গুচ্ছ/ভবিতব্য

উইকিসংকলন থেকে


ভবিতব্য



 অনেকদিন পরে দেশে ফিরিয়া আসিয়াছিদেশে এখন সবই যেন নতুন মনে হইতেছে, সবই বড় মধুর লাগিতেছে। অনেকদিন পরে কলিকাতায় আসিয়া প্রাণের আনন্দে খুব ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। থিয়েটার, সার্কাস, আলিপুরের চিড়িয়াখানা, যাদুঘর, ইডেন গার্ডেন্‌, গড়েরমাঠ দেখিয়া যেন আর আশা মিটিতেছে না। ইডেন গার্ডেনের সম্মুখেই জাহাজ লাগিবর জন্য মস্ত একটা নূতন ঘাট তৈার হইয়াছে। বিদেশ নাইবার পূর্ব্বে সেটা দেখিয়া যাই নাই, তাই প্রায় প্রত্যহই একবার করিয়া সেখানে যাইতাম। প্রতিদিন কত লোক আসিত, কত লোক জাহাজ চড়িয়া চলিয়া যাইত, তাই দেখিতাম।

 জেটির উপরে ষ্টীমার স্টেসন, সেখানে অনেকগুলি লোক-লস্কর থাকে, তাহারা সকলেই প্রায় চট্টগ্রামনিবাসী, ক্রমে তাহাদিগের সহিত আলাপ হইয়া গেল। যে তাহাদিগের সারেঙ, সে কাজ না কিন্তু জেটির ডেকে বসিয়া জাল বুনিত ও আমার সহিত গল্প করিত। তাহার নাম আবদুল, বিশাল কর্ণফুলি নদীর তীরে তাহার বাস, পৃথিবীতে এমন দেশ নাই, যাহা সে দেখে নাই। আজীবন বড় বড় জাহাজে খালাসী ও লস্করের কাজ করিয়া বুড়া বয়সে সে এই জেটীর সারেঙের পদ পাইয়াছে। আবদুল ডেকে বসিয়া ক্ষিপ্রহন্তে জাল বুনিয়া যাইত, আর আমাকে বানান দেশের গল্প শুনাইত। বিদেশ হইতে আসিয়া আমি এখনও বাড়ী যাই নাই গুনিয়া বৃদ্ধ বড়ই আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া গেল, আমাকে বলিল “বাবু আমি ভাবিয়ছিলাম কলিকাতাতেই আপনার বাড়ী।” দেশে আমার কেহ নাই; যাঁহারা আমার ছিল, তাঁহাদের হারাইয়া উদাস প্রাণে সপ্তদশ বর্ষ বয়সে মহাসমুদ্রের পারে গিয়াছিলাম। শুনিয়া বৃদ্ধ দুঃখিত হইল। জ্ঞাতি যাহারা আছেন তাঁহারা যে আমাকে দেখিয়া বিশেষ সন্তুষ্ট হইবেন না, তাহা বলিবামাত্র বৃদ্ধ বুঝিতে পারিল। তাহার দেশেও তাহার জ্ঞাতিবর্গ আছে। সে যখন দেশে দেশে ঘুরিয়া বেড়াইত তখন তাহারা সানন্দে তাহার জমীজমার অংশগুলি ফাঁকী দিয়া লইয়াছিল। তাহার পর বৃদ্ধ যখন শুনিল যে, আমার বয়স ছাব্বিশ বৎসর কিন্তু তখনও বিবাহ করি নাই, তখন সে বড়ই দুঃখিত হইল। বৃদ্ধ বলিল যে, বৃদ্ধা স্ত্রী ও শিশু কন্যা ব্যতীত তাহার জীবনের আর কোন বন্ধন নাই। সে দেশে ফিরিয়া আসিয়াছে কিন্তু তথাপি তাহার স্ত্রী কন্যার নিকট হইতে বহুদূরে আছে। কন্যাটিকে দেখিবার জন্য সময়ে সময়ে তাহার মন বড়ই ব্যাকুল হইয়া উঠে। যখন হাতে কাজ না থাকে তখন চিন্তার হাত হইতে পরিত্রাণ পাইবার জন্য সে একমনে জাল বুনতে থাকে। ক্রমে জেটির সকল লস্করই আমায় চিনিয়া ফেলিল এবং সারেঙের বন্ধু বলিয়া আমাকে খাতির করিত।

 একদিন একখানি জাপানী জাহাজ আসিয়া জেটতে লাগিতেছিল, আবদুলের সেদিন আর কথা কহিবার অবকাশ ছিলনা। লস্করেরা জাহাজের কাছি বাঁধিতেছিল। সিঁড়ি লাগাইতেছিল, আবদুল ব্যস্ত হইয়া জেটার চারিদিকে ছুটিয়া বেড়াইতেছিল! জাহাজখানা তখনও জেট হইতে একটু দূরে ছিল, আর আমি একরাশ মোটা কাছির উপরে বসিয়া একদৃষ্টে জাহাজ দেখিতেছিলাম। জাহাজখানি ছোট, তাহার নামটা এখনও মনে আছে, তাহার পশ্চাতে বড় বড় মোটা ইংরাজী অক্ষরে লেখাছিল, “হাকাতা মারু, নাগাসাকি।” জাহাজের উপর সারি সারি জাপানী নাবিক দাঁড়াইয়াছিল। তাহাদিগকে দেখিলে ইংরাজ বলিয়া ভুল হয়। তাহাদিগের কাপ্তেনও জাপানী। যখন জাহাজখানা জেটী হইতে দশহাত কি পনর হাত তফাৎ আছে, তখন জাহাজের প্রথম শ্রেণীর একটি কামরা হইতে তিনচার বৎসরের একটি শিশু বাহির হইয়া আসিয়া বারান্দায় দাঁড়াইল, তাহার সঙ্গে সঙ্গেই একটি বাঙ্গালী বালিকাও কামরা হইতে বাহির হইয়া আসিল। জাহাজ লাগিবে বলিয়া খালাসীরা রেলিং খুলিয়া লইতেছিল, বালক আসিয়া যেখানে দাঁড়াইল, সেখানকার রেলিং চিল-হইয়াছিল, বালক ভর দিবামাত্র রেলিং খুলিয়া জলে পড়িয়া গেল, ঝোঁক সামলাইতে না পারিয়া বালকও গঙ্গার জলে পড়িয়া গেল। বালককে জলে পড়িতে দেখিয়া বালিকা চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল “মা খোকা?” তাহার শেষকথাগুলি শোনা গেলন। কারণ সেও সেইসঙ্গে জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল। বালককে জলে পড়িতে দেখিয়া আমিও তাহার উদ্ধারের জন্য জলে লাফাইয়া পড়িয়াছিলাম। কিন্তু আমার পূর্ব্বেই বালিকা ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল। আমি জলে পড়িয়াই ডুব দিলাম। আমি ডুবিবার পূর্ব্বে জলে আর একটা গুরুভার দ্রব্যের পতন শব্দ শুনিতে পাইলাম। এক মুহূর্ত্ত পরেই কাহার কাপড় আমার হাতে ঠেকিল, টানিয়া দেখিলাম কাপড় খোলা। গঙ্গার মৃত্তিকা স্পর্শ করিয়াই বালকের দেহ পাইলাম। জলে পড়িয়া বালক তলাইয়া গিয়াছিল, তাহার পরণের কাপড়খানি তখনও স্রোতের বেগে ভাসিতেছিল। বালকের দেহ লইয়া যখন উপরে উঠিলাম, তখন জাহাজ ও জেটির লোকেরা চীৎকার করিয়া উঠিল, শুনিতে পাইলাম, সকলে চীৎকার করিয়া জাহাজ থামাইতে বলিল, জেটির উপর হইতে পাঁচ সাতজন লোক আমার হাত হইতে বালকের দেহ তুলিয়া লইল। এমন সময়ে প্রায় বিশহাত দূরে আবদুল ভাসিয়া উঠিল, লোকে তাহাকে দেখিয়া আবার চীৎকার করিয়া উঠিল, কিন্তু সে হাত নাড়িয়া জানাইল যে সে কিছুই পায় নাই। তাহার পরক্ষণেই আবদুল পুনরায় ডুব দিল, জাহাজ তখন জোট হইতে পাঁচ হাত দূরে। সকল লোকেই তখন জাহাজ থামাইবার জন্য চীৎকার করিতেছে, জাহাজের কর্ম্মচারীরাও তাহাদের ভাষায় কি আদেশ দিতেছিল, তাহা শুনিয়া আমার ভরসা হইল, আমি পুনরায় ডুবিলাম। দুই তিন বার ডুব দিয়া গঙ্গামৃত্তিকা স্পর্শ করিলাম,চতুর্থ বারে বালিকাকে পাইলাম, তখনও তাহার চেতনা ছিল, সে সবলে আমার হাত চাপিয়া ধরিল। আমি তখন তাঁহাকে লইয়া উপরে উঠতে লাগিলাম। অল্পদূর উঠিয়াই মাথায় বড় লাগিল, বুঝিলাম জাহাজের বা জেটির তলায় আসিয়াছি, ধীরে ধীরে তলা ধরিয়া উপরে উঠিলাম। তখন আমার শ্বাস প্রায় রুদ্ধ হইয়া আসিয়াছে। বুঝিলাম জাহাজ থামান হয় নাই। তখন জেটি বা জাহাজের উপরের লোক আমাকে আর দেখিতে পাইতেছে না। বালিকা প্রায় অচেতন হইয়া পড়িয়াছে, প্রাণপণ শক্তিতে জেটির পাশে যাইবার চেষ্টা করিলাম। পাঁচ-সাতখানিবড় নৌকার উপরে জোট নির্ম্মাণ করা হইয়াছিল, দেখিলাম দুইখান নৌকার মধ্যে একজন লোক জলে ভাসিতেছে, সে আবদুল। আমি বালিকাকে তাহার দিকে ঠেলিয়া দিলাম, সে বালিকাকে ধরিল, তাহার পর আর যাইতে পারিলাম না, জাহাজ আসিয়া আমার মাথায় লাগিল, আমার বোধ হইতে লাগিল মাথাটা জাহাজ ও জেটির মধ্যে পিষিয়া গেল, কে যেন চারিদিকে অন্ধকার ঢালিয়াদিল। তাহার পর সব অন্ধকার।

 যেদিন আমার সামান্য একটু জ্ঞান হইল, সেদিন মনে হইল, যেন একটা প্রকাণ্ড ঘরের ভিতর কয়খানি খাট রহিয়াছে। তাহার একখানিতে আমি শুইয়া আছি। মাথাটা যেন বড় ভারি, একেবারে তুলিতে পারি না। বিছানা ও বালিসগুলা বড় শক্ত, এক একবার মনে করি কথা বলি, কিন্তু কাহাকে বলিব খুঁজিয়া পাইনা। মাঝে মাঝে একটি বালিকা আসিয়া আমার পাশে দাঁড়াইয়া থাকে, তাহার পর আবার চলিয়া যায় একবার মনে হয় তাহাকে ডাকিব, কিন্তু সে আসিলে ডাকিবার কথা মনে থাকে না। মাঝে মাঝে আবার সব অন্ধকার হইয়া যায়।

 তাহার পর, কতদিন পর জানিনা একদিন জ্ঞানসঞ্চার হইলে দেখিলাম আমি যেন আর একস্থানে আর একটি ঘরে নীত হইয়াছি। বেশ ছোট ঘরটি, ভিতরট নীল রঙ্গের কাগজ দিয়া মোড়, দরজা-জানালা গুলিতে মোটা নীল রঙ্গের পর্দ্দা দিয়া ঢাকা, মাঝখানে একখানি খাট, তাহাতে নীল রঙ্গের নেটের মশারি। ঘরের ভিতরে দুই একটি ছোট টেবিল ব্যতীত আর কিছুই ছিলনা। খাটে শুইয়া আছি, ভাবিতেছি এখানে কি করিয়া আসিলাম, এ কাহার গৃহ। পূর্ব্বে যেখানে ছিলাম সেখানেই বা আমাকে কে লইয়া গিয়াছিল? ঘরের দরজার পরদা একটু ঈষৎ দুলিয়া উঠিল, সদ্যস্নাতা অবগুণ্ঠনরহিত অনিন্দ্য সু ন্দরী একটি কিশোরী ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল, পা টিপিয়া টিপিয়া আমার খাটের নিকট আসিল, বিশেষ মনোযোগের সহিত আমাকে দেখিল, আমি চাহিয়া আছি দেখিয়া অপ্রস্তুত হইয়া উঠিল, তাহার মুখখানি লাল হইয়া উঠিল, সে মাথায় কাপড় টানিয়া দিয়া পলাইয়া গেল। তাহার পরে একজন গৌরবর্ণ প্রৌঢ়বয়স্ক ভদ্রলোক গৃহে প্রবেশ করিলেন, অনুমানে বুঝিলাম তিনিই গৃহস্বামী। তিনি আসিয়া আমার খাটের পাশে এক খান চেয়ার টানিয়া বসিলেন, ধীরে ধীরে আমার অঙ্গ স্পর্শ করিলেন, তাহারপর জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি এখন কেমন আছেন?” আমি মাথা নাড়িয়া জানাইলাম যে ভাল আছি। তখন আমাকে অধিক কথা কহিতে নিষেধ করিয়া তিনি ঘর হইতে চলিয়া গেলেন, আমি বিছানায় পড়িয়া আকাশ-পাতাল চিন্তা করিতে লাগিলাম।

সেই দিন সন্ধ্যার সময় একজন পরিচিত ব্যক্তি আমার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল; সে আবদুল। আবদুলের নিকট সমস্ত সংবাদ পাইলাম। গৃহস্বামীর নাম শ্রীযুক্ত রসময় নদী, তিনি বর্ম্ম-প্রবাসী, রেঙ্গুনের রেল আফিসের উচ্চপদস্থ কর্ম্মচারী, বহুদিন পরে অবকাশ লইয়া দেশে আসিয়াছেন। জাহাজ হইতে তাঁহারই পুত্রকন্যা জলে পড়িয়া গিয়াছিল। জাহাজে ধাক্কা লাগিয়া আমি অজ্ঞান হইয়া জলে ডুবিয়া গিয়াছিলাম, আবদুল আমাকে গঙ্গাগর্ভ হইতে উদ্ধার করিয়াছিল। প্রায় একমাস কাল হাঁসপাতালে ছিলাম, তাহারপর রসময় বাবু আমাকে তাঁহার গৃহে আনিয়াছেন, জলের ন্যায় অর্থব্যয় করিয়া আমার চিকিৎসা করাইয়াছেন, এবং আমার জন্য দেশে না গিয়া কলিকাতায় বাস করিতেছেন। আবদুলের কথা শুনিতে শুনিতে আমার চোখে জল আসিল। সেদিন আবদুল অনেক রাত্রি অবধি বসিয়া আমার সহিত গল্প করিয়া গেল। তাহারপর সে প্রায়ই আসিত, রসময় বাবু স্বয়ং আমার তত্ত্বাবধান করিতেন, কিন্তু সে কিশোরীকে আর দেখিতে পাইতাম না। সপ্তাহ কাল মধ্যে সুস্থ ও সবল হইয়া উঠিলাম, গৃহস্বামীর নিকট বিদায় লইয়া বাসায় ফিরিলাম।

 আমার নিজের পরিচয় দিতে ভুলিয়া গিয়াছি, আমার নাম শ্রীচন্দ্রশেখর বসু, নিবাস বর্দ্ধমান জেলার অন্তর্গত হরিশপুর গ্রামে। জীবনের প্রথম সপ্তদশ বর্ষ কলিকাতায় কাটাইয়াছি, আমার পিতা আলিপুরে জজ আদালতে ওকালতি করিতেন, কিন্তু তিনি বিশেষ কিছু সঞ্চয় করিয়া রাখিয়া যাইতে পারেন নাই। সপ্তদশ বর্ষ বয়সে পিতৃহীন হইয়া অন্ধকার দেখিলাম, আমি আশৈশব মাতৃহীন। কলিকাতায় আসিলাম, তখন যুদ্ধের জন্য আফ্রিকায় সৈন্য যাইতেছিল, এক পিতৃবন্ধুর অনুগ্রহে চাকরি পাইয়া দেশত্যাগ করিয়া ছিলাম, তাহার নয়বৎসর পরে দেশে ফিরিয়াছি। কলিকাতার একটি ক্ষুদ্র গৃহে আমি এবং আমার বিদেশের সহচর রামদীন বাস করিতাম। আরোগ্য-লাভ করিয়া ধীরে ধীরে বাসায় ফিরিলাম, দেখিলাম দরজায় তালা লাগাইয়া রামদীন কোথায় চলিয়া গিয়াছে। ক্লান্তিবোধ হওয়ায় দরজায় বসিয়া পড়িলাম, মাথাটা কেমন করিয়া উঠিল। কলিকাতা সহরে কেহ কাহারও খোঁজ খবর লীয়না। রাস্তা দিয়া অবিরাম জনস্রোত বহিয়া যাইতেছিল, কিন্তু কেহই আমার দিকে ফিরিয়া চাহিল না। অনেকক্ষণ পরে একটু সুস্থ বোধ করিলাম। পাশে কলেজের ছাত্রদের একটা মেস ছিল, উপরের ঘরে একটা ভাঙ্গা হারমোনিয়ম লইয়া কে গাহিতেছিল:—

আমার পরাণ যাহা চায়,
তুমি তাই তুমি তাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই কিছু নাই গো।

 ভাবিলাম রসময় বাবুর বাড়ী ফিরিয়া যাই, একখানা গাড়ী ভাড়া করিয়া চলিয়াছি, সে রাস্ত ছাড়িয়া বড় রাস্তায় পড়িয়াছি, এমন সময় পিছন হইতে কর্কশস্বরে কে আমার নাম ধরিয়া ডাকিল, ফিরিয়া দেখি বাল্যবন্ধু সতীশচন্দ্র। সে আসিয়া গাড়ীতে উঠিয়া বসিল এবং গাড়োয়ানকে শ্যামপুকুর যাইতে আদেশ করিল। তাহার পর গাড়ী চলিতে আরম্ভ করিলে সে আমাক লইয়া পড়িল। “তুই গিয়াছিলি কোথায়? তোর চাকর ত তোর,জন্য কাঁদিয়া আকুল। আজ তিনমাস যে তোর দেখা নেই, তুই গিয়াছিলি কোথায়? রামদীন একমাস তোর প্রত্যাশায় থাকিয়া আর পারিলন, আমার কাছে আসিয়া কাঁদিয়া পড়িয়াছিল। আমি তোর বাসা তুলিয়া দিয়া তোর জিনিষ পত্র আমার বাড়ীতে আনিয়া দেশে পত্র লিখিতে ছিলাম আর কি। তোর তিনকুলে কেউ নাই তাত জানি, তবু তোর জিনিষটা পত্রটা তোর জ্ঞাতিরা পাইবে।” সতীশচন্দ্র এক নিশ্বাসে কথা গুলি খুব চেঁচাইয়া বলিয়া হাঁফাইয়া উঠিল। সে চুপ করিলে আমি ধীরে ধীরে সকল কথা খুলিয়া বলিলাম। তাহা শুনিয়া তাহার চোখে জল আসিল। সতীশ মানুষটা বড় ভালো, সহজেই রাগিয়া উঠে, কিন্তু তাহার রাগ অধিকক্ষণ থাকেনা। আমার শরীর তখনও পূর্ব্বের ন্যায় সুস্থ ও সবল হয় নাই। সতীশ বাড়ী ফিরিয়া আমার শুশ্রুষা করিতে প্রবৃত্ত হইল, দুই তিন দিনের মধ্যে আমি আর তাহার হাত ছাড়াইতে পারিলাম না। তিন দিনের দিন সতীশের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। রসময় বাবুর বাড়ীর সন্মুখে গিয়া দেখি বাড়ী নিস্তব্ধ, যেন লোক জন কেহ নাই। কি জানি কেন মনটা কেমন হইয়াগেল, কম্পিত পদে বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিলাম। নিম্নতলে কেহ ছিলনা, দ্বিতলৈ উঠিয়া দেখি রসময় বাবু স্নান মুখে বসিয়া আছেন। এই কয়দিনের মধ্যে তিনি যেন বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন, তাঁহার বয়স যেন দশ বৎসর বাড়িয়াছে। তিনি আমাকে দেখিয়া ছুটিয়া আসিলেন, আমার গলা জড়াইয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন, বলিলেন “বাবা, একবার তুমি মিনুকে বাঁচাইয়াছিলে, আমি কপালের দোষে আবার তাহাকে হারাইতে বসিয়াছি, তুমি তাহাকে বাঁচাও।” আমি অনেক কষ্টে বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দান করিয়া মৃণালিনীকে দেখিতে চলিলাম যে ঘরে আমার চেতনা ফিরিয়াছিল সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, সেই খাটের উপরে শুষ্ক মৃণালের ন্যায় মৃণালিনী পড়িয়া আছে। তাহার মাথা মুড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে, তারার মাতা শিয়রে বসিয়া, মাথায় বরফ দিতেছেন, আর অশ্রু বিসর্জ্জন করিতেছেন। মিনু বড়ই ছট ফট করিতেছিল। আমি তাহার নিকটে গিয়া বসিলাম। মিনু মাঝে মাঝে অনুচ্চ স্বরে কি বলিতেছিল। আমি তাহার পাশে বসিয়া তাহার গায়ে হাত বুলাইতে লাগিলাম। শুনিলাম ডাক্তার আসিয়া বলিয়া গিয়াছে যে, তাহার মস্তিষ্কের জ্বর হইয়াছে, জীবনের আশা অতি সামান্য, তবে যদি কোন উপায়ে দুই এক দিন বাঁচাইয়া রাখা যায়, তাহা হইলে রোগিণী রক্ষা পাইলেও পাইতে পারে।

 আমি আসিবার পর হইতে তাহার অবস্থার উন্নতি হইতে লাগিল। এইরূপে দুইদিন কাটা গেল, ডাক্তার আসিয়া যখন বলিয়া গেল আর বিপদের আশঙ্কা নাই, তখন রসময় বাবুর স্ত্রী কাঁদিতে কাঁদিতে মিনুর শীর্ণ হাতখানি আমার হাতে দিয়া বলিলেন “বাবা, আজ হইতে মিনু তোমার হইল, আর আমাদের নহে।” আমি লজ্জায় অধোবদন হইলাম।

 বলা বাহুল্য মিনু ওরফে মৃণালিনীর সহিত আমার বিবাহ হইয়া গেল। বিবাহের বরযাত্রী আবদুল আর রামদীন, আর বরকর্ত্তা স্বয়ং সতীশচন্দ্র। রসময় বাবুর অনুরোধ সত্ত্বেও দেশে কাহাকেও নিমন্ত্রণ করি নাই। মিনুকে লইয়া সতীশের বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম। ফুলশয্যার সময় আনন্দ চাপিয়া রাখিতে না পারিয়া সতীশচন্দ্র গান ধরিল

কাছে তার যাই যদি, কত যেন পাই নিধি,
তবু হরষের হাসি ফুটে ফুটে ফুটেনা।

 সতীশের স্ত্রী তখন আমায় ঠাট্টা করিতেছিলেন, তখনি তাঁহাকে ছুটিতে হইল কারণ সতীশের রাসভ-বিনিন্দিত কণ্ঠস্বর তাহার কনিষ্ঠ পুত্রের নিদ্রাভঙ্গ করিয়াছিল। সেই সময়ে একটা দম্‌কা বাতাসে ঘরের দরজা খুলিয়া গেল। দেখিলাম ছাদে বসিয়া রামদীন গাহিতেছে,

বৈরাগ যোগ করম কঠিন মঁয় না করুরে।

 আবদুল তাহার সম্মুখে বসিয়া নিবিষ্টচিত্তে শুনিতেছে।