ন্যায় নিপুণ ও নিখুঁতভাবে রচিত হইত; নীড়গুলিও সর্ব্বত্রই স্বজাতির অনুরূপ মামুলী উপকরণ সাহায্যে বেশ গোছাল মামুলী ধাঁজের হইত, বিদেশীয় পাখীর বাসা অনুকরণ করিবার কোন প্রয়োজনই থাকিত না।

    মিঃ চার্লস্ ডিক্‌সন লিখিয়াছেন যে, ১৯০০ খৃষ্টাব্দে তিনি তাঁহার আপন উদ্যানে এক জোড়া তরুণ অনভিজ্ঞ থ্র্যাস্ (Thrush) পক্ষীর নীড়রচনার নিষ্ফল উদ্যম তিনবার লক্ষ্য করিয়াছিলেন; তৎকালে কিন্তু তাঁহার উদ্যানে আর এক জোড়া পরিণত বয়স্ক ঐ জাতীয় পক্ষী সামান্য চেষ্টায় প্রথম উদ্যমেই তাহার নীড় পরিপাটিভাবে রচনা করিয়া গার্হস্থ্য জীবনের সুখানুভব করিতেছিল। তরুণবয়স্ক অনভিজ্ঞ পক্ষিদম্পতির শেষ উদ্যম শুষ্ক ঘাসের এক কদাকার স্তূপে পর্য্যবসিত হইয়া তিনটি ডিম্বের আশ্রয়স্থল হইলেও পক্ষিমিথুন সন্তান উৎপাদনে বিফলপ্রযত্ন হইয়া তথা হইতে যে অবশেষে পলায়ন করিয়াছিল, তাহা ডিক্‌সন্ (Dixon) মহোদয় বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়াছলেন। Vide Bird’s Nests by Charles Dixon, Chapter I, p. 17.

  4. অতি প্রাচীন কালে যখন মানুষ ইষ্টকপ্রস্তরাদির সাহায্যে বৃহৎ অট্টালিকা নির্ম্মাণ করিতে শিখে নাই, তখন হইতে মার্টিন (Martin) বা তালচঞ্চু পক্ষী জনপদ অথবা সমুদ্রতীরবর্ত্তী পর্ব্বতগাত্রে আপন নীড় সংলগ্ন করিয়া আসিতেছিল। মানবশিল্পের উদ্ভাবনা এবং বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উহারা ইষ্টক-প্রস্তরাদিবিনির্ম্মিত অট্টালিকাগত্রে নীড় রচনার সুবিধা বোধে আপনাদের চিরন্তন অভ্যাস পরিবর্ত্তন করিয়া ফেলিল। আবাবিল্ পক্ষী (swift)ও এই দৃষ্টান্তের অনুসরণ করিল। ভারতবর্ষের ন্যায়, ইংলণ্ডেও শালিক এবং অন্যান্য কয়েকটী পাখী প্রাসাদগহ্বরে সুবিধামত নীড়রচনায় ব্রতী হইল। পৃথিবীর প্রায় সকল স্থানে চড়াই পক্ষী দলে দলে মানব আবাসে আশ্রয় লইল। ইহা যে তাহাদের নিকট বিশেষ নিরাপদ স্থান এবং স্ব স্ব নীড়রচনার এবং সন্তান-প্রতিপালনের পক্ষে সুবিধাজনক, তাহা আমরা বেশ বুঝিতে পারি; নতুবা পাখী কি সহজে তাহার চিরন্তন অভ্যাস পরিত্যাগ করিতে অভিলাষী হয়? মানব-আবাসে আশ্রয় লইয়া চড়াই পাখী যে দিনে দিনে সংখ্যায় বর্দ্ধিত হইতেছে, তাহা সকলেই প্রায় বিরক্তির সহিত লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন।
  5. প্রয়োজন হইলে পাখী যে অনেক সময়ে তাহার নীড়রচনার মামুলী ধাঁজ বদলাইয়া বর্ত্তমান অবস্থার সহিত মিলাইয়া বাসা প্রস্তুত করিতে বাধ্য হয়, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। জলমোরগ বা বিলমোরগ (Moorhen) ভূমিতে বাসা নির্ম্মাণ করিতে অভ্যস্ত; কিন্তু অবস্থাবিশেষে ইহাকে বৃক্ষশাখায় নীড় রচনা করিতে দেখা গিয়াছে। যে সকল প্রদেশে বন্যার সম্ভাবনা অধিক, সেখানে অগত্যা তাহারা আপনাদিগের চিরন্তন অভ্যাস পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়া থাকে; এইরূপ স্থলে বৃক্ষশাখাই তাহাদের নীড়নির্ম্মাণের অনুকূল আশ্রয়স্থল। Tristan d'Acunha দ্বীপপুঞ্জে বহুকাল হইতে Penguin পক্ষী জমীতে অনাচ্ছাদিত বাসা করিয়া আসিতেছিল, কিন্তু যেদিন হইতে তথায় শূকরের আমদানি আরম্ভ হইয়াছে, সেইদিন হইতে তাহারা আবৃত রাসা রচনা করিতে শিখিয়াছে। —C. Dixon’s Bird’s Nests, p.13.
  6. এই যে জন্মস্থানে ফিরিয়া আসা,—পাখীর স্বল্পপরিসর জীবনকাহিনীর মধ্যে ইহা একটি অত্যন্ত সুন্দর ব্যাপার। শুধু যে পক্ষিশাবকের জন্মস্থানের দিকে একটা টান আছে তাহা নহে; প্রৌঢ়বয়সেও পক্ষিদম্পতি তাহাদিগের প্রথম-রচিত নীড়ের সন্ধানে ঘুরিয়া ফিরিয়া প্রত্যাবর্ত্তন করে। যে ঋতুতে তাহারা সাধারণতঃ বাসা তৈয়ার করে ঠিক সেই ঋতুতেই এই যে যৌবনের অবসানেও তাহাদের প্রথম যৌবনের প্রথম রচিত প্রমোদভবনের স্মৃতিকে জাগাইয়া রাখিবার চেষ্টা,—এমন বিস্ময়কর ব্যাপার মানবজীবনেও বিরল। মিঃ চার্লস ডিক্‌সন্ তাঁহার Bird’s Nests নামক গ্রন্থে পক্ষীর জন্মস্থানপ্রিয়তার উল্লেখ করিতে ভুলেন নাই; এমন কি কয়েকটি পক্ষী যে বাসা করিবার সময় আসিলে, ঠিক যে স্থানে তাহাদের প্রথম নীড় রচিত হইয়াছিল, সেই স্থানে নিশ্চয়ই প্রত্যাবর্ত্তন করিবে, মিঃ পাইক্রাফ্‌ট (W. P. Pycraft) তাঁহার Bird-Life নামক গ্রন্থে ইহার অনেদৃ কষ্টান্ত দিয়াছেন। Puffin, Swift এবং Swallow পক্ষী ঘড়ির কাঁটার মত যথাসময়ে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করিয়া আপনাদের পুরাতন পরিত্যক্ত বাসায় ফিরিয়া আইসে।