পাখীর কথা/তৃতীয় ভাগ/বিক্রমোর্ব্বশী

উইকিসংকলন থেকে

নাটকাবলী

(বিক্রমোর্ব্বশী)

 মহাকবি কালিদাসের দুই একখানি কাব্যে যে সকল পাখীর কথা আসিয়া পড়িয়াছে, তাহা লইয়া বৈজ্ঞানিক হিসাবে ইদানীং কিঞ্চিৎ আলোচনা করিবার চেষ্টা করিয়াছি। সংস্কৃত কাব্য-সাহিত্য হইতে বাছিয়া বাছিয়া, কেবলমাত্র পাখীগুলিকে তুলিয়া লইয়া, তাহাদিগকে Ornithologyর দিক হইতে আলোচনার বিষয়ীভূত করিয়া আমি যে শুধু পাশ্চাত্য তত্ত্বজিজ্ঞাসুর পথ অনুসরণ করিতেছি, তাহা নহে; আমি পদে পদে অনুভব করিতেছি যে, বহুশত বর্ষ পূর্ব্বে মহাকবি-বর্ণিত ভারতবর্ষের এই পাখীগুলিকে আমাদের আজকালের পরিচিত পাখীগুলির সহিত মিলাইয়া তাহাদিগকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা মত যথাযথ শ্রেণীবদ্ধ করা কিরূপ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অথচ আমাদের প্রাচীন কাব্য-সাহিত্যের উপর চারি দিক্ হইতে রশ্মিপাত হওয়া উচিত, নহিলে আলোকে-আঁধারে কাব্যের সমস্ত সৌন্দর্য্য পাঠকের সম্মুখে ফুটিয়া উঠিতে পারে না; তাই ব্যাপারটা যতই কষ্টসাধ্য হউক, এক বার ভাল করিয়া চেষ্টা করিয়া দেখিতে হইবে, আমাদের রস-সাহিত্যে এই পাখীগুলির বর্ণনা নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক ও অপ্রাসঙ্গিক হইয়াছে কি না। কাব্যামোদী ব্যক্তিমাত্রই হংস, পারাবত, পিক, চাতক, শিখী, কাদম্ব, কারণ্ডব, শুক প্রভৃতি পাখীগুলির ছবি সাহিত্যের স্তরে স্তরে দেখিতে পান। মানুষের সুখ-দুঃখের সহিত তাহাদের ক্ষুদ্র জীবনের ইতিহাস যেন গ্রথিত হইয়া যায়। দুঃখের বিষয় এই যে, যে বিহঙ্গজাতি আমাদের প্রাচীন সাহিত্যকুঞ্জে মানবের এত নিকটে আসিয়া দেখা দেয়, তাহাদের সম্বন্ধে সাহিত্যের বাহিরে সমাজবদ্ধ সাধারণ ভারতবাসীর অজ্ঞতা বড় কম নহে। সেই অজ্ঞতা দূরীকরণের চেষ্টা পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে অনেক দিন হইতে দৃষ্ট হয়। আমাদের দেশের মনীষিগণের দৃষ্টি এই দিকে আকর্ষণ করিবার জন্য, আমি কালিদাসের তিনখানি নাটক হইতে কয়েকটী পাখীর বর্ণনা অবলম্বন করিয়া তাহাদিগের সম্বন্ধে একটু আলোচনায় প্রবৃত্ত হইব।

 প্রথমেই ধরিয়া লইলাম যে, ‘বিক্রমোর্ব্বশী,’ ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ ও ‘অভিজ্ঞানশকুন্তল’ নাটকত্রয়ের রচয়িতা একই ব্যক্তি; এবং তিনি আর কেহই নহেন, স্বয়ং কালিদাস। এসম্বন্ধে এস্থলে কোনও তর্কবিতর্কের অথবা সমালোচনার আবশ্যকতা নাই। এইটুকু মানিয়া লইয়া আমরা উক্ত নাটকগুলির ভিতরে পক্ষিতত্ত্বের দিক হইতে কয়েকটি তথ্য সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিব।

 প্রথমেই ‘বিক্রমোর্ব্বশী’র কথা পাড়া যাউক। অসুরগণ বলপূর্ব্বক উর্ব্বশীকে হরণ করিয়া লইয়া যাইতেছে। চিত্রলেখাসমভিব্যাহারে কুবের-ভবন হইতে প্রত্যাবর্ত্তনকালে অর্দ্ধপথে তাঁহার এই বিপদ ঘটিল। রাজা পুরুরবা দৈবক্রমে তথায় উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে আততায়ীর হস্ত হইতে উদ্ধার করিলেন। রম্ভা, মেনকা প্রভৃতি অপ্সরাকে সঙ্গে লইয়া উর্ব্বশী চঞ্চুপুটে মৃণালসূত্রাবলম্বিনী রাজহংসীর ন্যায়, রাজার দেহ হইতে মনটিকে কাড়িয়া লইয়া আকাশমার্গে অদৃশ্য হইলেন।

 উর্বশী দানবের হস্তে বন্দী হইতেছেন কি না, এ সংবাদ যখন কেহই অবগত ছিলেন না, তখন সহসা আকাশ হইতে কুররীর কণ্ঠধ্বনির ন্যায় যেন কাহার করুণ আর্ত্তনাদ শ্রুত হইতেছে, এইটুকু আমরা সূত্রধার প্রমুখাৎ জানিতে পারিলাম। সূত্রধারের সংশয় উপস্থিত হইল,—শব্দটা কি কুসুমরসমত্ত ভ্রমরগুঞ্জন? অথবা ধীর পরভৃতনাদ?

মত্তানাং কুসুমরসেন ষট্‌পদানাং
শব্দোঽয়ং পরভৃতনাদ এষ ধীরঃ।

নাটকের প্রথম অঙ্কে উর্ব্বশী-পুরুরবা-ঘটিত ব্যাপারটি লইয়া মহাকবি যে রসের অবতারণা করিলেন, পক্ষিতত্ত্বের দিক্ হইতে রসভঙ্গ করিয়া আমি যদি ঐ মৃণালসূত্রাবলম্বিনী হংসী, ঐ আর্ত্ত কুররী ও ধীর পরভৃতকে লইয়া এস্থলে তাহাদের সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বৈজ্ঞানিক আলোচনা করিতে প্রবৃত্ত হই, তাহা হইলে আমাকে অরসিক বলিয়া কৃপার চক্ষে দেখিবার পূর্ব্বে, সহৃদয় পাঠক যেন মনে রাখেন যে মহাকবিরচিত নাটকের মধ্যে বর্ণিত পাখীগুলি বৈজ্ঞানিক সত্য ও বাস্তব জীবন হইতে তিলমাত্র বিচ্যুত হয় নাই। এখন কিন্তু নাটক হইতে আরও একটু ঘন কাব্যরস পাঠককে উপহার দিতে ইচ্ছা করি।

 উর্ব্বশী চলিয়া গেলেন। রাজার বিষম চিত্তবিকার উপস্থিত হইল। পাগলের ন্যায় তিনি বনে বনে ভ্রমণ করিতেছেন। বনের ফুল, বনের ফল দেখিয়া তাঁহার মনশ্চক্ষুর সমক্ষে উর্ব্বশীর রূপলাবণ্য ফুটিয়া উঠিতেছে; কিন্তু কেহই তাঁহাকে সান্ত্বনা দিতে পারিতেছে না। উর্ব্বশী কোথায় গেল, কে বলিয়া দিবে? তাহার সঙ্গলিপ্সু রসপিপাসু পুরুরবা, নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে “চাতকব্রত” অবলম্বন করিয়াছেন; চাতক যেমন একনিষ্ঠভাবে মেঘস্খলিত বারিবিন্দুর জন্য উন্মুখ হইয়া থাকে, রাজাও তেমনি একনিষ্ঠভাবে উর্ব্বশীর সঙ্গরূপ “দিব্যরসপিপাসু” হইয়াছেন। ক্ষণেকের জন্য রাজার পিপাসা মিটিল। রঙ্গিনী উর্ব্বশী চিত্রলেখাকে সঙ্গে লইয়া রাজার সহিত মিলিতা হইলেন। তাহার পর অপ্সরাদ্বয়ের তিরোভাব ও রাজ্ঞী ঔশীনরীর হঠাৎ আগমন। রাজা তখন বয়স্যের সহিত বিশ্রম্ভালাপ করিতেছিলেন। উর্ব্বশী অদৃশ্য থাকিয়া যে ভূর্জ্জপত্র রাজার নিকটে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, তাহা কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। তাঁহাকে অন্যমনস্ক করিবার জন্য বয়স্য নানা কথা পাড়িল,—দেখুন, মহারাজ! এই ময়ূরপুচ্ছ আমার ম্লায়মান কেশর বলিয়া ভ্রম হইতেছে। এমন সময় রাণী আসিয়া বলিলেন—কষ্ট করিবেন না মহারাজ! এই নিন্ আপনার ভূর্জ্জপত্র। কি বাক্যালাপ হইল, সে কথার প্রয়োজন নাই। কুপিতা রাণী লঘুহৃদয় পতির অনুনয় গ্রহন না করিয়া, সখীপরিবৃতা হইয়া ফিরিয়া গেলেন। বিদূষক রাজাকে স্মরণ করাইয়া দিল যে স্নান ভোজনের সময় হইয়াছে। রাজা ঊর্দ্ধে চাহিয়া বলিলেন, তাই ত’ অর্দ্ধ দিবস অতীত হইয়া গিয়াছে। আতপতপ্ত শিখী তরুমূলে স্নিগ্ধ আলবালে অবস্থান করিতেছে; ভ্রমরগণ কর্ণিকার কোরকে প্রবিষ্ট হইয়া রহিয়াছে; কারণ্ডব তপ্ত বারি ত্যাগ করিয়া তীরনলিনীকে আশ্রয় করিয়াছে; এবং ক্রীড়াভবনে পঞ্জরস্থ শুক ক্লান্ত ও অবসন্ন হইয়া বারিবিন্দু যাচ্ঞা করিতেছে।

উষ্মার্ত্তঃ শিশিরে নিষীদতি তরোর্মূলালবালে শিখী
নির্ভিদ্যোপরি কর্ণিকার মুকুলান্যাশেরতে ষট্‌পদাঃ।
তপ্তং বারি বিহায় তীরনলিনীং কারণ্ডবঃ সেবতে
ক্রীড়াবেশ্মনি চৈষ পঞ্জরশুকঃ ক্লান্তো জলং যাচতে॥

 নাটকের তৃতীয় অঙ্কে পুরুরবার প্রতি উর্ব্বশীর আসক্তি অতি নিপুণভাবে বিজ্ঞাপিত হইয়াছে। সুরসভাতলে সরস্বতীরচিত লক্ষ্মীস্বয়ম্বর নাটকের অভিনয়কালে বারুণী-ভূমিকা গ্রহণ করিয়া মেনকা লক্ষ্মীরূপিণী উর্ব্বশীকে জিজ্ঞাসা করিলেন—সমাগত সকেশব ত্রৈলোক্যপুরুষ লোকপালদিগের মধ্যে তুমি কাহাকে ভজনা কর? ইহার উত্তরে “পুরুষোত্তমকে” বলিতে গিয়া উর্ব্বশী বলিয়া ফেলিলেন—“পুরুরবাকে”। উত্তর শুনিয়া কেহ কেহ ক্রুদ্ধ হইলেন, কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র লজ্জাবনতমুখী উর্ব্বশীকে বলিলেন—তুমি পুরুরবার কাছে যাও, এবং যতদিন না তিনি পুত্রমুখ দর্শন করেন, ততদিন তুমি তাঁহার সহিত অবস্থান কর।

 একদিন আসন্ন সন্ধ্যায় রাজ্ঞী কাশীরাজ-তনয়ার নিকট হইতে বার্ত্তা বহন করিয়া কঞ্চুকী রাজসমীপে আসিতেছেন; রাজপ্রাসাদ দিবাবসানে রমণীয় বোধ হইতেছে; বাসযষ্টিগুলির উপরে নিশানিদ্রালস বর্হী চিত্রার্পিতের ন্যায় বোধ হইতেছে; গৃহবলভিতে পারাবতগুলি গবাক্ষজাল-বিনিঃসৃত ধূপে সন্দিগ্ধ ভাব ধারণ করিয়াছে।

উৎকীর্ণা ইব বাসযষ্টিষু নিশানিদ্রালসা বর্হিণে।
ধূপৈর্জালবিনিঃসৃতৈর্বলভয়ঃ সন্দিগ্ধপারাবতাঃ॥

 রাজাকে ডাকাইয়া আনিয়া রাণী বলিলেন—“আর্য্যপুত্রকে পুরঃসর করিয়া অমি চন্দ্ররোহিণীসংযোগ ঘটিত যে ব্রত গ্রহণ করিয়াছি তাহার উদ্‌যাপনের জন্য আপনাকে নিবেদন করিতেছি যে, আর্য্যপুত্র যে রমণীকে লইয়া সুখী হইবেন এবং যে রমণী আর্য্যপুত্র-সমাগম প্রণয়িনী, তাঁহাদের উভয়ের মিলনে যেন কোনও বাধা না হয়”।

 তাহাই হইল। উর্ব্বশী-পুরুরবার মিলনের উপর তৃতীয় অঙ্কের যবনিকা পতিত হইল।

 চতুর্থ অঙ্কে খণ্ডিতা উর্ব্বশী পুরুরবার সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া কুমার বনে প্রবেশ করিতে গিয়া লতায় পরিণত হইয়া গেলেন। তাঁহার দুর্গতিতে সহজন্যা ও চিত্রলেখা সখীদ্বয় সরোবরে সহচরীদুঃখালীঢ় বাষ্পাপবল্‌গিতনয়ন হংসীযুগলের দশা প্রাপ্ত হইল। উন্মাদগ্রস্ত রাজার চক্ষু অশ্রুপরিপ্লুত; সঙ্গিনীবিরহে কম্পিতপক্ষ হংসযুবার ন্যায় তিনি কাতর হইয়া পড়িলেন—

হিঅআহিঅপিঅদুক্‌খও সরবরএ ধুদপক্‌খও
বাহোবগ্‌গিঅণঅণও তম্মই হংসজুআণও।

পরক্ষণে তিনি স্পর্দ্ধার সহিত বলিলেন, আমি রাজা, কালের নিয়ামক। এই বর্ষাকে সবলে ঠেলিয়া ফেলিয়া পরভৃত-সহচর বসন্তের আগমন কল্পনা করিতে পারি। এমন সময়ে নেপথ্যে বসন্তের একটি আবাহন-সঙ্গীত শ্রুত হইল।

গন্ধোন্মাদিতমধুকরগীতৈ-
র্বাদ্যমানৈঃ পরভৃততূর্য্যৈঃ।
প্রসৃতপবনোদ্বেল্লিতপল্লবনিকরঃ
সুললিতবিবিধপ্রকারৈর্নৃত্যতি কল্পতরুঃ॥

রাজা আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিলেন। মুহূর্ত্ত মধ্যে আত্মসম্বরণ করিয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন—না, না, বর্ষাকে প্রত্যাখ্যান করিব না, সে আমাকে যথোপচারে পরিচর্য্যা করিতেছে;—আকাশের বিদ্যুল্লেখা-সমম্বিত কনকরুচির মেঘ আমার মাথার উপরে রাজছত্রের মত প্রসারিত হইয়া রহিয়াছে; কম্পমান নিচুল তরুর মঞ্জরী চামরব্যজন করিতেছে; নীলকণ্ঠ ময়ূর সুস্বরে আমার বন্দনা গান করিতেছে।

বিদ্যুল্লেখাকনকরুচিরং শ্রীবিতানং মমাভ্রং
ব্যাধূয়ন্তে নিচুলতরুভির্মঞ্জরীচামরাণি।
ঘর্মচ্ছেদাৎ পটুতরগিরো বন্দিনো নীলকণ্ঠা
ধারাসারোপনয়নপরা নৈগমাশ্চাম্বুবাহাঃ॥

নবীন শাদ্বল দেখিয়া উর্ব্বশীর শুকোদরশ্যাম অশ্রুসিক্ত স্তনাংশুক বলিয়া ভ্রম হইতেছে! এই যে ময়ূরটি আকাশ পানে তাকাইয়া উন্নতকণ্ঠে কেকারব করিতেছে, ইহাকে আমার প্রিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করি—

আলোকয়তি পয়োদান্ প্রবলপুরোবাতনর্ত্তিতশিখণ্ডঃ।
কেকাগর্ভেণ শিখী দূরোন্নমিতেন কণ্ঠেন॥

ময়ূরটি বারিধারাবর্ষণের মধ্যে শৈলতটস্থলীর পাষাণের উপরে অধিরূঢ় রহিয়াছে। পুরোবাতে ইহার পুচ্ছ কম্পিত হইতেছে। হে শিখী! এই অরণ্যে ভ্রমণ করিতে করিতে তুমি কি আমার প্রিয়াকে দেখিয়াছ? এই সকল লক্ষণে তুমি তাহাকে চিনিতে পারিবে;—তাহার চাঁদের মত মুখ, হংসের ন্যায় গতি—

ণিসম্মই মিঅঙ্কসরিসে বঅণে হংসগই
এ চিণ্‌হে জাণীহিসি আঅক্‌খিউ তুজ্‌ঝ মই।

হে শুক্লাপাঙ্গ নীলকণ্ঠ ময়ূর! তুমি কি আমার দীর্ঘাপাঙ্গা, আমার মূর্ত্তিমতী উৎকণ্ঠা-স্বরূপা বনিতাকে দেখিয়াছ—

নীলকণ্ঠ মমোৎকণ্ঠা বনেঽস্মিন্ বনিতা ত্বয়া।
দীর্ঘাপাঙ্গা সিতাপাঙ্গ দৃষ্টা দৃষ্টিক্ষমা ভবেৎ॥

কৈ, আমাকে উত্তর না দিয়া তুমি নৃত্য করিতেছ কেন? এই আনন্দের কারণ কি? ওঃ বুঝিয়াছি—আমার প্রিয়ার বিনাশ হেতু ইহার ঘনরুচির মৃদুপবনবিভিন্ন কলাপ নিঃসপত্ন হইয়াছে। নহিলে, উর্ব্বশীর করধৃত কুসুম-সনাথ রতিবিগলিতবন্ধ কেশপাশ বিদ্যমান থাকিলে, এই ময়ূর-কলাপের স্পর্দ্ধা কোথায় থাকিত? যাক্; পরব্যসনে যে আমোদ পায়, তাহাকে আর জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন নাই। এই যে, জম্বুবিটপমধ্যে পরভৃতা আতপান্তে সংধুক্ষিতমদা হইয়া বসিয়া আছে, ইহাকে জিজ্ঞাসা করি। এ ’ত পাখীদিগের মধ্যে পণ্ডিত—বিহগেষু পণ্ডিতৈষা জাতিঃ। হে মধুরপ্রলাপিনি পরভৃতে, পরপুষ্টে! তুমি কি আমার প্রিয়াকে দেখিয়াছ? * * * রাজা তাহাকে “মদনদূতী” সম্বোধনে অভিহিত করিয়া অনেক অনুনয় করিলেন; কিন্তু সেই বিজ্ঞ পাখীটি নিশ্চিন্ত মনে জম্বুবৃক্ষ-ফল ভক্ষণ করিয়া উড়িয়া গেল। * * * * * * নূপুর-শিঞ্জিতের মত ও কি শুনা যায়? হা ধিক! এ ত’ মঞ্জীরধ্বনি নয়। দিঙ্মণ্ডল মেঘশ্যাম দেখিয়া মানসোৎসুকচিত্ত রাজহংস কূজন করিতেছে। এই সমস্ত মানসোৎসুক রাজহংস এই সরোবর হইতে উড়িয়া যাইবার পূর্ব্বে ইহাদিগকে আমার প্রিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করি।—হে জলবিহঙ্গরাজ! তুমি মানস সরোবরে কিছু পরে যাইও; একবার তোমার বিসকিসলয় পাথেয়টুকু রাখ; আবার তুমি তুলিয়া লইও। আমার দয়িতার সংবাদটুকু দিয়া আমাকে শোকমুক্ত কর। রে হংস! তুই যদি সরোবরতটে আমার নতভ্রূ প্রিয়াকে না দেখিয়া থাকিস্, তাহা হইলে কেমন করিয়া তুই তাহার কলগুঞ্জিত গতিভঙ্গিটুকু চোরের মত অপহরণ করিলি। তুই আমার প্রিয়াকে ফিরাইয়া দে। জঘনভারমন্থরা প্রিয়ার গতি দেখিয়া তুই নিশ্চয়ই তাহা চুরি করিয়াছিস। * * * * * * একি! চৌর্য্যাপরাধে দণ্ডিত হইবার ভয়ে রাজার নিকট হইতে এ যে পলায়ন করিল! আচ্ছা, আর কাহাকেও জিজ্ঞাসা করি। এই যে প্রিয়াসহায় চক্রবাক রহিয়াছে; ইহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখি। হে গোরোচনা-কুঙ্কমবর্ণ চক্রবাক! আমাকে বল, মধুবাসরের রঙ্গিণী আমার প্রিয়াকে তুমি কি দেখ নাই? হে রথাঙ্গ-নামধেয় বিহঙ্গ! রথাঙ্গশ্রোণিবিম্বা স্ত্রী কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত এই রথী তোমাকে প্রশ্ন করিতেছে, তুমি উত্তর দাও। চুপ করিয়া রহিলে কেন? আমার অনুমান হয় যে, তোমারও অবস্থা আমারই মত। সরোবরবক্ষে তোমার ও তোমর পত্নীর মধ্যে সামান্য নলিনীপত্রের ব্যবধান থাকিলেও তুমি তোমার জায়া বহুদূরে আছে মনে করিয়া সমুৎসুক হইয়া বিলাপ করিতে থাক। জায়াস্নেহবশতঃ এই যে তোমার পৃথক্‌স্থিতিভীরুতা, কেন তবে আমার মত প্রিয়াজনবিরহবিধুরের প্রতি তুমি এমন প্রবৃত্তিপরাঙ্মুখ?

সরসি নলিনীপত্রেণাপি ত্বমাবৃতবিগ্রহাং
ননু সহচরীং দূরে মত্বা বিরৌষি সমুৎসুকঃ।
ইতি চ ভবতো জায়াস্নেহাৎ পৃথক্‌স্থিতিভীরুতা
ময়ি চ বিধুরে ভাবঃ কোঽয়ং প্রবৃত্তিপরাঙ্মুখঃ॥

উন্মাদগ্রস্ত রাজা ধীরভাবে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করিতে পারিলেন না; তাঁহার চঞ্চল চিত্তে সরোবরে প্রেমরসাভিষিক্ত ক্রীড়াশীল হংসযুবার চিত্র ফুটিয়া উঠিল। তিনি গাহিলেন—

এক্কক্কম-বড্ঢিঅ-গুরুঅর-পেম্মরসে।
সরে হংস জুআণও কীলই কামরসে॥

তাহার পর তিনি ভোম্‌রা, হাতী, পাহাড়, নদী যাহা কিছু সম্মুখে দেখিতে পান, তাহাকেই কাতর ভাবে নিজের বেদনা জ্ঞাপন করিতে লাগিলেন। তাঁহার মনে হইল, উর্ব্বশী নদীরূপে পরিণত হইয়াছেন;—তরঙ্গভঙ্গী প্রিয়ার ভ্রূভঙ্গী, তরঙ্গবেগে চঞ্চল বিহগশ্রেণী তাঁহার কাঞ্চীদামস্বরূপ, ফেনপুঞ্জ কোপবশে শিথিলীভূত বসনস্বরূপ। * * * * হে প্রিয়তমে, সুন্দরি, নদীরূপিণি উর্ব্বশি! তুমি আমার এই নমস্কার দ্বারা প্রসন্না হও। নদীরূপিণী তোমাতে হংসাদি পক্ষীরা চঞ্চল হইয়া করুণস্বরে কূজন করিতেছে। * * * জলনিধি সুললিত ভাবে নৃত্য করিতেছে। হংস, চক্রবাক্‌, শঙ্খ, কুঙ্কুম প্রভৃতি তাহার আভরণ। * * * কিংবা এ প্রকৃতই নদী, উর্ব্বশী নহে। নচেৎ পুরুরবাকে পরিত্যাগ করিয়া সাগরাভিমুখে অভিসারিণী হইবে কেন?

 এইরূপে কোকিল-কূজিত নন্দন-বনে গজাধিপ ঐরাবতের মত বিরহসন্তপ্ত রাজা বিচরণ করিতে লাগিলেন—

অভিনব কুসুমস্তবকিত-তরুবরস্য পরিসরে
মদকল-কোকিল-কূজিত-মধুপ-ঝঙ্কার-মনোহরে।
নন্দনবিপিনে নিজকরিণীবিরহানলেন সন্তপ্তো
বিচরতি গজাধিপতিরৈরাবতনামা॥

 কৃষ্ণসারকে দেখিয়া রাজা মৃগলোচনা, হংসগতি সুরসুন্দরীর কথা জিজ্ঞাসা করিলেন,—তাঁহাকে সে দেখিয়াছে কি?

 সহসা পাষাণের মধ্যে রক্তাশোক-স্তবকসম রাগবিশিষ্ট মণি দেখিয়া বলিলেন, “এটা কি?” নেপথ্যে দৈববাণী হইল—“বৎস! এই শৈলসুতাচরণ-রাগজাত মণিটিকে তুলিয়া লও। ইহা প্রিয়জনের সহিত আশু সঙ্গম ঘটাইবে।”

 রাজা মণিটিকে লইয়া ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করিতে করিতে, কুসুমরহিতা একটি লতাকে দেখিয়া অধীর ভাবে তাহাকে যেমন আলিঙ্গন করিতে যাইবেন, অমনি উর্ব্বশী তাঁহার বাহুপাশে ধরা দিলেন। রাজা বলিলেন,—“তোমাকে দেখিয়া আমার স-বাহ্যান্তরাত্মা প্রসন্ন হইল। আচ্ছা, বল দেখি, আমার বিরহে তুমি এতকাল কেমন ছিলে? আমি ত’ ময়ূর, পরভৃত, হংস, রথাঙ্গ, অলি, গজ, পর্ব্বত, কুরঙ্গ, সরিৎকে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছি।”

 এইরূপে উর্ব্বশীর সহিত মিলিত হইয়া, সহচরী-সঙ্গত হংসযুবার ন্যায় রাজা বিমানবিহারী নবীন মেঘের উপর ভর দিয়া প্রতিষ্ঠানাভিমুখে যাত্রা করিলেন।

 নাটকের পঞ্চম অঙ্কে একটা গৃধ্র আসিয়া গোল বাধাইল। আমিষভ্রমে সেই অশোকস্তবকের মত লাল মণিটিকে চঞ্চুপুটে লইয়া গৃধ্র অদৃশ্য হইল। রাজা অস্থির হইয়া নাগরিকদিগকে আদেশ দিলেন—কোথায় বৃক্ষাগ্রে ইহার বাসা আছে, অনুসন্ধান করা হউক। সহসা শরবিদ্ধ হইয়া বিহগাধম ভূমিতে নিপতিত হইল। শর পরীক্ষা করিয়া দেখা গেল যে, উর্ব্বশী-পুরুরবার পুত্র কর্ত্তৃক ইহা নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল। পুরুরবার বিস্ময়ের সীমা রহিল না। উর্ব্বশী যে জননী হইয়াছেন, ইহা তাঁহার সম্পূর্ণ অবিদিত। এমন সময়ে চ্যবন মুনির আশ্রম হইতে একজন তাপসী, কুমারের হাত ধরিয়া রাজার নিকটে আসিলেন। পরিচয়ান্তে রাজা বুঝিতে পারিলেন যে, এই বালকটি আশ্রমপাদপ-শিখরে নিলীয়মান গৃধ্রকে ভূমিতলে পাতিত করিয়া আশ্রমের পবিত্রতা নষ্ট করিয়াছে বলিয়া তাহাকে রাজসমীপে প্রেরণ করা হইয়াছে। ছেলেটিকে কনকপীঠে উপবেশন করাইয়া উর্ব্বশীকে ডাকান হইল। উর্ব্বশী কুমার আয়ুষকে দেখিয়া চিনিলেন। দুই একটি কথার পর তাপসী সত্যবতী প্রস্থানোদ্যতা হইলে, বালকটিও তাহার অনুগামী হইতে চাহিল। রাজা তাহাতে বাধা দিলেন। ছেলেটি বলিল, “তবে যে ময়ূরটি আমার অঙ্কে শিখণ্ডকণ্ডূয়নে সুখবোধ করিয়া আরামে নিদ্রা যাইত, সেই জাতকলাপ শিতিকণ্ঠ শিখীকে আমার নিকট পাঠাইয়া দাও।” তাপসী বলিলেন—আচ্ছা, তাহাই করিতেছি। তাপসী চলিয়া গেলেন। পুরুরবার আনন্দে বিষাদের কালিমা আসিয়া পড়িল। ইন্দ্রের আদেশ স্মরণ করিয়া জননী উর্ব্বশী, পুত্র ও স্বামীকে পরিত্যাগ করিয়া দেবরাজ সমীপে প্রত্যাবর্ত্তন করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। উর্ব্বশীর আসন্ন বিরহে ম্রিয়মাণ রাজা পুত্রের উপর রাজ্যভার অর্পণ করিয়া বনগমনের ব্যবস্থা করিতেছেন, এমন সময়ে দেবর্ষি নারদ তথায় উপস্থিত হইয়া মহেন্দ্র-সন্দেশ শুনাইলেন—“সুরাসুরের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী; আপনি সেই যুদ্ধে আমার সহায় হউন; শস্ত্র ত্যাগ করিবেন না। আপনি যতদিন জীবিত থাকিবেন, এই উর্ব্বশী আপনার সহধর্ম্মচারিণী থাকিবেন।”

 কুমারের যৌবরাজ্যাভিষেকের সময় সমস্ত চরাচরের কল্যাণকামনার সঙ্গে সঙ্গে এই নাটকের পরিসমাপ্তি হইল।

 এখন বক্তব্য এই যে, নাটকের গল্পাংশের প্রতি প্রধানতঃ পাঠকের মন আকৃষ্ট করিবার জন্য আমি আগ্রহ প্রকাশ করিতেছি না। কাব্য হিসাবে বা চরিত্রাঙ্কনের দিক্ হইতে ইহার বিচিত্র সৌন্দর্য্য পণ্ডিত-সমাজের অগোচর নাই। আমি বিশেষ ভাবে এইটি বলিতে চাই যে, নাট্যোল্লিখিত ব্যক্তিগণের বর্ণিত জীবনকাহিনীর সঙ্গে মুখ্যভাবে অথবা গৌণভাবে বিবিধ বিহঙ্গজাতি অত্যন্ত সহজে মিশিয়া গিয়াছে; এবং সেই মিশ্রণে উভয়েরই চিত্র সম্যক্‌রূপে পরিস্ফুট হইয়াছে,—অথচ সমস্তটা বাস্তব সত্য হইতে রেখামাত্র বিচলিত হয় নাই। বিহঙ্গ-তত্ত্বের উপর কবির বর্ণনা হইতে কোনও আলোকরশ্মি নিপতিত হইতেছে কিনা, তাহাই আমাদের আলোচ্য;—উর্ব্বশী-পুরুরবার উপাখ্যান একটা উপলক্ষ মাত্র। পাঠকের চিত্তে এমন কোনও কৌতূহল হয় না কি, যাহা Ornithologist ব্যতীত আর কেহ পরিতৃপ্ত করিতে পারেন না? ঐ যে সুদূর ব্যোমপথে করুণ আর্ত্তনাদের মত কি যেন শোনা যাইতেছে, উহা কি কুররীর কণ্ঠধ্বনি? কতকটা ভ্রমর-গুঞ্জন বলিয়া ভ্রম হইতেছে; আবার পরক্ষণেই ধীর পরভৃতনাদ বলিয়া মনে হইতেছে। ঐ পাখীটির স্বরূপ নির্ণয় করিতে হইবে। সখী-পরিবৃতা উর্ব্বশী যখন রাজার মনটি কাড়িয়া লইয়া আকাশপথে উড়িয়া গেলেন, তখন কবিবরের মনশ্চক্ষুর সম্মুখে চঞ্চুপুটে মৃণালসূত্রাবলম্বিনী রাজহংসীর ছবিটি স্বতঃই জাগিয়া উঠিল কেন? রূপে ও শব্দে উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য কতদূর আছে, তাহা বিচার করিয়া দেখা আবশ্যক। আবার কোন্ হিসাবে বিরহক্লিষ্ট রাজাকে চাতকব্রতাবলম্বী বলা হইয়াছে? আতপতপ্ত মধ্যাহ্নে যে শিখী তরুমূলে স্নিগ্ধ আলবালে অবস্থান করিয়া থাকে, যে কারণ্ডব তপ্তবারি পরিত্যাগ করিয়া তীরনলিনীকে আশ্রয় করিয়াছে, এবং ক্রীড়াভবনে যে পঞ্জরস্থ শুক ক্লান্ত ও অবসন্ন হইয়া বারিবিন্দু যাচ্ঞা করিতেছে, তাহাদের বৈজ্ঞানিক পরিচয় লইবার সময় আসিয়াছে। আসন্ন সন্ধ্যায় রাজপ্রাসাদের গৃহবলভিতে যে পারাবতগুলি আশ্রয় লইয়াছে, বিহঙ্গতত্ত্ববিৎ তাহাদিগকে কোন্ পর্য্যায়ভুক্ত করিবেন? উন্মাদগ্রস্ত রাজাকে দেখিয়া কেমন করিয়া কম্পিতপক্ষ হংসযুবার সহিত তাঁহাকে তুলনা করা যাইতে পারে? পরভৃত-সহচর বসন্ত, নীলকণ্ঠ ময়ূর, শুকোদরশ্যাম অংশুক, প্রিয়াসহায় চক্রবাকের কথা স্বতন্ত্রভাবে বিচারসাপেক্ষ। পরভৃতকে কবি কেন ‘বিহগেষু পণ্ডিতৈষা জাতিঃ’ বলিয়া বর্ণনা করিলেন? এই পরভৃত পরপুষ্ট পাখীটি বাস্তবিকই কি ফল খাইতে এত ভালবাসে যে, একাগ্রচিত্তে জম্বুবৃক্ষফলাস্বাদনে মত্ত হইয়া রাজাকে গ্রাহ্যই করিল না? ময়ূর কি মানুষের কাছে এত পোষ মানে যে, সে মানবশিশুর সহিত অবিচ্ছিন্ন সখ্যতা-সূত্রে আবদ্ধ হইয়া যায়? মাংসাশী গৃধ্রের কোনও নির্দ্দিষ্ট “নিবাস-বৃক্ষ” থাকে কি?

 এই সমস্ত প্রশ্নের সদুত্তর দিতে চেষ্টা করিবার পূর্ব্বে আমরা মহাকবিরচিত মালবিকাগ্নিমিত্রে ও অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকে, উল্লিখিত পাখীগুলির নূতন কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় কি না, তাহা একটু অনুসন্ধান করিয়া দেখিব। পরে সবগুলি মিলাইয়া, বিহঙ্গ-তত্ত্বের দিক্‌ হইতে পাশ্চাত্য রীতি অনুসারে তাহাদের জীবন-রহস্য উদ্ঘাটিত করিতে প্রয়াস পাইলে দেখা যাইবে যে, কবিবরের তুলিকায় পাখীগুলির যে চিত্র ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহা সুন্দর ত’ বটেই, পরন্তু তাহা অনেকাংশে সত্য।