পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নির্বাসিত বাংলার টুটোফাটা দর্পণ

 ‘মমতাবিহীন কালস্রোতে/বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে/নির্বাসিতা তুমি/সুন্দরী শ্রীভূমি’—একথা লিখেছিলেন সেই মানুষটি, বাংলা-সংক্রান্ত কোনো কিছু লিখতে গেলে যিনি অবধারিত ভাবে চলে আসেন কলমের ডগায়। তো, রবীন্দ্রনাথ অবশ্য পূর্ববঙ্গ থেকে ঔপনিবেশিক চক্রান্তে বিচ্ছিন্ন শ্রীহট্ট বা সিলেটের কথা লিখেছিলেন। উনিশ শতকে আসামের সঙ্গে তাকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। আর ১৯৪৭-এর গণভোটের প্রহসনে আসাম থেকে সরে গিয়ে তা চলে গেল সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে। এখনকার বাংলাদেশ। কিন্তু উনিশ ও বিশ শতক ধরে সিলেট-সংলগ্ন কাছাড় জেলা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে হয়ে রইল বঙ্গীয় সংস্কৃতির পূর্বপ্রান্তিক শেষ জনপদ। মূল স্রোত থেকে সরে থাকার ফলে এখানে জন্ম নিয়েছে বদ্ধ জলরাশির অনিবার্য বিচ্ছিন্নতা ও সংকীর্ণতা, সকারণ ও অকারণ অভিমান, আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রবোধ ও সীমাবদ্ধ পরিসরে বিচরণের অভ্যাস, আত্মতুষ্টি ও উদ্যমহীনতা। তার ওপর এখানকার মানুষদের সাংস্কৃতিক ও ভাষিক অভিজ্ঞান মুছে ফেলার জন্যে চক্রান্তে লিপ্ত আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদ। রাজধানী দিসপুরে যে-শাসকই থাকুক, বরাক উপত্যকার দুখিনী বর্ণমালা তাদের চক্ষুশূল। ছলে-বলে-কৌশলে অসমিয়াকরণ প্রক্রিয়া চাপিয়ে দেওয়াতে এরা বদ্ধপরিকর। বরাক উপত্যকার আধা-ঔপনিবেশিক অবস্থান ঘুচল না তাই।

 আসলে বরাকের প্রান্তিক বাঙালিদের জন্যে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। আর্যাবর্তের মৌলবাদী রাজনীতি হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের নীতি নিয়ে নিকৃষ্ট না-সংস্কৃতির নোংরা এঁদো ডোবার জল গিলিয়ে দিচ্ছে অহরহ। ১৯৬১ সালের ১৯ মে এগারো শহিদ প্রাণ দিয়েছিল বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে। ১৯৭২-এর আরও একজন আর ১৯৮৬তে দুজন শহিদ হল। নিরবচ্ছিন্ন ভাষা-সংগ্রামের এই ভূমিতে অসমিয়াকরণ আর হিন্দিকরণ এখনও নির্বাধ। উপত্যকার তিনটি উচ্চতম শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান জন্ম নিয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের পরে। আসাম (অসম নয়) নামক প্রদেশের উপনিবেশ এই বরাক উপত্যকায় সমস্ত সংখ্যালঘু মানুষের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও শৈক্ষিক অস্তিত্ব রক্ষার অধিকার যে স্বতঃসিদ্ধ, এই বোধ শানিত করবে এইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—এটাই ছিল কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু যার শিল তার নোড়া তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া’ নীতিতে কম -বেশি তিনটে প্রতিষ্ঠানেই বাঙালি সত্তা ও বাংলা ভাষার মর্যাদা অটুট রাখার জন্যে সংগ্রাম করতে হচ্ছে আজও-ইতিহাসের এ এক নিষ্ঠুর কৌতুক। আরও একটি বিচিত্র সমস্যা আছে বরাক উপত্যকার বাঙালিদের জন্য। পশ্চিমবাংলায় এবং বাংলাদেশে এখনও অনেকে জানেন না এবং জানবার জন্যে কোনও আগ্রহ দেখান না, যে,

৬০