নেপালে বঙ্গনারী/নেপালের বৌদ্ধ মন্দির

উইকিসংকলন থেকে
সিম্ভু অর্থাৎ সয়ম্ভুনাথের মন্দির।

নেপালের বৌদ্ধমন্দির।

 বৌদ্ধধর্ম্মের জন্মস্থান এবং প্রধান লীলা ভূমি ভারতবর্য হইতে বহু শতাব্দী হইল উক্ত ধর্ম্ম একেবারে নির্ব্বাসিত হইয়াছে। একটীও বিশুদ্ধ বৌদ্ধমন্দির ভারতের কুত্রাপি আর দেখা যায় না। লুম্বিনী, কপিলাবস্তু, গয়া, কুশীনগর, সকলই শ্মশান হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। ভারতবাসী আর সেখানে তীর্থ যাত্রা করে না। সময়ে যেখানে সহস্র সহস্র বিহারমন্দির ছিল এখন তাহা সমভূমি; হয় ত শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যানী। ভারতে বৌদ্ধধর্ম্মের এইরূপ শোচনীয় পরিণাম হইয়াছে। কিন্তু নেপাল-উপত্যকায় পদার্পণ করিলে সহসা যেন দ্বিসহস্র বৎসর পূর্ব্বের ছবি নয়নপথে উদ্ঘাটিত হয়। যে ধর্ম্ম ভারতবর্যে এইরূপে লাঞ্ছিত হইয়াছে তাহা দুর্গম নেপালরাজ্যে অভ্রভেদী পর্ব্বতমালাবেষ্টিত অপূর্ব্ব শোভাময় বিচিত্র প্রদেশে, এখনও জনসাধারণের প্রধান ধর্ম্ম। দেড় শত বৎসর পূর্ব্বে উহা ত সম্পূর্ণ রূপেই বৌদ্ধভূমি ছিল। চীন, জাপান, তীব্বত, ব্রহ্মদেশে যেরূপ বৌদ্ধধর্ম্মের জয়পতাকা উড্ডীয়মান আছে নেপালে একদিন তাহাই ছিল। এখন নেপালে বৌদ্ধধর্ম্মের হীনতার একশেষ হইলেও একেবারে তিরোধান হয় নাই। নেপাল-উপত্যকায় পদার্পণ করিলে সহস্র সহস্র বৌদ্ধমন্দির দৃষ্টিগোচর হইবে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি পশুপতিনাথের মন্দির হয় ত এক সময় বৌদ্ধমন্দির ছিল, কিন্তু এখনও নেপালে অত্যন্ত প্রাচীন বিশুদ্ধ বৌদ্ধমন্দির সকল অতি সুন্দর-অবস্থায় আছে। এই সকল বৌদ্ধমন্দির তিন প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়;—

 ১। কতকগুলি আদিবুদ্ধের নামে উৎসর্গীকৃত।

 ২। কতকগুলি কোন বোধিসত্ত্ব মহাত্মার স্মৃতিচিহ্ন।

 ৩। অধিকাংশ মন্দির কোন মৃত মহাত্মার দেহাবশেষ বা চিতাভস্ম রক্ষার জন্য নির্ম্মিত হইয়াছে।

 কাটমণ্ডু সহরের অদূরে স্বয়ম্ভূনাথের প্রসিদ্ধ বৌদ্ধমন্দির এই প্রথম শ্রেণীর অন্তর্গত। ইহা বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী নেওয়ারদিগের অতি পবিত্র তীর্থ। নেপালের ইহা প্রাচীনতম মন্দির বলিলেও চলে। দুই সহস্র বৎসর পূর্ব্বে ইহা প্রতিষ্ঠিত হয়, এই রূপ অনুমান করা অসঙ্গত নহে। কাটমণ্ডু সহরের এক মাইল পশ্চিমে একটী ফুদ্র পর্ব্বতের শিখরদেশে স্বয়ম্ভুনাথের বা আদিবুদ্ধের এই প্রসিদ্ধ মন্দির অবস্থিত। নেপাল উপত্যকা হইতে এই পর্ব্বতটী প্রায় ৩০০ ফিট্ উচ্চ হইবে।

 কথিত আছে মাঞ্জুশ্রী বোধিসত্ত্ব যখন নাগবাস হ্রদের জল নির্গত করিয়া দেন তখন হ্রদে একটী শতদলের মধ্যে স্বয়ম্ভূ ভগবান্ দিব্যজ্যোতিতে প্রকাশিত হইলেন। সেই পদ্মের মূল পশুপতিনাথের নিকটবর্ত্তী গুহ্যেশ্বরীতে নিহিত ছিল, এবং পুষ্পটীর উপর বর্ত্তমান স্বয়ম্ভূনাথের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। স্বয়ম্ভূনাথের মন্দিরের অদূরে মাঞ্জুশ্রীর মন্দির দেখিতে পাওয়া যায়। নেপালে মাঞ্জুশ্রীর অনেক মন্দির আছে। অনেক স্থলে বুদ্ধের চরণ এবং মাঞ্জুশ্রীর চরণ মন্দিরে অঙ্কিত দেখা যায়, মাঞ্জুশ্রীর চরণে চক্ষুও বুদ্ধের চরণে চক্র দেখা যায়। উপত্যকা হইতে প্রস্তরনির্ম্মিত সোপানাবলী দিয়া পর্ব্বতশিখরে স্বয়ম্ভূনাথের মন্দিরে উঠিতে হয়। এই সোপানশ্রেণী অতিক্রম করা বড় সহজ ব্যাপার নহে। সোপানশ্রেণীর পাদদেশে বুদ্ধদেবের প্রস্তরনির্ম্মিত ধ্যানমগ্ন এক প্রকাণ্ড মূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়। ইহার বামে ধর্ম্ম এবং দক্ষিণে সঙ্ঘের ক্ষুদ্র মূর্ত্তি আছে। ১৬৩৭ সালে এই বুদ্ধমূর্ত্তি নেপালরাজ প্রতাপমল্ল প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। সোপানাবলীতে আরও কিছু দূর অগ্রসর হইলে পথের উভয় পার্শ্বে সর্পোপরি গরুড়ের প্রস্তরমূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়। গরুড়ের মস্তকে বুদ্ধ অমোঘসিদ্ধের ক্ষুদ্র প্রতিমূর্ত্তি আছে। হিন্দুদিগের উপাস্য গরুড় বুদ্ধের বশ্যতা স্বীকার করিয়া মন্দিরের দ্বাররক্ষকরূপে নিযুক্ত হইয়াছেন ইহাই প্রতিপন্ন করা হইয়াছে। এই ভাবেই অনেক বৌদ্ধমন্দিরে গরুড় গণেশ প্রভৃতি হিন্দু-দেবদেবীর প্রতিমূর্ত্তি দেখা যায়। কিন্তু বর্ত্তমান সময়ে বৌদ্ধগণ পূর্ব্বের উদ্দেশ্য বিস্মৃত হইয়া হিন্দু-দেবদেবীগণের পূজা করিয়া থাকেন। সোপানাবলী দিয়া উঠিয়াই মন্দিরের সম্মুখে প্রকাণ্ড স্বর্ণবর্ণের বজ্র দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাও নেপালরাজ প্রতাপমল্ল কর্ত্তৃক স্থাপিত হইয়াছে। বৌদ্ধমন্দিরে বজ্রের সার্থকতা কি তাহা প্রথমে নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। বজ্রটী ইন্দ্রের, বুদ্ধকর্ত্তৃক হিন্দুদেবতা ইন্দ্রের পরাজয়ের চিহ্নস্বরূপ আদিবুদ্ধের মন্দিরের দ্বারদেশে বজ্রটী স্থাপিত হইয়াছে। বজ্রের সম্মুখে স্বয়ম্ভূর মন্দির; কিন্তু ইহাকে মন্দির বলিলে ঠিক্ হইবে না, ইহা মন্দির নয়, প্রকাণ্ড স্তুপ। এই স্তূপের চারিদিকে সুন্দর মন্দির আছে বটে। তাহার কোনটা বা বুদ্ধ অমােঘসিদ্ধ কোনটা বা বৈরচন, কোনটা বা অমিতাভ প্রভৃতির মন্দির। প্রাঙ্গনে বৌদ্ধভিক্ষুদিগের জন্য বিহার সকল দেখিতে পাওয়া যায়। চারিদিকেই প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঘণ্টা।

 মন্দিরের চতুর্দ্দিকে বৌদ্ধদিগের জপযন্ত্র বা মণি আছে। দর্শকগণ ঘণ্টাধ্বনি করিয়া এবং জপযন্ত্র ঘুরাইয়া পূজার ফল লাভ করে। স্বয়ম্ভু অদ্যাবধি বৌদ্ধদিগের প্রধান তীর্থ। নেপালে শীতকালে বিস্তর তিব্বতবাসীর সমাগম হয়। তাহাদিগের নিকট স্বয়ম্ভু অতি পবিত্র স্থান। নেপালবাসী নেওয়ারগণ সর্ব্বদা স্বয়ম্ভূনাথ দর্শন করিতে আসে বটে, কিন্তু হিন্দুদিগের নিকট এ স্থানের বিশেষ কোন সম্মান নাই। পশুপতিনাথের মন্দিরে হিন্দু বৌদ্ধ সকলেই গিয়া থাকে। এখানে জনসমাগম নাই বলিলেও হয়। প্রাঙ্গন, প্রায় জনশূন্য দেখিলাম। বানরদল, আনন্দে বিহার করিতেছে। স্বয়ম্ভূর মন্দির অত্যন্ত প্রাচীন। কথিত আছে দুই সহস্র বৎসর পূর্ব্বে নেপালরাজ গােরাদাস ইহার প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের নিকট প্রস্তরফলকে লিখিত বিবরণ হইতে কোন্ সময়ে কোন্ মহাত্মা এই মন্দিরের সংস্কার করিয়াছেন তাহা নির্ণয় করা যায়; যথা—

 ১। ১৫৯৬ সালে নেওয়াররাজ শিবসিংহমল্ল ইহার পূর্ণসংস্কার করেন।

 ২। ১৬৩৯ সালে লাসা হইতে আগত, সিয়া মা নামে জনৈক লামা ইহার পুনঃসংস্কার করেন।

 ৩। ১৬৫৩ সালে নেওয়াররাজ বিখ্যাত প্রতাপমল্ল আদি
বৌদ্ধস্তূপ-বৌধ
স্তূপের চারিদিকে পাঁচটী অতি সুন্দর মন্দির নির্ম্মিত করিয়া পঞ্চ-বুদ্ধমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।

 ৪। ১৭৫০ সালে লাসা হইতে দুইজন লামা আসিয়া এই মন্দিরের সংস্কার করেন। ইহার পরও অনেক বার অল্পাধিক পরিমাণে ইহার সংস্কার হইয়া আসিতেছে। জানি না এই রূপ প্রাচীন মন্দির আর আছে কি না। কিন্তু বর্ত্তমান সময়েও ইহার অবস্থা ভালই আছে।

বোধনাথ বা বৌধ

 কাটমণ্ডু সহরের তিন মাইল দূরে তিব্বতবাসী বৌদ্ধদিগের সর্ব্বপ্রধান তীর্থ বোধনাথ প্রতিষ্ঠিত। স্বয়ম্ভূর মন্দিরে হিন্দুগণ কদাচিৎ গিয়া থাকে; কিন্তু বোধনাথ খাঁটি বৌদ্ধতীর্থ। তিব্বতিগণ ইহার চতুর্দ্দিকে বাস করে। ইহা তাহাদিগের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, তাহাদিগেরই তীর্থ। ইহাও অতি প্রাচীন। অতি পুরাকালে লাসা হইতে কাশ নামে কোন তিব্বতী তীর্থভ্রমণোদ্দেশে নেপালে আগমন করেন, তাঁহারই দেহাবশেষ এই স্তূপের গর্ভে রক্ষিত হইয়াছে; ইহাও প্রকাণ্ড গোলাকার এক স্তূপ। ইহার ব্যাস ৯০ ফিট্ এবং মধ্যভাগ উচ্চে ১৫৩ ফিট্ হইবে। নেপাল-উপত্যকার সর্ব্বত্রই ইহার স্বর্ণময় চূড়া এবং তন্নিম্নস্থিত চক্ষুদ্বয় দেখিতে পাওয়া যায়। এই প্রকাণ্ড স্তূপটীর চতুর্দ্দিকেও জপযন্ত্র। ইহা তিব্বতীদিগের একটী ক্ষুদ্র সহর এবং অপরিচ্ছন্নতায় অতুলনীয়। বোধনাথের সহিত হিন্দুদিগের কোন সম্পর্ক নাই; তাহারা ইহার ত্রিসীমানায় পদার্পণ করে কিনা সন্দেহ।

 ৩।
পাটনে মৎসেন্দ্রনাথের মন্দির।

 নেপালের নেওয়ারগণ মৎসেন্দ্রনাথকে বোধিসত্ত্ব পদ্মপানির অবতার বলিয়া বিশ্বাস করেন। কথিত আছে আসামের কথপল পর্ব্বত মৎসেন্দ্রনাথের আবাস ছিল। একবার নেপালে দ্বাদশবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টি হয়। তখন ভাটগাঁওএর রাজা নরেন্দ্রদেব তাঁহাকে আহ্বান করিয়া আনেন এবং তাঁহার আগমনমাত্রে নেপালে প্রচুর বারিবর্ষণ হয় এবং প্রজাগণের প্রাণরক্ষা হয়। অদ্যাবধি মৎসেনাথের যাত্রার দিবস এক পসলা বৃষ্টি না হইয়া যায় না। এই মন্দির পাটনের দক্ষিণে নরেন্দ্রদেব কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।

 ৪।
কাটমণ্ডু সহরে ছোট মহেন্দ্রনাথের মন্দির আছে।

পাটনে অশোকের মন্দির।

 নেপালের ইতিহাসে দেখা যায় সম্রাট অশোক সপরিবারে সদলে নেপালে আগমন করেন। কাটমণ্ডু সহরের সন্নিহিত পুরাতন পাটন অর্থাৎ ললিত পাটন তাঁহাদ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। তিনি সহরের মধ্যভাগে এবং চারিকোণে আদিবুদ্ধের যে সকল মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন তাহা অদ্যাবধি সুন্দর অবস্থায় আছে। এই সকল মন্দিরের গর্ভে অশোক যাহা নিহিত করিয়াছিলেন তাহা অদ্যাবধি কেহ স্পর্শ করে নাই। জানি না ভবিষ্যতে এই সকল মন্দিরের গর্ভ হইতে কত অমূল্য পুরাতত্ত্ব সংগৃহীত হইবে।

 ভাটগাঁওএ অশোকের প্রতিষ্ঠিত মন্দির আছে। কীর্ত্তিপুরে এবং ভাটগাঁওতে অসংখ্য বৌদ্ধমন্দির আছে। ইহার কোনটা বা আদিবুদ্ধ, কোনটা বা মাঞ্জুশ্রী, কোনটা কোন বোধিস্বত্ত্বের উদ্দেশে উৎসর্গীকত হইয়াছে। সংকীর্ণ স্থানে তাহার বর্ণনা এবং উল্লেখ করা দুঃসাধ্য। এরূপ অসংখ্য বৌদ্ধকীর্ত্তি ভারতে আর কুত্রাপি নাই। নেপাল বৌদ্ধদিগের অতি প্রিয়ভূমি তাহাতে আর সন্দেহ নাই।