কাহাকে?/সপ্তম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

সপ্তম পরিচ্ছেদ।


 ময়মনসিং হইতে একখানি পত্র পাইলাম। চিঠিখালি একান্তই প্রীতি মিনতিপূর্ণ। পড়িয়া যেমন আর্দ্র হইলাম তেমনি আত্মগ্লানি অনুভব করিতে লাগিলাম। বলা বাহুল্য এখানি ইংরাজি পত্র; ইঙ্গবঙ্গ যুবা-যাঁহার জীবনই ইংরাজি অনুকরণ, তাঁহার প্রণয় পত্র যে মাতৃভাষায় লিখিত হইবে-বোধ করি আমি খুলিয়া না বলিলেও, এমন আজগুবি ভুল কেহ করিতেন না।

 আমি অবশ্য ইংরাজিতেই উত্তর লিখিতে বসিলাম।—ইঙ্গবঙ্গ সমাজের সুশিক্ষিতনামা কোন বঙ্গবালা হইতে যে আমার ইংরাজি ব্যুৎপত্তি প্রতিপত্তি কিছু কম তাহা নহে, আমিও লোরেটা কন্‌ভেণ্টে শিক্ষা লাভ করিয়াছি, বাবাকে জ্যেঠাইমাকে ও পিসিমাকে ছাড়া আর কাহাকেও চিঠি পত্র লিখিতে হইলে ইংরাজিতেই লিখিয়া থাকি; সখীদিগের সহিত কথাবার্ত্তাও অনেক সময়ে ইংরাজিতেই চলে; আর এপর্য্যন্ত যে কত শত ইংরাজি কবিতা উপন্যাস মস্তিষ্কজাত করিয়াছি তাহার ত ঠিক ঠিকানাই নাই। সত্য কথা বলিতে কি, দেশের ভাষা হইতে এই পরদেশী ভাষাটাকে অধিকতর আয়ত্তীভূত করিয়া লইয়াছি বলিয়াই বরঞ্চ এতদিন মনে মনে একটা গর্ব্ব অনুভব করিতাম, কিন্তু এ চিঠি লিখিতে বসিয়া সে ভুল আমার ভাঙ্গিল। এ ধরণের পত্র লিখিবার প্রয়াস এই আমার প্রথম। এক একটী মনোমত শব্দের চিন্তায়, ভাব ও ভাষার সুন্দর সঙ্গতিতে এক একটী সুললিত পদবিন্যাসের প্রয়াসে উৎকণ্ঠিত গলদ্‌ঘর্ম্ম হইয়া উঠিলাম। চিঠিখানি কতবার লিখিলাম, কতবার ছিঁড়িলাম তাহার ঠিক নাই। যেখানির ভাব ঠিক হয়—তাহার ভাষা ঠিক হয় না, যাহার বা ভাষা পসন্দ হয়—তাহাতে আমার মনের ভাব সুস্পষ্ট প্রকাশ হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। দৈবক্রমে কোনখানিতে ভাব ও ভাষার একরূপ নির্দ্দোষ সমম্বয় হইলে ও তখন ভাবনা জন্মে, ইহা ঔপন্যাসিক রস যুক্ত সুরচনা হইয়াছে কি না? এমন কি একটা in এবং to শব্দের স্থানান্তর সংঘটন সন্দেহে বহুযত্নে বহু সময় ধরিয়া লিখিত প্রায়-সমাপ্ত পত্রখনিও মুহূর্ত্তে শতছিন্ন হইয়া পড়ে,—এ অবস্থায় কি চিঠি শেষ হয়? এই চিঠি লিখিতে বসিয়া প্রথম আমি মাতৃভাষার সহজ গৌরব উপলব্ধি করিলাম। দশ এগার বৎসর বয়স পর্যন্ত রীতিমত যা বাঙ্গ্‌লা শিখিয়াছিলাম; তাহার পর কলিকাতা আসিয়া লোরেটোতে ভর্ত্তি হওয়া অবধি এ পর্যন্ত বাঙ্গ্‌লা চর্চ্চার মধ্যে প্রধানতঃ কথা কহা, দ্বিতীয়তঃ মাঝে মাঝে ভাল উপন্যাস কবিতা পাইলে যা পড়িয়া থাকি; তাহার সংখ্যাও ত নখাগ্রে গণনা করা যায়। কিন্তু তথাপি আমি যদি এ চিঠি বাঙ্গ্‌লাতে লিখিতাম তাহা হইলে কি কর্তৃ কর্ম্ম ভাববাচোর সুপ্রয়োগ নিরূপণে, বিশেষণ প্রতিশব্দ নিচয়ের সূক্ষ্ম ভাবার্থভেদ বিচারে,—সমাপক অসমাপক ক্রিয়ার স্থিতি গতির বৈচিত্র্য নির্দ্ধারণে অথবা সামান্য একটা অব্যয় শব্দের যথা-সন্নিবেশ চিন্তায় মস্তিষ্ক এতদূর আলোড়িত বিলোড়িত করিতাম! এককথায় চিঠি লেখার উদ্দেশ্য ভুলিয়া স্বরচনার উদ্দেশ্যে এতটা বিব্রত হইয়া পড়িতাম—অথবা শব্দ, ভাষার প্রতি লক্ষ্য না করিয়া যাহা বলিবার আছে বিনাড়ম্বরে সহজভাবে সেইটুকু বলিয়া লইয়া চিঠিখনি ডাকে ফেলিয়া দিয়াই যথেষ্ট সন্তোষলাভ করিতাম? বাঙ্গালী হইয়া বাঙ্গলা ভুল করিলে তাহাতে আমাদের লজ্জা করে না!—কিন্তু ইংরাজির একটা সামান্য ভুলে আমরা লজ্জায় মরিয়া যাই। বিপদে পড়িলেই মধুসূদনকে মনে পড়ে; সেই দিন আমার জ্ঞান জন্মিল, এই ইংরাজি পত্রখানির জন্য যতটা পরিশ্রম করিলান, তাহ নিতান্তই বৃথা হইল; কিন্তু বাঙ্গলা লিখিবার জন্য এতটা পরিশ্রম করিলে আমি বঙ্গদেশের মধ্যে একজন সুলেখক হইতে পারিতাম নাকি? সেই জ্ঞানের ফল আজ পাঠককে উপহার দিতেছি, তিনি ইহার মীমাংসা করিবেন।

 কিন্তু তাহাও বলি—নিতান্তই কি ভাষারি দোষ! মনের দোষ কি ইহাতে কিছুই ছিল না? লোকের যখন বিশেষ কোন হৃদয়ের কথা বলার না থাকে, সে তখন বেশ অসঙ্কোচে অনর্গল বলিয়া বা লিখিয়া যাইতে পারে, কিন্তু সত্য সত্যই বলিবার কথা বিশেষ কিছু থাকিলেই তাহা তখন বলা দায় হইয়া উঠে, তখনই, সে কথা কি ভাবে প্রকাশ করিব, কিরূপ আকৃতিতে তাহ সুস্পষ্ট অথচ নিখুঁত হইবে—এই চিন্তায় এই সঙ্কোচে, প্রকাশে শত সহস্র বাধা আসিয়া পড়ে। তাই একবার মনে হয়—ইংরাজিতে না লিখিয়া বাঙ্গ্‌লাতে লিখিলেই কি তাঁহার হাতে পত্রখানি পৌঁছিত? কে জানে!

 সপ্তাহ কাটিতে চলিল, তাঁহার আসিবার সময় হইয়া আসিল; দিস্ত দিস্ত কাগজ নষ্ট করিলাম তবু আমার চিঠি শেষ হইল না। বিরক্ত হইয়া লেখা বন্ধ করিলাম—মনকে বুঝাইলাম তিনি ত শীঘ্রই আসিবেন, আর লেখার সময়ই বা কৈ, আবশ্যকই বা কি? দেখা হইলে মুখেই সব বলিব, চিঠিতে কি অত কথা বলা যায়? কেন লিখি নাই কারণ শুনিলে তিনিও ইহাতে কিছু মনে করিবেন না।

 এক সপ্তাহ মাত্র তাঁহার মফঃস্বলে থাকিবার কথা—দশ বার’ দিন হইল তবু তিনি ফিরিলেন না। দিদি একদিন রাত্রে ডিনার পার্টি হইতে ফিরিয়া পরদিন সকালে আমার সহিত প্রথম দেখা হইবামাত্র সহসা জিজ্ঞাসা করিলেন—“তার চিঠিপত্র পেয়েছিস?”

 কি জানি প্রসঙ্গ ক্রমে যদি দিদি জানিতে পারেন যে সে চিঠির এখনো উত্তর দেওয়া হয় নাই; তাহা হইলে, একে নিজের মনের জ্বালায় জ্বলিতেছি তাহার উপর কর্ত্তব্য ত্রুটির উপদেশে ক্ষত স্থান লবণ জর্জ্জরিত হইয়া উঠিবে, এই ভয়ে আমি কথাটা কোন রকমে এড়াইয়া অন্য কথা পাড়িবার অভিপ্রয়ে বলিলাম—“গান টান কাল কেমন হোল?”

 দিদি বলিলেন—“গাইয়ে লোক কাল তেমন কেউ ছিল না। কুসুমরা সব এখনো ময়মনসিংয়ে-গান জমে কি করে বল? চঞ্চল একবার টিম টিম করে গাইলে, আমিও গেয়েছিলুম; কিন্তু মনটা কেমন খারাপ হয়ে গিয়েছিল—মোটেই ভাল করে গাইতে পারলুম না”—

 “ডিনার পার্টিতে গিয়ে মন আবার খারাপ হোল কেন?”

 “কি গুজব উঠেছে জানিস,—তোর সঙ্গে রমানাথের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, কুসুমের সঙ্গে তার বিয়ে। ময়মনসিংয়ে নাকি তাদের বাড়ীতেই সে ছিল।”

 “সেই জন্যেই আর কি গুজবটা উঠেছে। লোকদের ত খেয়ে দেয়ে কাজ নাই, পরচর্চ্চার একটা সুযোগ পেলে হয়। ত্রেতা যুগে বাল্মীকি রাম না হতে রামায়ণ সৃষ্টি করেছিলেন— এ যুগে সে ক্ষমতাটুকু ত কারো নেই,—তাই অহৰ্নিশি তার চেষ্টাটাই চলেছে। একটা গুজব শুনে তুমি অত মুষড়ে গেলে কেন?”

 “কথাটা নিতান্ত গুজব বলে মনে হচ্ছে না,—চঞ্চলের মার কাছে সব শুনলুম। তারা নাকি মেয়েকে ৫ হাজার টাকা যৌতুক দেবে।”

 চঞ্চলের মা কুসুমের কাকিমা। যাতৃ দুইজনের মধ্যে প্রীতি সদ্ভাব কিছুমাত্র নাই,—আত্মীরতা স্থলে কলহ বিবাদ হইলে যাহা ঘটয়া থাকে, কাহারো গুণ কেহ দেখিতে পান না, তিল দোষ পাইলে তাল করিয়া তুলিয়া তাহার সমালোচনায় উভয়েই পরমানন্দ লাভ করেন। আমি বলিলাম—“তিনি যখন বলেছেন তখন ত কথাটার মধ্যে কোন সত্য না থাকারই বেশী সম্ভাবনা।”

 “কিন্তু শুনছি রমানাথ পরশু এসেছে—কাল এখানে এলনা কেন? আগে হোলে কি তা করত?”

আমার মনে তখনো তাঁহার ভালবাসার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস, তাঁহার বিদায় কালের কাতরোক্তি তখনো মনে সুম্পষ্ট বাজিতেছে, তাহার পত্রের প্রীতিময় বাক্য তখনো হৃদয় অনুকম্পিত ব্যথিত করিতেছে, আমি কি বাহিরের সামান্য একটা গুজবে বা একদিন তাঁহার আসিতে বিলম্ব দেখিয়া সে মহা বিশ্বাস হারাই? আমি বলিলাম—“দিদি তুমি যেন কি? কাল আসতে পারেন নি আজ আসবেন এখন, তাতে আর এতই হয়েছে কি? কিছুদিন আগে তাঁর সৌজন্যে তোমার এতটা গভীর বিশ্বাস ছিল—আর সামান্য একটা গুজবে সমস্ত হারিয়ে ফেল্লে। যদি তাঁর ভালবাসা মিথ্যা না হয় তাহলে এ গুজব সত্য হতে পারে না—আর গুজবটা যদি সত্যি হয় তাহলে ত তাঁর ছলনা হতে মুক্তি পাওয়া গেল। তাতে দুঃখ করার কি আছে বল?”

 দিদি চুপ করিয়া গেলেন। ভক্ত ঐশ্বরিক প্রেমে বিশ্বাস করিয়া যে আনন্দ লাভ করে, আমি তাঁহার প্রেমে বিশ্বাস করিয়া যেন সেইরূপ আনন্দ পূর্ণ হইলাম। যিনি ভুক্তভোগী তিনিই মাত্র জানেন—এ ভক্তি বিশ্বাস জগতে কিরূপ অমূল্যধন, এ বিশ্বাসে কি পরমানন্দ; অপ্রেম হৃদয়ে ইহাতে প্রেম ফুটায়; সপ্রেম হৃদয় ইহাতে চিরপ্রেমময় হইয়া উঠে; আর এই বিশ্বাসের অভাবে প্রজ্জ্বলন্ত প্রেমও ক্রমে নিস্তেজ নির্ব্বাপিত শীতল হইয়া পড়ে।