এনক আর্ডেন

উইকিসংকলন থেকে

টেনিসন-প্রণীত

এনক আর্ডেন।

শ্রীযুক্ত দুর্গাদাস লাহিড়ী

কর্ত্তৃক

কবিতা-ছন্দে

সংগ্রথিত।

TENNYSON’S ENOCH ARDEN.

TRANSLATED IN BENGALI VERSE

BY

DURGADAS LAHIRI.


লর্ড টেনিসন প্রণীত

এনক আর্ডেন।

শ্রীযুক্ত দুর্গাদাস লাহিড়ী

কর্ত্তৃক

কবিতাছন্দে সংগ্রথিত।


প্রকাশক,

শ্রীধীরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী।

“পৃথিবীর ইতিহাস ” কার্য্যালয়,

হাওড়া।


১৩১৮



হাওড়া,

৪নং তেলকল ঘাট রোড, কর্ম্মযোগ প্রেস হইতে

শ্রীযুগলকিশোর সিংহ দ্বারা

মুদ্রিত।



ভূমিকা।

 ইংলণ্ডীয় রাজকবি, অদ্বিতীয় প্রতিভাশালী ‘লর্ড টেনিসন্ প্রণীত’ ‘এনক আর্ডেন’ অতি মধুর মর্ম্মস্পর্শী কাব্য-গ্রন্থ। সমালোচকদিগের মতে, তাঁহার রচনার মধ্যে ‘এনক্ আর্ডেন’ অত্যুৎকৃষ্ট সম্পৎ। এই কাব্যগ্রন্থের সর্ব্ববিধ সৌন্দর্য্যের বিষয় বিবেচনা করিয়া দেখিলে, তাঁহার অন্য কোনও কবিতা ইহার উপরে স্থান পাইতে পারে না। ইহার গল্পাংশ—বিচিত্র নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতপূর্ণ, ভাষা-ভাব—সরল ও আবেগময়, প্রতি অংশই—সম্পূর্ণতার অথচ সৌন্দর্য্যের আধারভূত।

 এমন এক খানি অনুপম কাব্য-রত্ন বাঙ্গালা ভাষায় কবিতাছন্দে সংগ্রথিত হইলে, ভাষার পুষ্টি-সাধন হইবে বলিয়া বিশ্বাস হয়; তাই এই গ্রন্থ প্রকাশের লোভ সংবরণ করিতে পারি নাই।

 টেনিসনের ‘এনক্ আর্ডেন্’ ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। একটী সমুদ্র-ভ্রমণকারী নাবিকের নিদারুণ জীবন-কাহিনী ইহাতে বর্ণিত হইয়াছে। বীরত্বের উচ্ছাস বা ঘটনার ঘনঘটা যদিও ইহাতে নাই; কিন্তু ইহার ক্ষুদ্র-কাহিনীটী হৃদয়-তন্ত্রীতে গিয়া এমনই আঘাত করে যে, তাহা মর্ম্মে মর্ম্মে বিধিয়া থাকে।

 আমাদের বঙ্কিমচন্দ্রের ‘চন্দ্রশেখরে’ প্রতাপের ত্যাগস্বীকারের যে চিত্র অঙ্কিত হইয়াছে, কেহ কেহ অনুমান করেন, তাহা ‘এনক্‌’-চরিত্রের অনুকৃতি। যদিও তাহা হয়, আমাদের মতে, প্রতাপ-চরিত্র অধিকতর ঔজ্জ্বল্যসম্পন্ন। ‘এনক’ পাশ্চাত্যভাবপূর্ণ মনোহারিত্বের আধার, প্রতাপ জাতীয়-মহত্ত্বের আদর্শ।

 বিগত ১৩১১ সালের ১৮ই ফান্তুন বুধবার এই গ্রন্থের অনুবাদ শেষ হয়। কিন্তু নানা কারণে এত দিন ইহা প্রকাশ করিতে পারি নাই। এক্ষণে এই গ্রন্থ পাঠকগণের করকমলে অর্পিত হইল। বাঙ্গালাসাহিত্যের এক পার্শ্বে এই গ্রন্থ একটু স্থান পাইলেই আমার পরিশ্রম সার্থক জ্ঞান করিব।

“পৃথিবীর ইতিহাস” কার্য্যালয়,
হাওড়া।
৮ই ভাদ্র, ১৩১৮ সাল।

বিনীত
শ্রীদুর্গাদাস লাহিড়ী।

এনক আর্ডেন।

স্তরে স্তরে শৈলমালা—দূর-প্রসারিত;
বিদার সঞ্চার তায় গহ্বর সঞ্জাত।
ক্ষীণ তনু ঢালিয়াছে ক্ষুদ্র শৈবলিনী
সাগর-সঙ্গম-সাধে; বিক্ষুব্ধ গহ্বর,
পীতবর্ণ-বালুপূর্ণ ফেণপুঞ্জময়।
পার্শ্বে পোতাধিষ্ঠ-স্থান[১] —সঙ্কীর্ণ প্রাচীন।
দূরে তবকিত রক্তিম বরণ ছাদ
গ্রাম্য কুটীরের।[২] তদূর্দ্ধ বিরাজে গির্জ্জা—
জরাজীর্ণ ভগ্ন। গিরি’পরে বায়ুভরে।
সঞ্চালিত উচ্চচুড় ময়দার কল;
উর্দ্ধগতি দীর্ঘপথ তাহার উদ্দেশে।
পশ্চাতে গগনস্পর্শীবালুর পাহাড়,
তৃণাচ্ছন্ন ধূসরিত; বক্ষে স্মৃতিস্তম্ভ
সমাধির—পুরাকীর্ত্তি ‘ডেনিশ’ জাতির;
শোভমান তাহে আর, স্থালীর মতন,

নিম্নভূমি মনোহর—হরিৎ শ্যামল
‘হেজেল’[৩]পাদপে পূর্ণ,—ফল-লোতে যথা
শরৎ ঋতুতে আসে ফললোভী জন।


শত বরষের কথা। এই বেলাভূমে,
খেলিত শৈশব-খেলা শিশু তিন জন;—
তিন সংসারের তারা তিনটী আনন্দ।
‘এনি-লি’ কুমারী বালা, কমল কলিকা,
বন্দরে রূপের সেরা; বালক ‘ফিলপি’—
একমাত্র পুত্র সেই কলের কর্ত্তার।
‘এনক্ আর্ডেন্’ নাম, অনাথ বালক,
অসভ্য নাবিকপুত্র; পিতৃহীন এবে,
পোতমগ্নে বরষার বিষম ঝঞ্চায়।
বেলাভূমে পরিত্যক্ত নানা দ্রব্যজাত;—
কঠিন রজ্জুর স্তুপ কুণ্ডলী আকার;
মৎস্য ধরিবার জাল, কষায় বরণ।
নীলাম্বুর নীলজলে;—নোঙ্গর পড়িয়া।
ইতস্ততঃ, ফলক কলঙ্কপূর্ণ তার;
নৌকাগুলি বিপর্যস্ত—আছে অধোমুখে।

এই তীরে, পরিত্যক্ত এই সব মাঝে,
তিন জনে ধূলাখেলা খেলিত তাহারা।
গড়িত খেলার ঘর সিক্ত বালুকায়;
ভগ্নপ্রাণে নির্নিমেষে দেখিত চাহিয়া—
সাগর-তরঙ্গ তারে কেমনে ভাসায়।
শ্বেত উর্ম্মিমালা যত আসিত নিকটে,
উপরে উঠিত তারা—পলাইত দুরে।
ক্ষুদ্র পদচিহ্ন নিত্য পড়িত তাদের,
বিধৌত হইত নিত্য তরঙ্গ-বিক্ষেপে।


পর্ব্বতের সানুদেশে ক্ষুদ্র গিরিগুহা;
শিশুরা খেলিত তাহে কুটীর রচিয়া।
এক দিন সাজিত ‘এনক’ গৃহস্বামী,
অতিথি ‘ফিলিপ’; পরিবর্ত্ত পর দিন;
‘এনি’ কিন্তু কর্ত্রীরূপে নিত্য বিরাজিত।
কখনো এমন হ’তো,—‘এনক্’ একাই,
কর্ত্তা হ’য়ে কাটাইত সপ্তাহ সময়;
কহিত—“আমার গৃহ, গৃহিণী আমার।”
‘আমারও!’—কহিত ফিলিপ ভগ্নস্বরে,—
‘হইবে আমারে পুনঃ পালার সময়।’

দ্বন্দ্ব তাহে যদ্যপি বাধিত দুই জনে;
কর্তৃত্ত্ব করিত লাভ ‘এনক্’ বলিষ্ঠ।
‘ফিলিপের’ দুই গণ্ডে জলধারা বহি,
নীল চক্ষু ভাসাইত ক্ষুব্ধ রোষাবেগে;
কাঁদিয়া কহিত আর,—“ঘৃণা করি তোরে,
ঘৃণিত ‘এনক্’ তুই।” বিবাদ দেখিয়া,
বালিকা কাঁদিত অনুরাগে; কহিত সে,—
“মিনতি আমার এই, করো না বিবাদ
আমার কারণ দোঁহে; আমি উভয়েরি;
বালিকা বধূটী হ’য়ে রব চিরদিন।”


কুসুম-প্রতিম উষা কিশোর-কালের
ক্রমে অপগত; এবে নবীন অরুণ
কনক-কিরণ ঢালে প্রাণে উভয়ের;
দোঁহার হৃদয় ভাসে কিশোরীর প্রেমে।
ভালবাসা জানায় ‘এনক্’ স্পষ্টভাবে;
‘ফিলিপ’ নীরবে ভালবাসে; অনুরাগ
দেখার ফিলিপে বালা; অন্তরে ‘এনকে’
ভালবাসে,—আপনার মনের অজ্ঞাতে;
জিজ্ঞাসিলে কেহ তাহা অস্বীকার করে।

 ‘এনকের’ মনে এবে সুদৃঢ় সঙ্কল্প,—
আয়াসে অশেষ অর্থ করিবে সঞ্চয়,
কিনিবে তাহাতে নৌকা নিজস্ব করিয়া,
রচিবে এনির তরে একটা কুটীর।
সফল সাধনা; সুপ্রসন্না ভাগ্যদেবী;
শুভ দিন এনকের আসিল এমন,—
তরঙ্গ-তাড়িত তীরে বহু দূর মাঝে,
তার সম ভাগ্যবান না রহিল কেহ,
মৎস্যজীবী না জন্মিল সাহসী তেমন,
বিপদে সতর্ক কেহ তাহার মতন।
বর্ষাবধি কর্ম্ম করি সদাগরী পোতে,
হইল সুদক্ষ দৃঢ় নাবিকের কাজে;
উদ্ধারিল তিন বার তিনটী জীবন,
ভীষণ ভাটার স্রোতে সমুদ্রের মাঝে।
সকলের প্রীতিপাত্র হইল এনক।
একবিংশ বসন্তের নবীন বিকাশ।
এনক-জীবনে। সে এখন কিনিয়াছে
নিজের তরণী এক; এনির কারণ।
রচেছে কুটীর রম্য, কুলায়-সদৃশ।
পরিচ্ছন্ন মনোহর; সঙ্কীর্ণ যে পথ

উঠিয়াছে কলঘর পাশে,—সে কুটীর
এনকের, শোভমান্ তারি মধ্যপথে।


সোনার শরতে এক অপরাহ্ণ-কালে,
আনন্দ-উৎসবে মাতি যুবকের দল,
কাঁধে লয়ে ছোট-বড় ‘ব্যাগ’, থলি, ঝুড়ি,
পাড়িতে ‘হেজেল’-ফল গিয়াছিল বনে।
অসুস্থ জনক, তার পরিচর্যা-হেতু,
এক ঘণ্টা বিলম্ব হইল ফিলিপের।
পল্লবাগ্রভাগ যথা হইয়া আনত
পক্ষপুট বিস্তারিয়া গহ্বরের প্রতি,—
পাহাড়ের সেইখানে উঠিলে ফিলিপ,
দেথিল যুগল মূর্ত্তি—এনি ও এনক,
বসিয়া রয়েছে দোঁহে হাতে হাত রাখি।
ফিলিপের ধূসর বৃহৎ চক্ষুর্দ্বয়,
ঋতু-নিপীড়িত রুক্ষ্ম লাঞ্ছিত বদন,
আরক্তিম হইল যুগপৎ; বিচ্ছুরিল
প্রেমের পবিত্র জ্যোতি সে মুখমণ্ডলে,—
বেদী মাঝে পূত শান্ত দীপ্ত শিখা সম।
‘এনি আর নহে তার’ দেখিল ফিলিপ—

নয়নে বদনে লেখা স্পষ্ট দোঁহাকার।
দুই জনে মুখোমুখী মিশামিশি যবে,
স্বরভঙ্গ ফিলিপের; যাইল সে দূরে।
সবিষাদে ব্যথিত অন্তরে অবশেষ,
বনের গহ্বর-প্রান্তে লুকাইল মুখ।
সকলে প্রমত্ত যবে আনন্দ-কল্লোলে;
প্রগাঢ় আঁধার-ভরা ফিলিপের হৃদি
না দেখিল কেহ আর। উঠিল ফিলিপ,
চলিল একাকী পুনঃ—অন্তরের এক
অতৃপ্ত পিয়াসা চির হৃদয়ে বহিয়া।


পরিণয়ে এনক এনির সম্মিলন।
আনন্দের ঘটাধ্বনি বাজিল গির্জ্জায়;
আনন্দের বর্ষরাজি হাসিল হরষে।
সাতটি সুখের বর্ষ,—সৌভাগ্যের আর
স্বাস্থ্যের আধার সাত সুখের বৎসর,—
পবিত্র দাম্পত্য প্রেমে যশস্কর শ্রমে
হইল অতীত, সন্তান-সন্ততি সহ।
প্রথমে তনয় এক; প্রথম শিশুর
সেই প্রথম ক্রন্দন—জাগাইয়া দিল

মনে সঞ্চয়ের এক পিয়াসা দারুণ;—
ভালরূপে সন্তানের শিক্ষাদান তরে,
পিতামাতা দোঁহাকার মিটাইয়া সাধ।
দুই বর্ষ পরে পুনঃ জন্মিল কুমার;
আশামূলে অঙ্কুরিত নবীন মুকুল।
তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ ঘোর সাগরের ক্রোড়ে,
কিম্বা কোন গ্রামান্তরে যাইলে এনক;
নিরালা কুটীরে শিশু কুসুম-পুতুলি—
জননীর সুখশান্তি সান্ত্বনা-সম্বল।


কর্ম্মঘোরে গৃহছাড়া সতত এনক।
এনকের শ্বেত-অশ্ব-চালিত শকট,
লবণাম্বু-গন্ধময় পেটিকার মৎস্য,
শীতবাত্যানিপীড়িত রুক্ষ্ম রক্ত-মুখ,
কেবল বিপণী-মাঝে নহে প্রকটিত;—
বালুর-পাহাড়-প্রান্তে পত্রাবৃত পথে,
ধনীর প্রস্তরময় দৃপ্ত সিংহদ্বারে,
কর্ত্তিত-ময়ুরাকার-ঝাউ-শোভমান—
নিভৃত সে উদ্যান-ভবন মাঝে আর,

শুক্রবাসরীয় খাদ্য[৪] মৎস্য যোগাইতে,
গতিবিধি নিয়মিত ছিল এনকের।


এক অঙ্ক পরিবর্ত্ত। মানব-জীবন,
নিয়তির চক্রে সদা পরিবর্ত্তশীল।
সেই ক্ষুদ্র বন্দরের উত্তরের দিকে,
পাঁচ ক্রোশ ব্যবধানে, হয়েছিল এক
বৃহত্তর পোতাশ্রয়; ছিল গতিবিধি
এনকের স্থলপথে কভু জলপথে।
দৈবের ঘটনা এক,—উঠিতে মাস্তুলে
স্খলিল চরণ, পড়িল এনক নীচে;
ভাঙ্গিল পঞ্জর; ধরিয়া উঠাতে হ’ল।
সেই স্থানে রোগের শুশ্রুষা যে সময়,
প্রসবিল পত্নী তার তৃতীয় কুমার—
রুগ্ন নব শিশু এক। করিল গ্রহণ,
এনকের ব্যবসায় অন্য ব্যবসায়ী;
অন্নগ্রাসে হন্তারক হইল বিষম।

ঈশ্বর বিশ্বাসী দৃঢ়, গম্ভীর এনক,
অকর্ম্মণ্য শয্যাশায়ী হইয়া এখন,
সংশয়ে হতাশে ঘোর প্রমাদ গণিল;
নিশি-শেষে নিদ্রাঘোরে দেখিল স্বপন
মর্মন্তুদ,—শিশুরা তাহার দারিদ্র্যের
দারুণ যন্ত্রণা ভুঞ্জে, অন্ন-কষ্ট পায়;—
আর তার—আদরের আদরিণী এনি,
ভিখারিণী পথে পথে। কাতরে ডাকিল—
“জগদীশ! রক্ষা কর বিপদে তাদের।
ঘটে যাহা ঘটুক আমার ভাগ্য’পরে।”
ঈশ্বরে জানায় যবে প্রার্থনা এরূপ,
আসি উপস্থিত তথা পোতাধ্যক্ষ এক—
যাঁহার অধীনে কর্ম্ম করিলা এনক।
জানিতেন এনকের গুণ সবিশেষ;
দৈব দুর্ঘটনা তার শুনি সেই হেতু,
আসিলেন পাশে তার; কহিলেন ধীরে,—
“চীনদেশে যাইবে জাহাজ আমাদের,
আছে প্রয়োজন তার কর্মচারী এক
দ্রব্য-জাত-রক্ষা-হেতু; যাবে কি এনক?
ছাড়িবে জাহাজ এই বন্দর হইতে।

যদিও বিলম্ব আছে সপ্তাহ কয়েক,
সে কাজে নিযুক্ত তুমি হবে কি এনক?”
সম্মতি-জ্ঞাপনে নাহি হইল বিলম্ব;
আনন্দ ধরে না প্রাণে—ভগবান যেন
শুনিয়া প্রার্থনা তার দিলেন উত্তর।


দুর্দ্দৈবের ছায়া যেন নহে গাঢ়তর।
খণ্ডমেঘে আবরিলে সূর্যরশ্মি-পথ,
দূর বারিধির বক্ষে সঞ্চরে যেমতি
আলোকের ক্ষুদ্র দ্বীপ—অল্পক্ষণস্থায়ী;
ভবিষ্য আঁধারে দেখে এনক তেমতি।
তথাপি ভাবিল মনে—‘যাইলে বিদেশে,
কি হবে পত্নীর দশা, পুত্রদের আর।’
অনেক চিন্তার পর করিল সুস্থির,—
বেচিবে আপন পোত,—আহা! ভালবাসে
কত যারে; সমুদ্রের ঘোরাবর্ত্ত মাঝে
কাটিয়াছে কত কাল। যার ক্রোড়াশ্রয়ে!
অশ্বারোহী আপন ঘোটকে জানে যথা,
সে জানে তেমন যারে! বেচিবে তথাপি!
পাইবে বেচিয়া যাহা, কিনি পণ্যদ্রব্য,

দোকান সাজায়ে দিবে এনির কারণ।
সেইমত দ্রব্যজাত থাকিবে দোকানে
চাহে যাহা বন্দরের যাত্রীরা নিয়ত।
বড় আশা—বিদেশে যাইলে কিছুদিন
বজায় রাখিবে এনি গৃহস্থালী তার।
এনক ভাবিল মনে-সে কি পারিবে না
বিদেশে যাইতে কভু বাণিজ্য কারণ?
পারিবে না যাইতে কি একাধিক বার
দূর সমুদ্রের পথে প্রয়োজন হ’লে?
অবশ্য পারিবে!—দুই বার তিন বার—
যত বার আবশ্যক হয়! প্রত্যাবৃত্ত
হবে গৃহে ধনবান হয়ে অবশেষে;
বৃহৎ পোতের এক হবে অধীশ্বর,
পাবে লাভ পূর্ণরূপে, স্বচ্ছন্দ জীবনে;
ভালরূপে বিদ্যাশিক্ষা দিবে শিশুগণে,
কাটিবে শান্তির দিন স্বগণের মাঝে।


অন্তরে সঙ্কল্প হেন করিয়া এনক,
গৃহ অভিমুখে ধীরে হ’ল অগ্রসর।
সম্মুখেই ভেটিল এনির পাংশু মুখ;

ক্রোড়ে লয়ে সদ্যোজাত রুগ্ন শিশুটিরে,
কতই যতনে এনি পরিচর্য্যা করে।
এনকে দেখিয়া এনি আনন্দের স্বরে,
তনয়ের ক্ষীণতনু সযতনে ধরি,
আগুবাড়ি এনকের দেয় ক্রোড়ে তুলে।
ক্রোড়ে লয়ে হাত দিয়া দেখে প্রতি অঙ্গ,
আহা!—শিশু কত শীর্ণ! অনুমান করে
লঘুতার; দেখে আর বিমর্ষ বদন
শিশুটির—পিতৃসম। না হ’ল সাহস—
আপন প্রস্তাব-কথা কহিতে সেদিন;
ভাঙ্গিল মনের ভাব পরদিন প্রাতে।


এনকের স্বর্ণাঙ্গুরী পরিয়া আঙ্গুলে,
এই সে প্রথম দিন—বিবাহের পর—
জানায় আপত্তি এনি পতির ইচ্ছায়।
তীব্র প্রতিবাদ নহে কোন্দলের রোলে,
বিনয়ে মিনতি ক’রে ছল ছল আঁখি।
বিষাদ চুম্বনে কত দিন রাত্রি কাটে;
না টুটে সংশয় তাহে—আতঙ্ক প্রবল!
মিনতি করিয়া এনি প্রার্থনা জানায়,—

“যদি ভালবাস নাথ! এই অভাগীরে,
যদি ভালবাস তুমি প্রিয় শিশুগণে,
যেওনা বিদেশে।” এনক ভাবিল মনে,—
‘নাহি ভাবি বিন্দুমাত্র আপন ভাবনা;
না চাহি নিজের সুখ; উদ্দেশ্য কেবল
পত্নী আর পুত্রদের দারিদ্র-মোচন।’
সে হেতু সে না মানিল কোন অনুরোধ।
ব্যথা দিয়ে এনির কোমল প্রাণে এবে।
অটুট সঙ্কল্প ধায় উদ্দেশ্য-সাধনে।


বিক্রীত হইল পোত; যে ছিল তাহার
সমুদ্রের সহযাত্রী—বন্ধু পুরাতন।
হইল সঞ্চিত তাহে এনির কারণ
দোকানের আসবাব, পণ্যদ্রব্য আর।
পথ পার্শ্বে ক্ষুদ্র ঘর ছিল বসিবার;
হইল সজ্জিত তাহা কাঠের তবকে;
ভাণ্ডারের স্থান হৈল কোণে এক দিকে।
হাতুড়ি, কুড়ালি আর করাতে, বেধকে,
বাজিল ঝঞ্জনা; সে ঝঞ্চনা শেলসম

পশিল এনির কাণে; মনে হ’ল তার
ফাঁসিকাষ্ঠ হ’তেছে প্রস্তুত তার তরে।
শেষ দিন!—যে দিন যাইবে গৃহ ছাড়ি,
সে দিনও খাটিয়া থাটিয়া সারা বেলা,
নাড়িল গৃহের যত সামগ্রী এনক।
ক্ষুদ্র গৃহে অল্প স্থান, সাজাইলা তাহে
দ্রব্যজাত সুকৌশলে কিবা পরিপাটী!
যেন দেবী প্রকৃতি আপনি মুর্ত্তিমতী
বীজাঙ্কুরে সঞ্চারিলা ফুল-ফল-তরু।
সাঙ্গ করি শেষ কাজ আয়াসে এনক
(এনির সুখের তরে দৃঢ়ব্রত সদা)
শান্তি হেতু উঠিল উপরে শয্যাগৃহে,
ঘুমাইলা গাঢ় নিদ্রা প্রভাত অবধি।


বিদায়ের প্রাতঃকাল! এনকের চোখে
প্রতিভাত আনন্দের উৎসাহের ছবি।
অমঙ্গল জাগে যত এনির অন্তরে,
হাসিয়া উড়ায়ে দিল তুচ্ছ জ্ঞান করি।
তথাপি সে ঈশ্বর-বিশ্বাসী দৃঢ় যেই;
সাধিলা প্রক্রিয়া গূঢ়;—আত্মার মিলন

যাহে পবিত্র আত্মায়; করিলা প্রার্থনা
নত জানু; মাঙ্গিল মঙ্গল স্ত্রী-পুত্রের;
ভাবিল বিন্দুমাত্র আপনার তরে।
সম্ভাষিয়া কহিল এনিকে অবশেষ,—
“শুভযাত্রা এই! ঈশ্বরের করুণায়,
শুভদিন অনিশ্চয় আসিবে ত্বরায়।
রেখ’ প্রিয়ে, পরিপাটী গৃহস্থালী মোর;
ফিরিয়া আসিব শীঘ্র; এত শীঘ্র—তাহা
অনুভবে নারিবে জানিতে কদাচন।”
দোলাইয়া ধীরে ধীরে শিশুর দোলন,
কহিল এনক পুনঃ—“বাছাটা আমার,
একে অতি ক্ষুদ্র, তায় শীর্ণ ক্ষীণ দেহ;
ভালবাসি সে হেতু অধিক আরো আমি।
করিবেন শিশুর মঙ্গল জগদীশ।
আসিব ফিরিয়া যবে বিদেশ হইতে,
কতই আনন্দ হবে বাছার আমার।
বসিবে আমার ক্রোড়ে আসি, শুনাইব
বিদেশের কাহিনী কতই। এস এনি,
বিদায়ের পূর্ব্বে কেন বিমর্ষ সদাই?”
বাক্যের শহর ছোটে আশা-আশ্বাসের,

এনির হৃদয়ে হয় আশার সঞ্চার।
কিন্তু যবে চিন্তার বিষয় গাঢ়তর,
ব্যক্ত হয় নাবিকের কর্কশ ভাষায়,
ঈশ্বর বিশ্বাসে আর অদৃষ্ট-নির্ভরে।
দেয়উপদেশ পুনঃ; এনি অন্যমনা!—
পশিয়া না পশে কথা কাণে; যেন কোন
গ্রাম্যবালা নির্ঝরে আনিতে গিয়া বারি,
কলসী রাখিয়া তলে, চিন্তায় মগন
প্রেমিকের; শুনিয়া না শুনে কিছু কাণে;
দেখিয়া না দেখে বারি উছলিয়া পড়ে।


এনি কহে অবশেষ,—“তুমি জ্ঞানবান
হে এনক! তবু জাগে মনে দৃঢ় মম,
আর না দেখিতে কভু পাইব তোমায়।”


কহিল এনক,—“দেখিব তোমায় আমি।
যাব’ আমি যে জাহাজে, যাবে এই পথে;
(যাত্রার তারিখ এবে কহিলা এনক)
দেখিও আমায় তুমি দুরবীণ দিয়া;
হাসিয়া উড়ায়ে দেও বিপদ আশঙ্কা।”

সমাগত হৈল ক্রমে বিদায়ের দিন।
এনিরে এনক পুনঃ কহে,—“প্রাণপ্রিয়ে!
হও প্রফুল্ল হৃদয়; রহ শান্তি-সুখে;
শিগুগণে করহ পালন সযতনে;
যাইব নিশ্চয় আমি!—রেখ গৃহস্থালী
বজায় আমার—না ফিরিব যত দিন।
না ক’রো আশঙ্কা কিছু আমার কারণ;
কিম্বা থাকে যদি শঙ্কার কারণ কিছু,
সে উদ্বেগ ক’রো সমর্পণ ভগবানে—
অকুল পাথারে যিনি নিত্য কর্ণধার।
নহেন বিরাজমান কোন্ দেশে তিনি?
এ দেশ ছাড়ি বা যদি, তাঁরে ছাড়া কই?
অর্ণব তাঁহার, তিনি অর্ণবের রূপ,
সৃষ্টিকর্ত্তা অর্ণবের তিনিই আবার।”


উঠিল এনক; এনি দুঃখভারানত;
উঠাইলা তাহে দৃঢ় বাহু-আলিঙ্গনে;
করিলা চুম্বন শিশুদের; চমকিত
হৈল তারা, না বুঝিল ঘটনা বিশেষ।
তৃতীয় শিশুটি, রুগ্ন যেটি, সারারাতি

কাঁদিয়া জাগিয়া, জ্বর-ভোগে মগ্ন এবে
ঘুমঘোরে; চাহে জাগাইতে তারে এনি।
নিবারি এনক কহে,—‘দেও ঘুমাইতে।
কাজ নাই জাগাইয়া। না থাকিবে কভু
শিশুর স্মরণে এ সকল কথা কিছু।”
এত বলি চুমিল শিশুর শয্যা স্নেহে।
অঘন কুঞ্চিত কেশ শিশুর মস্তকে,
কাটিল তখন এনি গুটিকত তার;
সমর্পিল স্মৃতিচিহ্ন এনকের করে।
রাখিল এক তাহা কতই যতনে
জীবনের সারা ভবিষ্যৎ।  অবশেষে
তাড়াতাড়ি লইল গাঁটরি আপনার,
মাঙ্গিল বিদায় শেষ হস্ত-সঞ্চালনে,
চলিল গন্তব্য পথে দূর বিদেশের।


সেই দিন!—বলেছিল ছাড়িবে জাহাজ
যেই দিন! চাহিয়া আনিল এনি এক
দূরবীণ; ব্যর্থ চেষ্টা তথাপি তাহার।
না পারিল সম্ভবতঃ মিলাইতে কাচ—
দৃষ্টি উপযোগী করি; অথবা কম্পিত

হস্ত তার, ছল ছল দু’নয়ন ঘোর,
সে হেতু সে না পাইল দেখিতে এনকে।
দাঁড়ায়ে দোদুল্য ‘ডেকে’—জাহাজ উপরে,
দেখা’ল বিদায় চিহ্ন এনক যখন;
সে শুভ মুহূর্ত্ত এনি না দেখিল আর,
চলিল জাহাজ দুর সমুদ্রের মাঝে।
দেখা গেল যতক্ষণ জাহাজের পাল,
চাহিয়া দেখিল এনি; ক্রমে যবে সব
হইল অদৃশ্য, যেন ডুবিল সাগরে,
কাঁদিতে কাঁদিতে এনি প্রত্যাবৃত্ত হ’ল।
বিলাপিলা বহু, মৃতের উদ্দেশে যথা
শোকতপ্ত আত্মজন; ভগ্নপ্রাণ পুনঃ
নিয়োজিলা সাধিতে স্বামীর অভিপ্রায়।
কিছুই উন্নতি কিন্তু নাহি ব্যবসায়ে;
না জানে দোকানদারী বিকিকিনি ভাল;
মিথ্যা কথা না পারে কহিতে কদাচন;
জানে ছলনা, কিসে লাভ হয় বড়;
অতি দর চেয়ে পরে কম দর নিতে—
জানে কখনো বালা; আদেশ-পালন
শুধু তার—‘কি বলিবে এনক’ এহেতু।

না জানে ব্যবসা কিছু! তাই কত বার,
দারুণ সঙ্কটে প’ড়ে অভাবের দিনে,
বেচিল কতই দ্রব্য কত কম দরে—
 যে দরে কিনিয়াছিল তারো কত কমে!
সেই হেতু হইল দোকান দেউলিয়া,
দহিল হৃদয় দুঃখে দেখি পরিণাম।
একে একে আশামূল হইল উচ্ছেদ।
না আসিল এনকের কোনই সংবাদ।
অতি কষ্টে দিনান্তে আহার-মুষ্টি যোটে;
জীবন নীরবে সহে মরম বেদন।


রুগ্ন জন্মাবধি সেই তৃতীয় শিশুটি;
ক্রমে পীড়াবৃদ্ধি তার; যদিও জননী।
রাখে সন্তর্পণে, মাতৃস্নেহে যথাশক্তি।
তথাপি হইতে পারে—ছাড়িয়া শিশুরে
কার্য্যের আহ্বানে সদা ব্যস্ততার হেতু,
অথবা অভাব ছিল—যথা প্রয়োজন,
পরিচ্ছদ আর খাদ্য-সামগ্রীর; কিংবা
পারিত না যোগাইতে যথাযোগ্য ব্যয়
শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকে; অথবা যেহেতু হোক,

দারুণ যাতনা ভুঞ্জি, জীর্ণ দেহ হ’য়ে,
এক দিন, জননীর চোখে ধূলি দিয়ে,
পলাইল সরল নিস্পাপ আত্মা তার;
পলায় পিঞ্জর ত্যজি বিহঙ্গ যেমতি।


আসিল রাখিয়া যবে কবরের মাঝে
শিশুটিরে আপনার; সেই সে সপ্তাহে,
প্রীতিভরা সরল অন্তর ফিলিপের,
এনির শান্তির তরে কামনা যাহার,
আত্মগ্লানি পূর্ণ হ’ল;—ছিল উদাসীন
(এনকের গৃহত্যাগ—কত দিন হ’ল
লয় নাই কোন তত্ত্ব তার পর আর!)
এতক যেহেতু তার প্রতি; মনে মনে
কহিল সে,—“এখনো দেখিতে পারি তারে,
হইলে হইতে পারে কিছু সুখী তাহে।”
চলিল ফিলিপ। ছিল যে দোকান-ঘর
বাটীর সম্মুখ-দিকে, নিরালা এখন,
অতিক্রম করি তাহা, দাঁড়াল ফিলিপ
থষকিয়া অন্দরের দ্বারে ক্ষণকাল।
দ্বারদেশে করিল আঘাত তিন বার;

না খুলিল কেহ; প্রবেশিল আপনিই।
কবরে রাখিয়া আসি প্রাণের পুতলি,
সদ্যঃ শোকাচ্ছন্ন এনি, বসে ছিল একা,
আনমনা, অপরের প্রতি লক্ষ্যহীন;
প্রাচীরের দিকে সুধু ফিরাইয়া মুখ,
আকুল নয়ন ঝরে। ফিলিপ তখন,
দাঁড়াইয়া পার্শ্বদেশে, কহে ভগ্নস্বরে,—
“এনি, আসিয়াছি আমি, অনুগ্রহ চাই।”


উত্তরিলা শোকতপ্ত প্রবল আবেগ,—
“অনুগ্রহ! অনাথিনী দুঃখিনীর কাছে!”
কহিল বসিবার তরে একবার।
দিশাহারা ফিলিপের সঙ্কুচিত মুখ;
লজ্জা আর স্নেহে হৃদে বাধিল সংগ্রাম;
নিকটে বসিয়া পুনঃ কহিল ফিলিপ,—
“জানাতে যে কথা আজি আসিয়াছি আমি,
এনক—তোমার স্বামী, তাঁর অভিপ্রেত।
কহিয়াছি কতবার—করেছ পছন্দ
শ্রেষ্ঠ জনে তুমি, আমা দোঁহাকার মাঝে
প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় যেই; জাগিত জীবনে

যে বাসনা, নিয়োজিয়া শক্তি আপনার,
সমর্পিয়া মনঃপ্রাণ, করিত পূরণ;
না মানিত বাধা-বিঘ্ন কার্য্য-সম্পাদনে।
যাইল কি হেতু সেই কষ্টকর পথে
বিদেশের, একাকিনী রাখিয়া তোমায়?
আত্মতৃপ্তি তরে সে নাহি ভ্রমিতে গেল।
পৃথিবীর নানা স্থান! উদ্দেশ্য তাহার—
অর্থ উপার্জ্জন,—বিদ্যাশিক্ষা শিশুদিগে।
দিতে ভালমতে,—যে শিক্ষা নাহিক তার,
নিজের তোমার; আকাঙ্ক্ষা তাহার এই।
সে যদি ফিরিয়া আসে গৃহে পুনরায়,
দেথে যদি বিফলে কাটিয়া যায়—
মহামূল্য প্রভাত-জীবন শিশুদের;
কত না হইবে ক্ষুন্ন! রহিবে সে ক্ষোভ
মরণের পরে মনে,—যদি উচ্ছৃঙ্খল
হয় শিশুগণ প্রান্তর মাঝারে যথা
অশ্ব অশিক্ষিত। এনি, শুন মোর বাণী,
বাল্যাবধি পরিচয় তোমায় আমায়,
পর নহি কদাচ আমরা। সে কারণ,
মিনতি আমার এই—ভালবাস যদি

এনকেরে, ভালবাস যদি শিশুদিগে,
না করিও প্রত্যাখ্যান আমার প্রস্তাবে।
ভাল, সেই ইচ্ছা যদি, এনক আসিয়া।
শোধিবে আমার ঋণ; আমি ধনবান,
অবস্থা আমার ভাল। দেহ অনুমতি,
বালক-বালিকা-গণে দেই বিদ্যালয়ে।
চাই এই অনুগ্রহ—এসেছি এ হেতু।”


প্রাচীরের অন্য দিকে ফিরাইয়া মুখ,
উত্তরিলা এনি,—“না পারি চাহিতে আর।
তোমার মুখের পানে,—এত জ্ঞানহারা,
এত অবসন্ন প্রাণ। এসেছ যখন,
তখনি আমার দ্রবিল হৃদয় দুঃখে;
এখন আবার দ্রবিল করুণার প্রস্রবণে
ডুবাইলে দুখিনীরে। কে যেন আমার
কাণে কাণে কহে,—‘এনক বাঁচিয়া আছে।’
করিবে সে পরিশোধ তোমার এ ঋণ;
অর্থ-ঋণ হ’বে পরিশোধ, না হইবে
তব করুণার!” জিজ্ঞাসে ফিলিপ পুনঃ,—
“তবে কি বাসনা মোর করিবে পূরণ?”

এনি ফিরাইল মুখ, দাঁড়াইল উঠি;
প্লবমান্ দু’নয়ন ঘোর, ন্যস্ত হ'ল
ফিলিপের প্রতি; স্থিরদৃষ্টে ক্ষণকাল
দেখিয়া লইল সেই করুণ বদন;
মঙ্গল প্রার্থনা তার করি অবশেষে,
আবেগে ধরিল হস্ত; দেখাল উচ্ছ্বাস
কৃতজ্ঞের; সঙ্গে সঙ্গে যাইল বাহিরে
কুটীরের, ক্ষুদ্র বাগানের সীমানায়।
ফিলিপ ফিরিল গৃহে উল্লাস-উৎফুল্ল।


দিল বিদ্যালয়ে বালক-বালিকাদ্বয়ে,
দিল পুস্তক কিনিয়া প্রয়োজন-মত;
কর্ত্তব্য যেরূপ আপন তনয় প্রতি,
করিল পালন দোঁহে ফিলিপ তেমতি,
যোল আনা শিশুদের হইল আপন।
অপরন্তু, এনির সুনাম-রক্ষা-হেতু,
নিষ্কর্ম্ম লোকের মিথ্যা রটনার ভয়ে,
অন্তরের প্রিয় আশা রাখিত অন্তরে,
ক্কচিৎ করিত তার দ্বারে পদার্পণ।
তবে পাঠাইত ভেট শিশুদের সনে

নব নব; কত ফলমূল বাগানের,
অসময়ে প্রস্ফুট গোলাপ প্রাচীরের,
অথবা শশক ধরি উপত্যকা হ’তে;
আরো পাঠাইত কত, যখন তখন,
(কত সূক্ষ্ম জন্মিয়াছে সেই অছিলায়,
দান মনে করি পাছে ক্ষুব্ধ হয় বালা),—
কলের ময়দা আপনার,—যে কলের
শিশধ্বনি নিয়ত ধ্বনিত সে প্রদেশে।


না পারে ফিলিপ কিন্তু করিতে নির্ণয়
গভীরতা এনির অন্তরে; প্রীতিভরা।
রমণী-হৃদয়, অসীম সে কৃতজ্ঞতা,
কদাচ খুঁজিয়া পায় অস্ফুটন্ত ভাষা
ধন্যবাদ প্রকাশিতে, আসিলে ফিলিপ।
শিশুদের সর্ব্বময় পরন্তু ফিলিপ।
দূর পথ প্রান্ত হতে দৌড়ে আসে তারা,
হৃদয়ের সম্ভাষণে সম্ভাষিতে তারে।
তাঁহার বাড়ীর যেন প্রভুই তাহারা;
তাঁহার সে কলঘর—যেন তাহাদের;
সামান্য কষ্টের কিম্বা হর্ষের কথায়,



পরিপূর্ণ করে ফিলিপের স্থির কর্ণ।
কাঁধে চড়ে, খেলা করে তাঁহাকে লইয়া;
‘ফাদার ফিলিপ’ বলি করে সম্বোধন।
ফিলিপের প্রতি যবে দৃঢ় ভালবাসা,
ধীরে ধীরে ভুলিল এনকে শিশুগণ।
এনকের স্মৃতি এবে তাহাদের মনে,
স্বপ্নদৃষ্ট অনিশ্চিত ছায়ামূর্ত্তি সম;
ঘোর উষাকালে যথা বিটপী মাঝারে,
অস্ফুট চঞ্চল মুর্ত্তি, আপনি সঞ্চরি,
আপনি উবিয়া যায়—কে জানে কোথায়!
দেখিতে দেখিতে আজি দশ বর্ষ কাল,
গৃহস্থালী জন্মভূমি ত্যজেছে এনক,
তার পর নাহি আর কোনই সংবাদ।


এক দিন অপরাহ্নে হেন সংঘটন,
যাইবে অনেকে বনে ‘হেজেল’ পাড়িতে;
এনির শিশুরা সাথে যাবে অভিলাষী;
এনিও যাইবে সঙ্গে করেছে মনন।
যাইবারে অনুরোধ করিল শিশুরা
প্রিয় ‘ফাদার ফিলিপে’ (ডাকিত তাহারা

এই নামে); ভেটিলা ফিলিপে কলঘরে,
কুসুম-পরাগ-মাঝে সদাশ্রমরত
মধুমক্ষিকার প্রায়, শ্বেতবর্ণ-দেহ—
গোধূম-চূর্ণক-সমাচ্ছন্ন; নিবেদিলা,—
“চলহ মোদের সাথে হে পিতঃ ফিলিপ।”
অস্বীকার যেই, ধরিলা বসন টানি;
হাসিলা ফিলিপ, জ্ঞাপিলা সম্মতি পুনঃ
তাদের ইচ্ছায়; এনিও যে সঙ্গে ছিল—
নহে কি সে হেতু! চলিল সকলে তারা।
উঠিতে সে ক্লান্তিকর বালুর পাহাড়ে,
পল্লবাপ্রভাগ যথা আছিলা আনত
পক্ষপুট বিস্তারিয়া গহ্বরের প্রতি;
 অর্ধপথে—সেই স্থানে—অবসন্ন এনি;
একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিল তখন;
“একটু বিশ্রাম করি”— কহিল অস্ফুট।
বসিল বিশ্রাম হেতু সে সাথে ফিলিপ,
হরষিত মন। ছুটিল শিশুর দল
আনন্দ-কল্লোলে; ত্যজিল তাদের সঙ্গ;
ডুব দিল হেজেলের শ্বেত পত্র মাঝে
অসংবদ্ধ; উতরিল গহ্বর ভিতরে;

বিস্তারিল, বেঁকাইল, ফেলিল ভাঙ্গিয়া
সহজ-ভঙ্গুর সেই অবিনম্র শাখা;
ছিঁড়িতে লাগিল পিঙ্গল ফলের গুচ্ছ;
আরম্ভিল পরস্পর কোলাহল ঘোর,
অরণ্যের চারিভিতে, এদিকে সেদিকে।


এনি যে নিকটে ছিল—ভুলিল ফিলিপ
রহিয়া তাহার পাশে; জাগিল স্মরণে
বিষাদের দিন ঘোর-মর্ম্মাহত যবে
নিদারুণ—বৃক্ষ-আড়ে লুকাইলা মুখ।
কহিল সে অবশেষ তুলিয়া মস্তক,
“শুন এনি, শিশুদের আনন্দ-কল্লোল।
গহ্বরের নীচে বনমাঝে; হয়েছ কি
ক্লান্ত তুমি বড়?” না দিল উত্তর এনি।
জিজ্ঞাসিল পুনঃ,—“হয়েছ কি ক্লান্ত বড়?”
হস্তে আবরিল এনি আপন বদন।
ক্রোধের সঞ্চার তাহে ফিলিপের মনে।
“ডুবেছে জাহাজ” কহে,—“ডুবেছে জাহাজ”
কেন বৃথা আশা তার? কেন বধ কর
আপনারে অকারণ? কেন কর আর

পূর্ণরূপে পিতৃমাতৃহীন শিশুগণে?”
উত্তরিল এনি,—“না ভাবি কখনো হেন;
না জানি কারণ, কেন শিশুদের স্বরে
জাগাইয়া দেয় মনে আমি অনাথিনী!


কিছু সন্নিকট আসি কহিল ফিলিপ,—
‘শুন এনি, মনের কামনা মম এক
এতকাল আসিয়াছি করিয়া পোষণ;
জানি না প্রথমে কবে জেগেছে সে মনে।
জানি শুধু একদিন পাইবে প্রকাশ।
দীর্ঘ দশ বর্ষ কাল নিরুদ্দেশ যেই,
আছে কি বাঁচিয়া আজি? অসম্ভব এনি!
আশার অতীত কথা! ব্যক্ত করি তাই,
মনোভাব মম। বড় ব্যথা বাজে প্রাণে,
দরিদ্র অভাবগ্রস্ত যেহেতু তোমরা।
না পারি করিতে উপকার, মিটাইয়া
সাধ আপনার—যে তক না হও তুমি—”
(কহিতে সঙ্কোচ আসে ফিলিপের মুখে)
“বলুক চঞ্চল লোকে রমণীর মন;
জান তুমি, অনুমানি, আমার হৃদয়;

মনে এই আশা—পত্নী তুমি হও মম।
দেখাইব আমি পিতার মতন স্নেহ
তোমার সন্তানগণে; অনুমানি হেন
পিতৃসম ভালবাসে তারাও আমায়।
আমিও নিশ্চয় জানি—ভালবাসি আমি
আপন তনয় সম। বিশ্বাস আমার,
এখনো যদ্যপি কর বিবাহ আমায়,
এত অনিশ্চিত বিমর্ষ বর্ষের পর,
আবার হইতে পারি সুখী দুই জনে,—
ঈশ্বরের করুণায় যদি এ ঘটন।
বিচার করিয়া দেখ; আমি ধনবান,
না আছে আত্মীয় কেহ, চিন্তার সামগ্রী,
ভারাক্রান্ত নহি কিছু; ভাবনার শুধু
তনয় তনয়া তব, আর তুমি মম।
পরিচয় বাল্যাবধি তোমায় আমায়,
কত ভালবাসি আমি—কি জানিবে তুমি?”
উত্তরিলা এনি; কহিলা মরমস্পর্শী;—
“করিয়াছ পদার্পণ আমাদের গৃহে
ঈশ্বরের দূত সম পবিত্র অন্তরে।
মঙ্গল বিধান তব করুন ঈশ্বর;

পুরস্কার লভ তুমি জগদীশ পাশে
সুখকর দ্রব্য কিছু আমার অধিক।
ভালবাসা দুই বার না—জানি কেমন!
দিতে পারি কখনো কি সেই ভালবাসা,
এনকে দিয়েছি যাহা; অসম্ভব কথা!
একি জিজ্ঞাসিছ তুমি!” কহিল ফিলিপ,—
“পরিতৃপ্ত হব আমি পাইলে কিঞ্চিৎ
অল্প ভালবাসা এনকের তুলনায়।”
কতই সন্ত্রস্ত এনি উচ্চকণ্ঠে কহে,—
“হে প্রিয় ফিলিপ! করহ অপেক্ষা অল্প;
আসে যদি এনক আমার! নাই আশা
আসিবার তার! তবু করহ অপেক্ষা
বর্ষ এক! এক বর্ষ—বেশী দিন নয়;
এক বর্ষে হইব অভিজ্ঞ সুনিশ্চয়;
করহ অপেক্ষা কিছু।” কহিল ফিলিপ
ভগ্নস্বরে,—“কাটায়েছি সারাটি জীবন
এই অপেক্ষায় এনি! করিতে পারিব
আরো অপেক্ষা কিঞ্চিৎ।” কান্দিয়া কহিলা
বালা,—“না-না, বাধ্য আমি তোমার নিকটে!
পাইবে প্রতিজ্ঞা মম, দেখি বরষেক।

নারিবে কি তুমি করিতে পালন
এক বর্ষ আমার মতন?” উত্তরিলা
ফিলিপ আবার,—“অবশ্য পালিব বর্ষ।”


ক্ষণকাল নীরব দুই’জনে মৌনপ্রায়।
সঞ্চালিত ফিলিপের কটাক্ষ সহসা।
পশ্চিম গগন প্রতি; দেখিল ফিলিপ
‘ডেনিস্’ কবর চূড়া অতিক্রম করি,
অস্তাচলে তপনের ক্ষীণ রশ্মি-রাজি।
হইল আশঙ্কা মনে, পাছে রাত্রি হয়,
হিম লাগে এনির শরীরে; দাঁড়াইল,
ফুকারিয়া ডাকিল ফিলিপ উভরায়।
বনের ভিতর দিয়া পশিল সে স্বর
গহরের নীচে। উঠিল শিশুরা তথা
ফল-ভারবাহী। চলিল নামিয়া সবে
বন্দরের দিকে অতঃপর। থমকিল
এনির দুয়ারে গিয়া সহসা ফিলিপ;
হাতে হাত দিয়া তার কহিল মৃদুল,—
“কহেছি যে সব কথা আজিকার দিনে,
অন্যায় হয়েছে বড়; যেহেতু তখন

ছিলে তুমি আত্মহারা, আকুল চিন্তায়।
বাধ্য প্রতিজ্ঞায় আছি আমি চিরদিন;
স্বেচ্ছাধীন তুমি এবে।” উত্তরিল এনি,
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ,—“আমিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”


বৎসর বহিয়া গেল নিমেষের প্রায়।
গৃহকার্য্যে ব্যস্ত যবে এনি আপনার,
শেষ প্রতিজ্ঞার কথা না ভাবিতে পুনঃ,
ভালবাসে কি না আর না জানিতে মনে,
শরতের পর চকিল শরৎ নব।
স্মরণ করিয়া দিতে প্রতিজ্ঞার কথা,
দাঁড়াল ফিলিপ আসি সম্মুখে এনির।
জিজ্ঞাসিল এনি—“হইল কি বর্ষ গত?”
ফিলিপ উত্তর দিল,—“সন্দেহ যদ্যপি,
পেকেছে ‘হেজেল’ পুনঃ দেখিবে আইস!”
এনি কিন্তু চাহে কিছু অবসর আর;
পরিবর্ত্ত হেন—কত আছে ভাবিবার!
আরো এক মাস—মাসেক সময় চায়।
আছে বদ্ধ প্রতিজ্ঞায়, মনে আছে তার;
তবু এক মাস!—আর বেশী দিন নয়।

অতৃপ্ত পিয়াসা-ভরা ফিলিপের চক্ষু,
উন্মত্ত মদ্যপ সম কম্পমান্ হস্ত,
আবেগ-উচ্ছ্বাস-পূর্ণ বিকশিত স্বর;
কহিল সে,—“যথা ইচ্ছা লইও সময়;
লইও সময় এনি, যত ইচ্ছা হয়!”
করুণায় অশ্রুপূর্ণ এনির নয়ন;
তথাপি সে রাখিল অপেক্ষা বহুতর;
অবিশ্বাস্য নানা ছলনায় সততার।
করিল পরীক্ষা, দেখিল ধৈর্য্যের সীমা।
আরো অর্দ্ধ বর্ষ তাহে কাটিল ঝটিতি।


জল্পনা নিস্ফলা যায়— সেহেতু বিরক্ত
বন্দরের অলস নিষ্কর্ম্ম লোক যারা;
হেন উত্তেজিত তারা,—করিয়াছে দোঁহে
ঘোর অত্যাচার যেন তাহাদের প্রতি।
করিল কেহ বা মনে,—খেলিছে ফিলিপ
ছলনা এনির সাথে। ভাবিল কেহ বা,—
এনি বাড়াইছে দর। গণিল অপরে
হাসির সামগ্রী-মাঝে এনি ও ফিলিপে,
সে হেতু মতির স্থির না দেখে তাদের।

একজন, হৃদে যার সর্পডিম্ব গাঁথা,
ইঙ্গিতে কুভাব ঘষে ঈষৎ হাসিয়া।
বিবাহ-সম্বন্ধে মৌন এনির কুমার,
নীরব সম্মতি যেন প্রকটিত মুখে।
উত্তেজিত করে সদা তনয়া তাহার,
তাদের সে প্রিয় জনে বিবাহের তরে,
ঘুচাইতে সংসারের দারিদ্র্য ভীষণ।
গোলাপ-সন্নিভ মুখ ছিল ফিলিপের,
শুক পাংশুবর্ণ এবে চিন্তা-জর্জ্জরিত!
সবাকার এই ভাব করি নিরীক্ষণ,
এনির অন্তর দহে আত্মগ্লানি ঘোর।


অবশেষে এক রাত্রি ঘটিল এমন,
না আসিল নিদ্রা মাত্র এনির নয়নে;
একান্তে প্রার্থনা এনি মাঙ্গিল তখন,
‘এনক জীবিত কিনা’—চিহ্ন যেন দেখে।
সূচীভেদ্য অন্ধকার; ঘেরিয়া এনির
চারিধার রহে অন্ধ প্রাচীর নিশার;
উদ্বেগে অন্তরে ত্রাস বিষম অসহ;
শয্যা ত্যজি উঠে এনি, জ্বালিল আলোক;

দুঃসাহসে পরশিল ‘পবিত্র পুস্তক’;
সহসা খুলিল পত্র দেখিবারে চিহ্ন;
সহসা অঙ্গুলি দিল মূল বাক্যে এক;
পড়িল আপনি ভাষা—“তালতরুতলে।”
তার পক্ষে কোন কথা যদিও তা নয়;
যদিও কোনই অর্থ নাহিক তাহার;
পুস্তক করিয়া বন্ধ, ঘুমাইল এনি।
দেখিল স্বপন—যেন এক তাহার,
উচ্চ গিরি’পরে এক তাল তরুতলে,;—
মস্তক উপরে তার অরুণ কিরণ।
“গিয়াছে এনক স্বর্গে!”—ভাবে মনে এনি,
“সে এখন কত সুখী! গাহিছে স্বরগে
ঈশ্বরের গুণ-গাথা। উজলে অদূরে।
জ্ঞান-সূর্য্য; আর সেই তাল-তরুতলে
সমবেত সুধী জন, গাহিছে স্বরগে
ঈশ্বরের গুণগাথা। নিদ্রাভঙ্গে এনি
হইল সুস্থির মন; আনাইল ডাকি।
ফিলিপে প্রভাতে; কহিল আবেগ-ভরে,—
“না হবে বিবাহ কেন—না দেখি কারণ।”
ফিলিপ উত্তর দিল;—“ঈশ্বর-কৃপায়,

মঙ্গল কারণ দোঁহাকার, ইচ্ছা যদি
বিবাহ করিতে মোরে, হউক ত্বরায়।”


হইল বিবাহ; আনন্দের ঘণ্টাধ্বনি
দিল জানাইয়া। হইল মিলন শুভ;
আনন্দের ঘণ্টাধ্বনি বাজিল গির্জায়।
এনির অন্তরে কিন্তু না ফুটিল কভু
সে আনন্দ-ধ্বনি; সে যেন সদাই দেখে,—
পথ-পাশে পদক্ষেপ কার!—না জানে সে
কোথা হ’তে আসে! কে যেন কাণের কাছে
কথা কয় ফুসফুস;—কি কথা কিছুই
নাহি বোঝে। বাড়ীতে থাকিতে একাকিনী
নাহি আর চায় মন; না পায় সাহস
বাহিরে যাইতে একা। কি ব্যাধি বিষম!—
প্রবেশিতে গৃহে, অর্গলে রাখয়ে কর,
শঙ্কিত চকিত সদা। ভাবিত ফিলিপ
কারণ তাহার অন্য; সঞ্চরে যেহেতু
সংশয়-আশঙ্কা ঘোর অনেকের প্রাণে,
গর্ভের সংক্রম-কালে। পরন্তু যখন
জনমিল এক সন্তান এনির; তার,

নবীন কুমার সনে নবীন জীবন;
জননীর নব স্নেহে পূর্ণ হ’ল হৃদি;
হইল ফিলিপ এবে সর্ব্বময় তার;
উন্মুলিত হৈল সেই মনের বিকার।


কি হইল এনকের? কোথা সে এখন?
“উত্তম সৌভাগ্য” নামে সে অর্ণব-তরী,
মঙ্গল্যে করিল যাত্রা যবে; প্রতিহত
প্রথমেই প্রতীচ্যের বিঘের বাত্যায়,
পর্ব্বত-প্রমাণ ভীষণ তরঙ্গ-ভঙ্গে
বিস্কে উপসাগরের; হইল কিঞ্চিৎ
ব্যাহত কম্পিত পোত; এড়াইল তবু
বিশৃঙ্খলা বহু ক্লেশে; উত্তরিল পরে
দক্ষিণ অয়ন পারে, চির-গ্রীষ্মময়; -
উত্তমাশা-অন্তরীপ পাশে অতঃপর,
উৎক্ষিপ্ত প্রকম্প পোত আবর্ত্তে পুনশ্চ।
পরিবর্ত্ত পুনঃপুনঃ শুভাশুভ বায়ু!
গ্রীষ্মমণ্ডলের সীমা করি অতিক্রম,
সুবাতাস—স্বরগের মৃদুল নিশ্বাস—
কয় দিন ক্রমাগত লভিল তরণী!

স্বর্ণপ্রসূ দ্বীপপুঞ্জ ভারত-সাগরে,
মধ্যপথ বাহি তার উপনীত তরী,
প্রাচ্যরাজ্যে সুপ্রাচীন চীনের বন্দরে।


করিল এনক তথা বাণিজ্য আপন,
কিনিল সে শিশুদের তরে রঙ্গদার
বিকট পুতুল— ‘ড্রাগুণ’ তাহারে কয়—
আধ-সর্প আধ-অশ্বাকৃতি; সে সময়
বড়ই চলন সেদেশে বাজারে তার।


নহে যেন গৃহ-যাত্রা শুভদ কিঞ্চিৎ।
বাস্তব প্রথমে হেন হইল প্রতীত,—
সাগরের বৃত্ত-সীমা-মাঝে, দিন দিন,
অলস মন্থর গতি পোত; পুরোভাগে
প্রতিকৃতি—পূর্ণদেহ উন্নত মস্তক—
স্থির-দৃষ্টে বিস্মিত লোচনে যেন দেখে’—
শ্বেতপক্ষ সম উর্ম্মি গলুই-সম্মুখে।
নির্ব্বাত প্রকৃতি পুনঃ; পরিবর্ত্তশীল
বায়ুগতি পুনঃ; পরে বিপরীত বায়ু
বহিল বহুত দিন; বিষম ঝটিকা

অবশেষ, বিতাড়িত করিল তরণী
চন্দ্র তারাহীন ঘোর আন্ধারের পথে।
“পাহাড়ে লাগিবে ধাক্কা”—না সরিতে বাক্,
পাহাড়ে আছাড়ি বেগে তরী চুরমার।
পোত-ধ্বংসে ধ্বংস হৈল যতেক জীবন;
বাঁচিল এনক শুধু, আর দুই জন।
মাস্তুলের ভগ্নকাষ্ঠ রশারশি ধরি,
ভাসিল সমুদ্রে তারা শেষ অর্দ্ধ রাতি;
ভাসিতে ভাসিতে শেষে পরদিন প্রাতে,
উপনীত হৈল এক অতি-ক্ষুদ্র দ্বীপে;
ফুলফুল-সমন্বিত উর্ব্বর সে দ্বীপ,
নিভৃত-সমুদ্র-মাঝে জনমাত্র হীন।


না ছিল অভাব তথা কোন খাদ্য দ্রব্য—
জীবন-ধারণ-যোগ্য; ছিল পক্ক ফল,
সুদৃঢ় বাদাম, কত পুষ্টিকর মূল।
দয়ামায়াহীন হ’লে, না ছিল অভাব
খাদ্য-মাংস; নিঃশঙ্ক নিরীহ জীব কত,
অসহায়ে বিচরে পালিত প্রাণী-প্রায়।
সেই দ্বীপে ছিল এক পর্ব্বত গহ্বর,

সাগরের দিকে যেন এক দৃষ্টে চেয়ে।
তাহে রচিল কুটীর তারা; তালপত্রে
ছাইল কুটীর-চাল; আধ কুঁড়ে ঘর,
আধ বন্য গিরিগুহা, প্রকৃতি-রচিত।


এইরূপে নিবসয়ে তিনটী পরাণী,
প্রকৃতি ভাণ্ডার পূর্ণ স্বর্গীয় উদ্যানে
অনন্ত গ্রীষ্মের মাঝে, নিরানন্দ মনে।
সবাকার ছোট যেটি, বালক বয়স,
রাত্রির দুর্দ্দৈব ঘোরে ভগ্নধ্বংস পোতে,
আহত—শয্যায় শায়ী পাঁচটি বৎসর,
জীবন-মরণ-সন্ধিস্থলে। সেই হেতু
নিয়ত তাহার পাশে কাটাইল তারা।
অবশেষে ইহলোক ত্যজিল সে যবে;
দেখিতে পাইল তারা কাষ্ঠগুঁড়ি এক।
এনকের সহচর, সাবধান-হীন,
মার্কিণের আদিম অসভ্য জাতি মত,
অগ্নি-যোগে কাঠে বেধ করিবারে গিয়া,
পড়িল—মরিল নিজে সর্দ্দি-গর্ম্মি হয়ে।
রহিল তখন শুধু এক একাই।

এই দুই মৃত্যু হেতু মনে হৈল তার,—
ঈশ্বর বলেন যেন—“অপেক্ষা করহ।”


আপাদ-মস্তক গিরি রাজে বনরাজি;
হরিৎ প্রান্তর; আঁকাবাঁকা বনপথ,
চলিয়াছে স্বরগের অভিমুখে যেন।
দাঁড়াইয়া ক্ষীণদীর্ঘ নারিকেল-তরু,
আনত মুকুট শোভে শিরে; ঝকমকে
পক্ষী-পতঙ্গের কান্তি; নবীন বল্লরী,
জড়াইয়া তরুর বিশাল দেহ কিবা,
বিকাশিছে বিচিত্র কুসুম-কান্তি নব,
বিস্তারিয়া বেলাভূমি; গ্রীষ্মমণ্ডলের
চাকচিক্য বিভব গৌরব যত কিছু,
নিরখে এনক সব; না দেখে কেবল—
দেখিবারে সাধ যাহা—স্নেহভরা মুখ
মানুষের; না শুনে সে স্নেহ-মাখা স্বর।
শ্রবণে সদাই ভাসে,—কর্কশ কাকলী
উড্ডীন সমুদ্র-পক্ষী দলবদ্ধ যবে;
যোজন-বিস্তৃত ঘোর তরঙ্গ আবর্ত্তে
বজ্রনাদ পর্ব্বতের গায়; আন্দোলিত

মৃদু স্বর বিশাল বৃক্ষের—সমুকুল
সশাখ গগনস্পর্শী যেই; কিম্বা সেই
কলকল ধ্বনি—পর্ব্বত-বাহিনী যবে
সাগরে ঝাঁপিয়া পড়ে। কখনো এনক
ভ্রমমাণ তটভূমে; কভু সারাদিন
বসিয়া সমুদ্র-মুখী গুহার মাঝারে;
পোতমগ্নে এক দৃষ্টে চেয়ে দেখে একা
যদি দেখা যায় কোন জাহাজের পাল।
আসে দিন, চলে যায়; না যাইল দেখা।
চিহ্ন মাত্র কোন’ জাহাজের; নিত্য শুধু
বিচ্ছিন্ন রক্তিম বিভা অরুণ কিরণে,
খেলে তরু—মাঝে—প্রপাতে, তমালে, তালে।
উজ্জ্বলতা পূর্ব্বশার জলরাশি-মাঝে;
উজ্জ্বলতা মস্তক উপরে সেই দ্বীপে;
উজ্জ্বলতা প্রতীচ্যের সলিল-সমীপে;
উজলে স্বরগে আর বৃত্তাকারে তারা;
ঘন ঘন জলধির গভীর গর্জ্জন;
সূর্য্যোদয়ে ভাসে পুনঃ রক্তিম কিরণ;
না দেখে তথাপি চিহ্ন কোন’ জাহাজের।

সদা অন্যমনা—কি দেখে কি ভাবে যেন।
সংজ্ঞাহীন—দেহে বসে সুবর্ণ গোধিকা!
কল্পনা-কুহকে ভাসে কল্পনার ছবি,—
সে যেন তাদের পাশে, তারা আশে-পাশে;
সেই স্থান, সেই সব, সেই সে আপন,
বিষুব-উত্তর সেই দ্বীপ আপনার;
সেই শিশুগণ; সেই অফুটন্ত স্বর;
সেই এনি; সেই ক্ষুদ্র কুটার তাহার;
সেই কল-ঘর; পর্ব্বত উপরে পথ;
কর্ত্তিত-ময়ূরাকার সেই ঝাউ-গাছ;
পত্রাবৃত গলি-পথ সেই, নিভৃত সে
উদ্যান-বাটীকা; আপন ঘোটক সেই;
সেই তার বিক্রীত তরণী; সেই শীত
নিদারুণ, পৌষ-প্রাতে; নীহার-আচ্ছন্ন
সেই বালুর পাহাড় ঘোর; যেন সেই
মৃদু বৃষ্টি; সেই ঘ্রাণ—পতিত পত্রের;
ধীর গরজন সেই সীসক-বরণ
জলধির চিন্তা মাঝে হেন, বাজে কাণে—
মৃদুল সে ধ্বনি—দূরে কত দূরে, তবু।
শুনিল সে যেন— গির্জ্জার চূড়ায় সেই

আনন্দের ঘণ্টাধ্বনি বাজিছে আবার—
না জানে কেন বা? সহসা কাঁপিল দেহ,
উঠিল শিহরি; সংজ্ঞালাতে দেখে পুনঃ,—
ঘৃণিত সুন্দর দ্বীপ—সেখানেই সে যে।
নিরাশ্রয় হৃদি, কথা কয় তাঁর সনে—
যিনি সত্য সর্ব্বময়; না থাকিলে তিনি,
ঘটিত নিশ্চয় মৃত্যু নির্জ্জনতা-হেতু।
কথা কয় যাহারা তাঁহারে ডাকি, তিনি
না রাখেন তাহাদের কাহাকেও একা।


মস্তকে অকাল-পঙ্ক কেশ এনকের;
তদুপরি আসে যায় গ্রীষ্ম বর্ষা ঋতু,
বর্য পরে বর্ষ কত; তবু জাগে আশা,—
দেখিতে আপনা জনে; মরে না কামনা—
যাইবারে পুরাতন পূত প্রিয় দেশে।


অবসান সহসা সে নির্জ্জন-বাসের।
অপর জাহাজ এক (পানীয় খুঁজিছে)
বিচালিত ‘উত্তম সৌভাগ্য’ পোত-প্রায়;
হ’য়ে পথভ্রষ্ট, বিপরীত বাত্যাঘোরে,

উপনীত এই দ্বীপে—অজানা প্রদেশে।
কুজ্ঝটিকা-সমাচ্ছন্ন দ্বীপের মাঝারে,
এক দিন উষাকালে কুয়াসার ফাকে,
পাইল দেখিতে সেই পোতের ‘মালিম’
ধীরে ধীরে জলধারা বহে পাহাড়ের।
মাঝি মাল্লা হইল প্রেরিত সেই হেতু;
ঘূরিল তাহারা তথা নদীর সন্ধানে
কিম্বা কোন ঝরণার; চীৎকারে তাদের
পূরিল সে তটদেশ; নামিল তখন,
ধীরে ধীরে আপনার গিরিগুহা হ’তে,
দীর্ঘ-কেশ দীর্ঘ-শ্মশ্রু সে নিভৃত-বাসী।
তাম্রবর্ণ; নরের আকৃতি নহে যেন;
বেশভূষা অলৌকিক; বাতুল-সমান,
বিড়বিড় অফুটন্ত ভাষ; অব্যক্ত সে
উগ্রভাব; প্রকাশিল অঙ্গভঙ্গি হেন—
না বুঝে না জানে তারা; দেখাইয়া পথ,
চলিল তথাপি সাথে—যথা বহমান্
তটিনীর মিষ্ট জল; মিশিল কতই
মাঝিদের সনে, শুনিল তাদের বাক্,
হইল স্খলিত তার জিহ্বার বন্ধন;

বুঝাইল তাহাদিগে অবস্থা আপন।
জলপূর্ণ হৈল যেই পিপা-সমুদয়,
লইল এনকে তারা জাহাজ উপর।
কহিল এনক যবে আপন কাহিনী,
প্রথমে সবার মনে জাগে অবিশ্বাস।
ক্রমে ক্রমে হৈল কিন্তু আশ্চর্য সবাই;
হৃদয় দ্রবিল তার—যে শুনিল কথা;
দিল বস্ত্র পরিধেয়; হইল সম্মত—
না লইবে ভাড়া তার, পৌঁছে দিবে দেশে।
এনক খাটিল নিত্য মাঝিদের সাথে,
নির্জ্জনতা-স্মৃতি তার উন্মলন-তরে।
নাহি ছিল সে জাহাজে স্বদেশের কেহ,
জিজ্ঞাসিলে না মিলিত কোনই উত্তর—
যে কথা জানিতে মন নিয়ত ব্যাকুল।
সমুদ্রের উপযোগী নহে সে তরণী;
মন্থর গমন তার, বিলম্ব বহুল।
অলস বায়ুর গতি না ফিরিতে দেশে,
মনোগতি এনকের যাইত সে দেশে।
না পৌঁছিতে মেঘাচ্ছন্ন সে আকাশ-তলে,
যেন এক প্রেমিকের প্রেমভরা প্রাণে,

লইত নিশ্বাস সেই দূর ইংলণ্ডের
নীহার-নিষিক্ত মাঠে প্রভাত-বায়ুর;—
যেই বায়ু বহমান্ পাংশু-বর্ণ সেই
পর্ব্বত-প্রাচীরে। একদিন প্রাতঃকালে,
পরস্পর জাহাজের কর্ম্মচারিগণ,
সংগ্রহ করিল চাঁদা—অনুগ্রহ-দান;
নিঃসহায় এনকেরে দিল করুণায়।
তীরে তরী থামাইল পরে; নামাইল
এনকেরে যথাস্থানে— সেই পোতাশ্রয়ে;
যেখান হইতে যাত্রা করেছিল আগে।


না কহিল কোন’ কথা কাহাকে এনক;
চলিল আপন মনে—গৃহ-অভিমুখে।
কিন্তু কোথা গৃহ?—আছে কি সে গৃহে তার?
ছিল উজ্জ্বল সে অপরাহ্, দীপ্তিমান্।
কিন্তু শৈত্যময়; ক্রমে ভাসমান তাহে
সাগর-কুয়াসা পর্ব্বত-বিদার-পথে;
ঘেরিল সে দুইটি বন্দর কুয়াসায়,
ধূসর আচ্ছন্ন হৈল ধরণীর গায়।
রুদ্ধ এবে দুর-দৃষ্টি সম্মুখের পথে;

ক্ষীণ-দৃষ্টি বদ্ধ শুধু—সঙ্কীর্ণ সীমায়
আশেপাশে, শুষ্ক-প্রায় বনভূমি আর,
কৃষিক্ষেত্র কিম্বা কোন’ গোচারণ-মাঠ।
ডাকিছে ‘রবিণ’-পক্ষী নগ্ন তরু-শাখে
অসন্তুষ্ট কর্কশ চীৎকার; ঝরিতেছে
শুষ্ক পত্র—যেন গুরুভার আপনার—
বিগলৎ কুজ্ঝটিকা-মাঝে। অন্ধকার
গাঢ়তর—নীহার-পতন যত ঘন।
চমকিল চোখের উপর অবশেষ
কুয়াসা-লাঞ্ছিত এক দূরের আলোক।
আসিল অভীষ্ট-স্থানে এবার এনক।


চুপি চুপি চলে পথ, চোরের মতন;
হৃদে প্রতিভাত প্রতিচ্ছবি বিপদের;
নেত্রে ভাসে কঠিন প্রস্তর; সেই গৃহ—
এনি ছিল যেথা—ভালবাসিত তাহাকে।
ছিল শিশুরা তাহার—সাত বর্ষ পূর্ব্বে—
গত জীবনের দুর সুখময় দিনে;
না দেখিল সেই স্থানে আলোক কিছুই,

না শুনিল কোনরূপ নর-কণ্ঠস্বর।
(দেখা গেল শুধু, কুয়াসার ক্ষীণাললাকে,
আছে এক বিজ্ঞাপন—বাড়ী-বিক্রয়ের।)
নামিল নদীর তীরে লুকাইয়া মুখ;
ভাবিল বিষন্ন মনে,—“মরিয়াছে তারা,
কিম্বা মরিয়াছে তারা আমার সম্পর্কে।”
নিয়ে নদীর কিনার—অবতর-স্থান,
সেই দিকে চলে পুনঃ; করে অন্বেষণ
পান্থশালা—পুরাতন পূর্ব্ব-পরিচিত;
দারুময় পুরোভাগ আছিল তাহার;
প্রাচীনকালের চিহ্ন—ক্রুশের আকার।
তখনি ছিল সে বাড়ী—জীর্ণ পুরাতন;
কীটদষ্ট, অবলম্ব’পরে অবস্থিত।
অনুমানে মনে—নিশ্চয় হয়েছে তার,
লয় এত দিন। কিন্তু গিয়াছে সে চ’লে
পান্থশালা ছিল যার; বিধবা তাহার,
‘মিরিয়াম লেন’, রাখিয়াছে টায় টায়,
নিত্য-হ্রস্বমান্ আয়ে; আগে ছিল উহা
আডড়ঘর যাত্রীদের, কোলাহল ময়;
এবে কোলাহল কম, বিশ্রামের স্থান

প্রবাসী পথিক তরে। সেখানে এনক,
চুপি চুপি লভিল বিশ্রাম কত দিন।


ছিল সরল প্রকৃতি ‘মিরিয়াম লেন’,
গল্পপ্রিয় বড়; না দিত থাকিতে একা,
এনকে সে; নির্জ্জনতা ভাঙ্গিত তাহার,
কহিত কতই কথা; কহিত সে কভু
‘বন্দরের পুরাণ’ কাহিনী; কহিত সে
এনকের গল্প-সমুদায়,— চিনিয়া।
সম্মুখে এনক ব’সে;—এত তাম্রবর্ণ,
এত নত-দেহ এত ভগ্ন-শরীর সে।
শিশুটির মৃত্যু; এনির দারিদ্র্য-বৃদ্ধি;
যেই মতে করিল ফিলিপ, শিশুদের
শিক্ষা আর পালনের ব্যবস্থা-বিধান;
ফিলিপের কামনা এনির পাণিগ্রহে;
ধীরে ধীরে সম্মতি এনির; পরিণয়
দোঁহাকার; এনি-গর্ভে পুত্র ফিলিপের;
একে একে কহিল সে সকল কাহিনী।
অবিকারে শুনিল এনক সবিস্তার;
বদনমণ্ডলে তার না হ’ল বিকাশ—

কোনরূপ উত্তেজনা কিম্বা শোকাভাস।
দেখিলে তখন কেহ, করিত বিশ্বাস
শ্রোতার অপেক্ষা যেন বক্তা বিচলিত।
গল্প শেষ করিল রমণী এই বলি,—
“মরিল জাহাজ ডুবি অভাগা এনক।”
নাড়িয়া ব্যথিত ভাবে ধূসর মস্তক,
কহিল এনক তাহে অফুটন্ত স্বর,—
“মরিল জাহাজ ডুবি!” বহিল নিশ্বাসে
নিভূত-হৃদয়-মাঝে—“মরিল” সে ধ্বনি।


দেখিতে কামনা তবু এনির বদন;
“দেখি যদি তার সেই প্রীতি-ভরা মুখ,
জানি যদি সে আমার সুখে আছে ভাল,
কত সুখী হয় প্রাণ!” আকুল চিন্তায়
ব্যথিত বিব্রত হৃদি; বিচলিত দেহ
পাহাড়ের প্রতি, পৌষ-অপরাহ্নে এক,—
গাঢ়তর যবে প্রদোষ-আঁধার-মেঘে।
বসিল নিভৃতে তথা, স্থির নিম্ন-দৃষ্টি;
সহস্র চিন্তার স্মৃতি ঘেরিল অন্তর
অব্যক্ত বিষাদ-ক্ষুন্ন। চকিল সহসা

চোখের উপর এক দীপ্তিময় স্থান,
সুখের আলোক-ভরা; দূর উদ্ভাসিয়া
ভাসে সে আলোকরশ্মি, গৃহপ্রান্ত হ’তে
ফিলিপের; প্রলুব্ধ এনক তাহে হয়;—
অর্ণবে আলোক-গৃহে প্রলুব্ধ যেমতি
প্রবাসী বিহঙ্গ, মত্ততায় আত্মক্ষেপে
করে অবসান স্বীয় শ্রান্ত জীবনের।


লোকালয়-প্রান্তে ছিল ফিলিপের বাড়ী,
সম্মুখীন পথ প্রতি। পশ্চাতে তাহার
সুরম্য উদ্যান, ক্ষুদ্র চতুষ্কোণ,
প্রাচীরবেষ্টিত; ছোট এক ‘গেট’ তার
প্রান্তরের দিকে। ছিল এক ঝাউ গাছ,
চিরশোভাময় সুপ্রাচীন। উদ্যানের
চারিপাশ ঘেরিয়া কঙ্করময় পথ;
আর এক ছিল পথ মাঝখান দিয়া।
না যাইল মধ্যপথে; উঠিল এনক,
প্রাচীর উপর দিয়া চোরের মতন;
দাঁড়াইল নিভৃতে সে ঝাউগাছ-পাশে;
দেখিল বৃক্ষের আড়ে মর্ম্মভেদী দৃশ্য,—

না দেখা যা ছিল ভাল; অথবা সে হৃদে—
ভাল মন্দ কিবা আর—সে যাতনা-মাঝে!


উজলিছে উজল সে ‘টেবিল’ উপর
পিয়ালা, রেকাব, চামচ—রূপার সব।
উজলিছে অগ্নিকুণ্ডে সুখদ অনল;
তাহার দক্ষিণ পাশে বসিয়া ফিলিপ,—
অবজ্ঞিত পূর্ব্বের প্রণয়াকাঙ্ক্ষী যেই,—
আপন শিশুটি ক্রোড়ে হরিষে মগন;
দৃঢ়-কায় সুন্দর গোলাপ-কান্তি এবে!
হেলাইয়া দেহ দ্বিতীয় পিতার দিকে,—
যেন নবীন এনি-লি দীর্ঘতরা,—শোভে
সুন্দরী বালিকা, কৃশাঙ্গী বিপুল-কেশা;
উত্তোলিত হস্তে তার দোদুল্য অঙ্গুরী
রেশমী ফিতায় বাঁধা,—তাহে প্রলোভন
শিশুটির; শিশু, বাড়া’য়ে কমল-কর,
ধরিবার চেষ্টা করে,—না পারে ধরিতে;
রঙ্গ দেখে হাসয়ে সকলে। অন্য দিকে,
অগ্নিকুণ্ড-বামপার্শ্বে শিশুর জননী,
কটাক্ষে চাহিছে সদা তনয়ের প্রতি;

ক্ষণে ক্ষণে ফিরাইয়া মুখ, কহিতেছে
কত কথা জ্যেষ্ঠপুত্র সনে। জ্যেষ্ঠপুত্র,
এবে দীর্ঘ কৃঢ় দেহ, মাতৃ-পাশ্বে বসি’।
কহিছে যে কথা এনি, হইতেছে তাহে
আনন্দ সঞ্চার; তাই হাসিছে নন্দন।
মৃত ব্যক্তি বাঁচিয়া আসিয়া যেন পুনঃ,
দেখিছে আপন পত্নী—পত্নী আর নয়;
তার শিশু—সে নহে নিজের পুত্র আর—
আপন জনক-ক্রোড়ে আছে বিদ্যমান।
সব সুখ, সব শান্তি, সকল আনন্দ,
বয়স্থ সুন্দর স্বীয় পুত্র কন্যা আদি,—
সকলি অন্যের এবে; সে অন্য এখন
করিছে রাজত্ব তার স্থানে; সে এখন
স্বত্ববান সব স্বত্বে,—পায় ভালবাসা।
তনয় তনয়াদের। পূর্ব্বে এ সকল
ক’য়েছিল সবিস্তার মিরিয়াম্ লেন;
তথাপি পার্থক্য—শ্রবণে দর্শনে কত!
অবসাদে ঘূরিল মস্তক এনকের;
কাঁপিল চরণ; সামাল হইল কষ্টে,
বৃক্ষ-শাখা ধরি। আশঙ্কা বড়ই মনে,—

পাছে কণ্ঠস্বর চীৎকারে প্রকাশ পায়,
পাছে ভেঙ্গে যায় সুখ-স্বপ্ন সংসারের!—
ভাঙ্গে শেষের সে দিনে—ডঙ্কাধ্বনি যথা
আহ্বানি মানবগণে বিচারের তরে।


ফিরিল এনক পুনঃ, তস্করের প্রায়,
ধীর পদক্ষেপ, পাছে কোন’ শব্দ হয়,
কঙ্করে চরণ লাগি; পাছে মুর্চ্ছা যায়,
উছট লাগিয়া পড়ে; পাছে দেখে কেহ;
মনে হৈল তার সকল প্রাচীর যেন;
দেখিল সে হাত দিয়া অন্ধের মতন;
হামাগুড়ি আসিল সে ‘গেটের’ নিকট,
খুলিল কবাট; সাবধানে হৈল পার;
করিল দরজা বন্ধ —ধীরে অতি ধীরে,
রোগীর গৃহের দ্বার বন্ধ হৈল যেন;
উতরিল অবশেষে প্রান্তর-মাঝারে।


না পারিল নতজানু ডাকিতে ঈশ্বরে—
হাঁটু দু’টি এত ক্ষীণ! সামলিয়া গেল
পড়িতে পড়িতে যেন! অঙ্গুলি-হেলনে

ভর দিল সিক্ত মৃত্তিকায় সন্তর্পণে
অতঃপর করিল প্রার্থনা ঈশ্বরের।


‘অসহ জীবন ভার! কেন বা আনিল,
সে নির্জ্জন দ্বীপ হ’তে তাহারা আমায়?
জগদীশ! ত্রাণকর্ত্তা! করুণা-নিদান!
করুণায় রেখেছিলে সে নির্জ্জন দ্বীপে;
করুণায় রাখ পিতং!—আর অল্প কাল
এ নিভৃত ভাবে! সেই শক্তি দেহ প্রভু!—
না বলি তাহারে কিছু না জানাই যেন!’
কর সহায়তা—নাহি ভাঙ্গি শান্তি তার।
নাহি যেন দেখি আর পুত্রকন্যাগণে,
না কহি এ কথা; তারা না জানে আমায়!
সঙ্কল্প—অজ্ঞাতবাস! না করিব কভু
আপনা-প্রকাশ! নাহি মোর অধিকার—
সন্তান-চুম্বনে আর। তনয়া আমার—
যে এবে সুন্দরী তার মাতার মতন—
সে নহে আমার আর! আমার কুমার—
সে এখন পর—সে আর আমার নয়!”

মনে মনে এই কথা এই চিন্তা যবে,
ক্ষীণ দেহ ক্ষীণতর হইল অধিক;
মুর্চ্ছায় পড়িল ভূমে, হৈল সংজ্ঞাহীন।
কতক্ষণ পরে ভাঙ্গিল মোহের ঘোর;
উঠিল আপনি; চলিল আপন-পথে;
পশ্চাতে রাখিল পুনঃ নির্জ্জন আলয়
আপনার; ধীরে নামিল নীচের দিকে,
অল্প-পরিসর সেই দীর্ঘ পথ বাহি;
আক্লান্ত মস্তিষ্কে তার হইল ধ্বনিত
পুনঃপুনঃ, সঙ্গীতের ধ্রবক যেমতি,
‘না বলি তাহারে কিছু না জানাই যেন।’


নহে সে অসুখী তত! দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়,
সঞ্চারিল বল হৃদে; অটল বিশ্বাস
ভগবানে, আর তার ফোটে যে প্রার্থনা
হৃদয়ের অনন্ত নির্ঝরে, দূর করে।
পৃথিবীর কটু তীব্র;—উঠে প্রস্রবণ
লবণাম্বু-মাঝে যথা সুস্বাদু জলের;
জীবন-প্রবাহ বহে হতাশ-সাগরে।
জিজ্ঞাসিছে মিরিয়ামে একদা এনক,—

“সেই কলের কর্ত্তার পত্নী,— গল্প যার
করেছিলে তুমি,—সে কি নাহি পায় ভয়—
প্রথম স্বামীটি তার বেঁচে আছে ভেবে!”
মিরিয়াম কহে,—“হঁ- হাঁ, বড় ভয় পায়,
সে কথা ভাবিয়া মনে। যদি দেখে থাক—
মরেছে এনক, যদি পার বলিবারে—
সে কথা এনিরে, সুখী হয় সে এখন।”
মনে মনে কহিল এনক,—“জানিবে সে,
ঈশ্বর যে দিন লইবেন অভাগায়!
অপেক্ষায় আছি শুধু তাঁর আহ্বানের।”
ভিক্ষাবৃত্তি বড় ঘৃণ্য ছিল এনকের;
আরম্ভিল পরিশ্রম জীবিকার তরে।
সকল কাজেই দক্ষ ছিল তার হস্ত;
কখন সে করিত প্রস্তুত পিপা আদি;
কখন বা ছুতারের কাজ; কখন বা
বুনানিত মাঝিদের মাছধরা জাল;
উঠাইত নামাইত জাহাজের মাল,—
সে কালে বাণিজ্য-দ্রব্য যদিচ অল্পই।
করিত আপনা তরে অল্প উপার্জ্জন;
নিজ ভিন্ন অন্য কেহ না ছিল যেহেতু।

নৈরাশ্য-চালিত কর্ম্ম, প্রাণ শক্তি-হীন,
দুঃসহ জীবন-ভার তাহে দিন দিন
বর্ষচক্র ঘূরিল আপন গতি পুনঃ;
দেখিল সে এনকের প্রত্যাগতি-দিন।
দেহে অবসাদ দৃঢ়; মৃদু মৃদু জ্বর;
শক্তি—ক্ষীণ ক্ষীণতর; কর্ম্মে অপারক;
আবদ্ধ—বাড়ীতে রহে, ক্রমে কেদারায়,
অবশেষে শয্যার উপর। এ দৌর্ব্বল্য
সহিল এনক; না হইল নিরানন্দ।
মগ্নপ্রায় ভগ্নপোত, অকূল সমুদ্রে,
উড্ডয়ন ঝঞ্চাবাতে, মেঘান্ত-রেখায়,
দেখে যদি আশাবাহী তরী অগ্রসর
বিপন্ন হতাশ প্রাণ উদ্ধারের হেতু;—
যত না আনন্দ তাহে হয়;—এনকের
এ আনন্দ আরো কত বেশী! সে দেখিছে,—
মরণের উষা আসিছে তাহার দিকে,
অবসান হইবে সকল যন্ত্রণার।


চমকে সুখদ আশা ভাবী উষালোকে।
ভাবে মনে মনে,—“আমার মরণ পরে,

বুঝিবে সে শেষ ভালবাসা তার প্রতি।”
কহিল ফুকারি ডাকি মিরিয়াম্ লেনে,—
“হে রমণী! আছে মোর গুপ্ত কথা এক;
কহিবার আগে চাহি শপথ তোমার।
ধর্ম্মগ্রন্থ স্পর্শ করি করহ শপথ,
নাহি প্রকাশিবে মরণের পূর্ব্বে মম।”
“মরণ!—”
উচ্চৈঃস্বরে উত্তরিলা সুমনা রমণী,—
“একি কথা কহ তুমি? কহি সুনিশ্চয়,
চিকিৎসায় রোগমুক্ত করিব তোমায়।”
কহিল এনক দৃঢ়তায়,—“আছে কথা।
স্পর্শ কর ধর্ম্মগ্রন্থ, করহ শপথ।”
শপথিল মিরিয়াম্ পুস্তক-পরশে,
অর্দ্ধ-ত্রস্তভাবে। বিঘূর্ণিত এনকের
ধূসর নয়ন পুনঃ মিরিয়াম্ প্রতি,—
“জানিতে কি কভু তুমি এনক আর্ডেনে
এই নগরের? জান কি তাহারে তুমি?”
কহিল রমণী,—“জানিতাম বহু পূর্ব্বে!
হাঁ—হাঁ, মনে হয়, দেখেছি নামিতে এই পথে!
ছিল তার উন্নত মস্তক; গ্রাহ্য নাহি

করিত কাহাকে।” এনক উত্তর দিল,
অতি ধীর ক্ষুব্ধ স্বর,—“মস্তক এখন
অবনত; সকলে অগ্রাহ্য করে তারে।
আমি মনে করি —বাঁচিব না আমি আর
তিন দিন কাল! আমিই এনক সেই।”
উঠিল রমণী-কণ্ঠে বিস্ময়-চীৎকার,
অর্দ্ধ-অবিশ্বাস অর্দ্ধ-বিকৃতির স্বর;—
“তুমি কি আর্ডেন? তুমি! না—না! সে যে ছিল।
তোমার অপেক্ষা বড় আরো এক ফুট্!”
এনক কহিল পুনঃ,—“আমায় ঈশ্বর,
দিয়াছেন নোয়াইয়া; যা-ছিলাম আমি,—
ভাঙ্গিয়া দিয়াছে দেহ দুঃখ-নির্জ্জনতা।
জানিও তথাপি স্থির—আমি হই সেই;
যে আমার ছিল পত্নী, নাম পরিবর্ত্ত
দুই দুই বার তার, করেছে বিবাহ
তাহারে ফিলিপ। বস নারী, শুন আরো।”
পরে কহিল সে,—সমুদ্র-যাত্রার কথা,
পোত-ভঙ্গ, আর তার নিভৃত-নিবাস,
দেশে প্রত্যাগতি, কটাক্ষে এনিরে দেখা,
প্রতিজ্ঞা আপন, কেমনে পালিল তাহা।

সে কাহিনী শুনিল রমণী যেই; স্বতঃ
প্রবাহিল জলধারা নয়নে তাহার;
নিদারুণ উত্তেজনা ভরিল অন্তর;
মনে হৈল—তখনি ঘোষণা করে গিয়া
ক্ষুদ্র বন্দরের ঘরে ঘরে পরিচয়
এনকের, আর তার কাহিনী দুঃখের!
কিন্তু সঙ্কোচিলা প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ হেতু;
কহিল কেবল,—“দেখিতে কি সাধ হয়,
চির-বিদায়ের আগে তনয়-তনয়া?
বল তো আনিয়া দেই তাদিগে এনক।”
উঠিল। রমণী ব্যগ্রভাবে সেই হেতু।


এনক নির্ব্বাক্ ক্ষণ; পরে উত্তরিলা,—
“হে রমণী! দেখাওনা প্রলোভন আর,
জীবনের শেষ পরীক্ষায়; পালিয়াছি,
পালিব প্রতিজ্ঞা মম, আমরণ পণ।
বস’ পুনরায়; বিচার করিয়া দেখ;
শুন মন দিয়া কথা মোর,—যতক্ষণ
শক্তি আছে কহিবার; লহ এই তার,—

দেখা হ’লে তার সনে বলিও তাহাকে,
মরিয়াছি—ভাল-বাসিতে-বাসিতে তারে,
মরিয়াছি—আশীর্ব্বাদ করিতে করিতে,
মরিয়াছি—মঙ্গল যাচিয়া তার তরে;
পড়িয়াছে ব্যবধান দু’জনের মাঝে,
ভালবাসি তবু তারে পূর্ব্বের মতন,
প্রাণের সঙ্গিনী ছিল সে যবে আমার।
আর কহিও কন্যারে মোর,—দেখিয়াছি
সেই দিন যেন তার মাতার মতন,—
তাহার মঙ্গল তরে করেছি প্রার্থনা,
করেছি আশীষ তারে শেষ শ্বাস যবে।
বল’ পুত্রকে আমার—মরিয়াছি আমি
কল্যাণ-কামনা করি তার। বল আর
ফিলিপেরে, শুভাকাঙ্ক্ষা করিয়াছি তার;
ভাল ভিন্ন মন্দ কিছু করে নাই সে তো!
মরণের পর মোর, তনয়-তনয়া,—
না জানে যাহারা আমি জীবিত কি মৃত,—
দেখিতে বাসনা যদি করে মৃতদেহ,
দিও দেখিবারে;—আমি পিতা তাহাদের!
কিন্তু সে যেন না আসে! মরণের মুখ,

ভবিষ্য-জীবনে বিঁধিবে পরাণে তার।
আছে অবশিষ্ট আর এক,— সে আমার
রক্তবিন্দু জীবনের; ভবিষ্য-জগতে
এইবার লভিব তাহার আলিঙ্গন;
এই দেখ চুল তার, কেটেছিল এনি,
দিয়েছিল মোরে; এত বর্ষ কাল,
বহিয়া এসেছি আমি; মনে ছিল সাধ,
কবরে বহিব উহা স্মৃতিচিহ্ন সম;
না দেখি সে প্রয়োজন আর; পরলোকে
দেখিব শিশুকে, স্বর্গসুখে সুখী, এবে।
করহ গ্রহণ উহা; মরণের পর,
যতনে এনিরে দিও; পাবে সে সান্ত্বনা;
আরো দেখিবে প্রমাণ—সেই আমি তার!”


থামিল সে। উত্তরিলা মিরিয়াম্ লেন,
জানাইয়া সকল সম্মতি বহু ভাষে।
না বুঝি গুরুত্ব তাহে, আবার এনক
চাহিল তাহার প্রতি ঘূর্ণিত নয়নে;
জানাইল পুনরায় আপন বাসনা,
করাইল পুনরায় প্রতিজ্ঞা তাহাকে।

তার পর তৃতীয়া যামিনী! এনকের—
তন্দ্রা-ঘোর, গতি-হীন, পাংশুল বদন।
সদাই সতর্ক মিরিয়াম; নিদ্রা যায়
কচিৎ যদ্যপি। ফুকারিল বংশীধ্বনি
উচ্চ রবে, ডাকিয়া সমুদ্র-যাত্রীদের,
বন্দরের প্রতি গৃহ করিয়া ধ্বনিত।
বিকারে—জাগিল, উঠিয়া বসিল, বাহু
প্রসারিল, উচ্চৈঃস্বরে চীৎকারি কহিল,—
“ওই পোত! ওই পোত! ওই আসিয়াছে।
রক্ষা পাইলাম আমি।” ঢলিয়া পড়িল
মস্তক তাহার। আর না সরিল বাক্।


এইরূপে অবসান এনক জীবন
সঙ্কল্প-সাধনে যার প্রতিজ্ঞা অটুট।


তাহারা আসিয়া যবে করিল সমাধি,
করিল এতই ব্যয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়—
তত ব্যয় সে বন্দর দেখেছে ক্কচিৎ।

সম্পূর্ণ।

প্রকাশক

ধীরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী।

“পৃথিবীর ইতিহাস” কার্যালয়।

হাওড়া।

  1. পোতাধিষ্ট স্থান অর্থাৎ ‘জেটি’।
  2. টালির চালযুক্ত কুটীর (tiled huts); সুতরাং রক্তিম বরণ।
  3. হেজেল—বাদাম বৃক্ষের ন্যায় এক প্রকার বৃক্ষ।
  4. শুক্রবার— যীশুখৃষ্টের ক্রুশে বিদ্ধ হওয়ার দিন। ‘রোমান ক্যাথলিক’ ও ‘ইংলিস হাই চার্চ্চ’ খৃষ্ট সম্প্রদায় ঐ দিন মাংস ভক্ষণ করেন না। মাংসের পরিবর্ত্তে তাঁহারা মৎস্য ভোজন করেন।