বাঙ্গালার ইতিহাস (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রথম ভাগ/একাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে
বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ২৬

সাগরদীঘির নিকট আবিষ্কৃত বিষ্ণু-মূর্ত্তি


বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ২৭

সাগরদীঘির নিকট আবিষ্কৃত নূতন প্রকারের বিষ্ণুমূর্ত্তি


বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ২৮

ঢাকায় আবিষ্কৃত লক্ষ্মণসেনের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিত চণ্ডীমূর্ত্তি


বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ২৯

গৌড়ে আবিষ্কৃত শ্রীকৃষ্ণের জন্ম চিত্র



একাদশ পরিচ্ছেদ।


সেন-রাজবংশ।

 কুমারপাল—বৈদ্যদেব—অনন্তবর্ম্মা চোড়গঙ্গের আক্রমণ—দক্ষিণবঙ্গে নৌ-যুদ্ধ—কামরূপ-রাজের বিদ্রোহ—বৈদ্যদেবের কামরূপ জয়—তৃতীয় গোপাল—মান্দার-শিলালিপি—মদনপাল—বিজয়সেন—বঙ্গজয়—বরেন্দ্রজয়—মদনপাল ও গোবিন্দচন্দ্র—মদনপালের তাম্রশাসন—সেন-রাজবংশের উৎপত্তি—রাঢ়দেশে বাস—প্রদ্যুম্নেশ্বর মন্দির—সামন্তসেন—হেমন্তসেন—বিজয়সেন—গৌড়েশ্বরের পরাজয়—নান্য, বীর, রাঘব ও বর্দ্ধন—বিজয়সেনের শিলালিপি—তাম্রশাসন—বিলাসদেবী—শূরবংশের সহিত সম্বন্ধ—বল্লালসেন—কৌলীন্য—দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর—সীতাহাটীর তাম্রশাসন—লক্ষ্মণসেন—গোবিন্দচন্দ্রের মগধ জয়—লক্ষ্মণসেনের তাম্রশাসনসমূহ—লক্ষ্মণসেনের রাজ্যে সাহিত্য চর্চ্চা—লক্ষণাব্দ—রাঢ়ের ঘোষ-বংশ।

 রামপালদেবের মৃত্যুর পরে তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র কুমারপাল গৌড় সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। রামপালদেবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে নবজিত কামরূপ রাজ্যে, সামন্তরাজ তিঙ্গ্যদেব বিদ্রোহী হইয়াছিলেন, উৎকল-রাজ অনন্তবর্ম্মা চোড়গঙ্গ গৌড়রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন এবং সম্ভবতঃ সেনবংশীয় বিজয়সেন রাঢ়ে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন। রাজ্যাভিষেকের অব্যবহিত পরে চতুর্দ্দিক হইতে বিপজ্জাল বেষ্টিত হইয়াও নবীন গৌড়েশ্বর কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হন নাই। কমৌলিতে আবিষ্কৃত বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, রামপালদেবের মন্ত্রী বোধিদেবের পুত্র, বৈদ্যদেব কুমারপালের মন্ত্রী ছিলেন। “তিনি সাম্রাজ্য-লক্ষ্মী সেবিত সুবিখ্যাত রামপাল-দেবের পুত্র কুমারপাল নরপতির চিত্তানুরূপ মন্ত্রী হইয়াছিলেন। পরাজিত শত্রু-নরপাল-মুকুট সমাহৃত স্বর্ণনির্ম্মিত যে সিংহমূর্ত্তি তদীয় সমুচ্চ প্রাসাদ-শিখর অলঙ্কৃত করিতেছে, সেই সিংহের গ্রাসত্রাসে সন্ত্রস্ত হইয়া চন্দ্রমণ্ডলমধ্যস্থ বিম্বাঙ্করূপী মৃগ পলায়নপর হইবে[১]।” সর্ব্বপ্রথমে বোধ হয় উৎকল-রাজ অনন্তবর্ম্মা চোড়গঙ্গ গৌড়রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন, কারণ বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে কুমারপালের রাজ্যকালের ঘটনাবলীর মধ্যে সর্ব্বপ্রথমে দক্ষিণবঙ্গে নৌযুদ্ধের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়[২]। উৎকল-রাজ দ্বিতীয় নরসিংহের তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায় যে, অনন্তবর্ম্মা গঙ্গা তীরবর্ত্তী ভূভাগের কর সংগ্রহ করিয়াছিলেন[৩]। ইহা হইতে অনুমান হয় যে, অনন্তবর্ম্মা উত্তররাঢ়া ও দক্ষিণরাঢ়া অধিকার করিয়াছিলেন। এই তাম্রশাসনের আর এক স্থানে দেখিতে পাওয়া যায় যে, অনন্তবর্ম্মা মন্দারদূর্গ অধিকার করিয়া মন্দারাধিপতিকে পলায়ন করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন[৪]। এই সময়ে দক্ষিণবঙ্গে একটি নৌ-যুদ্ধে বৈদ্যদেব জয়লাভ করিয়াছিলেন। “দক্ষিণবঙ্গের সমরবিজয় ব্যাপারে চতুর্দ্দিক হইতে সমুত্থিত তদীয় নৌবাট হী হী রবে সন্ত্রস্ত হইয়াও, দিগ্‌গজসমূহ গম্যস্থানের অসদ্ভাবেই স্বস্থান হইতে বিচলিত হইতে পারে নাই। উৎপতনশীল ক্ষেপণী বিক্ষেপে সমুৎক্ষিপ্ত জলকণাসমূহ আকাশে স্থিরতা লাভ করিতে পারিলে চন্দ্রমণ্ডল কলঙ্কমুক্ত হইতে পারিত[৫]।” এই সময়ে অনন্তবর্ম্মা চোড়গঙ্গের সাহায্যে বিজয়সেন বোধ হয় উত্তররাঢ়া ও দক্ষিণরাঢ়া অধিকার করিয়াছিলেন। ইহার পরে পাল-রাজগণ আর কখনও দক্ষিণবঙ্গে অধিকার বিস্তার করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। এই সময়ে “পূর্ব্বদিগ্বিভাগে বহুমান প্রাপ্ত তিঙ্গ্যদেব নৃপতির বিদ্রোহবিকার শ্রবণ করিয়া গৌড়েশ্বর তাঁহার রাজ্যে এইরূপ বিপুলকীর্ত্তি সম্পন্ন বৈদ্যদেবকে নরেশ্বর পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন[৬]।” বৈদ্যদেব কামরূপরাজকে পরাজিত করিয়া স্বয়ং কামরূপের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। “সাক্ষাৎমার্তণ্ডবিক্রম বিজয়শীল সেই বৈদ্যদেব আপন তেজস্বী প্রভুর আজ্ঞাকে মাল্যদানের ন্যায় মস্তকে ধারণ করিয়া কতিপয় দিবসের দ্রুত রণযাত্রার অবসানে নিজভুজবিমর্দ্দনে সেই অবনিপতিকে যুদ্ধে পরাভূত করিবার পর, তদীয় রাজ্যে মহীপতি হইয়াছিলেন[৭]।” কুমারপালদের বোধ হয় অতি অল্পকাল রাজত্ব করিবার পরে পরলোকগমন করিয়াছিলেন, কারণ সন্ধ্যাকরনন্দী ‘রামচরিতে’ একটিমাত্র শ্লোকে তাঁহার রাজত্বকালের বিবরণ শেষ করিয়াছেন[৮] কুমারপালদেব বোধ হয় এক বা দুই বৎসর গৌড়-সিংহাসনে আসীন ছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পরে তৎপুত্র তৃতীয় গোপালদেব গৌড় সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। তৃতীয় গোপালদেব বোধ হয় অতি অল্পকাল সিংহাসনে আসীন ছিলেন, এবং শৈশবেই গুপ্তঘাতকের হস্তে নিধন প্রাপ্ত হইয়াছিলেন[৯]। কুমারপালদেবের মহিষী অথবা অন্য কোন পুত্রের নাম অদ্যাবধি জানিতে পারা যায় নাই, এবং তাঁহার কোন শিলালিপি বা তাম্রশাসনও অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। তৃতীয় গোলাপদেবের মৃত্যুর পরে রামপালদেবের কনিষ্ঠপুত্র মদনপাল গৌড়-সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন[১০]। মদনপালদেব বোধ হয় শিশু ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত্যা করিয়া সিংহাসনের পথ প্রশস্ত করিয়াছিলেন। তৃতীয় গোপালদেবের রাজ্যকালের একখানি শিলালিপি শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় কর্ত্তৃক রাজসাহী জেলার অন্তর্গত মান্দাগ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছে[১১]। ইহা এক্ষণে কলিকাতার চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। শিল্পীর অসাবধানতার জন্য এই শিলালিপিটি ভ্রম পরিপূর্ণ এবং ইহার অনুবাদ করা অসম্ভব।

 মদনপালদেবের রাজত্বকালে পাল-সাম্রাজ্য, মগধ ও উত্তরবঙ্গে সীমাবদ্ধ ক্ষুদ্ররাজ্যে পরিণত হইয়াছিল। মগধের পূর্ব্বাংশ মাত্র এই সময়ে গৌড়েশ্বরের অধীন ছিল। তৃতীয় গোপালদেবের মৃত্যুর পরে বৈদ্যদেব কামরূপের স্বাধীন রাজা হইয়াছিলেন। তাঁহার চতুর্থ রাজ্যাঙ্কে প্রদত্ত তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, উহা সম্পাদন কালে তিনি পরমমাহেশ্বর-পরমবৈষ্ণব-মহারাজাধিরাজ-পরমেশ্বর-পরমভট্টারক উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত রাঢ় ও বঙ্গ বিজয়সেনের হস্তগত হইয়াছিল। বিজয়সেন ক্রমে গঙ্গাপার হইয়া বরেন্দ্রীর দক্ষিণাংশ অধিকার করিয়াছিলেন। রাজশাহী জেলার অন্তর্গত দেবপাড়া গ্রামে আবিষ্কৃত উমাপতিধর রচিত বিজয়সেনের প্রশস্তিতে তৎকর্ত্তৃক গৌড়েশ্বরের পরাজয়ের উল্লেখ আছে[১২]। বিজয়সেন বোধ হয় মদনপালদেবের অষ্টম রাজ্যাঙ্কের পরবর্ত্তী সময়ে সমগ্র বরেন্দ্রভূমি অধিকার করিয়াছিলেন এবং পাল-রাজগণকে চিরকালের জন্য তাঁহাদিগের পিতৃভূমি বরেন্দ্রী হইতে নির্ব্বাসিত করিয়াছিলেন। মদনপাল এই সকল যুদ্ধে কান্যকুব্জের গাহডবাল রাজবংশের রাজগণের নিকটে বিশেষ সাহায্য লাইয়াছিলেন[১৩]। কোন্ সময়ে, কিরূপে মদনপালের রাজ্যাবসান হইয়াছিল এবং তাঁহার কোন বংশধর পাল-সাম্রাজ্যের কোন অংশের অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন কিনা তাহা নির্ণয় করিবার কোন উপায়ই অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। মদনপালদেবই বোধ হয় পাল-রাজবংশের শেষ রাজা। খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে গোবিন্দপাল নামক একজন নরপতি কিয়ৎকালের জন্য মগধের অধিকার লাভ করিয়াছিলেন, কিন্তু সেন-রাজগণের আক্রমণে তাঁহার অধিকারের অধিকাংশ তাঁহার হস্তচ্যুত হইয়াছিল। পরবর্ত্তী অধ্যায়ে মুসলমান-বিজয়-প্রসঙ্গে গোবিন্দপালের রাজত্বের কথা আলোচিত হইবে[১৪]

 মদনপালদেবের একখানি তাম্রশাসন ও দুইখানি শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। মদনপাল তাঁহার অষ্টম রাজ্যাঙ্কে পৌণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির অন্তঃপাতী কোটীবর্ষবিষয়ে কাষ্ঠগিরি (?) গ্রাম, মহারাজ্ঞী পট্টমহাদেবী চিত্রমতিকাদেবীকে মহাভারত পাঠ করিয়া শুনাইবার দক্ষিণাস্বরূপ চম্পাহিট্টি নিবাসী বটেশ্বরস্বামীশর্ম্মা-নামক জনৈক ব্রাহ্মণকে দান করিয়াছিলেন[১৫]। মদনপালদেবের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে একটি ষষ্ঠীমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল[১৬]। এই মূর্ত্তিটি বিহার নগরে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। তাঁহার ঊনবিংশ রাজ্যাঙ্কে আর একটি মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল; এই মূর্ত্তিটি মুঙ্গের জেলায় জয়নগর গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল[১৭]। কিন্তু এই দুইটি মূর্ত্তির একটিরও সন্ধান পাওয়া যায় না।

 সেনবংশীয় রাজগণের পূর্ব্বপুরুষ কোন্ সময়ে বাঙ্গালা দেশে আসিয়াছিলেন তাহা অদ্যাপি নির্ণীত হয় নাই। তাঁহাদিগের তাম্রশাসন ও শিলালিপিসমূহে সর্ব্বপ্রথমে সামন্তসেনের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। সমস্ত খোদিতলিপিতেই দেখিতে পাওয়া যায় যে, তাঁহারা চন্দ্রবংশীয় কর্ণাটদেশবাসী ক্ষত্রিয় ছিলেন[১৮]। সেনবংশীয় রাজগণের খোদিত লিপিমালায় দেখিতে পাওয়া যায় যে, পূর্ব্বকালে চন্দ্রবংশে বীরসেন নামক একজন রাজা ছিলেন,[১৯] তাঁহার বংশে সামন্তসেন জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সামন্তসেনের পূর্ব্ববর্ত্তী সেনবংশীয়গণ রাঢ়দেশে বাস করিতেন। কাটোয়ার নিকটে সীতাহাটী গ্রামে আবিষ্কৃত বল্লালসেনদেবের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, “তাঁহার (সেই চন্দ্রদেবের) সমৃদ্ধ-বংশে অনেক রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন;—তাঁহারা বিশ্বনিবাসিগণকে নিরন্তর অভয়দান করিয়া বদান্য বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন; এবং ধবল কীর্ত্তিতরঙ্গে আকাশতলকে বিধৌত করিয়াছিলেন। তাঁহারা সদাচারপালনখ্যাতিগর্ব্বে গর্ব্বান্বিত রাঢ় দেশকে অননুভূতপূর্ব্ব প্রভাবে বিভূষিত করিয়াছিলেন।”

 “তাঁহাদিগের বংশে, প্রবলপ্রতাপান্বিত, সত্যনিষ্ঠ, অকপট, করুণাধার, শত্রুসেনাসাগরে প্রলয়তপন, সামন্তসেন জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি কীর্ত্তিজ্যোৎস্নায় সমুজ্জ্বল শোভা প্রাপ্ত হইয়া প্রিয়জনরূপ কুমুদবনের উল্লাসলীলাসম্পাদক শশধররূপে প্রতিভাত হইতেন; এবং আজন্ম স্নেহপাশনিবদ্ধ বন্ধুগণের মনোরাজ্যে সিদ্ধিপ্রতিষ্ঠায় শ্রীপর্ব্বতের ন্যায় বিরাজমান ছিলেন[২০]।”

 রাজসাহী জেলায় দেবপাড়া গ্রামে আবিষ্কৃত প্রদ্যুম্নেশ্বর মন্দিরের শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, সামন্তসেন কর্ণাটলক্ষ্মীর লুণ্ঠনকারী দস্যুগণকে একাকী নিহত করিয়াছিলেন[২১]। সামন্তসেন বৃদ্ধবয়সে গঙ্গাতীরে হোমধূম-সুগন্ধী ঋষিগণের বাসস্থানে বিচরণ করিতেন[২২]। সামন্তসেনের কোন খোদিত লিপি বা তাম্রশাসন অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। তাঁহার পত্নীর নামও সেন-রাজগণের কোন খোদিতলিপিতে দেখিতে পাওয়া যায় নাই। সামন্তসেনের পুত্রের নাম হেমন্তসেন। হেমন্তসেন সম্বন্ধে দেবপাড়ার শিলালিপিতে কথিত আছে যে, তিনি “নিজভুজ-মদমত্ত অরাতি”গণকে বিনাশ করিয়াছিলেন[২৩]। তাঁহার পত্নীর নাম যশোদেবী[২৪]। হেমন্তসেনের কোন খোদিতলিপি বা তাম্রশাসন অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। দেবপাড়ার শিলালিপি এবং বল্লালসেনের তাম্রশাসনে সামন্ত এবং বিজয়সেনের পূর্ব্বোক্ত পরিচয় অবগত হওয়া যায়। হেমন্তসেনের পুত্রের নাম বিজয়সেন[২৫]। পূর্ব্বে মদনপাল ও ভোজবর্ম্মদেবের রাজত্বকালের ঘটনা প্রসঙ্গে বিজয়সেনের কথার অবতারণা করিতে হইয়াছে। সেন-রাজবংশের খোদিতলিপিমালা হইতে বুঝিতে পারা যায় যে, বিজয়সেনই সেন-রাজবংশের প্রথম স্বাধীন নরপতি। অনুমান হয় যে, বিজয়সেন প্রথমে রাঢ়দেশের অংশবিশেষের এবং পরে সমগ্র রাঢ়দেশের অধিপতি হইয়াছিলেন। উৎকল-রাজ অনন্তবর্ম্মা চোড়গঙ্গ যথন গৌড় রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন তখন বিজয়সেন বোধ হয় পালবংশীয় গৌড়েশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন। যুদ্ধান্তে বোধ হয় সমগ্র উত্তররাঢ়া ও দক্ষিণরাঢ়া তাঁহার করতলগত হইয়াছিল। বিজয়সেনই বোধ হয় পূর্ব্ববঙ্গে বর্ম্মবংশীয় ভোজবর্ম্মা অথবা তাঁহার উত্তরাধিকারীর অধিকার লোপ করিয়াছিলেন। পালবংশীয় গৌড়েশ্বরগণের সহিত সেনবংশীয় রাজগণের প্রীতিবন্ধন ছিল না, কারণ রামপাল যখন দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইয়া সাহায্য ভিক্ষার জন্য দেশভ্রমণ করিতেছিলেন, তখন সেন-রাজগণ তাঁহাকে সাহায্য করেন নাই। তাঁহারা কৈবর্ত্ত-বিদ্রোহ দমনে যোগদান করিলে সন্ধ্যাকরনন্দী অবশ্যই রামচরিতের দ্বিতীয় অধ্যায়ে তাঁহাদিগের নামোল্লেখ করিতেন। দানসাগর নামক স্মৃতিনিবন্ধের মতে বিজয়সেন প্রথমেই বরেন্দ্র দেশের অধিপতি ছিলেন[২৬], কিন্তু শিলালিপি বা তাম্রশাসনের প্রমাণ হইতে এই কথা সমর্থিত হয় না। রাঢ় ও বঙ্গ অধিকৃত হইলে বিজয়সেন পাল-সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশ আক্রমণ করিয়াছিলেন। দেবপাড়ার শিলালিপি হইতে জানিতে পারা যায় যে, গৌড়েশ্বর বিজয়সেন কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন[২৭]। মদনপালের অষ্টম রাজ্যাঙ্কের পর বোধ হয় সমগ্র বরেন্দ্রভূমি বিজয়সেনের করতলগত হইয়াছিল। দেবপাড়ার শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, বিজয়সেন গৌড়েশ্বরকে পরাজিত করিয়া কামরূপাধিপতিকে দমন করিয়াছিলেন, এবং কলিঙ্গ-রাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন। কামরূপ ও কলিঙ্গবিজয়ের পরে বিজয়সেন নান্য, বীর, রাঘব ও বর্দ্ধন নামধেয় নরপতিগণকে পরাজিত করিয়াছিলেন[২৮]। এই সময়ে কে কামরূপের সিংহাসনে আসীন ছিলেন তাহা অদ্যাবধি নির্ণীত হয় নাই। বল্লভদেবের পিতামহ রায়ারিদেব[২৯] ত্রৈলোক্যসিংহ বোধ হয় তখনও কামরূপে স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করিতে সমর্থ হন নাই। এই সময়েও কলিঙ্গদেশে অনন্তবর্ম্মা চোড়গঙ্গদেবের অধিকারে ছিল[৩০]। তাঁহার গৌড়াভিযানের পরে বোধ হয় উৎকল-রাজ দ্বিতীয়বার রাঢ় আক্রমণ করিয়াছিলেন, এবং সেই সময়ে বোধ হয় বিজয়সেন তাঁহাকে পরাজিত করিয়াছিলেন। বিজয়সেন কর্ত্তৃক পরাজিত নান্যদেব মিথিলার রাজা। তিনি মিথিলার কার্ণাটক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। নেপালের রাজা জয়প্রতাপমল্লের শিলালিপিতে নান্যদেব কার্ণাটক রাজবংশের প্রথম রাজা বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন[৩১]। নেপাল-রাজগণের বংশাবলীতে কার্ণাটক রাজবংশের তালিকায় সর্ব্ব প্রথমে নান্যদেবের নাম দেখিতে পাওয়া যায়[৩২]। বার্লিনের প্রাচ্যবিদ্যানুশীলন সমিতির গ্রন্থাগারে ১০১৯ শকাব্দে (১০৯৭ খৃষ্টাব্দে) নান্যদেবের রাজত্বকালে লিখিত একখানি গ্রন্থ রক্ষিত আছে[৩৩]। ইহা হইতেও প্রমাণ হয় যে, মিথিলা-রাজ নান্যদেব বিজয়সেনের সমসাময়িক ব্যক্তি[৩৪]। বীর, গোবর্দ্ধন বা রাঘব নামধেয় রাজগণের কোন পরিচয় অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। তীরভুক্তি বা মিথিলা জয় করিয়া বিজয়সেন আর্য্যাবর্ত্তের পশ্চিমাংশ জয় করিবার জন্য নৌবিতান প্রেরণ করিয়াছিলেন[৩৫]। বোধ হয় পালবংশীয় গৌড়েশ্বরকে পরাজিত করিয়াছিলেন বলিয়াই কান্যকুব্জ-রাজ চন্দ্রদেব অথবা তৎপুত্র গোবিন্দচন্দ্র এই সময়ে আর্য্যাবর্ত্তের পূর্ব্বভাগ আক্রমণ করিয়াছিলেন। বিজয়সেন শূরবংশের দুহিতা বিলাসদেবীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার পুত্রের নাম বল্লালসেন। বিজয়সেন অন্যূন পঞ্চত্রিংশ বর্ষকাল গৌড়সিংহাসনে আসীন ছিলেন, কারণ তাঁহার ৩২শ রাজ্যাঙ্কে সম্পাদিত একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বিজয়সেন স্বর্গারোহণ করিয়াছিলেন, এবং বিলাসদেবীর গর্ভজাত তাঁহার পুত্র বল্লালসেন পিতৃরাজ্যের অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। বিজয়সেনদেবের একখানি শিলালিপি ও একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। শিলালিপিখানি পূর্ব্বোক্ত দেবপাড়ার শিলালিপি। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, বিজয়সেন প্রদ্যুম্নেশ্বর নামক শিবলিঙ্গের জন্য একটি বৃহৎ মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন, এবং তাহার সম্মুখে একটি বৃহৎ হ্রদ খনন করাইয়াছিলেন। রাজসাহী জেলার দেবপাড়া গ্রামে এই বৃহৎ হ্রদতীরে পাষাণনির্ম্মিত প্রদ্যুম্নেশ্বর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ অদ্যাপি বিদ্যমান আছে। প্রসিদ্ধ কবি উমাপতিধর কর্ত্তৃক এই প্রশস্তি রচিত হইয়াছিল এবং ইহা বারেন্দ্রক শিল্পীগোষ্ঠী-চূড়ামণি রাণক শূলপাণি কর্ত্তৃক উৎকীর্ণ হইয়াছিল[৩৬], বিজয়সেনের তাম্রশাসনখানি কোন্ স্থানে আবিষ্কৃত হইয়াছিল তাহা বলিতে পারা যায় না। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে জনৈক ভদ্রব্যক্তি ইহা পাঠোদ্ধারের জন্য আমার নিকট আনিয়াছিলেন। পাঠোদ্ধার শেষ হইলে তিনি উহা লইয়া গিয়াছেন এবং প্রতিশ্রুত হইয়াও আমাকে উহার উদ্ধৃতপাঠ প্রকাশ করিবার অবসর প্রদান করেন নাই। এখন শুনিতেছি, ইহা সুমেকার (Schumacher) নামক জনৈক বিদেশীয় ভদ্রলোকের সম্পত্তি[৩৭]১৯১৫ খৃষ্টারে প্রত্নতত্ত্ববিভাগের পূর্ব্বচক্রের তাৎকালীন অধ্যক্ষ ডাঃ ডি. বি. স্পুনার এই তাম্রশাসনের একখানি চিত্র আমাকে প্রেরণ করিয়া আমার উদ্ধৃতপাঠ প্রকাশ করিবার অনুমতি দিয়াছিলেন। তদনুসারে এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হইবার পরে আমি এই তাম্রশাসনের পাঠ প্রকাশ করিয়াছি। এই তাম্রশাসনখানির দ্বারা বিজয়সেনদেব তাঁহার মহিষী বিলাসদেবীর কনকতুলাপুরুষ মহাদানের হোমের দক্ষিণস্বরূপ পৌণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির খাড়ি বিষয়ের ঘাসসম্ভোগভাট্টবড়াগ্রামে চারিটি পাটক, মধ্যদেশের কান্তিযোঙ্গিবিনির্গত রত্নাকরদেবশর্ম্মার প্রপৌত্র, রহস্করদেবশর্ম্মার পৌত্র, ভাস্করদেবশর্ম্মার পুত্র, বাৎস্যগোত্রীয়, ঋগ্বেদের আশ্বলায়নশাখাধ্যায়ী ষড়ঙ্গের অনুশীলনকারী উদয়করশর্ম্মাকে তাঁহার দ্বাত্রিংশ রাজ্যাঙ্কে প্রদান করিয়াছিলেন। এই তাম্রশাসন “বিক্রমপুরোপকারিকামধ্যে” প্রদত্ত হইয়াছিল এবং ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, বিলাসদেবী শূরবংশজাতা[৩৮]

 খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমপাদে বিজয়সেনের পুত্র বল্লালসেন গৌড়-সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। বল্লালসেনের রাজ্যকালের কোন ঘটনাই অদ্যাবধি নির্দ্ধারিত হয় নাই। কুলশাস্ত্রসমূহে দেখিতে পাওয়া যায় যে, বল্লালসেন কৌলীন্যপ্রথার সৃষ্টি করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি স্বয়ং, তাঁহার পুত্র লক্ষ্মণসেন এবং পৌত্র কেশবসেন ও বিশ্বরূপসেন তাঁহাদিগের তাম্রশাসনসমূহে নবপ্রচলিত আভিজাত্যবিধির কোনই উল্লেখ করেন নাই এবং শাসনগ্রহীতা ব্রাহ্মণগণের নামোল্লেখকালেও তাঁহাদের নূতন পদমর্য্যাদা উল্লিখিত হয় নাই, এই কারণে কৌলিন্যপ্রথা বল্লালসেন কর্ত্তৃক সৃষ্ট হইয়াছিল কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ জন্মে। বল্লালসেন ‘দানসাগর’ নামক স্মৃতির নিবন্ধ[৩৯] ও ‘অদ্ভুতসাগর’[৪০] নামক জ্যোতিষের নিবন্ধ রচনা করিয়াছিলেন। এই গ্রন্থদ্বয়ের কোন কোন পুথিতে বল্লালসেনের কালবাচক এক বা ততোধিক শ্লোক দেখিতে পাওয়া যায়[৪১]। এই শ্লোকদ্বয় হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ১০৯০ শকাব্দে (১১৬৮ খৃষ্টারে) ‘দানসাগর’ রচিত হইয়াছিল[৪২] এবং ১০৯১ শকাব্দে ‘অদ্ভুতসাগর’ সমাপ্ত হইয়াছিল[৪৩]। অদ্যাবধি ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগরের’ যে সমস্ত পুথি আবিষ্কৃত হইয়াছে তন্মধ্যে কতকগুলিতে এই শ্লোকদ্বয় দেখিতে পাওয়া যায় না[৪৪]। ইহা হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, এই শ্লোকদ্বয় পরবর্ত্তীকালে প্রক্ষিপ্ত হইয়াছে। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু[৪৫], শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ[৪৬] ও শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী[৪৭] এই মানবাচক শ্লোকগুলিকে প্রক্ষিপ্ত বলিয়া স্বীকার করেন না। শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ কুমার[৪৮], শ্রীমান্ ননীগোপাল মজুমদার[৪৯] ও স্বর্গগত ডাক্তার হর্ণ্‌লি[৫০] আমার মত সমর্থন করিয়াছেন। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু স্বীকার করেন যে, এই শ্লোকগুলিতে গোল আছে। “কিন্তু ঐ শকাঙ্ক দুইটি সম্বন্ধে কিছু বলিবার আছে, যদি ১০৯০ শকে বৃদ্ধ বল্লালসেন প্রিয়পুত্র লক্ষ্মণসেনকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করিয়া থাকেন ও ‘অদ্ভুতসাগর’ অসম্পূর্ণ রাখিয়াই মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে ১০৯১ শকে আবার তাঁহাদ্বারাই ‘দানসাগর’ সম্পূর্ণ হইল কিরূপে[৫১]?” এই সমস্যার মীমাংসা করিবার জন্য বসুজ মহাশয়কে বলিতে হইয়াছে, “তাঁহার গুরুদেব অনিরুদ্ধভট্টই তাঁহার হইয়া ‘দানসাগর’ সমাধা করেন।” বলা বাহুল্য, প্রমাণাভাবে এই কথা স্বীকার করা উচিত নহে। বল্লালসেনের রাজত্বকালের একখানিমাত্র খোদিতলিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। ১৩১৭ বঙ্গাব্দে বর্দ্ধমান জেলার কাটোয়ার নিকটে, সীতাহাটী গ্রামে একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছিল, ইহাই বল্লালসেনের তাম্রশাসন। এই তাম্রশাসন দ্বারা বল্লালসেনদেব তাঁহার একাদশ রাজ্যাঙ্কে রাজ-মাতা বিলাসদেবীর সূর্য্যগ্রহণোপলক্ষে হেমাশ্ব মহাদানের দক্ষিণাস্বরূপ বর্দ্ধমানভুক্তির অন্তঃপাতী উত্তর-রাঢ়ামণ্ডলে বাল্লহিট্টগ্রাম বরাহদেবশর্ম্মার প্রপৌত্র, ভদ্রেশ্বর দেবশর্ম্মার পৌত্র, লক্ষ্মীধর দেবশর্ম্মার পুত্র, ভরদ্বাজ গোত্রীয় সামবেদী কৌথুমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী শ্রীশ্রীশ্রীবাসুদেবশর্ম্মাকে প্রদান করিয়াছিলেন[৫২]। এই তাম্রশাসনখানি এক্ষণে কলিকাতার চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। বল্লালসেন ১১১৮ অথবা ১১১৯ খৃষ্টাব্দে পরলোক গমন করিয়াছিলেন। বল্লালসেনের রাজত্বকালে হরিঘোষ তাঁহার সান্ধিবিগ্রহিক ছিলেন।

 ১১১৯ খৃষ্টাব্দে বল্লালসেনের পুত্র লক্ষ্মণসেন গৌড়সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার মাতার নাম রামদেবী, মাধাইনগরে আবিষ্কৃত লক্ষ্মণসেনদেবের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, রামদেবী চালুক্যবংশের দুহিতা[৫৩]। লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে কান্যকুব্জের গাহডবালবংশীয় রাজগণ মগধ আক্রমণ করিয়া অধিকার করিয়াছিলেন। পাল-রাজবংশের শেষ নরপতিগণ সম্ভবতঃ পিতৃভূমি বরেন্দ্রী হইতে তাড়িত হইয়া মগধে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। এইরূপ অনুমানের বিশেষ কারণ আছে, কারণ গোবিন্দপাল নামক জনৈক পালোপাধিধারী রাজা খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে মগধে রাজত্ব করিতেন[৫৪]। পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে, কান্যকুব্জের গাহডবাল বংশের রাজগণের সহিত মদনপালদেবের বন্ধুত্ব ছিল। সম্ভবতঃ মদনপালদেব অথবা তাঁহার উত্তরাধিকারী, সেনবংশীয় রাজগণ কর্ত্তৃক গৌড়ের অধিকারচ্যুত হইলে মদনপাল ও তাঁহার পুত্র গোবিন্দচন্দ্র তাঁহাদিগকে সেন-রাজগণের অত্যাচার হইতে রক্ষা করিবার জন্য, অথবা পিতৃরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিবার জন্য সসৈন্যে মগধ ও অঙ্গ আক্রমণ করিয়াছিলেন। গোবিন্দচন্দ্র কর্ত্তৃক মগধ আক্রমণের প্রমাণ তাঁহার দুইখানি তাম্রশাসন হইতে পাওয়া গিয়াছে। গোবিন্দচন্দ্রদেব ১১১৪ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে কান্যকুব্জের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন[৫৫]। রাজ্যাভিষেকের প্রথম ত্রয়োদশ বৎসর মধ্যে মগধের অধিকাংশ তাঁহার অধিকারভুক্ত হইয়াছিল, কারণ ১১৮৩ বিক্রমাব্দে তিনি মগধদেশের একখানি গ্রাম জনৈক ব্রাহ্মণকে দান করিয়াছিলেন। উক্ত বর্ষের জ্যৈষ্ঠমাসের কৃষ্ণা একাদশীতে গোবিন্দচন্দ্রদেব রবিবাসরে কান্যকুব্জে গঙ্গাস্নান করিয়া মণিঅরি পত্তলায় অবস্থিত পাদোলি ও গুণাবে গ্রাম গণেশ্বর শর্ম্মা নামক কাশ্যপগোত্রীয় জনৈক ব্রাহ্মণকে দান করিয়াছিলেন[৫৬]। এই তাম্রশাসনখানি এক্ষণে পাটনা জেলায় জনৈক ব্রাহ্মণের নিকট আছে। অধ্যাপক শ্রীযুক্ত যদুনাথ সরকার আমাকে ইহার একখানি চিত্র প্রদান করিয়াছিলেন। এই তাম্রশাসনে উল্লিখিত মণিঅরি এবং গঙ্গা ও শোণের সঙ্গমরূলে অবস্থিত বর্ত্তমান মনের বা মুনের গ্রাম অভিন্ন। মুসলমান বিজয়কালে মহম্মদ বখ্‌তিয়ার তাঁহার ভিওয়ালি গ্রামের জায়গীরে থাকিয়া মনের ও বিহার লুণ্ঠন করিতে আসিতেন। ১২০২ বিক্রমাব্দে গোবিন্দচন্দ্র অঙ্গদেশের কিয়দংশ পর্য্যন্ত অধিকার করিয়া মুদ্গগিরি বা মুঙ্গের পর্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন। উক্ত বর্ষের বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষে অক্ষয় তৃতীয়ায় গোবিন্দচন্দ্রদেব মুদ্গগিরিতে গঙ্গাস্নান করিয়া জনৈক ব্রাহ্মণকে একখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন[৫৭]। এই তাম্রশাসনদ্বয় গোবিন্দচন্দ্র কর্ত্তৃক মগধ ও অঙ্গ অধিকারের স্পষ্ট প্রমাণ। গোবিন্দচন্দ্র বোধ হয় পালবংশীয় নরপালগণের সাহায্যার্থ মগধ আক্রমণ করিয়াছিলেন। কিন্তু দেশ অধিকৃত হইলে তিনি উহা পাল-রাজগণকে প্রত্যর্পণ করেন নাই। লক্ষ্মণসেনের পুত্র কেশবসেন ও বিশ্বরূপসেনের তাম্রশাসনদ্বয়ে দেখিতে পাওয়া যায় যে, লক্ষ্মণসেন বারাণসীতে এবং প্রয়াগে জয়স্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন[৫৮]। বোধ হয় মগধে কান্যকুব্জ-রাজের সহিত যুদ্ধের সময়ে লক্ষ্মণসেন বারাণসী ও প্রয়াগ অবধি অগ্রসর হইয়াছিলেন। মাধাইনগরে আবিষ্কৃত লক্ষ্মণসেনদেবের তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তিনি প্রথম যৌবনে কলিঙ্গের অঙ্গনাগণের সহিত কেলি করিয়াছিলেন[৫৯]। এতদ্বারা বোধ হয় সূচিত হইতেছে যে, লক্ষ্মণসেন এক সময়ে কলিঙ্গদেশ আক্রমণ করিয়াছিলেন। মাধাইনগরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসন হইতে আরও অবগত হওয়া যায় যে, তিনি কামরূপ জয় করিয়াছিলেন[৬০]। লক্ষ্মণসেনের মহিষীর নাম তান্দ্রাদেবী বা তাড়াদেবী[৬১]। ইঁহার গর্ভে লক্ষ্মণসেন দুই পুত্র উৎপাদন করিয়াছিলেন। ইঁহাদিগের নাম বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন এবং ইঁহারা যথাক্রমে লক্ষ্মণসেনদেবের মৃত্যুর পরে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। লক্ষ্মণসেনদেবের রাজত্বের শেষভাগে মগধ সেন-রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল, কারণ বুদ্ধগয়ায় দুইখানি শিলালিপিতে লক্ষ্মণসেনের রাজ্যাভিষেককালে প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মণাব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে[৬২]। তাঁহার রাজত্বের শেষভাগে গোবিন্দপালদেব নামক জনৈক রাজা মগধের কিয়দংশের রাজা হইয়াছিলেন।

 লক্ষ্মণসেনদেবের পাঁচখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। তাঁহার রাজত্বকালের তৃতীয় বর্ষে ভাদ্রমাসের তৃতীয় দিবসে তিনি হেমাশ্বরথ দানের দক্ষিণাস্বরূপ পৌণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির অন্তঃপাতী বরেন্দ্রমণ্ডলে বেলহিষ্টী গ্রাম “শ্রীমদ্বিক্রমপুর সমাবাসিত জয়স্কন্ধাবার হইতে” ঈশ্বরদেবশর্ম্মা নামক জনৈক ভরদ্বাজ গোত্রীয় ব্রাহ্মণকে প্রদান করিয়াছিলেন[৬৩]। দিনাজপুর জেলায় তর্পণদীঘি গ্রামে এই তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছিল এবং ইহা এখন বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। তাঁহার তৃতীয় রাজ্যাঙ্কের ভাদ্রমাসের নবম দিবসে তিনি পৌণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির অন্তঃপাতী ব্যাঘ্রতটী গ্রাম কৌশিক গোত্রীয় যজুর্ব্বেদীয় রঘুদেবশর্ম্মাকে প্রদান করিয়াছিলেন। এই তাম্রশাসনখানি নদীয়া জেলায় আনুলিয়া গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় ইহা ক্রয় করিয়াছেন[৬৪]। পাবনা জেলার অন্তর্গত মাধাইনগর গ্রামে লক্ষ্মণসেনদেবের তৃতীয় তাম্রশাসনখানি আবিষ্কৃত হইয়াছিল। এই তাম্রশাসনের শেষাংশ ক্ষয় হইয়া যাওয়ায় ইহা কোন্ বর্ষে সম্পাদিত হইয়াছিল, তাহা নির্ণয় করিতে পারা যায় নাই। এতদ্বারা লক্ষ্মণসেন পৌণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তির অন্তঃপাতী বরেন্দ্রমণ্ডলে কিঞ্চিৎ ভূমি কৌশিক গোত্রীয় গোবিন্দদেবশর্ম্মাকে প্রদান করিয়াছিলেন[৬৫]। লক্ষ্মণসেনদেবের চতুর্থ তাম্রশাসনখানি সুন্দরবনে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ৺ রামগতি ন্যায়রত্ন ইহার আংশিক পাঠোদ্ধার করিয়াছিলেন[৬৬]। এখন আর ইহার সন্ধান পাওয়া যায় না। লক্ষ্মণসেনদেবের পঞ্চম তাম্রশাসনখানি চব্বিশ পরগণা জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। অধ্যাপক শ্রীযুক্ত অমূল্যচরণ ঘোষ বিদ্যাভূষণ ইহার পাঠ বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের এক মাসিক অধিবেশনে পাঠ করিয়াছিলেন, কিন্তু ইহার উদ্ধৃত পাঠ অদ্যাবধি প্রকাশিত হয় নাই; লক্ষ্মণসেনের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে বঙ্গে ‘অধিকৃত’ নারায়ণ কর্ত্তৃক একটি পাষাণময়ী চণ্ডী-মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল[৬৭]

 লক্ষ্মণসেনদেবের রাজত্বকাল সেন-রাজবংশের চরম উন্নতির সময়। ধোয়ী, জয়দেব, প্রভৃতি কবিগণ তাঁহার সভা অলঙ্কৃত করিতেন। লক্ষ্মণসেন স্বয়ং সুকবি ছিলেন। তাঁহার অমাত্য বটুদাসের পুত্র শ্রীধরদাস কর্ত্তৃক সংগৃহীত ‘সদুক্তিকর্ণামৃতে’ তাঁহার রাজত্বকালের কবিগণের বহু শ্লোক দেখিতে পাওয়া যায়। রামপালদেবের রাজত্বকাল হইতে গৌড়ীয় ভাস্কর শিল্পের পুনরুন্নতি আরব্ধ হইয়াছিল। লক্ষ্মণসেনের সময়ে গৌড়ীয় শিল্প উন্নতির অতি উচ্চ সোপানে আরোহণ করিয়াছিল। এই যুগের নিদর্শনগুলি প্রথম পাল-সাম্রাজ্যের শিল্প-নিদর্শনসমূহের সমতুল না হইলেও তদপেক্ষা অধিক হীন নহে। লক্ষ্মণসেনদেব প্রায় ত্রিংশৎ বর্ষ কাল গৌড়-সিংহাসনে আসীন ছিলেন। ১১৭০ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছিল।

 লক্ষ্মণসেনদেবের রাজ্যাভিষেককাল হইতে একটি নূতন অব্দ গণনা আরম্ভ হইয়াছিল। ইহা ‘লক্ষ্মণাব্দ’, ‘লক্ষ্মণ সংবৎ’ বা ‘লসং’ নামে পরিচিত। মুসলমান-বিজয়ের পরে এই অব্দ বহুকাল মিথিলায় ব্যবহৃত হইয়াছিল এবং শুনিতে পাওয়া যায় যে, বর্ত্তমান সময়েও ইহা সময়ে সময়ে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। জগদ্বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ্ স্বর্গীয় ডাঃ কিলহর্ণ গণনা করিয়া স্থির করিয়াছেন যে, এই অব্দ ১১১৮-১৯ খৃষ্টাব্দ হইতে গণিত হইতেছে[৬৮]। লক্ষ্মণাব্দের উৎপত্তি সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। ডাঃ কিলহর্ণের মতই ইহার মধ্যে সমীচীনতর বলিয়া বোধ হয়। এই অনুসারে লক্ষণসেনদেবের অভিষেককাল হইতে লক্ষ্মণাব্দ গণিত হইয়াছে[৬৮]। দ্বিতীয় মত, প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ্ স্বর্গীয় মনোমোহন চক্রবর্ত্তী কর্ত্তৃক প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল; চক্রবর্ত্তী মহাশয় বলেন যে, সামন্তসেনের রাজ্যাভিষেক কাল হইতে লক্ষ্মণাব্দ গণিত হইতেছে[৬৯]। তৃতীয় মত, তিব্বতদেশীয় ইতিহাসকার লামা তারানাথ কর্ত্তৃক প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল, তদনুসারে লক্ষ্মণাব্দ হেমন্তসেনের রাজ্যাভিষেক কাল হইতে গণিত হইতেছে[৭০]। চতুর্থ মত, ৺ভিন্সেণ্ট স্মিথ কর্ত্তৃক প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল, তদনুসারে বিজয়সেনের রাজ্যাভিষেক কাল হইতে লক্ষ্মণাব্দ গণিত হইতেছে[৭১]। পঞ্চম মতানুসারে লক্ষ্মণাব্দ দুইটি, প্রথমটি ১১১৯ খৃষ্টাব্দ হইতে গণিত হইয়াছে এবং দ্বিতীয়টি মুসলমান-বিজয়কাল হইতে, অর্থাৎ—১২০০ খৃষ্টাব্দ হইতে গণিত হইয়াছে। শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ[৭২], শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু[৭৩] ও শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী[৭৪] এই মতের প্রবর্ত্তক। ভট্টশালী মহাশয় বলেন যে, দ্বিতীয় লক্ষ্মণাব্দ বর্ত্তমান সময়ে পরগণাতিসন নামে পূর্ব্ববঙ্গে প্রচলিত আছে[৭৫]। এই সকল ভিন্ন ভিন্ন মতের নিরসন অতি সহজ। যে অব্দের নাম লক্ষ্মণাব্দ, তাহা লক্ষ্মণসেনের কোন পূর্ব্ব পুরুষ কর্ত্তৃক প্রচলিত হইতে পারে না। ভারতবর্ষের ইতিহাসে কোন রাজবংশের কোন উত্তরপুরুষ, পূর্ব্বপুরুষ প্রচলিত অব্দ স্বনামে পুনঃ প্রচলিত করেন নাই। সুতরাং প্রমাণাভাবে লক্ষ্মণাব্দকে সামন্তসেন, হেমন্তসেন, বিজয়সেন অথবা বল্লালসেন কর্ত্তৃক প্রবর্ত্তিত অব্দ বলা যাইতে পারে না। যাঁহারা ঐতিহাসিক তথ্যের অনুসন্ধান করিতে যাইয়া পূর্ব্ব সংস্কার পরিত্যাগ করিতে ক্লেশানুভব করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের প্রবর্ত্তিত একাধিক লক্ষ্মণাব্দের অস্তিত্ব সম্বন্ধে অধিক কথা বলা উচিত নহে। আর্য্যাবর্ত্ত বা দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসে এক রাজা কর্ত্তৃক একাধিক অব্দ প্রচলনের একটিও দৃষ্টান্ত অন্বেষণ করিয়া পাওয়া যায় না। কোন রাজ্য ধ্বংসের কাল হইতে একটি অব্দ গণিত হইবার দৃষ্টান্তও ভারতের ইতিহাসে নাই এবং ইহা সম্ভবপর বলিয়া বিদ্বজ্জনমণ্ডলীর বিশ্বাস আছে—বর্ত্তমান সময়ে ইহা দেখিলেও দুঃখিত হইতে হয়। গৌপ্তাব্দের প্রকৃত কাল নির্দ্ধারিত হইবার পূর্ব্বে যাঁহারা মনে করিতেন যে, গুপ্তবংশ ধবংসের কাল হইতে গৌপ্তাব্দ গণিত হইতেছে, তাঁহারা পরিশেষে কিরূপ পরিহাসস্পদ হইয়াছিলেন তাহা সকলেরই স্মরণ রাখা উচিত।

 খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর কোন সময়ে মহামাণ্ডলিক উপাধিধারী কায়স্থ অথবা গোপ জাতীয় সামন্ত-রাজগণ স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। দিনাজপুর জেলায় মালদোয়ার রাজ-ষ্টেটের দপ্তরখানায় বহুকাল হইতে একখানি তাম্রশাসন সযত্নে রক্ষিত হইতেছে। মালদোয়ার ষ্টেট ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দে প্রথমবার কোর্ট-অব-ওয়ার্ডসের অধীন হইবার সময়ে এই তাম্রশাসনখানিও তালিকাভুক্ত হইয়াছিল[৭৬]। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, রাঢ়দেশের অধিপতির পুত্র ধূর্ত্তঘোষ, তাঁহার পুত্রের নাম শ্রীবালঘোষ, বালঘোষের পুত্রের নাম ধবলঘোষ। সদ্ভাবা নাম্নী পত্নীর গর্ভে ধবলঘোষের ঈশ্বরঘোষ নামক এক পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। ঈশ্বরঘোষ ঢেক্করী হইতে পিয়োল্ল মণ্ডলান্তঃপাতী গাল্লিটিপ্যকবিষয়ে দিগ্ঘাসোদিয়াগ্রাম, ভার্গব গোত্রীয় ভট্ট শ্রীনিব্বোকশর্ম্মা নামক জনৈক যজুর্ব্বেদীয় ব্রাহ্মণকে মার্গশীর্ষের সংক্রান্তিতে জটোদায় স্নান করিয়া প্রদান করিয়াছিলেন[৭৭]। এই তাম্রশাসন ঈশ্বরঘোষের পঞ্চত্রিংশ রাজ্যাঙ্কে সম্পাদিত হইয়াছিল। শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় এই তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধার করিয়াছেন, কিন্তু তিনি ইহার কাল নির্দ্দেশ করেন নাই। তৎকর্ত্তৃক প্রকাশিত চিত্রে, ইহার অক্ষর দেখিয়া বোধ হয় যে, এই তাম্রশাসনখানি বিজয়সেন অথবা বল্লালসেনের তাম্রশাসনের পূর্ব্বে উৎকীর্ণ হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত অন্য প্রমাণাভাবে ঈশ্বরঘোষের তাম্রশাসন সম্বন্ধে কোন কথাই বলা যাইতে পারে না।

 খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষপাদে সেন উপাধিধারী দুইজন রাজা মগধের দক্ষিণভাগে রাজত্ব করিতেন। ইঁহারা সম্ভবতঃ সেন-রাজবংশজাত এবং লক্ষ্মণসেনের রাজ্যকালে মগধ বিজিত হইলে উহার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। পরে সেন-রাজবংশের অধঃপতনের সময়ে তাঁহারা স্বাধীনতা লাভ করিয়াও রাজোপাধি গ্রহণ করেন নাই। এই বংশের প্রথম রাজা বুদ্ধসেন। মহাবোধিমন্দিরের প্রাঙ্গণের পাষাণাচ্ছাদনের একখানি প্রস্তর ফলকে বহু পূর্ব্বে একখানি শিলালেখ আবিষ্কৃত হইয়াছিল[৭৮]। ইহা হইতে জানিতে পারা যায় যে, রাজপুতানার সপাদলক্ষ দেশের অধিপতির এবং কমাদেশের রাজগুরু ভিক্ষু পণ্ডিত শ্রীধর্ম্মরক্ষিত যখন বুদ্ধ গয়ায় আসিয়াছিলেন তখন বুদ্ধসেনদেব পীঠি প্রদেশের অধিপতি ছিলেন। ১৮১৩ বুদ্ধনির্ব্বাণাব্দে ধর্ম্মরক্ষিত বুদ্ধগয়ায় একটি গন্ধকূটী নির্ম্মাণে ব্যাপৃত ছিলেন[৭৯]। অধ্যাপক শ্রীযুক্ত ননীগোপাল মজুমদার অনুমান করেন যে, বুদ্ধগয়ার মন্দির প্রাঙ্গনের এই শিলালিপিতে উল্লিখিত বুদ্ধসেন গয়ার ১৮১৩ বুদ্ধনির্ব্বাণাব্দের শিলালিপিতে উল্লিখিত মগধ-রাজ[৮০]। প্রত্নতত্ত্ববিভাগের পূর্ব্বচক্রের ভূতপূর্ব্ব সহকারী অধ্যক্ষ স্বর্গগত পণ্ডিত হরনন্দন পাণ্ডেয় বুদ্ধগয়া বা মহাবোধিগ্রামের তিনক্রোশ পূর্ব্বে অবস্থিত জানিবিঘা গ্রামে এই বুদ্ধসেনের পুত্র জয়সেনের দান সম্বন্ধীয় একখানি শিলালিপি ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে আবিষ্কার করিয়াছিলেন[৮১]। এই শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, লক্ষ্মণসেনদেবের অতীত রাজ্যের ৮৩ সম্বৎসরে কার্ত্তিক মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চদশ দিবসে, পীঠি প্রদেশের অধিপতি বুদ্ধসেনের পুত্র আচার্য্য রাজা জয়সেন সপ্তঘট্টে অবস্থিত কোট্ঠলা গ্রাম শ্রীমদ্বজ্রাসনের জন্য সিংহল দেশীয় ভিক্ষু মঙ্গলস্বামীকে দান করিয়াছিলেন। এই শিলালিপি হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, রামচরিত[৮২] ও সারনাথে আবিষ্কৃত গাহড্বাল-রাজ গোবিন্দচন্দ্রের মহিষী কুমারদেবীর শিলালিপিতে[৮৩] উল্লিখিত পীঠি প্রদেশ বর্ত্তমান গয়া জেলার প্রাচীন নাম এবং খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষপাদে এই প্রদেশ সেন উপাধিধারী দুইজন রাজার অধিকারভুক্ত ছিল; কারণ তাঁহারা লক্ষ্মণসেন কর্ত্তৃক প্রবর্ত্তিত অব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। এই শিলালিপি হইতে আরও প্রমাণ হইতেছে যে, ১১৯৯ খৃষ্টাব্দে প্রাচীন উদ্দণ্ডপুর ও নালন্দ (বর্ত্তমান বিহার নগর ও বড্গাঁও গ্রাম) এবং বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হইলেও বুদ্ধগয়া ধ্বংস হয় নাই এবং তথায় বুদ্ধসেনের পুত্র জয়সেন ১২০২ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত রাজ্য করিয়াছিলেন।


পরিশিষ্ট (ঞ)

 সেন-রাজবংশ:—

 
বীরসেন
 
 
 
 
 
 
 
সামন্তসেন
 
 
 
 
 
 
 
হেমন্তসেন
 
যশোদেবী
 
 
 
 
 
 
 
 
বিজয়সেন
 
বিলাসদেবী (শূর-রাজবংশের কন্যা)
 
 
 
 
 
 
 
 
বল্লালসেন
 
রামদেবী (চালুক্যবংশের কন্যা)
 
 
 
 
 
 
 
 
লক্ষ্মণসেন
 
তাড়াদেবী বা তান্দ্রাদেবী
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
মাধবসেনকেশবসেনবিশ্বরূপসেন
 
 

 স্বর্গগত ভিন্সেণ্ট স্মিথ বলেন যে, বিজয়সেন কর্ত্তৃক পরাজিত ‘বীর’ নরকের বংশজাত বীরবাহু, (Early History of India, 3rd Edition, p. 422)। বীরবাহুর পুত্রের নাম বলবর্ম্মা। বলবর্ম্মার একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে, (Report on the Progress of Historical Research in Assam, p. 11)। ইহার অক্ষর দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, বলবর্ম্মার পিতা কখনই একাদশ শতাব্দীর লোক হইতে পারেন না। পরম শ্রদ্ধাস্পদ ৺মনোমাহন চক্রবর্ত্তী মহাশয় বলেন (Journal and Proceedings, Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. I, p. 47,) যে, বিজয়সেন কর্ত্তৃক পরাজিত রাঘব, অনন্তবর্ম্মা চৌড়গঙ্গের পৌত্র (Epigraphia Indica, Vol. VI, App. I, p. 17)।

 দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর:—

 দানসাগরের কয়েকখানি পুথিতে গ্রন্থ-রচনার কালবাচক নিম্নলিখিত শ্লোকটি দেখিতে পাওয়া যায়:—

নিখিলচক্রতিলকশ্রীমদ্বল্লালসেনেন পূর্ণে।
শশিনবদশমিতে শকবর্ষে দানসাগরো রচিতঃ॥

 বিশ্বকোষ-কার্য্যালয়ে রক্ষিত একখানি পুথিতে এবং বিলাতে ইণ্ডিয়া অফিসে অক্ষিত আর একখানি পুথিতে এই শ্লোকটি দেখিতে পাওয়া যায়। বিশ্বকোষ কার্য্যালয়ের পুথিতে এতদ্ব্যতীত আরও দুইটি শ্লোক আছে:—

রবিভগনাঃ শরশিষ্টা যে ভূতা দানসাগরস্যাস্য।
ক্রমশোঽত্র সংপরিদানুদাদ্যা বৎসরা পঞ্চ॥
তদেবমেকনবত্যধিকবর্ষসহস্রারেঽন্বিতে শাকে
সংবৎসরাঃ পতন্তি বিশ্বপদারভ্য চ।

 এই শ্লোকদ্বয় সকল পুথিতে দেখিতে পাওয়া যায় না। অদ্ভুতসাগর রচনাকাল সম্বন্ধে কোন পুথিতে একটি শ্লোক দেখিতে পাওয়া যায়:—

শাকে খনবখেন্দ্বাখ্যে আরেভেঽদ্ভুতসাগরম্।
গৌড়েন্দ্রকুঞ্জরালানস্তম্ভবাহুর্ম্মহীপতিঃ॥

 দানসাগর ও অদ্ভুতসাগরের সমস্ত পুথিতে যখন এই শ্লোকগুলি দেখিতে পাওয়া যায় না, তখন এইগুলিকে প্রক্ষিপ্ত বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। এই গ্রন্থদ্বয়ের যতগুলি পুথি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার কোনখানিই দুই তিন শত বৎসরের অধিক পুরাতন নহে। ইহার প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া সমসাময়িক খোদিতলিপির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ বিজ্ঞানসম্মত-প্রণালী-অনুমোদিত নহে।

 ডাঃ হর্ণ্‌লি এই সম্বন্ধে লিখিয়াছেন:—

 I thank you very much for the offprint of your paper on Lakshmana Sena, which I received by this week’s mail. It is a very interesting and scholarly paper, and I am quite disposed to agree with your argumentation regarding the true date of Lakshmana Sena’s death.

 You are certainly right in saying that contemporary Epigraphical records are worth more than more or less modern copies of literary works..........This too, however, is a minor point; and as I said I think you are right in your general argument. It is a real pleasure to meet with such scholarly historical research, on which I congratulate you.

—Letter, dated, 3rd January, 1914.

 পরম স্নেহাস্পদ অধ্যাপক শ্রীমান্ ননীগোপাল মজুমদার সম্প্রতি লক্ষ্মণসেনের অব্দ সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া প্রমাণ করিয়াছেন যে, লক্ষ্মণাব্দ নিশ্চয়ই লক্ষ্মণসেনের রাজ্যকাল হইতে গণিত।—Indian Antiquary, Vol. XLVIII, 1919, pp. 171-76.

 অধ্যাপক শ্রীযুক্ত অমূল্যচরণ ঘোষ বিদ্যাভূষণ গোবিন্দপুরে আবিষ্কৃত লক্ষ্মণসেনের তাম্রশাসনের দুইখানি ফটোগ্রাফ গ্রন্থের একাদশ পরিচ্ছেদ মুদ্রণকালে গ্রন্থকারকে দিয়াছিলেন। তর্পণদীঘির ও আনুলিয়ার তাম্রশাসনের ন্যায় এই তাম্রশাসনখানাও লক্ষ্মণসেনের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে প্রদত্ত হইয়াছিল। ইহা লক্ষ্মণসেনের অন্যান্য তাম্রশাসনের ন্যায় বিক্রমপুর সমাবাসিত জয়স্কন্ধাবার হইতে প্রদত্ত এবং মহাসান্ধিবিগ্রহিক নারায়ণদত্ত এই তাম্রশাসনের দূতক। এই তাম্রশাসন দ্বারা লক্ষ্মণসেনদেব বর্দ্ধমানভুক্তির অন্তর্গত পশ্চিম খাটিকায় বেতড্ড চতুরষ্কে ৬০ দ্রোণ ১৭ উন্মান ভূমি বাৎস্যগোত্রীয় শ্রীব্যাসদেবশর্ম্মাকে প্রদান করিয়াছিলেন। তখন এক দ্রোণ পরিমাণ ভূমির বাৎসরিক আয় ১৫ পূরাণ বা রজতমুদ্রা ছিল এবং এক নলের পরিমাণ ৬৫ হস্ত ছিল। বেতড্ড বর্ত্তমান হাওড়া জেলায় অবস্থিত বেতড় গ্রাম। বেতড় কলিকাতার উৎপত্তির পূর্ব্বকাল পর্য্যন্ত একটি বিখ্যাত গঞ্জ ছিল। বড় বড় বিলাতী জাহাজ ভাগীরথী বহিয়া সপ্তগ্রাম পর্য্যন্ত পৌঁছিতে পারিত না বলিয়া বেতড়ে আসিয়া নোঙ্গর করিত এবং বিলাতী জাহাজ ভারতীয় মাল বোঝাই করিয়া চলিয়া গেলে লোকে বাজার পুড়াইয়া দিয়া চলিয়া যাইত। গঙ্গার দক্ষিণে ও ভাগীরথীর পশ্চিমে অবস্থিত ভূখণ্ডের নাম বর্দ্ধমানভুক্তি। এই তাম্রশাসনে তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়, কারণ প্রদত্ত ভূমির পূর্ব্ব সীমায় জাহ্নবী। পূর্ব্বে বল্লালসেনের তাম্রশাসনে প্রদত্ত উত্তর-রাঢ়ামণ্ডলের বাল্লহিট্টগ্রাম এই বর্দ্ধমানভুক্তিতে অবস্থিত।

 অধ্যাপক শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য “লক্ষ্মণসেন ও তাঁহার পূর্ব্বপুরুষগণের তারিখ” সম্বন্ধে একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। ভট্টাচার্য্য মহাশয় এই প্রবন্ধে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, দানসাগরে ও অদ্ভুতসাগরে বল্লালসেনের যে তারিখ দেওয়া আছে তাহাই ঠিক, কারণ লক্ষ্মণসেনের বন্ধু ও সামন্ত বটুদাসের পুত্র শ্রীধরদাস রচিত “সদুক্তিকরণামৃত” ১২০৬ খৃষ্টাব্দে রচিত হইয়াছিল। ভট্টাচার্য্য মহাশয় ইহা বুঝাইতে পারেন নাই যে, লক্ষ্মণসেন যদি ১১৭০ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে ইহলোক পরিত্যাগ করিয়া থাকেন তাহা হইলে তাঁহার বন্ধু ও সমকালীন ব্যক্তির পুত্র ১২০৬ খৃষ্টাব্দে কেন গ্রন্থরচনা করিতে পারিবেন না। এই ভট্টাচার্য্য মহাশয় মিথিলার কার্ণাটক বংশের রাজা নান্যদেবের তারিখ সম্বন্ধে একটি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া তাহার মূল সন্ধান করিয়া পান নাই অথচ তাহা স্বীকার করিতেও লজ্জাবোধ করেন নাই। “পাল-রাজবংশের তারিখ” নামক প্রবন্ধে এই ভট্টাচার্য্য মহাশয় “শেখ-শুভোদয়ার” রামপালের মৃত্যুকালবাচক একটি শ্লোকের পরিবর্ত্তন করিতে গিয়া যেরূপ হাস্যাস্পদ হইয়াছেন, “দানসাগর” ও “অদ্ভুতসাগর” বল্লালসেনের রচনা বলিয়া প্রমাণ করিতে গিয়া ততোধিক হাস্যাস্পদ হইয়াছেন। দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর কি জন্য বল্লালসেনের রচনা বলিয়া গৃহীত হইতে পারে না তাহার প্রমাণ গ্রন্থ মধ্যে প্রদত্ত হইয়াছে এবং ভট্টাচার্য্য মহাশয় এমন কোন প্রমাণই দেখাইতে পারেন নাই যাহার জন্য লোকে বিশ্বাস করিতে বাধ্য হইবে যে, লক্ষ্মণসেন ১১১৯ খৃষ্টাব্দে জন্মিয়াছিলেন এবং ১১৬৯ খৃষ্টাব্দে সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের প্রবন্ধ, শ্রীমান্ ননীগোপাল মজুমদারের প্রবন্ধের পরে প্রকাশিত হইয়াছে বটে কিন্তু ইহাতে নূতন প্রমাণ বা যুক্তি কিছুই নাই।—Indian Antiquary, Vol. XLIX, 1920, pp. 189-193, A chronology of the Pala Dynasty of Bengal; Date of Lakshmanasena and his predecessors—Indian Antiquary, Vol. LI, 1922, pp. 145-48, 153-58.


  1. সোয়ং রামনরেন্দ্রজস্য সচিবঃ সাম্রাজ্যলক্ষ্মীজুষঃ
    প্রখ্যাতস্য কুমারপালনৃপতেশ্চিত্তানুরূপোঽভবৎ।
    যস্যারাতি-কিরীট-হাটক-কৃত-প্রাসাদ-কণ্ঠীরব-
    গ্রাস-ত্রাস-বশাদপৈষ্যতি বিধোর্বিম্বাঙ্করূপী মৃগঃ॥ ৯
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৩০।

  2. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৩০, ১৩৯।
  3. গৃহ্ণাতি স্ম করং ভূমের্গঙ্গাগোতমগঙ্গয়োঃ।
    মধ্যে পশ্যৎসু বীরেষু প্রৌঢ়ঃ প্রৌঢ়ঃস্ত্রিয়া ইব॥ ২২
     —দ্বিতীয় নরসিংহের তাম্রশাসন—Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1896, pt. I, p. 239.

  4. আরম্যানগরাৎ কলিঙ্গজবলপ্রত্যুগ্রভগ্নাবৃতি
    প্রাকারায়ততোরণপ্রভৃতিতো গঙ্গাতটস্থাত্ততঃ।
    পার্থাস্ত্রৈর্যুধি জর্জ্জরীকৃতনমদ্রাধেয়গাত্রাকৃতি
    র্ম্মন্দারাধিপতিগর্গতো রণভুবো গঙ্গেশ্বরানুদ্রুতঃ॥ ৩০
    —Ibid, p. 241.

  5. যস্যানুত্তরবঙ্গসঙ্গরজয়ে নৌবাটহীহীরব
    ত্রস্তৈর্দ্দিক্করিভিশ্চ যন্নচলিতং চেন্নাস্তি তদ্গম্যভূঃ।
    কিঞ্চোৎপাতুককেনিপাতপতনপ্রোৎসর্পিতৈঃ শীকরৈ
    রাকাশে স্থিরতাকৃতা যদি ভবেৎ স্যান্নিষ্কলঙ্কঃ শশী॥ ১১
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৩০।

  6. এতাদৃশোহরিহরিদ্ভুবিসৎকৃতস্য
    শ্রীতিম্গ্যদেবনৃপতের্ব্বিকৃতিং নিশম্য।
    গৌড়েশ্বরেণ ভুবি তস্য নরেশ্বরত্বে
    শ্রীবৈদ্যদেব উরুকীর্ত্তিরয়ং নিযুক্তঃ॥ ১৩
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৩১।

  7. র্ন্নিজভুজপরিষ্পন্দৈঃ সাক্ষাদ্দিবস্পতিবিক্রমঃ॥ ১৪স্রজমিব শিরস্যাদায়াজ্ঞাং প্রভোরুরুতেজসঃ
    কতিপয়দিনৈর্দ্দত্তা জিষ্ণুঃ প্রয়াণমসৌদ্রুতং।

    তমবনিপতিং জিত্বা যুদ্ধে বভূব মহীপতি
    র্ন্নিজভুজপরিষ্পন্দৈঃ সাক্ষাদ্দিবস্পতিবিক্রমঃ॥ ১৪
    —গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৩১।

  8. অথ রক্ষতা (?) কুমারোদিতপৃথুপরিপন্থিপার্থিবপ্রমদঃ।
    রাজ্যমুপভুজ্য ভরস্য সূনুরগমদ্দিবং তনুত্যাগাৎ॥
    —রামচরিত ৪।১১।

  9. অপি শত্রুঘ্নোপায়াদ্গোপালঃ স্বর্জগাম তৎসূনুঃ।
    হন্তুঃ কুম্ভীনস্যাস্তনয়স্যৈতস্য সাময়িকমেতৎ॥
    —রামচরিত। ৪।১২।

  10. তদনুমদনদেবীনন্দনশ্চন্দ্রগৌরৈ
    শ্চরিতভুবনগর্ভঃ প্রাংশুভিঃ কীর্ত্তিপুরৈঃ।
    ক্ষিতিমচরমতাতস্তস্য সপ্তাব্ধিদায়ী
    মৃতমদনপালো রামপালাত্মজন্মা॥ ১৮
    —গৌড়লেখমালা পৃঃ ১৫২।

  11. বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৯শ ভাগ, পৃঃ ১৫৫।
  12. ত্বং নান্যবীরবিজয়ীতি গিরঃ কবীনাং শ্রুত্বাঽন্যথামননরূঢ়নিগূঢ়রোষঃ।
    গৌড়েন্দ্রমদ্রবদপাকৃত কামরূপভূপং কলিঙ্গমপি যস্তরসা জিগায়॥ ২০
    —Epigraphia Indica, Vol. 1, p. 309.

  13. সিংহীসুতবিক্রান্তেনার্জ্জুনধাম্না ভুবঃ প্রদীপেন।
    কমলাবিকাশভেষজভিষজা চন্দ্রেণ বন্ধুনোপেতাম্॥—রামচরিত, ৪।২০।

  14. গোবিন্দপালের রাজত্বকালের ঘটনাসমূহ সম্বন্ধে দ্বাদশ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
  15. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ১৫৪।
  16. Cunningham, Archæological Survey Reports, Vol. III, p. 124, no. 16.
  17. Ibid, p. 125. No. 17. pl. XLI.
  18. পৌরাণীভিঃ কথাভিঃ প্রথিতগুণগণে বীরসেনস্য বংশে
    কর্ণ্ণাটক্ষত্রিয়াণামজনি কুলশিরোদাম সামন্তসেনঃ।
    কৃত্বা নির্ব্বীরমুর্ব্বীতলমধিকতরান্তৃপ্যতা নাকনদ্যাং
    নির্ণ্ণিক্তো যেন যুধ্যদ্রিপুরুধিরকণাকীর্ণ্ণধারঃ কৃপাণঃ॥
    —Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, New Series, p. 471. 

  19. বংশে তস্যামরস্ত্রীবিততরতকলা সাক্ষিণো দাক্ষিণাত্য-
    ক্ষোণীন্দ্রৈর্ব্বীরসেনপ্রভৃতিভিরভিতঃ কীর্ত্তিমদ্ভির্ব্বভূবে।
    যচ্চারিত্রানুচিন্তাপরিচয়শুচয়ঃ সূক্তিমাধ্বীকধারাঃ।
    পারাশর্যেণ বিশ্বশ্রবণপরিসরপ্রীণনায় প্রণীতাঃ॥ ৪
    —Epigraphia Indica, Vol. I, p. 307.

  20. সাহিত্য, ২২শ বর্ষ, ১৩১৮, পৃঃ ৫৭৬।
  21. দুর্ব্বৃত্তানাময়মরিকুলাকীর্ণ্ণকর্ণাটলক্ষ্মী-
    লুণ্ঠাকানাং কদনমতনোত্তাদৃগেকাঙ্গবীরঃ।
    যস্মাদদ্যাপ্যবিহতবসামান্সমেদঃ সুভিক্ষাং
    হৃষ্যৎপৌরস্ত্যজতি ন দিশং দক্ষিণাং প্রেতভর্ত্তা॥ ৮
    —Epigraphia Indica, Vol. 1, p. 308.

  22. উদ্গন্ধীন্যাজ্যধূমৈর্ম্মৃগশিশুরসিতাখিন্নবৈখানসস্ত্রী-
    স্তন্যক্ষীরাণি কীরপ্রকরপরিচিতব্রহ্মপারায়ণানি।
    যেনাসেব্যন্ত শেষে বয়সি ভবভয়াস্কন্দিভির্ম্মস্করীন্দ্রৈঃ
    পূর্ণ্ণোৎসঙ্গানি গঙ্গাপুলিনপরিসরারণ্যপুণ্যাশ্রমাণি॥ ৯ —Ibid.

  23. অচরমপরমাত্মজ্ঞানভীষ্মাদমুষ্মান্নিজভুজমদমত্তারাতিমারাঙ্কবীরঃ।
    অভবদনবসানোদ্ভিন্ননির্ণ্ণিক্ততত্তদ্গুণনিবহমহিম্নাং বেশ্ম হেমন্তসেনঃ॥ ১০
    —Ibid.

  24. মহারাজ্ঞী যস্য স্বপরনিখিলান্তঃপুর বধূ-
    শিরোরত্নশ্রেণীকিরণসরণিস্মেরচরণা।
    নিধিঃ কান্তেঃ সাধ্বীব্রতবিততনিত্যোজ্বলযশা
    যশোদেবী নাম ত্রিভুবনমনোজ্ঞাকৃতিরভূৎ॥ ১৪
    —Epigraphia India, Vol. I, pp. 308-309.

  25. তস্মাদভূদখিলপার্থিবচক্রবর্ত্তী নির্ব্ব্যাজবিক্রমতিরস্কৃতসাহসাঙ্কঃ।
    দিক্পালচক্রপুটভেদনগীতকীর্ত্তিঃ পৃথ্বীপতির্ব্বিজয়সেনপদপ্রকাশঃ॥ ৭
    —বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৭শ ভাগ, ১৩১৭, পৃঃ ২৩৫।
    —Epigraphia Indica, Vol. XIV, p. 159-160.

  26. “তদনু বিজয়সেনঃ প্রাদুরাসীৎ বরেন্দ্রে।”—গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৬০।
  27. Epigraphia Indica, Vol. 1. p 309, verse 20.
  28. শূরং মন্য ইবাসি নান্য কিমিহ স্বং রাঘব শ্লাঘসে
    স্পর্দ্ধাং বর্দ্ধন মুঞ্চ বীর বিরতো নাদ্যাপি দর্পস্তব।
    ইত্যন্যোন্যমহর্ন্নিশপ্রণয়িভিঃ কোলাহলৈঃ ক্ষ্মাভুজাং
    যৎকারাগৃহযামিকৈর্ন্নিয়মিতো নিদ্রাপনোদক্লমঃ॥
    —Ibid.—verse 21.

  29. Epigraphia Indica, Vol. V, p. 183.
  30. Ibid, Vol. VIII, app. 1, p. 17, List no. 22.
  31. Indian Antiquary Vol. IX, p. 188; Vol. XIII, p. 418.
  32. Bendall’s Catalogue of Buddhist Sanskrit Manuscripts in the University Library, Cambridge, p. xv.
  33. Pischel, Katalog der Bibliothek der Deutschen Morgenlandischen Gessellschaft, Vol. II, p. 8.
  34. সুহৃদ্‌বর শ্রীযুক্ত কালীপ্রসাদ জায়সবাল আমাকে জানাইয়াছেন যে, বিহার প্রদেশে ১৯২৩ খৃষ্টাব্দে নান্যদেবের একখানি শিলালেখ আবিষ্কৃত হইয়াছে।
  35. পাশ্চাত্যচক্রজয়কেলিষু যস্য যাবদ্‌গঙ্গাপ্রবাহমনুধাবতি নৌবিতানে।
    ভর্গস্য মৌলিসরিদম্ভসি ভস্মপঙ্কলগ্নোজ্ঝিতেব তরিরিন্দুকলা চকাস্তি॥ ২২
    —Epigraphia Indica, Vol. I, p. 309.

  36. Epigraphia Indica, Vol. I, p. 311.
  37. Epigraphia Indica, Vol. XV, 278 p. অধ্যাপক শ্রীযুক্ত রাধাগোবিন্দ বসাক পরে এই তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধার করিয়াছেন। তাঁহার মতানুসারে ইহা বিজয়সেনের ৬২ রাজ্যাঙ্কে প্রদত্ত হইয়াছিল। সাহিত্য, ৩১শ ভাগ, ১৩২৮, পৃঃ ৮১-৯৭।
  38. অভবৎ বিলাসীদেবী শূরকুলাম্ভোধিকৌমুদী তস্য।
    নয়নযুগমঞ্জুখঞ্জনবিহারকেলীস্থলীমহিষী॥ ৭
    —Epigraphia Indica, Vol. XV, p. 283.

  39. Mahamahopadhyaya Haraprasad Shastri’s Notices of Sanskrit Manuscripts, Second Series, Vol. I, p. 170.
  40. Report on the Search of Sanskrit Manuscripts in the Bombay Presidency, 1887-91, p. LXXXV.
  41. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1896, pt. I, p. 23.
  42. Journal & Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series. Vol IX, p. 274.
  43. Ibid, p. 275.
  44. Ibid, pp. 275-6.
  45. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ৩২১।
  46. গৌড়লেখমালা, পৃঃ ৬২।
  47. Indian Antiquary, 1912, p. 167.
  48. Ibid, 1913, p. 185.
  49. Ibid, Vol. XLVIII, 1919, pp. 171-76.
  50. ডাক্তার হর্ণ্‌লি ১৯১৪ খৃষ্টাব্দের ৩রা জানুয়ারী তারিখে লিখিত পত্রে আমার মত সমর্থন করিয়াছেন। এই পত্রের কিয়দংশ পরিশিষ্টে মুদ্রিত হইল।
  51. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (রাজন্যকাণ্ড), পৃঃ ৩২২।
  52. বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৭শ ভাগ, পৃঃ ২৩৭-৩৮;—Epigraphia Indica, Vol. XIV, pp. 156-63.
  53. ধরাধরান্তঃপুরমৌলিরত্ন চালুক্যভূপালকুলেন্দুলেখা।
    তস্য প্রিয়াভূদ্বহুমানভূমির্লক্ষ্মী পৃথিব্যোরপি রামদেবী॥
     —Journal & Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, p. 472.

  54. Cunningham’s Archaeological Survey Reports, Vol. III, p. 125, pl. xxxviii, No. 18.
  55. Epigraphia Indica, Vol. VIII, App. I, p. 13, list no. 12.
  56. অধ্যাপক শ্রীযুক্ত যদুনাথ সরকার আমাকে জানাইয়াছিলেন যে, এই তাম্রশাসনখানি সত্বর এসিয়াটিক সোসাইটীর পত্রিকায় প্রকাশিত হইবে। ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে পরম স্নেহাস্পদ অধ্যাপক শ্রীমান্ ননীগোপাল মজুমদার এম, এ, ইহা প্রকাশ করিয়াছেন।—(Journal & Proceedings of the Asiatic Society, Bengal, Vol XVIII, 1922, pp. 81-84). তৎপূর্ব্বে পাণ্ডেয় রামাবতার শর্ম্মা ইহা Journal of the Bihar & Orissa Research Society নামক পত্রে প্রকাশ করিয়াছিলেন—Vol II, pp. 441-47.
  57. Epigraphia Indica, Vol. VII, p. 98.
  58. বেলায়াং দক্ষিণাব্ধের্ম্মুসলধরগদাপাণিসংবাসবেদ্যাং
    ক্ষেত্রে বিশ্বেশ্বরস্য স্ফুরদসিবরণাশ্লেষগঙ্গোর্ম্মিভাজি।
    তীরোৎসঙ্গে ত্রিবেণ্যাঃ কমলভবমখারম্ভনির্ব্ব্যাজপূতে
    যেনোচ্চৈর্যজ্ঞযূপৈঃ সহ সমরজয়স্তম্ভমালান্যধায়ি॥ ১২
     —Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1896, pt. I, p. 11.

  59. Journal & Proceedings of the Asistic Society of Bengal, New Series, Vol. V, p. 473.
  60. Ibid. এই তাম্রশাসনেও লক্ষণসেনের সহিত কাশী-রাজের যুদ্ধের কথা উল্লিখিত আছে; “যেনাসৌ কাশিরাজঃ সমরভুবি জিতা......।”
  61. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1896, pt. I, p. 11.
  62. বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৭শ ভাগ, পৃঃ ২১৪-২১৬;
    —Epigraphia Indica, Vol. XII, pp. 27-30.
  63. বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৭শ ভাগ, পৃঃ ২৩৮-৪০;
    —Epigraphia Indica, Vol. XII, pp. 6-10.
  64. ঐতিহাসিক চিত্র, ১ম পর্য্যায়, ১ম ভাগ, পৃঃ ২৮৭-৯০।
  65. Journal & Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. V, pp. 471-75.
  66. ৺ রামগতি ন্যায়রত্ন প্রণীত ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক প্রস্তাব’।
  67. Journal & Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. IX, p. 290, pl. xxii-xxiv.
  68. ৬৮.০ ৬৮.১ Indian Antiquary, Vol. XIX, p. 1.
  69. Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. I, p. 50.
  70. Early History of India, 3rd Edition, p. 418.
  71. Ibid, pp. 418-19.
  72. গৌড়রাজমালা, পৃঃ ৬৪।
  73. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, (রাজন্য কাণ্ড), পৃঃ ৩৫১-৫২।
  74. Dacca Review, 1912, pp. 88-93.
  75. Ibid, p. 90; Indian Antiquary Vol. XLI, 1912, pp. 167-69.
  76. সাহিত্য, ১৩২০, ২৪শ বর্ষ, ১ম খণ্ড,পৃঃ ৩৬-৪৩, ১৭২-৭৮।
  77. সাহিত্য, ১৩২০, ২৪শ বর্ষ, পৃঃ ১৭২-৭৭।
  78. Cunningham’s Mahabodhi, pl. xxviii, c; বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৭শ ভাগ, ১৩১৭, পৃঃ ২১৭; Indian Antiquary, Vol. XLVIII, 1919, p. 45.
  79. Ibid Vol. X, 1881, pp. 342-43.
  80. Ibid, 1919, Vol. XLVIII, p. 416.
  81. Journal of the Bihar and Orissa Research Society, Vol. IV, pp. 266-11.
  82. রামচরিত, ২।৫ টীকা।
  83. Epigraphia Indica, Vol. IX, p. 323.