বাঙ্গালার ইতিহাস (রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রথম ভাগ/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে
বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ৩০

গোবিন্দপালের রাজ্য বিনষ্ট হইলে ১১৯৯ খৃষ্টাব্দে লিখিত পঞ্চাকারের শেষপত্র


বাঙ্গালার ইতিহাস
চিত্র ৩১

রঙ্গপুরে আবিষ্কৃত বিষ্ণুমূর্ত্তি



দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।

মুসলমান-বিজয়।

 দিল্লীর তােমর-রাজবংশ—পৃথ্বীরাজ—তিরৌরীর যুদ্ধ—মহম্মদ-বিন্-সামের গাহডবাল-রাজ্য আক্রমণ—জয়চ্চন্দ্রের মৃত্যু—হরিশ্চন্দ্র—জয়চ্চন্দ্রের মৃত্যুর পরে কান্যকুব্জের স্বাধীনতা—বেলখরা-স্তম্ভলিপি—নায়ক বিজয়কর্ণ—গােবিন্দপাল—দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে মগধের অবস্থা—গোবিন্দপালের রাজ্যকালে লিখিত পুথি—গােবিন্দপালের বিনষ্ট রাজ্য—মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার—উদ্দণ্ডপুরের যুদ্ধ—মগধ-বিজয়—নালন্দ ও বিক্রমশিলা ধ্বংস—মাধবসেন—বিশ্বরূপসেন—কেশবসেন—নদীয়া-বিজয় কাহিনী—গৌড়ে মুসলমানাধিকারের প্রকৃত ইতিহাস।

 উদভাণ্ডপুরের ষাহি-রাজ্যের অবসানে সমগ্র পঞ্চনদ গজনীর মুসলমান-রাজগণের পদানত হইয়াছিল। মহ্‌মূদের মৃত্যুর পর সবুক্-তিগীনের বংশধরগণ ক্রমশঃ দুর্ব্বল হইয়া পড়িলেন। সেই সময়ে আফগানিস্থানের আর একটি পার্ব্বত্য উপত্যকায় একটি নূতন রাজ্যের সৃষ্টি হইল। এই উপত্যকার নাম গাের। ইংরাজী ইতিহাস-দর্শনে যে সমস্ত গ্রন্থ রচিত হইয়াছে, তাহাতে এই উপত্যকা ঘাের নামে পরিচিত। গােরের পার্ব্বত্য উপত্যকার অধিপতিগণ ক্রমশঃ ধীরে ধীরে সমস্ত আফগানিস্থানে অধিকার বিস্তার করিলেন, অবশেষে মহ্‌মূদের বংশধরগণকে গজনী পরিত্যাগ করিয়া ভারতবর্ষে আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইল। তাঁহারা পঞ্চনদে আসিয়া লাহােরে রাজধানী স্থাপন করিলেন। উদভাণ্ডপুরের ষাহীয়গণ যেমন দশম ও একাদশ শতাব্দীতে উত্তরাপথের প্রতীহার-রক্ষক হইয়াছিলেন, খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে মহ্‌মূদের বংশধরগণ সেইরূপ আর্য্যাবর্ত্তের তোরণ-রক্ষায় নিযুক্ত ছিলেন। এই সময়ে পঞ্চনদের পূর্ব্ব ও দক্ষিণ-সীমান্তসংলগ্ন ভূখণ্ডে কোন্ রাজবংশের অধিকার ছিল, তাহা অদ্যাপি নির্ণীত হয় নাই। রাজপুত জাতির চারণের গাথা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, পঞ্চনদের মুসলমান-রাজ্যের পূর্ব্ব-সীমান্তে তোমর-বংশজাত রাজপুত জাতির অধিকার ছিল। ধীরে ধীরে পঞ্চনদ-রাজ্যও মহ্‌মূদের বংশধরগণের হস্তচ্যুত হইল; গোর-রাজগণ তোমর-রাজ্যের সীমান্ত পর্য্যন্ত স্বীয় অধিকার বিস্তার করিয়াছিলেন। এই সময় হইতে দিল্লীর তোমর-বংশের সহিত গোর-রাজগণের বিবাদ আরম্ভ হইল। দিল্লীর তোমর-বংশের কোন শিলালিপি বা তাম্রশাসন অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। রাজপুত চারণগণের বংশাবলী তোমর-বংশের ইতিহাস গঠনের একমাত্র উপাদান। বাঙ্গালা দেশের কুলশাস্ত্রের ন্যায় রাজপুত-চারণগণের বংশাবলীও ভ্রমপরিপূর্ণ এবং কল্পনাপ্রসূত। এখন আর কেহ বিশ্বাস করে না যে, মেবারের রাণাগণ সূর্য্যবংশসম্ভূত ভগবান রামচন্দ্রের বংশজাত। শ্রীযুক্ত দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর প্রমাণ করিয়াছেন যে, রাণা-বংশের আদিপুরুষ জনৈক নাগর-ব্রাহ্মণের ঔরসে হীনজাতীয়া রমণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন[১]। এখন আর কেহ বিশ্বাস করেন না যে, যোধপুরের রাঠোর-রাজবংশ কান্যকুব্জ-রাজ জয়চ্চন্দ্রের বংশসম্ভূত। যোধপুর-রাজবংশের আদিপুরুষের সহিত কান্যকুব্জের গাহডবাল-বংশের শোণিতসম্পর্ক ছিল না[২]। পঞ্চনদে রোহতক জেলায় পালাম নামক গ্রামে আবিষ্কৃত ১৩৩৬ বিক্রমাব্দে (১২৮৪ খৃষ্টাব্দে) সুলতান গিয়াস্‌উদ্দীন বল্‌বনের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ একখানি শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, উক্ত প্রদেশে প্রথমে তোমর-জাতির অধিকার ছিল; পরে উহা চৌহান বা চাহমানগণ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল[৩]। খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে চাহমান-রাজ বীসলদেব তোমর-রাজগণকে পরাজিত করিয়া দিল্লী অধিকার করিয়াছিলেন[৪]। তোমর ও চাহমানবংশীয় দিল্লীপতিগণ পঞ্চনদের মুসলমান-রাজগণের আক্রমণে সর্ব্বদা ব্যস্ত থাকিতেন। সময়ে সময়ে মুসলমান-সেনাপতিগণ দিল্লীর অধিকার পার হইয়া কান্যকুব্জের গাহড-বালবংশীয় রাজগণের অধিকারও আক্রমণ করিতেন। গোবিন্দচন্দ্রের পুত্র বিজয়চন্দ্র, আমীর (সংস্কৃত হম্মীর) উপাধিধারী কোন সেনাপতিকে পরাজিত করিয়াছিলেন[৫]

 পঞ্চনদ অধিকৃত হইলে গোর-রাজগণ উত্তরাপথের মধ্যদেশের প্রতি লোলুপ দৃষ্টিপাত করিতেছিলেন। এই সময়ে চাহমান-বংশীয় দ্বিতীয় পৃথ্বীরাজ দিল্লীর সিংহাসনে আসীন ছিলেন। তিনি মহোবার চন্দেল্ল-বংশীয় পরমর্দ্দিদেবকে পরাজিত করিয়া মহোবা দুর্গ অধিকার করিয়াছিলেন[৬] এবং বার বার মুসলমান-সেনাপতিগণকে পরাজিত করিয়াছিলেন। এই সময়ে পৃথ্বীরাজের চেষ্টাতে উত্তরাপথের মুসলমান-বিজয় কিয়ৎকালের জন্য স্থগিত ছিল। বারংবার মুসলমানগণ কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া চাহমান-বীর ক্রমশঃ অবসন্ন হইয়া পড়িলেন। তখন অন্যান্য আর্য্যাবর্ত্ত-রাজগণের মধ্যে কেহই তাঁহার সাহায্যার্থ অগ্রসর হন নাই। স্মিথ বলিয়াছিলেন যে, মুসলমানগণের আক্রমণের আশঙ্কায় আর্য্যাবর্ত্ত-রাজগণ কিয়ৎকালের জন্য গৃহ-বিবাদ স্থগিত রাখিয়া মুসলমানগণের বিরুদ্ধে একত্র দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন[৭]; কিন্তু এই উক্তি কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত হয় নাই। আর্য্যাবর্ত্তের কোন রাজা পৃথ্বীরাজের পক্ষাবলম্বন করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। ১৭৬১ খৃষ্টাব্দের পাণিপথের প্রাচীন যুদ্ধক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র-শক্তি যখন সমবেত মুসলমান-রাজগণের চেষ্টায় বিধ্বস্ত হইয়াছিল তখনও রাজপুত-রাজগণ হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্রধারণ করেন নাই। জাঠগণ মহারাষ্ট্রীয়গণকে সাহায্যের পরিবর্ত্তে বারংবার তাঁহাদিগের শিবির লুণ্ঠন করিয়া আহ্‌মদ শাহ আবদালীর সাহায্য করিয়াছিল। সেইরূপ খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষপাদে মুসলমানগণের আক্রমণে চাহমান-রাজ যখন আত্মরক্ষার জন্য কাতর হইয়াছিলেন তখন পূর্ব্বকৃত অপমানের প্রতিশোধ লইবার জন্য চন্দেল্ল-রাজ নিশ্চিন্তমনে কালঞ্জর দুর্গে দিন যাপন করিতেছিলেন। গর্ব্বিত গোবিন্দচন্দ্রের পৌত্র জয়চ্চন্দ্র তাঁহার সাহায্যার্থ অগ্রসর হওয়া কর্ত্তব্য মনে করেন নাই, মগধে পাল-রাজবংশের শেষ রাজা আত্মরক্ষার চিন্তায় ব্যস্ত ছিলেন এবং গৌড়ের সেনবংশীয় রাজা অধিকার-বিস্তারের চিন্তায় অথবা কবিতা রচনায় দিবস অতিবাহিত করিতেছিলেন। ১১৯২ খৃষ্টাব্দে পৃথ্বীরাজ গোর-রাজ মহম্মদ-বিন-সামকে পরাজিত করিয়াছিলেন, কিন্তু পরবৎসর তিনি স্বয়ং পরাজিত হইয়াছিলেন। পৃথ্বীরাজের মৃত্যুর পরে দিল্লী হইতে আজমীর পর্য্যন্ত সমস্ত ভূভাগ অধিকার করিতে মুসলমান-বিজেতৃগণকে বিশেষ চেষ্টা করিতে হইয়াছিল। আজমীর জয় করিতে দুইটি স্বতন্ত্র অভিযানের আবশ্যক হইয়াছিল। পৃথ্বীরাজের মৃত্যুর পর তাঁহার ভ্রাতা হেমরাজ আমরণ রাজধানী রক্ষা করিয়াছিলেন,[৮] এ কথা মুসলমান ঐতিহাসিকগণও স্বীকার করিয়াছেন। বিজেতৃগণ আজমীর অধিকার করিয়া পৃথ্বীরাজের দাসী-পুত্রকে সিংহাসন প্রদান করিয়াছিলেন। সুলতান মহম্মদের প্রতিনিধি কুতব্-উদ্দীনকে পুনরায় আজমীর জয় করিতে হইয়াছিল। দিল্লী ও আজমীর হস্তগত করিয়া সুলতান মহম্মদ বিস্তৃত সমৃদ্ধ গাহডবাল-রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। কথিত আছে যে, কান্যকুব্জ-রাজ জয়চ্চন্দ্র সংযুক্তা-হরণের জন্য চাহমান-রাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়াছিলেন এবং তিনি মুসলমান-রাজের সহিত সন্ধিবন্ধনে আবদ্ধ হইয় একই সময়ে পৃথ্বীরাজের রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। ইহার পুরস্কারস্বরূপ গোর-রাজ মহম্মদ-বিন-সাম পরবৎসর গাহডবাল-রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। তাজ্-উল্-মাসির, তবকাত্-ই-নাসীরী এবং কামিল-উৎ-তবারিখ্ নামক ইতিহাসত্রয়ে গোর-রাজ কর্ত্তৃক কান্যকুব্জ-রাজ্য বিজয়ের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। ইহার মধ্যে সদর-উদ্দীন মহম্মদ-বিন-হসন নিজামীর তাজ-উল্-মাসির গ্রন্থ কান্যকুব্জ-রাজ্য জয়ের একাদশ বর্ষ পরে আরব্ধ হইয়া ১২২৮ খৃষ্টাব্দে শেষ হইয়ছিল। তাজ্-উল্-মাসিরের বিবরণ এই গ্রন্থত্রয়ের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বিশদ[৯]

 “কিয়ৎকাল দিল্লীতে অবস্থান করিয়া কুতব্-উদ্দীন ৫৯০ হিজিরাব্দে (১১৯৪ খৃষ্টাব্দে) পবিত্র-সলিলা জূন (যমুনা) নদী পার হইয়া কোল ও বারাণসীর দিকে অগ্রসর হইয়াছিলেন। তিনি ভারতের দুর্গসমূহের মধ্যে বিখ্যাত কোল দুর্গ অধিকার করিয়াছিলেন। দুর্গ-রক্ষীদিগের মধ্যে যাহারা বুদ্ধিমান ছিল, তাহারা ইসলাম-ধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়াছিল, কিন্তু যাহারা পূর্ব্বধর্ম্মানুরাগ ত্যাগ করিতে পারিল না, তাহারা নিহত হইল। সেই স্থানে গজনী হইতে সুলতান মহম্মদ গোরীর আগমন-সংবাদ পাওয়া গেল। কুতব্-উদ্দীন সুলতানের সহিত মিলিত হইবার জন্য অগ্রসর হইলেন। উভয়ের সেনা একত্র হইলে দেখা গেল যে, পঞ্চাশৎ সহস্র বর্ম্মাবৃত অশ্বারোহী সেনা একত্রিত হইয়াছে। এই সৈন্য লইয়া তাঁহারা কাশী-রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলেন। মহম্মদ-বিন-সাম, কুতব্-উদ্দীনকে সহস্র অশ্বারোহী লইয়া অগ্রসর হইতে আদেশ করিলেন। এই সৈন্য শত্রুসেনা আক্রমণ করিয়া তাহাদিগকে পরাজিত করিল। কাশী-রাজ জয়চাঁদ তাঁহার রণদক্ষ হস্তিসমূহের গর্ব্ব করিতেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে হস্তিপৃষ্ঠে বসিয়া শরাঘাতে নিহত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার ছিন্ন শীর্ষ শূলবিদ্ধ হইয়া রাজসকাশে নীত হইয়াছিল”[১০]

 মুসলমান ঐতিহাসিকগণ জয়চ্চন্দ্রের মৃত্যুর বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া গাহডবাল-রাজ্যের ইতিহাস শেষ করিয়াছেন। জয়চ্চন্দ্রের পরে কান্যকুব্জের অন্য কোন গাহডবাল-বংশীয় রাজার অস্তিত্বের কথা তাঁহাদের গ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায় না। একখানি শিলালিপি এবং নবাবিষ্কৃত একখানি তাম্রশাসন হইতে জয়চ্চন্দ্রের পুত্র কান্যকুব্জ-রাজ হরিশ্চন্দ্রের অস্তিত্বের কথা অবগত হওয়া যায়। হরিশ্চন্দ্র নামক জয়চ্চন্দ্রের এক পুত্রের অস্তিত্বের কথা জয়চ্চন্দ্রেরই দুইখানি তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায়। ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে বারাণসীতে বরণা-সঙ্গমের নিকটে কমৌলি গ্রামে একবিংশতি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছিল, তন্মধ্যে কামরূপ-রাজ বৈদ্যদেবের তাম্রশাসন অন্যতম। ইহার মধ্যে একখানি তাম্রশাসন হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ১২৩২ বিক্রমাব্দে ভাদ্র বদি অষ্টমীতে রবিবারে রাজপুত্র শ্রীহরিশ্চন্দ্রদেবের জাতকর্ম্ম উপলক্ষে রাজপুরোহিত প্রহরাজশর্ম্মা একখানি গ্রাম লাভ করিয়াছিলেন[১১]। ডাক্তার কিলহর্ণের গণনানুসারে ১১৭৫ খৃষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট তারিখে জয়চ্চন্দ্রদেবের পুত্র হরিশ্চন্দ্রদেব জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন[১২]। ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে কাশীজেলায় সিহবর গ্রামে একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, ১২৩২ বিক্রমাব্দে ভাদ্র মাসে শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে রবিবারে জয়চ্চন্দ্র বারাণসীতে গঙ্গাস্নান করিয়া রাজপুত্র শ্রীহরিশ্চন্দ্রদেবের নামকরণোপলক্ষে একখানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন[১৩]। ডাক্তার কিলহর্ণের গণনানুসারে ১১৭৫ খৃষ্টাব্দে হরিশ্চন্দ্রের জন্ম হইয়াছিল[১২]; ৫৯০ হিজিরাব্দে মহারাজ জয়চ্চন্দ্রের মৃত্যু হইয়াছিল। ৫৯০ হিজিরা ১১৯৩ খৃষ্টাব্দের ২৭শে ডিসেম্বর আরম্ভ হইয়া ১১৯৪ খৃষ্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর শেষ হইয়াছিল[১৪]। অতএব পিতার মৃত্যুকালে হরিশ্চন্দ্রদেবের বয়স মাত্র অষ্টাদশ বর্ষ হইয়াছিল। অষ্টাদশবর্ষীয় যুবক কিরূপে জয়োল্লাসোন্মত্ত দুর্দ্ধর্ষ মুসলমান-সেনার সম্মুখীন হইয়াছিলেন, তাহা কোন চারণের গাথায় অথবা কোন ঐতিহাসিকের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ নাই। পৃথ্বীরাজের মৃত্যুর পরে যখন দলে দলে আফগান ও তুরস্ক-সেনা উত্তরাপথ আচ্ছন্ন করিতেছিল, যখন অতি প্রাচীন চিরস্মরণীয় রাজবংশসমূহের পতন-সংবাদ প্রতিদিন শ্রুত হইত, তখন কাশী-কুশীকোত্তর-ইন্দ্রস্থান প্রভৃতি তীর্থ-সমন্বিত বিশাল গাহডবাল-সাম্রাজ্যের বিস্তৃত সীমান্ত রক্ষা করা যুদ্ধ-বিদ্যায় পক্বকেশ সেনাপতির পক্ষেও দুরূহ ছিল। এই অবস্থায়, পিতার মৃত্যুর পরে, ছয় বৎসরকাল, হরিশ্চন্দ্র কিরূপে স্বাধীনতা রক্ষা করিয়াছিলেন তাহা অদ্যাপি জানিতে পারা যায় নাই। কিন্তু ইহা স্থির যে, ১২০০ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত হরিশ্চন্দ্রদেব উত্তরাপথের একজন স্বাধীন নরপতি ছিলেন। ১২৫৩ বিক্রমাব্দে হরিশ্চন্দ্রদেব পমহৈ গ্রাম জনৈক ব্রাহ্মণকে দান করিয়াছিলেন[১৫]। এই তাম্রশাসনখানি তিন বৎসর পরে, ১২৫৭ বিক্রমাব্দে (১২০০ খৃষ্টাব্দে) সম্পাদিত হইয়াছিল[১৬]। ইহার পরে হরিশ্চন্দ্রদেবের অস্তিত্বের আর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই তাম্রশাসন হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, জয়চ্চন্দ্রদেবের মৃত্যুর পরে সমস্ত গাহডবাল-সাম্রাজ্য মহম্মদ-বিন-সামের পদানত হয় নাই। জয়চ্চন্দ্রের পুত্র যথাসাধ্য আত্মরক্ষার চেষ্টা করিয়াছিলেন। গাহডবাল-সাম্রাজ্যের রাজধানী কান্যকুব্জ নগর সুলতান শমস্‌উদ্দীন আল্‌তামশের রাজত্বকালে মুসলমানগণ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল। আল্‌তামশ কান্যকুব্জ-বিজয় স্মরণার্থ নূতন প্রকারের রজতমুদ্রা মুদ্রাঙ্কণ করাইয়াছিলেন[১৭]। মিনহাজ-উস-সিরাজ প্রণীত তবকাৎ-ই-নাসীরীতে কথিত আছে যে, আল্‌তামশের রাজত্বকালে লক্ষাধিক মুসলমান-নিহন্তা অযোধ্যাবাসী বর্ত্তু বা বৃতু পরাজিত ও নিহত হইয়াছিলেল[১৮]। এই সমস্ত প্রমাণ হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, জয়চ্চন্দ্রের মৃত্যুর পরেই গাহডবাল-বংশের অধিকার শেষ হয় নাই এবং মুসলমানগণ গঙ্গার দক্ষিণ তীরবর্ত্তী ভূখণ্ড মাত্র অধিকার করিয়াছিলেন। গঙ্গার দক্ষিণতীরেও কান্যকুব্জ-রাজের সামন্তগণ ১১৯৭ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত মুসলমানগণের অধীনতা স্বীকার করেন নাই। ১২৫৩ বিক্রমাব্দে (১১৯৭ খৃষ্টাব্দে) চুনারের আট ক্রোশ দূরবর্ত্তী বেলখরা গ্রামে কান্যকুব্জরাজের সামন্ত রাণক বিজয়কর্ণ স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন[১৯]। উক্ত বর্ষে রাউত শকরুক একটি শিলাস্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এই স্তম্ভলিপিতে হরিশ্চন্দ্রদেবের নাম নাই। “শ্রীমদ্ধরিশ্চন্দ্রদেবস্য বিজয়রাজ্যে” ইত্যাদি পদের পরিবর্ত্তে “শ্রীমদ্‌কন্যকুব্জ বিজয়রাজ্যে” পদ ব্যবহৃত হইয়াছে। এতদ্দ্বারা সূচিত হইতেছে যে, কান্যকুব্জের গাহডবাল-বংশের অধিকার তখন ধ্বংসোন্মুখ, মধ্যবর্ত্তী ভূভাগ মুসলমান কর্ত্তৃক অধিকৃত হওয়ায় রাণক বিজয়কর্ণ জানিতে পারেন নাই যে, জয়চ্চন্দ্রের পুত্র হরিশ্চন্দ্র তখনও জীবিত আছেন এবং কান্যকুব্জ নগর তখনও শত্রুহস্তগত হয় নাই। স্বামিভক্ত বিজয়কর্ণ তখনও গাহডবাল-বংশের স্বামিত্ব অস্বীকার করেন নাই এবং সেই জন্যই “শ্রীমদ্‌কন্যকুব্জবিজয়রাজ্যে” পদ ব্যবহার করিয়া গিয়াছেন।

 গোবিনচন্দ্রের পুত্র বিজয়চন্দ্র মগধ ও করুষদেশের অধিকাংশ স্বীয় অধিকারভুক্ত করিয়া লইয়াছিলেন। এই সময়ে রোহিতাশ্ব দুর্গের নিকটস্থিত জাপিল গ্রামের মহানায়কগণ প্রবল হইয়া উঠিয়াছিলেন। জাপিলীয় মহানায়ক প্রতাপধবল খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে বিদ্যমান ছিলেন। এই বংশের সর্ব্বপ্রাচীন খোদিতলিপি খৃষ্টীয় ১১৫৮ অব্দে খোদিত হইয়াছিল[২০]। রোহিতাশ্ব দুর্গে আবিষ্কৃত একখানি অপ্রকাশিত শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, প্রতাপধবল দুর্গমধ্যে কতকগুলি কীর্ত্তি স্থাপন করিয়াছিলেন[২১]। ১১৫৮ খৃষ্টাব্দের শিলালিপি আরা জেলায় তুত্রাহি জলপ্রপাতের নিকটে উৎকীর্ণ আছে। উক্ত জেলায় তারাচণ্ডী নামক স্থানে প্রতাপধরলের আর একখানি শিলালিপি আছে[২২]। এই সমস্ত শিলালিপিতে কান্যকুব্জ-রাজ্যের কোন উল্লেখই দেখিতে পাওয়া যায় না কিন্তু তারাচণ্ডীর শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, কয়েক জন ব্রাহ্মণ কান্যকুব্জ-রাজ বিজয়চন্দ্রদেবের দেউ নামক জনৈক দাসকে উৎকোচ দ্বারা বশীভূত করিয়া কলহণ্ডী এবং বড়পিলা নামক গ্রামদ্বয় প্রাপ্ত হইয়াছে। এই শিলালিপি দ্বারা প্রতাপধবলদেব জনসাধারণকে অবগত করাইতেছেন যে, পূর্ব্বোক্ত গ্রামদ্বয়ের রাজস্ব পূর্ব্ববৎ সংগৃহীত হইবে। ইহা হইতে প্রমাণ হইতেছে যে, মহানায়ক প্রতাপধবলদেব সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিলেন না। কান্যকুব্জ-রাজগণ তাঁহার অধিকারস্থিত গ্রামগুলি যাহাকে ইচ্ছা দান করিতে পারিতেন। বিজয়চন্দ্রের পুত্র জয়চ্চন্দ্রেদবের অধিকার পূর্ব্বে গয়া অবধি বিস্তৃত ছিল; কারণ, ১২৪০ হইতে ১২৪৯ বিক্রমাব্দের মধ্যে (১১৮৩-১১৯২ খৃষ্টাব্দ) কোন সময়ে উৎকীর্ণ জয়চ্চন্দ্রদেবের নামযুক্ত একখানি শিলালিপি বুদ্ধগয়ায় আবিষ্কৃত হইয়াছে[২৩]। এই সময়ে মগধের অধিকার লইয়া পাল, সেন ও গাহডবাল-বংশীয় রাজগণের বিবাদ চলিতেছিল। পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে, ১৪৪৬ খৃষ্টাব্দে গোবিন্দচন্দ্রদেব মুদ্গগিরি বা মুঙ্গের পর্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন। ১১৬৫ খৃষ্টাব্দে পাটনা জেলার বিহার মহকুমায় অবস্থিত নালন্দনগর গোবিন্দপাল নামক জনৈক নরপতির অধিকারভুক্ত ছিল। উক্ত বর্ষে নালন্দায় লিখিত একখানি ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’ লণ্ডনের রয়েল এসিয়াটীক সোসাইটীর গ্রন্থাগারে রক্ষিত আছে; এই গ্রন্থের পুষ্পিকায় লিখিত আছে যে, ইহা নালন্দায় গোবিন্দপালদেবের চতুর্থ রাজ্যাঙ্কে লিখিত হইয়াছিল।

 “পরমেশ্বরপরমভট্টারকপরমসৌগত মহারাজাধিরাজশ্রীমদ্‌গোবিন্দপালদেবস্য বিজয়রাজ্যে সম্বৎসরে ৪ শূন্যোদকগ্রামবাস্তব্য শ্রীমন্নালন্দ......মস্তু সর্ব্বজগতাম্[২৪]॥”

 গোবিন্দপালদেবের চতুর্থ রাজ্যাঙ্ক ১১৬৫ খৃষ্টাব্দে পতিত হইয়াছিল; কারণ ১২৩২ বিক্রমাব্দে গয়ায় উৎকীর্ণ একখানি শিলালিপি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, উহা গোবিন্দপালদেবের চতুর্দ্দশ রাজ্যাঙ্কে উৎকীর্ণ হইয়াছিল[২৫]। ১১৭০ খৃষ্টাব্দে বুদ্ধগয়া সেন-বংশীয় রাজগণের অধিকারভুক্ত ছিল; কারণ উক্ত বর্ষে সপাদলক্ষদেশের রাজা অশোকচল্লদেবের মহাবোধি মন্দিরের একখানি শিলালিপিতে লক্ষ্মণাব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে[২৬]। ১১৮৩ হইতে ১১৯২ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন সময়ে বুদ্ধগয়া কান্যকুব্জ-রাজ জয়চ্চন্দ্রের অধিকারভুক্ত হইয়াছিল। ১১৯৩ খৃষ্টাব্দে বুদ্ধগয়া পুনরায় সেন-রাজগণ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল; কারণ উক্ত বর্ষে উৎকীর্ণ সপাদলক্ষ-রাজ অশোকচল্লের কনিষ্ঠ ভ্রাতা দশরথের শিলালিপিতে পুনরায় লক্ষ্মণাব্দের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়[২৭]। ইহার পরে মগধদেশ মুসলমান-নায়ক মহম্মদ্-ই-বখ্‌তিয়ার খিল্‌জির আক্রমণে জর্জ্জরিত হইয়া উঠিয়াছিল এবং দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ বৎসরদ্বয়ে মগধ ও গৌড় মুসলমানগণ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল।

 খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মগধাধিপ গোবিন্দপাল কে? এবং পাল-রাজবংশের সহিত তাঁহার কোন সম্বন্ধ ছিল কি না, তাহ নির্ণয় করিবার কোন উপায়ই অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। তাঁহার পাল উপাধি, “পরমেশ্বরপরমভট্টারক, মহারাজাধিরাজ” ইত্যাদি সম্রাটপদবী এবং বৌদ্ধধর্ম্মে প্রগাঢ় অনুরাগসূচক “পরমসৌগত” বিশেষণ দেখিয়া অনুমান হয় যে, তিনি পাল-রাজবংশসম্ভূত ছিলেন। নালন্দায় লিখিত ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’ পুথি হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তাঁহার চতুর্থ রাজ্যাঙ্কে নালন্দা নগর তাঁহার অধিকারভুক্ত ছিল[২৮]। ১১৭৫ খৃষ্টাব্দেও তিনি জীবিত ছিলেন; কারণ উক্ত বর্ষে উৎকীর্ণ গদাধর-মন্দিবের শিলালিপিতে তাঁহার রাজ্যাঙ্ক উল্লিখিত হইয়াছে। এই শিলালিপিতে বিক্রমাব্দের ব্যবহার আছে, তাহা সত্ত্বেও গোবিন্দপালের চতুর্দ্দশ রাজ্যঙ্কের উল্লেখ[২৯] দেখিয়া বুঝিতে পারা যায় যে, গোবিন্দপাল তখন জীবিত ছিলেন; কিন্তু গয়া নগরী তখন তাঁহার হস্তচ্যুত হইয়াছিল। গয়া বোধ হয় ১১৭৫ খৃষ্টাব্দের অব্যবহিত পূর্ব্বে গোবিন্দপালের অধিকারভুক্ত ছিল, তাহা না হইলে বিক্রমাব্দের ব্যবহার সত্ত্বেও গদাধর-মন্দিরের শিলালিপিতে গোবিন্দপালের নাম ব্যবহৃত হইল কেন? খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে লিখিত বহু বৌদ্ধ গ্রন্থে গোবিন্দপালদেবের রাজ্যাঙ্কের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়:—

 (১) কলিকাতার এসিয়াটীক সোসাইটীর গ্রন্থাগারে রক্ষিত ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’; ইহার শেষ পত্রে লিখিত আছে—“দেয়ধর্ম্মোয়ং প্রবরমহায়ান (যায়ি)নঃ খানোদকীয় যশরাপুরাবস্থানেবং॥ দানপতি ক্ষান্তিরক্ষিতস্য যদত্র পুণ্যন্তদ্ভবত্যাচার্য্যোপাধ্যায়মাতাপিতৃপূর্ব্বং গমং কৃত্বা সকলসত্তরাশেরনুত্তরজ্ঞানফলাবাপ্তয় ইতি। শ্রীমদ্‌গোবিন্দপালদেবস্যাতীতসম্বৎস ১৮ কার্ত্তিক দিনে ১৫ চঙ্গডপাটকাবস্থিত খানোদ কীয়যশরাপুরে আচার্য্যপ্রজ্ঞানু......”

 (২) কলিকাতার এসিয়াটীক সোসাইটীর গ্রন্থাগারে রক্ষিত ‘অমরকোষে’র শেষ পত্রে লিখিত আছে:—

 “লিঙ্গসংগ্রহঃ সমাপ্তঃ পরমভট্টারকেত্যাদি রাজাবলী পূর্ব্ববৎ শ্রীগোবিন্দপালীয় সম্বৎ ২৪ চৈত্র শুদি ৮ শুভমস্তু সর্ব্বজগতাম্ ইতি[৩০]

 (৩) ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে রক্ষিত ‘গুহ্যাবলীবিবৃতি’ নামক গ্রন্থের শেষ পত্রে লিখিত আছে:—

 “গুহ্যাবলীবিবৃতিঃ॥ বিবৃতিঃ পণ্ডিতস্থবিরশ্রীঘনদেবস্য॥ গোবিন্দপালদেবানাং সং ৩৭ শ্রামণ দিনে ১১ লিখিতমিদং পুস্তকং কা শ্রীগয়াকরেণেতি[৩১]॥”  (৪) ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে রক্ষিত ‘পঞ্চাকার’ গ্রন্থের শেষ পত্রে লিখিত আছে:—

 ‘সম্যক্‌সম্বুদ্ধভাষিতঃ পঞ্চাকারঃ সমাপ্তঃ॥ পরমেশ্বরেত্যাদি রাজাবলী পূর্ব্ববৎ। শ্রীমদ্‌গোবিন্দপালদেবানাম্ বিনষ্টরাজ্যে অষ্ঠত্রিংশৎ সম্বৎসরেঽভিলিখ্যমানে জ্যৈষ্ঠকৃষ্ণাষ্ট্যম্যাং তিথৌ যত্র সং ৩৮ জ্যৈষ্ঠদিনে ৮ লিখিতমিদং পুস্তকং কা শ্রীগয়াকরেণ[৩২]।”

 (৫) ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে রক্ষিত কৃষ্ণাচার্য্য বা কাহ্নপাদ-বিরচিত ‘যোগরত্নমালা’ গ্রন্থের শেষ পত্রে লিখিত আছে:—

 “শ্রীহেবজ্রপঞ্জিকা যোগরত্নমালা সমাপ্তা॥ কৃতিরিয়ং পণ্ডিতাচার্য্যশ্রীকাহ্নপাদানামিতি। পরমেশ্বরেত্যাদি রাজাবলী পূর্ব্ববৎ। শ্রীমদ্‌গোবিন্দপালদেবানাম্ সং ৩৯ ভাদ্রদিনে ১৪ লিখিতমিদং পুস্তকং কা শ্রীগয়াকরেণ[৩৩]।”

 বেলখরাগ্রামের শিলাস্তম্ভলিপিতে দেখিতে পাওয়া যায় যে, কান্যকুব্জরাজের সম্রাটপদবীজ্ঞাপক উপাধিমালার পরিবর্ত্তে “পরমভট্টারকেত্যাদি রাজাবলী পূর্ব্ববৎ” ব্যবহৃত হইয়াছে[৩৪]। গোবিন্দপালের রাজ্যকালে অথবা জীবিত কালে লিখিত তিনখানি পুথিতে এই জাতীয় বিশেষণ দেখিতে পাওয়া যায়। এই বিশেষণ সম্বন্ধে মৃত অধ্যাপক বেণ্ডল বলিয়াছিলেন যে, কায়স্থ (লেখক) বোধ হয় সমস্ত বিশেষণ লিখিতে অস্বীকৃত হইয়াছিল[৩৫]। স্থানবিশেষে অথবা সমগ্র রাজ্যে রাজার অধিকার লোপ বোধ হয়, লেখকের রাজার সমস্ত উপাধি লিখনে অস্বীকার হইবার কারণ। ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে রক্ষিত একখানি গ্রন্থে ‘বিনষ্টরাজ্যে’ শব্দের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়। ইহা গোবিন্দপালের ৩৮ রাজ্যাঙ্কে, অর্থাৎ—১১৯৯ খৃষ্টাব্দে লিখিত হইয়াছিল। এই বৎসরই মগধদেশ মহম্মদ্-ই-বখ্‌তিয়ার খিল্‌জি কর্ত্তৃক বিজিত হইয়াছিল। ইহার পূর্ব্ববৎসরও গোবিন্দপালদেব জীবিত ছিলেন; কারণ, তাঁহার ৩৭ রাজ্যাঙ্কে লিখিত গ্রন্থে ‘অতীত, বিনষ্ট’ অথবা “পরমেশ্বরেত্যাদি রাজাবলী পূর্ব্ববৎ” প্রভৃতি বিশেষণের ব্যবহার নাই। ঐতিহাসিক ভিন্সেণ্ট স্মিথ ১১৭০ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে লক্ষ্মণসেনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেন না,[৩৬] কিন্তু তিনি স্বীকার করিয়াছেন যে, গোবিন্দপাল ১১৭৫ খৃষ্টাব্দে মগধের কোন স্থানে রাজত্ব করিতেছিলেন[৩৭]। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু প্রমাণাভাব সত্ত্বেও বলেন যে, গোবিন্দপালদেব ১১৬০ খৃষ্টাব্দে রাজ্যচ্যুত হইয়াছিলেন[৩৮]। গাহডবাল ও সেন-রাজবংশের দ্বন্দ্বকালে গোবিন্দপালদেব বোধ হয়, নানা স্থান হইতে তাড়িত হইয়া অবশেষে মুসলমানগণের হস্তে জীবন বিসর্জ্জন দিয়াছিলেন।

 সুলতান মহম্মদ-বিন-সাম কর্ত্তৃক জয়চ্চন্দ্র পরাজিত ও নিহত হইলে কান্যকুব্জ-রাজ্য মুসলমান সেনাপতিগণের মধ্যে বিভক্ত হইয়াছিল। ইউরোপের মধ্যযুগের ইতিহাসে যেরূপ ফিউডাল (feudal) প্রথা প্রচলিত ছিল, নববিজিত রাজ্যে গোরীয় সুলতানগণ সেইরূপ প্রথাই প্রচলিত করিয়াছিলেন। কোন নূতন হিন্দুরাজ্য বিজিত হইলে সুলতান পূর্ব্বতন ভূম্যাধিকারিগণকে অধিকারচ্যুত করিয়া তাহাদিগের পরিবর্ত্তে বিশ্বস্ত সেনা-নায়কগণকে ভূমি প্রদান করিতেন। মিন্‌হাজ-উস্-সিরাজের বর্ণনানুসারে গৌড়-মগধ-বিজেতা মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার গোর-উপত্যকার অধিবাসী ছিলেন। সুলতান মহম্মদ কর্ত্তৃক চৌহান ও গাহডবাল-রাজ্য বিজিত হইলে তিনি অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টায় জন্মভূমি পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। মহম্মদ ভারতবর্ষে আসিয়া অযোধ্যা বা আউধের নূতন ভূম্যাধিকারী মালিক হসাম্-উদ্দীন আগল্‌বকের অধীনে সেনাদলে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন[৩৯]। তিনি গাহডবাল-রাজ্যের একাংশ জায়গীরস্বরূপ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন এবং জায়গীর হইতে সেনা লইয়া চতুর্দ্দিকের গ্রাম ও নগরসমূহ লুণ্ঠন করিতেন। মিনহাজ্ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন যে, এই সময়ে মহম্মদ বর্ত্তমান পাটনার নিকটবর্ত্তী মনের এবং বিহার নগর পর্য্যন্ত লুণ্ঠন করিতে আসিতেন[৪০]। গাহডবাল-বংশের ক্ষমতার হ্রাস হইলে গোবিন্দপালদেব বোধ হয়, মগধের পূর্ব্বভাগে উদ্দণ্ডপুর, নালন্দ, বিক্রমশিলা প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষুদ্র নগরের অধিপতি ছিলেন। পূর্ব্বে সেন-বংশজ লক্ষ্মণসেনের পুত্রগণের সহিত তাঁহার প্রীতিবন্ধন ছিল না, সুতরাং মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ারের অত্যাচার নিবারণ করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মহম্মদ-ই-বখ্‌তিয়ার লুণ্ঠন-লব্ধ অর্থে নূতন সেনাদল গঠন করিয়া যখন গোবিন্দপালের রাজধানী আক্রমণ করিলেন, তখন মুষ্টিমেয় সেনা লইয়া নগর-রক্ষা মগধ-রাজের পক্ষে অসম্ভব দেখিয়া অসম্ভব দেখিয়া সংসারত্যাগী বৌদ্ধ-ভিক্ষুগণ সদ্ধর্ম্ম ও আত্মরক্ষার্থ অস্ত্রধারণ করিয়াছিলেন। উদ্দণ্ডপুর নগরের, গিরি-শীর্ষে অবস্থিত সঙ্ঘারাম, দুর্গের ন্যায় সুরক্ষিত; এই সঙ্ঘারামে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া গোবিন্দপাল মুষ্টিমেয় সেনা ও বৌদ্ধ-ভিক্ষুগণের সাহায্যে আত্মরক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন[৪১]। সে চেষ্টা সফল হয় নাই, তখন আর্য্যাবর্ত্তের কোন রাজা মগধেশ্বরের সাহায্যার্থ অগ্রসর হন নাই। উদ্দণ্ডপুর-সঙ্ঘারাম অধিকৃত হইলে সসৈন্য গোবিন্দপালদেব নিহত হইয়াছিলেন। মুসলমান ইতিহাসবেত্তা সরলভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন যে, দুর্গ অধিকৃত হইলে দেখা গেল যে, উহা একটি বিদ্যালয়; উহাতে রাশি রাশি গ্রন্থ সঞ্চিত আছে। কিন্তু তখন দুর্গরক্ষী সেনা ও ভিক্ষুগণ নিহত হইয়াছিল, মগধদেশে এমন কেহ ছিল না যে, বিজেতৃগণের কৌতূহল নিবারণার্থ ঐ সকল গ্রন্থের পরিচয় প্রদান করিতে পারে[৪২]। এইরূপে ধর্ম্মপাল ও দেবপালের বিশাল সাম্রাজ্যের অবসান হইয়াছিল। গোবিন্দপাল নিহত হইলে মগধদেশ মহম্মদ্-ই-বখ্‌তিয়ারের পদানত হইয়াছিল। বিজেতার আদেশে উদ্দণ্ডপুর ও বিক্রমশিলা-বিহারের শত শত বর্ষব্যাপী যত্নে সংগৃহীত অমূল্য পুস্তকরাজি ভস্মীভূত হইয়াছিল। মগধ-বিজয়ের পঞ্চ শত বর্ষ পরে লামা তারানাথ তুরুস্কজাতীয় মুসলমান-ধর্ম্মাবলম্বী বিজেতৃগণ কর্ত্তৃক প্রাচীন উদ্দণ্ডপুর ও বিক্রমশিলা বিহারের ধ্বংসকাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন[৪৩]। বিজেতৃগণের অত্যাচারে দলে দলে নর-নারী মগধ পরিত্যাগ করিয়া নিকটবর্ত্তী পর্ব্বতসঙ্কুল প্রদেশের হিন্দুরাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল। বৌদ্ধধর্ম্মের প্রতি মুসলমানগণের যত বিদ্বেষ ছিল, হিন্দুধর্ম্মের প্রতি তত অধিক ছিল না। এই সময়ে মধ্য এসিয়াবাসী বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী তুরুস্কজাতি আরবগণের সাম্রাজ্য ধ্বংসার্থ অগ্রসর হইতেছিল। মুসলমানগণ বার বার পরাজিত হইয়া পশ্চাৎপদ হইতেছিলেন। মগধ বিজয়ের অর্দ্ধ শতাব্দী মধ্যে মুসলমান-সাম্রাজ্যের রাজধানী বোগ্‌দাদ নগর বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী হুলাগু খাঁ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল এবং আরবজাতীয় শেষ সম্রাট্ মুস্তাসিম্ বিল্লা নৃশংসভাবে নিহত হইয়াছিলেন[৪৪]। এই জন্যই খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এসিয়াবাসী মুসলমানগণ বৌদ্ধগণের প্রতি অত্যন্ত বিদ্বেষভাবাপন্ন হইয়া উঠিয়াছিলেন। মুসলমানগণের অত্যাচার-ভয়ে বৌদ্ধভিক্ষুকগণ অমূল্য ধর্ম্মগ্রন্থনিচয় ও দেবমূর্ত্তিসমূহ সঙ্গে লইয়া নেপালে পলায়ন করিয়াছিলেন। এই জন্যই নেপালে পাল-রাজগণের রাজত্বকালে লিখিত বহু বৌদ্ধ-গ্রন্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে।

 ১১৭০ খৃষ্টাব্দের পরে ১২০০ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে লক্ষ্মণসেনের পুত্রত্রয় গৌড়-সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। ইঁহাদিগের নাম মাধবসেন, বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন। ইঁহাদিগের প্রত্যেকের এক একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু বলিয়াছেন যে, কুমায়ুনে মাধবসেনের একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে[৪৫]। ফরিদপুর জেলায় মদনপাড় গ্রামে বিশ্বরূপসেনের একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে[৪৬]। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, পৌণ্ড্রবর্দ্ধন ভুক্ত্যন্তঃপাতী বঙ্গে বিক্রমপুরভাগে কিঞ্চিৎ ভূমি বিশ্বরূপসেনের চতুর্দ্দশ রাজ্যাঙ্কে শ্রীবিশ্বরূপ দেবশর্ম্মা নামক জনৈক ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত হইয়াছিল। ফরিদপুর জেলার ইদিলপুর পরগণায় কেশবসেনের একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে, পৌণ্ড্রবর্দ্ধন ভুক্তির অন্তঃপাতী বঙ্গে বিক্রমপুরভাগে তালপাটক গ্রাম কেশবসেনের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে ঈশ্বরদেবশর্ম্মা নামক জনৈক ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত হইয়াছিল[৪৭]। কেশবসেন ও বিশ্বরূপসেনের তাম্রশাসনদ্বয় হইতে অবগত হওয়া যায় যে, তাঁহারা উভয়ে মুসলমানগণের (গর্গযবন) সহিত যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হইয়াছিলেন[৪৮]। কান্যকুব্জ-রাজ্যের অধঃপতনের পরে দলবদ্ধ মুসলমান-সেনা যখন মগধ, অঙ্গ ও গৌড়ে লুণ্ঠন করিয়া বেড়াইত, তখন তাহাদিগেরই একদল বােধ হয় সেনবংশীয় গৌড়-রাজ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিল।

 মগধ-জয়ের পরে মহম্মদ্-ই-বখ্‌তিয়ারের যশঃ, বঙ্গ ও কামরূপ পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল[৪৯]। তিনি দিল্লীর সুলতান কুতব্-উদ্দীন কর্ত্তৃক সম্মানিত হইয়াছিলেন[৫০]। “দিল্লী হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া মহম্মদ্-ই-বখ্‌তিয়ার সেনা সংগ্রহ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং গৌড়-রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। তিনি অষ্টাদশ অশ্বারোহী সমভিব্যাহারে নোদিয়া নগরে উপস্থিত হইয়াছিলেন। নগরবাসিগণ প্রথমে তাঁহাকে অশ্ববিক্রেতা বণিক্ মনে করিয়াছিল। তিনি প্রাসাদে উপস্থিত হইয়া অবিশ্বাসীদিগকে আক্রমণ করিয়াছিলেন। এই সময়ে রায় লখ্‌মনিয়া আহার করিতেছিলেন। তিনি মুসলমানগণের আগমন শ্রবণ করিয়া পুরমহিলাগণ, ধন-রত্ন-সম্পদ্, দাস-দাসী পরিত্যাগ করিয়া অন্তঃপুরের দ্বার দিয়া বঙ্গে পলায়ন করিয়াছিলেন”। ইহাই ইতিহাসবেত্তা মিন্‌হাজ-উস্-সিরাজের বিবরণ[৫১]। মিন্‌হাজ গৌড়-বিজয়ের চত্বারিশৎ বর্ষ পরে নিজাম্ উদ্দীন এবং সম্‌সাম্‌উদ্দীন নামক ভ্রাতৃদ্বয়ের নিকটে বখ্‌তিয়ারের বিজয়-কাহিনী শ্রবণ করিয়াছিলেন। মিন্‌হাজ ৬৪১ হিজিরাব্দে (১২৪৩-৪৪ খৃষ্টাব্দে) লক্ষ্মণাবতী নগরে, অর্থাৎ—গৌড়ে সম্‌সাম্‌উদ্দীনের সাক্ষাৎ পাইয়াছিলেন[৫২]

 মহম্মদ্-ই-বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক গৌড়ে ও রাঢ়ে সেন-রাজগণের অধিকার লুপ্ত হইয়াছিল, ইহা নিশ্চয়, কিন্তু যে ভাবে বিজয়-কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে, তাহা পাঠ করিয়া বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয় না। প্রথম কথা, নোদিয়া কোথায়? নোদিয়া যদি নবদ্বীপ হয়, তাহা হইলে বোধ হয় যে, মহম্মদ্-ই-বখ্‌তিয়ার লুণ্ঠনোদ্দেশে আসিয়া সেন-রাজ্যের জনৈক সামন্তকে পরাজিত করিয়াছিলেন; কারণ নবদ্বীপে যে সেন-বংশের রাজধানী ছিল, ইহার কোনও প্রমাণই অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। দ্বিতীয় কথা, আগমনের পথ; কান্যকুব্জের নিকট হইতে মগধ লুণ্ঠন যত সহজ, মগধ হইতে সামান্য সেনা লইয়া গৌড় বা রাঢ় লুণ্ঠন তত সহজ নহে। মহম্মদ্-ই-বখ্‌তিয়ার কোন্ পথে নোদিয়া আক্রমণ করিতে আসিয়াছিলেন, তাহা জানিতে পারা যায় নাই। তিনি যদি রাজমহলের নিকট দিয়া গঙ্গার দক্ষিণকূল অবলম্বন করিয়া আসিয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনি কখনই অল্প সেনা লইয়া আসিতে পারেন নাই এবং রাজধানী গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী অধিকার না করিয়া আসেন নাই। তখন ঝাড়খণ্ডের বনময় পর্ব্বতসঙ্কুল পথ সামান্য সেনার পক্ষে অগম্য ছিল। এই সকল কারণে অষ্টাদশ অশ্বারোহী লইয়া মহম্মদ্-ই-বখ্‌তিয়ারের গৌড়-বিজয়কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া বোধ হয় না। গৌড়-জয়ের প্রকৃত ঘটনা এখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন আছে। তাহা নূতন আবিষ্কারের আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া না উঠিলে আমরা তাহা বুঝিতে পারিব না। তৃতীয় কথা, লক্ষ্মণসেন তখন জীবিত ছিলেন না। লক্ষ্মণসেনের পুত্রত্রয়ের মধ্যে তখন কে গৌড়-রাজ্যের আধকারী ছিলেন, তাহা অদ্যাপি নির্ণীত হয় নাই। সিংহাসন লইয়া ভ্রাতৃগণের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল কি না, তাহাও অদ্যাপি স্থির হয় নাই। এই মাত্র বলা যাইতে পারে যে, মহম্মদ্-ই-বখ্‌তিয়ারের নদীয়া-বিজয়-কাহিনী সম্ভবতঃ অলীক। ইহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হইবে যে, নোদিয়া পুনর্ব্বার হিন্দু-রাজগণ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়াছিল; কারণ, মহম্মদ-ই-বখতিয়ারের অর্দ্ধশতাব্দী পরে বাঙ্গালার স্বাধীন সুলতান মুগীস্‌উদ্দীন য়ুজবক্ নোদিয়া-বিজয় করিয়া বিজয়কাহিনী স্মরণার্থ নূতন মুদ্রা মুদ্রাঙ্কন করাইয়াছিলেন[৫৩]ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতিহাসে বিজয়-কাহিনী স্মরণার্থ নূতন মুদ্রার মুদ্রাঙ্কনের দৃষ্টান্ত বিরল নহে। পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে, কান্যকুব্জ-বিজয়ের পরে সুলতান শমস্-উদ্দীন্ আলতামশ্ এইরূপ মুদ্রা মুদ্রাঙ্কিত করাইয়াছিলেন[৫৪] এবং বাঙ্গালার স্বাধীন সুলতান সিকন্দর শাহ কামরূপ-বিজয়ের পরে স্মরণার্থ মুদ্রায় বিজয়ের কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন[৫৫]। এই তমসাচ্ছন্ন যুগে গৌড়ে সেন-বংশের অধিকার লোপ হইয়াছিল; কোন্ সময়ে কিরূপে গৌড়দেশ মুসলমান বিজেতার হস্তগত হইয়াছিল, তাহা অদ্যাবধি নির্ণীত হয় নাই। গৌড়-রাজ্যবিজয়ের পরে লক্ষ্মণসেনের বংশধরগণ যে বঙ্গদেশে স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন, ইতিহাসবেত্তা মিন্‌হাজ-উস্-সিরাজ স্বয়ং সে কথা স্বীকার করিয়া গিয়াছেন[৫৬]

  1. Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. V, 1909, pp. 67-87.
  2. Indian Antiquary, Vol. XL, 1912, p. 183.
  3. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1874, Vol. XLIII, p. 108.
  4. V. A. Smith, Early History of India, 3rd Edition, p. 387; কেহ কেহ এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে প্রস্তুত নহেন।
  5. অজনি বিজয়চন্দ্রো নাম তস্মান্নরেন্দ্রঃ
    সুরপতিরিব ভূভৃৎপক্ষবিচ্ছেদদক্ষঃ।
    ভুবনদলনহেলাহর্ম্ম্যহম্মীরনারী
    নয়নজলদধারা-শান্তভূলোকতাপঃ॥ ১০
    —Epigraphia Indica, Vol. IV, p. 119.

  6. V. A. Smith, Early History of India, 3rd Edition, p. 387.
  7. V. A. Smith, Early History of India, 3rd Edition, p. 389.
  8. Elliott’s History of India, Vol II, p. 225.
  9. Ibid, pp. 215-35.
  10. Elliot’s History of India, Vol. II, p. 223.
  11. Epigraphia Indica, Vol. IV, p. 127.
  12. ১২.০ ১২.১ Ibid, Vol. V, App. p. 24, no. 164.
  13. Indian Antiquary, Vol. XVIII, p. 131.
  14. Catalogue of Coins in the Indian Museum, Calcutta, App. A.
  15. Epigraphia Indica, Vol. X, p. 93.
  16. Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. VII, p. 762.
  17. Ibid, p. 768; Catalogue of Coins in the Indian Museum, Calcutta, Vol. II, pt. 1, p. 21, no. 39.
  18. Tabaqat-i-Nasiri, (Raverty’s Trans.) pp. 628-29.
  19. Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. VII, p. 763, pl. X.
  20. Epigraphia Indica, Vol. IV, p. 311.
  21. Ibid, Vol. V, App. p. 22, no. 152.
  22. Journal of the American Oriental Society, Vol. VI, p. 547.
  23. Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1880, p. 77.
  24. Journal of the Royal Asiatic Society, New Series, Vol. VIII, 1876, p. 3.
  25. Epigraphia Indica, Vol. V, App. p. 24, no. 166; Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, p. 109.
  26. বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৭শ ভাগ, পৃঃ ২১৪।
  27. বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ১৭শ ভাগ, পৃঃ ২১৬।
  28. Journal of the Royal Asiatic Society, New Series, Vol. VIII, p. 3.
  29. Cunningham’s Archaeological Survey Reports, Vol. III, p. 125, pl. XXXVIII, no. 18; Memoirs of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V, p. 109.
  30. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1900, pt. 1, p. 100, no. 25.
  31. Bendall’s Catalogue of Buddhist Sanskrit Manuscripts in the University Library, Cambridge, p. 189, no. Add. 1699, ii.
  32. Bendall’s Catalogue of Buddhist Sanskrit Manuscripts in the University Library, Cambridge, p. 188, no. Add. 1699, I; p. iii.
  33. Ibid, p.189-90, no. Add. 1699, IV.
  34. Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. VII, p. 763.
  35. Catalogue of University Library, Cambridge, p. iii.
  36. V. A. Smith’s Early History of India, 3rd. Edition, p. 403.
  37. Ibid, p. 401.
  38. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, রাজন্যকাণ্ড, পৃঃ ২১৩, ৩২৩।
  39. Tabaqat-i-Nasiri, (Trans. by Raverty), р. 549.
  40. Ibid, p. 550.
  41. Muhammad-i-Bakhtyar by the force of his intrepidity, threw himself into the postern of the gateway of the place, and they captured the fortress, and acquired great booty. The greater number of inhabitants of that place were Brahmans, and the whole of those Brahmans had their heads shaven; and they were all slain.—Tabaqat-i-Nasiri, (Trans. by Raverty), p. 552.
  42. There were great number of books there; and when all these books came under observation of the Musalmans, they summoned a number of Hindus that they might give them information respecting the import of those books; but the whole of the Hindus had been killed. On becoming acquainted, it was found that the whole of that fortress and city was a college, and in the Hindi tongue, they call a College—Bihar.—Ibid.
  43. Indian Antiquary, Vol. IV, pp. 366-67.
  44. Ameer Ali’s History of the Saracens, pp. 596-97.
  45. Atkinson’s Kumaon, p. 516; শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু এই গ্রন্থ উল্লেখ করিয়াছেন কিন্তু Atkinson-রচিত N. W. P. Gazetteer, Vol. XII Himalayan Districts, ৫১৬ পৃষ্ঠায় তাম্রশাসনের উল্লেখ নাই।
  46. Journal of the Asiatic Society of Bengal, 1896, part I, pp. 9-15.
  47. Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. X, 99-104.
  48. শশাস পৃথিবীমিমাং প্রথিতবীরবর্গ্গাগ্রণীঃ।
    সগর্গযবনান্বয়প্রলয়কালরুদ্রো নৃপঃ॥
    —Ibid, p. 102.

  49. Tabaqat-i-Nasiri, (Trans. by Raverty), p. 554.
  50. Ibid, p. 552.
  51. Ibid, pp. 567-8.
  52. Ibid, p. 552.
  53. Catalogue of Coins in the Indian Museum, Calcutta, Vol. II, pt. II, p. 146, no. 6.
  54. Catalogue of Coins in the Indian Museum, Calcutta, Vol. II, Pt. I, p. 21, no. 39.
  55. Ibid, part II, p. 158, no. 38.
  56. Tabaqat-i-Nasiri, (Raverty’s Translation) p. 558.