পাখীর কথা/তৃতীয় ভাগ/রঘুবংশ ও কুমারসম্ভব

উইকিসংকলন থেকে

রঘুবংশ ও কুমারসম্ভব


 মহাকবি কালিদাসের রচিত কাব্যসাহিত্য অবলম্বন করিয়া আমাদের দেশের পাখীগুলির বৈজ্ঞানিক আলোচনা করিতে যখন প্রবৃত্ত হইয়াছি, তখন রঘুবংশ কুমারসম্ভব বাদ দিলে চলিবে না। যে সকল পাখীর পরিচয় আমরা পূর্ব্বে পাইয়াছি, এখানেও তাহাদের সহিত নূতন পরিচয়-লাভে আনন্দ পাওয়া যাইবে। সেই সারস-কলহংস-শিখী, সেই কপোত-পারাবত-শুক, সেই চক্রবাক-রাজহংস-পরভৃত, সেই গৃধ্র শ্যেন কুররী পুনরায় আমাদের নয়নগোচর হয়। আমরা মনে করি না যে, তাহাদের পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। যাঁহার তুলিকায় ছবির পর ছবি পত্রে পত্রে ফুটিয়া উঠিয়াছে, তিনি যখন বারম্বার বিহঙ্গ-পরিচয় নিষ্প্রয়োজন মনে করেন নাই, নূতন নূতন পরিবেষ্টনীর মধ্যে অভিনর সৌন্দর্য্যে মণ্ডিত করিয়া সেই পাখীগুলিকে আমাদের সমক্ষে ধরিয়াছেন, তখন তাঁহারই পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া সেই সমস্ত চিত্রের পরিচয় দিতে হইলে, আমাদেৱও বারম্বার নূতন পারিপার্শ্বিক অবস্থার সহিত মিলাইয়া পাখীগুলিকে লইয়া নাড়াচাড়া করিতে হইবে। হয়’ত এইরূপ নাড়াচাড়া করিবার ফলে কিছু কিছু নূতন তথ্যে উপনীত হইতে পারা যাইবে।

 যে সারসগণ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া আকাশমার্গে “অস্তম্ভাং তোরণস্রজম্” সৃষ্টি করিতেছে, রঘুবংশের মধ্যেই অন্যত্র তাহাদিগকে পম্পাসরোবরে এবং গোদাবরীবক্ষে দেখিতে পাই। এই জলচর ও খেচর বিহঙ্গের পরিচয় পাঠক পাইয়াছেন বটে, কিন্তু এমন করিয়া শূন্যে মালাগাঁথার ছবি আর কোথাও দেখিয়াছেন কি? কলহংসের গতি ও নিনাদ পুনরায় আমাদের সুখোৎপাদন করে। দ্বন্দ্বচর, অবিযুক্ত চক্রবাক-মিথুন, পম্পাসরোবরে উৎপলকেশর লইয়া ক্রীড় করিতেছে। রামচন্দ্র যখন যমুনা নদী দেখিতে পাইলেন, তখন দেখিলেন—যমুনা চক্রবাকবতী; যেন পৃথিবীর হেমভক্তিমতী বেণী বলিয়া মনে হইতেছে। আমরা পূর্ব্বে যে গোরোচনাকুঙ্কমবর্ণ চক্রবাকের উল্লেখ পাইয়াছি, তাহার সহিত এই হেমভক্তিমতী চক্রবাকীর কিছুমাত্র অসামঞ্জস্য নাই। চক্রবাকাঙ্কিত গঙ্গার শ্রী অতিক্রম করিয়া গৌরী বিরাজ করিতেছেন। রাজহংসের মদপটুনিনাদে সুরগজের নিদ্রাভঙ্গ হইতেছে; মানস-রাজহংসী সরোবরের সমীরণোত্থিতা তরঙ্গলেখার উপর পদ্ম হইতে পদ্মান্তরে নীত হইতেছে। কাদম্বসংসর্গবতী মানসগামিনী রাজহংস-পংক্তির ন্যায় গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম দৃষ্ট হইতেছে। সন্নতাঙ্গী গৌরীর মঞ্জীরধ্বনির অনুকরণে কণ্ঠস্বর মিলাইয়া প্রত্যুপদেশচ্ছলে রাজহংস গৌরীকে নিজের লীলাঞ্চিত গতি যেন শিখাইতেছে। দিক্‌চক্রবাল সহসা ধূমাবৃত অথবা ধূলিসমাচ্ছন্ন হইলে মেঘভ্রমে পুলকিত রাজহংস মানসসরোবরে প্রয়াণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইল। শরৎকালে গঙ্গা হংসমালা-শোভিতা; মরালের উল্লসিত কূজন যেন দেবতার আশীর্ব্বচন বলিয়া মনে হয়; সুরাঙ্গনা-প্রতিবিম্বিতা সুরধূনীর বক্ষে হিরণ্য-হংসাবলী কেলি করিতেছে। কুমার দেখিলেন, অমরাবতীর সুরসেবিত দীর্ঘিকার জল মত্তদিগ্‌গজমদে আবিল হইয়াছে, হিরণ্যহংসব্রজ সেই জল বর্জ্জন করিয়াছে। দীর্ঘিকার পদ্মপত্রান্তরালে যে সকল বিহঙ্গ ক্রীড়া করিতেছে, অথবা তারস্বরে কূজন করিতেছে, সেই সকল “উদকললোলবিহঙ্গ,” “নীরপতত্রী,” “কমলাকরালয়-বিহঙ্গ” চিত্রমধ্যে সুবিন্যস্ত হইয়া শোভা পাইতেছে।

 শুধু চিত্রগুলি পাঠকের সম্মুখে, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে কাব্য হইতে সঙ্কলন করিয়া উপস্থাপিত করা আমাদের উদ্দেশ্য নহে; পক্ষিতত্ত্বের দিক্ হইতে দেখিতে হইবে যে, চিত্রগুলি অবাস্তব কি না। সারসের (crane)সারস আকাশে উড়িয়া যাওয়া সম্বন্ধে পাশ্চাত্য পর্য্যবেক্ষক এইরূপ লিখিয়াছেন,—

 “During their migrations, these birds always fly in two lines, which in front meet in an acute angle, thus forming a figure somewhat resembling the Greek letter “gamma” which, indeed, is said to have derived its shape from this very circumstance.”[১]

 ইনিও এই পাখীকে যে ভাবে উড়িয়া যাইতে দেখিয়াছেন, তাহা অনেকটা কবিবর্ণিত তোরণমালার মত মনে হয়। কাদম্ব-কলহংসের আলোচনা প্রসঙ্গে পূর্ব্বে যাহা বলা হইয়াছে, তাহাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট। পাঠকহিরণ্য হংস গোরোচনাকুঙ্কুমবর্ণ চক্রবাক দেখিয়াছেন; এখন হেমভক্তিমতী চক্রবাকী ও হিরণ্যহংসকে দেখিতেছেন। পুংপক্ষীর বর্ণ orange brown ও ruddy ochreous; স্ত্রী-পক্ষীর বর্ণ অপেক্ষাকৃত হীনাভ; তাই কবি তাহাকে কেবলমাত্র হিরণ্য অথবা হেমভক্তি আখ্যায় বিশেষিত করিয়াছেন। উভয়ের মধ্যে বর্ণের পার্থক্য এত অধিক যে, মিঃ ব্লানফোর্ড লিখিয়াছেন—

 “The plumage in both sexes varies considerably in depth of tint. Females are as a rule, duller in stint * * * the black collar is always wanting.”

 ঋতু সন্ধেও কালিদাসের কিছুমাত্র ভুল হয় নাই। কুমারসম্ভবে দেখিতে পাই যে, গৌরী তুষারবৃষ্টিক্ষতপদ্মসম্পৎ সরোবরবক্ষে অত্যন্তহিমোৎকরানিলা রজনী অতিবাহিত করিবার সময় বিচ্ছিন্ন চক্রবাকমিথুনের প্রতি কৃপাবতী হইয়াছিলেন। শীতকাল; সরোবরের পদ্ম তুষারপাতে বিক্ষত হইয়াছে; চক্রবাক মিথুন নিশীথে বিয়োগ-বিধুর

সারস
 
[পৃঃ ২৬০

U. RAY & SONS, CALCUTTA.

হইয়া কালযাপন করিতেছে। বাস্তবিক এই যাযাবর বিহঙ্গ শীতকালে ভারতবর্ষের জলাশয়ে দৃষ্ট হয়। মিঃ ব্লানফোর্ড লিখিতেছেন—

 “The bird is a winter visitor to India, arriving about October, and leaving ......... Northern India in April.”

 ইহারা উৎপলভুক্ বটে, কারণ ইহার উদ্ভিজ্জাশী; কিন্তু শম্বুকাদিও ইহাদের ভক্ষ্য। ঋতুসংহারে হংসকে শরৎকালে দেখিয়াছি; কুমারসম্ভবেও বর্ণিত আছে—“তাং হংসমালাঃ শরদীব গঙ্গাং”। যাযাবর হাঁসগুলি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে শরদাগমে আসিয়া উপস্থিত হয়, এ কথা বিশদভাবে পূর্ব্বে বলা হইয়াছে; এস্থলে নূতন করিয়া আর কিছু না বলিলেও চলে।

 “মত্তচকোরনেত্রা” ও “চকোরাক্ষি” শব্দদ্বয়ের মধ্যে যে পাখীটা পাওয়া গেল, সেটির কথা এপর্য্যন্ত আলোচনা করিবার সুযোগ হয় নাই। টীকাকার ডল্লনাচার্য্য নির্দ্দেশ করিতেছেন—“রক্তাক্ষোচকোর বিষসূচক স্বনাম্না খ্যাতঃ।” হেমাদ্রি বলেন—“রক্তত্বাচ্চকোরস্য অক্ষিণী বাক্ষিণী যস্যাঃ সা”। দেখা যাইতেছে, চকোরের রক্তচক্ষুই তাহার বিশিষ্ট শারীরিক লক্ষণ। ইংরাজ বর্ণিত Partridge পর্য্যায়ভুক্ত এই পাখীর শারীরিক লক্ষণের মধ্যে চোখের রং কমলালেবুর মত (orange) অর্থাৎ রক্তাভ এবং চোখের পাতা রীতিমত লাল[২]

 চকোর (caccabis chucar) বিস্কির বিহঙ্গগণের অন্যতম। কিন্তু হারীত (crocopus chlorogaster) প্রতুদ-পর্য্যায়ভুক্ত। এই Green pigeon এর বর্ণনা ডল্লন এইরূপ দিয়াছেন—“হরিতপীতবর্ণ হরিতাষ ইতি লোকে।” বর্ণ কতকটা সবুজ ও পীতের সংমিশ্রণ; সাধারণতঃ সকলেই ইহা লক্ষ্য করিয়াছেন। এই ফলশস্যাশী পাখীকে মরিচবনে পর্ব্বতের উপত্যকায় দেখিতে পাওয়া আশ্চর্য্যের বিষয় নহে।

 আর একটি নূতন পাখী পাওয়া যাইতেছে,—কঙ্ক। অমরকোষে আছে—“লোহপৃষ্ঠস্তু কঙ্কঃ স্যাৎ”। আচার্য্য ডল্লন মিশ্র এইরূপ নির্দ্দেশ করিতেছেন—“কঙ্কঃ স্যাৎ কঙ্কমল্লাখ্যো বাণপত্রার্হপক্ষকঃ।কঙ্ক লৌহপৃষ্ঠো দীর্ঘপাদঃ পক্ষাধঃ পাণ্ডুবর্ণভাক্” ইতি। আগাগোড়া বর্ণনা মিলাইয়া দেখা যায় যে, এই পাখী Heron বা Ardea পর্য্যায়ভুক্ত পক্ষিবিশেষ। ইহার পৃষ্ঠদেশ কতকটা লাল্‌চে—“back, wings and tail reddish ash” (Jerdon); ঘাড়ের কাছটা “ferruginous red” (Blanſord)। পাখীটার বৈজ্ঞানিক নাম Ardea manillenis

 এই কঙ্ক সম্বন্ধে পণ্ডিতসমাজে মতদ্বৈধ দেখা যায়। যে যে কারণে আমরা ইহাকে Ardea পরিবারভুক্ত করিয়াছি, তাহা সংক্ষেপতঃ উপরে লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে। যাঁহারা ইহাকে Vulturidæর মধ্যে গণ্য করেন, তাঁহারা এমন কোনও কারণ নির্দ্দেশ করেন নাই বা যুক্তি প্রদর্শন করেন নাই, যাহাতে তাঁহাদের ব্যাখ্যা সম্বন্ধে নিঃসংশয় হওয়া যাইতে পারে। পাশ্চাত্য পণ্ডিত Gustav Qppert যাদবের “বৈজয়ন্তী” সম্পাদন করিয়াছেন। যাদব বলিতেছেন,—

কঙ্কস্তু কর্কটস্কন্ধঃ পর্কটঃ কমলচ্ছদঃ
দীর্ঘপাদঃ প্রিয়াপত্যো লোহপৃষ্ঠশ্চ মল্লকঃ।

 এখানেও লক্ষ্য করা যাইতেছে যে, কঙ্কের বিশিষ্টতা এই যে, সে দীর্ঘপাদ এবং লোহপৃষ্ঠ। অতএব এসম্বন্ধে অন্য অভিধানকারের সহিত যাদবের মতভেদ নাই। কিন্তু ইনি কঙ্কের যে কয়েকটি প্রতিশব্দ দিয়াছেন, তাহার প্রত্যেকটির ব্যাখ্যা স্বতন্ত্রভাবে Oppert করিতেছেন—“kind of vulture” অর্থাৎ গৃধ্র-পর্য্যায়ভুক্ত। আপত্তি এই যে vulture পর্য্যায়ভুক্ত কোনও পাখীকে বিশেষভাবে দীর্ঘচঞ্চু অথবা দীর্ঘপাদ বলিয়া বর্ণনা করা যায় না। বৈদিক সাহিত্যেও অধিকাংশ স্থলে কঙ্ক বলিতে বক বুঝায়। Roth প্রণীত St. Petersberg নামক বিরাট অভিধানে কঙ্ক অর্থে Reiher লেখা আছে। এই reiher শব্দ জার্ম্মাণ ভাষায় বক অর্থাৎ heronকে বুঝায়।

 অমরকোষে “বকঃ কহ্বঃ” ও তাহার পাঠান্তর “বকঃ কঙ্কঃ” দেখিয়া আমাদের অনুমানই সত্য বলিয়া প্রতীতি জন্মে, যদিও শেষোক্ত পাঠান্তর সাধারণতঃ লিপিবদ্ধ দেখা যায় না। কহ্ব, ক্রৌঞ্চ প্রভৃতি যতগুলি বক জাতীয় পাখীর বিষয় এপর্য্যন্ত আলোচনা করা গেল, তাহারা সকলেই Ardeidæ পরিবারের অন্তর্গত। পুরাকালে কঙ্কপত্র এদেশে শরশোভনরূপে ব্যবহৃত হইত, এইটি মনে রাখিলে—“নখ প্রভাভূষিত” কঙ্কপত্রের তাৎপর্য্য ও সৌন্দর্য্য ভাল করিয়া বুঝা যাইবে। আধুনিক কালে কিন্তু বকজাতীয় অনেক পাখীর পালক পাশ্চাত্য সমাজে শরশোভন না হইয়া শিরোশোভনরূপে ব্যবহৃত হইতে দেখা যায়। আচার্য্য ডল্লন মিশ্রের মতে কঙ্ক প্রসহশ্রেণীভুক্ত। ইহার মৎস্য ভেক প্রভৃতি ধরিয়া খায়।

 মদনভষ্ম হইল; সমীরণ সেই কপোতকর্ব্বুর ভস্মরাশি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত করিতেছে। ভস্মপ্রসঙ্গে এই কপোতকর্ব্বুর বর্ণের পরিচয় বোধ করি পাঠককে নূতন করিয়া দিতে হইবে না। এই কপোত আমাদের পুরাতন পরিচিত columbinæ পরিবারভুক্ত পাখী। আর হৈমবতী-মহাদেবের বিলাসকক্ষে যে পারাবতটি প্রবেশ করিল—

সূকান্তকান্তাভণিতানুকারং কূজন্তমাঘুর্ণিতরক্তনেত্রম্
প্রষ্ফারিতোন্নম্রবিনম্রকণ্ঠং মুহুর্মুহুর্ন্যঞ্চিতচারুপুচ্ছম্।
বিশৃঙ্খলং পক্ষতিযুগ্মমৌষদ্দধানমানন্দগতিং মদেন
শুভ্রাংশুবর্ণং জটিলাগ্রপাদমিতস্ততো মণ্ডলকৈশ্চরন্তম্।

রতিদ্বিতীয়েন মনোভবেন হ্রদাৎ সুধায়াঃ প্রবিগাহ্যমানাৎ
তং বীক্ষ্য ফেনস্য চয়ং নবোত্থমিবাভ্যনন্দৎ ক্ষণমিন্দুমৌলিঃ।

 তাহাও এই পরিবারের অন্তর্গত। এখন পাঠকমহাশয় মনোযোগসহকারে এই পারাবতের বর্ণনাটি পাঠ করিয়া দেখুন—

 পারাবত মণ্ডলাকারে ইতস্ততঃ বিচরণকালে সুকান্তকান্তার ভণিত অনুকরণ করিয়া কূজন করিতেছে; তাহার রক্তনেত্র আঘূর্ণিত, কণ্ঠ স্ফীত, উন্নত ও বিনম্র হইতেছিল, চারু পুচ্ছ মুহুর্মুহুঃ সঙ্কুচিত হইতেছিল; পক্ষদ্বয় বিশৃঙ্খল, গতি হর্ষসূচক, বর্ণ শুভ্রাংশু অথবা নবোত্থিত ফেনপুঞ্জের ন্যায় ধবল; পাদাগ্র জটাবিশিষ্ট। কবিবর্ণিত এই গৃহকপোতের ছবি কিছুমাত্র অতিরঞ্জিত নহে, তাহা বলা বাহুল্য। শুভ্রাংশুবর্ণ, অগ্রপাদ জটাযুক্ত, আরক্তনেত্র,—এই সমস্ত গৃহপালিত পারাবতের বিশিষ্ট লক্ষণ। এই গৃহপালিত পারাবত প্রাচীন Rock Pigeonএর অর্ব্বাচীন সংস্করণ।

 শ্যেন ও গৃধ্র সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করিয়াছি বটে, কিন্তু রঘুবংশে ও কুমারসম্ভবেশ্যেন ও গৃধ্র তাহাদিগকে যুদ্ধক্ষেত্রের উপরে আকাশমার্গে উড়িতে দেখা যায়—

বিভিন্নং ধন্বিনাং বাণৈর্ব্যথার্ত্তমিব বিহ্বলম্
ররাস বিরসং ব্যোম শ্যেনপ্রতিরবচ্ছলাৎ।

পুনশ্চ,—

শিরাংসি বরযোধানামর্দ্ধচন্দ্রহৃতান্যলম্
আদধানা ভৃশং পাদৈঃ শ্যেনা ব্যানশিরে নভঃ।

আরও,—

আধোরণানাং গজসংনিপাতে শিরাংসি চক্রৈর্নিশিতৈঃ ক্ষুরাগ্রৈঃ
হৃতান্যপি শ্যেননখাগ্রকোটিব্যাসক্তকেশানি চিরেণ পেতুঃ।

এবঞ্চ,—

সা বাণবর্ষিণং রামং যোধয়িত্বা সুরদ্বিষাম্
অপ্রবোধায় সুষ্বাপ গৃধ্রচ্ছায়ে বরুথিনী।

আবার,—

উন্মুখঃ সপদি লক্ষ্মণাগ্রজো বাণমাশ্রয়মুখাৎ সমুদ্ধরন্
রক্ষসাং বলমপশ্যদম্বরে গৃধ্রপক্ষপবনেরিতধ্বজম্।

 ব্যোমপথে গৃধ্র উড়িতেছে; ক্বচিৎ ছিন্নমস্তক ভূপতিত হইবার পূর্ব্বে শ্যেননখর দ্বারা ধৃত হইতেছে; ক্বচিৎ উড্ডীয়মান বিস্তৃতপক্ষ গৃধ্রের ছায়ার অন্তরালে সৈন্যগণ চিরনিদ্রায় মগ্ন। শরনিপাত কালে ব্যোমপথ বিরস শ্যেনপ্রতিরবের ছলে নিনাদিত হইতেছে। গৃধ্রপক্ষ বিধূত সমীরণ কর্ত্তৃক রাক্ষস-সৈন্যধ্বজা আকাশে আন্দোলিত হইতেছে।

 শ্যেন ও গৃধ্র উভয়েই Accipitres জাতিভুক্ত; শ্যেন Falcon পরিবার ও গৃধ্র vulturidae পরিবারের অন্তর্গত। উহাদিগের পরস্পরের মধ্যে বিশিষ্ট শারীরিক লক্ষণের প্রভেদ এই যে, শ্যেনের মস্তক ও গলদেশ পতত্রাবৃত, কিন্তু গৃধ্রের তাহা নহে। এই falconidaeর মধ্যে এক শ্রেণীর পাখী দেখা যায়, যাহারা বৈজ্ঞানিকের নিকটে Gypætus barbatus বা Bearded Vulture নামে পরিচিত। অতএব কোন কোন স্থলে শ্যেন গৃধ্রের নামান্তর হইতে পারে। মহাকবি বর্ণিত শ্যেনের ও গৃধ্রের আচরণে বুঝা যায় যে, উহারা উভয়েই শবভুক শকুনি। শ্যেনের রব যে বিরস বা অত্যন্ত কর্কশ, সে সম্বন্ধে কাহারও সাক্ষ্য লওয়া অনাবশ্যক। রঘুবংশে শ্যেনপক্ষের রঙের বর্ণনা পাওয়া যায়,—“শ্যেনপক্ষপরিধূসর” * * *। অমরকোষে আছে “ঈষৎ পাণ্ডুস্তু ধূসর।” শব্দার্ণবে দেখা যায়—“ধূসরস্তু সিতঃ পীতলেশবান্ বকুলচ্ছবিঃ”। আবার, “ধূসর স্তোকপুণ্ডুরঃ,—ইতি অভিধানরত্নমালা। দেখা যাইতেছে যে, ধূসর ঈষৎ পাণ্ডুবর্ণ অথবা পীতলেশবান্ সিতবর্ণকে বুঝায়। এই সিতবর্ণ যে নিছক শুভ্র বা শ্বেতবর্ণ নহে, সে সম্বন্ধে পূর্ব্বে বিশদভাবে আলোচনা করিয়াছি; কোথাও বা শ্বেতের সহিত পীত, কোথাও বা অন্য কোনও বর্ণ অল্পবিস্তর মিশিয়া যায়। শ্যেন-গৃধ্রের বর্ণনায় পাশ্চাত্য পক্ষিতত্ত্ববিৎ whitish, brownish, black-tipped, ferruginous, rufous প্রভৃতি আখ্যায় এই সিতবর্ণের তারতম্য বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন।

 কবিবর্ণিত বিহঙ্গগুলি সম্বন্ধে আপাততঃ আমার বক্তব্য প্রায় শেষ হইয়া আসিল। রঘুবংশে যে মঞ্জুবাক্ পিঞ্জরস্থ শুককে দেখিতে পাই যে চাতককে নির্গলিতাম্বুগর্ভ শরদ্‌ঘন প্রলুব্ধ করিতে পারিতেছে না; যে বর্হিকে আবাসবৃক্ষোন্মুখ হইয়া বনভূমিকে শ্যামায়মান করিতে দেখা যায়; এবং কুমারসম্ভবে অভিজাতবাক্ গৌরীর কণ্ঠস্বর যে অন্যপুষ্টার কণ্ঠস্বরকেও প্রতিকূল ও কর্ক্কশ করিয়া তুলিয়াছে; ও চূতাঙ্কুরাস্বাদকষায়কণ্ঠ পুংস্কোকিলের মধুর কণ্ঠস্বর স্মরের বচন বলিয়া মনে হয়; তাহাদের জাতি, বর্ণ ও প্রকৃতিগত অনেক কথা পূর্ব্বে আলোচনা করিয়াছি। সেই আলোচনার সহিত এই সকল বর্ণনার কিছুমাত্র বিরোধ নাই। এমন কিছু নূতন কথাও আসিয়া পড়িতেছে না যে, আবার প্রসঙ্গক্রমে কিছু বলা আবশ্যক হয়।

 শৃঙ্গারতিলকে একটি নূতন পাখী পাওয়া যায়;—“একোহি খঞ্জনবরো নলিনীদলস্থঃ”। এই যে পদ্মপত্রের উপরখঞ্জন খঞ্জন পাখী রহিয়াছে, ইহার ইংরাজি নাম wagtail। জলাশয়ের নিকটে ইহারা প্রায়ই বিচরণ করে। মিঃ ওট্‌স্ লিখিয়াছেন—“They (wagtails) freqnent open land, fields and the banks of rivers and ponds, some of the species of yellow wagtails being only found on marshy land.”

 খঞ্জনকে নলিনীদলস্থ অবস্থায় ক্বচিৎ দেখিতে পাওয়া যায়,—

“যে যে খঞ্জনমেকমেব কমলে পশ্যন্তি দৈবাৎ ক্বচিৎ।”

কিন্তু ডগ্‌লস্ ডেওয়ার নলিনী পত্রের উপরে ইহাকে বিচরণ করিতে দেখিয়া লিখিয়াছেন[৩]—“The birds that run about on the floating leaves of water lilies and other aquatic plants—the jacanas, water-pheasants and wagtails."


সমাপ্ত।

  1. Cassell’s Book of Birds, by Thomas Rymer Jones, Vol. IV, p. 89.
  2. The Game Birds of India and Asia, by F. Finn.
  3. A Bird Calendar for Northern India, p. 183