পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কারণ, চার অধ্যায়ের এলা যেমন অতীনকে বলেছিল—তেমনি তো আমাদের দেশের বর্তমান কর্ণধারেরাও রাষ্ট্রকে বিশ্বপুঁজিবাদের স্বেচ্ছাবৃত মুৎসুদ্দি করে তুলে দিবারাত্র এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন: ‘দস্যু আমার, কেড়ে নিতে হবে না গো, নাও এই নাও। দুয়ার-ভেঙে এসে যাচ্ছেন জ্যোর্তিময় পশ্চিমীরা: প্রথম গেছে লজ্জা এবার যাবে একে একে সমস্ত ভূষণ। সবেমাত্র গেল বীমাশিল্প, তারপর যাবে ব্যাঙ্কিং। না, মুৎসুদ্দি রাষ্ট্র নিজের বলে কিছু রাখবে না আর। তোমার চরণে আমার পরাণে বাঁধিল প্রেমের ফাঁসি/সব সমর্পিয়া একমন হৈয়া নিশ্চয় হইলাম দাসী’-এই তো গাইছেন রাষ্ট্রনায়কের ছদ্মবেশে ইজারাদার মত্সবদারেরা। মার্কিনী শাহানশাহ গোটা দুনিয়ার ইজারা নিয়েছেন; তার রক্তচক্ষু ও জ্বভঙ্গে তৈরি হচ্ছে কত ইরাক-বসনিয়া-চেচেনিয়াকারগিল-ইন্দোনেশিয়া-আফগানিস্তানের রঙ্গভূমি। হর্ষদ মেহেতা-নরসিমা রাওমনমোহন সিং মশায়েরা পালাগানের সূত্রধার ছিলেন, তারপর নাচনকোঁদন করে ডুগডুগি বাজাতে-বাজাতে মঞ্চে এসে গেলেন স্বদেশি নামাবলী পরা পুরুতের দল। এঁরা একদিকে রুপার্ট মারডুকের মতো তিমিঙ্গিলদের কাছে তুলে দিয়েছেন তথ্যবিনোদনের কামধেনু, অন্যদিকে ত্রিশূলধারী শেয়ালদের লেলিয়ে দিচ্ছেন মহারাষ্ট্রে, রাজস্থানে, উত্তরপ্রদেশে, গুজরাটে। বিশুদ্ধ স্বদেশি মতে চরণ শাহ সতী হলো।

 অযোধ্যায়-কাশীতে-মথুরায়-মোচ্ছব আবার লাগবে কি?

 উলঙ্গের দেশে পোষাকের প্রয়োজন কী! একদিকে সামন্তবাদের অঘোরপন্থা ওঁ নমঃ শিবায়, শ্রী শ্রী হনুমান জাতীয় অন্তহীন ভিস্যুয়ালের সন্ত্রাসে মনকে পাথর করে দিচ্ছে, অন্যদিকে আধুনিকোত্তর প্রতিনন্দন কম্পিউটার প্রযুক্তিতে ভর করে বিজ্ঞানকেও বিভ্রম বলে প্রতিপন্ন করছে। অজস্র অধিবাস্তব বিদেশি ছবির মধ্য দিয়ে (যেমন ইণ্ডিপেণ্ডেস ডে, টার্মিনেটর, ফারস্কেপ, নাইটম্যান ইত্যাদি) দর্শক একসময় অসম্ভাব্য ভবিষ্যতের কৃষ্ণবিবরে ঢুকে যায় এবং যথাপ্রাপ্ত বাস্তবকে অসম্পূর্ণ, রিক্ত, পরিত্যাজ্য বলে মনে হতে থাকে তার। শনির থানে ভিড় বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত, মসজিদে-গুরুদ্বারে উপচে পড়ে বাঘে-গরুতে সহাবস্থান। এত সব উদ্ভটের পরস্পর সন্নিবেশ কাদের স্বার্থে মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে গত দশ বছরে, এ নিয়ে প্রশ্ন জাগে না কোনো। কারণ, আমরা প্রশ্ন করতে শিখি না এবং প্রশ্ন করতে দেওয়াও হয় না আমাদের। সব কিছু মান্যতা পেয়ে যায় বলে অন্তরে-বাহিরে আমাদের উৎকট নগ্নতাও প্রতিভাবাদর্শের সমর্থন পেয়ে যায়। যেভাবে মহাকাশযান পৃথিবীর অভিকর্ষ পেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতায় দূর মহাশূন্যে পৌছে যায়, তেমনি প্রচণ্ড এসকেপ ভেলোসিটি নিয়ে আমরাও শতাব্দীর প্রদোষবেলায় ইতিহাস থেকে, সত্য থেকে, বাস্তবতা থেকে, সংস্কৃতি থেকে নামহীন রূপহীন চরিত্রহীন শূন্যতায় নিষ্ক্রান্ত হয়েছি। এখন আমরা প্রতিমুহূর্তে চিহ্নায়ক তৈরি করছি এবং ভেঙে ফেলছি। স্মৃতির ভারমুক্ত হয়ে সত্তার দায়মুক্ত হয়ে জমিয়ে তুলছি শুধু পুঞ্জপুঞ্জ অভ্যাসের ছাই। বর্তমানে দাঁড়াতে-না-দাঁড়াতে নিমিষে ভবিষ্যৎ অতীত হয়ে যাচ্ছে। যা যা হয়ে যাচ্ছে তাদের সন্ত্রাসে ক্রমাগত পেছনপানে হাঁটছে যা যা আছে। এবং যা যা হতে পারত।

২৫