পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রান্তিক বাঙালির বিহ্বল বয়ান

 না, কোনও ধরনের নাটকীয়তা তৈরি করার জন্যে এমন শিরোনাম দিইনি। কিংবা ‘আমাকে দেখুন’ বলে নাকিকান্না জুড়ে দেওয়ার ইচ্ছেও নেই। বিশ শতকের শেষ কয়েকটি দশকে এত বেশি সংশয় ও আঁধি তৈরি হয়েছে যে বিহ্বলতাও উপযুক্ত শব্দ নয়। কৃষ্ণবিবর এখন আগ্রাসী জীবনের প্রতিটি স্তরে। যন্ত্র-প্রযুক্তির অতিবিজ্ঞাপিত উদ্ভাসন, বিশ্বায়নের তুমুল কোলাহল, আত্মবিস্মৃতির উৎকট মাদক আমাদের শেকড় উপড়ে ফেলছে অহরহ। চৈতন্যে মড়ক এখন; ভ্রুক্ষেপ কিছুতেই নেই কারও। চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো বহুদিনকার বিশ্বাস ভেঙে পড়তে থাকলেও গণ্ডারের চামড়ায় আঁচড়টি পর্যন্ত পড়ে না। জ্ঞানী কুচক্রীদের ভিড়ে হারিয়ে গিয়ে প্রলাপ বকলেও কোনও অস্বস্তি হয় না। অন্তর্ঘাতকের ছুরির আস্ফালন দেখতে দেখতে এখন আর ডি এক্স বিস্ফোরণ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তবু সেই পুরনো পি পু ফি শু নীতি আঁকড়ে রয়েছি। মেনে নিচ্ছি মূখের প্রগলভ ঔদ্ধত্য; এমন কি আমাদের মাথার উপরের ছাউনি আর পায়ের নিচের জমি কেড়ে নিতে চাইলেও কোনও আপত্তি করছি না কেউ।

 একুশ শতকের প্রথম দশকও শেষ হতে চলেছে। বিশ শতক ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দ নিয়ে পণ্ডিতেরা অনেক কথাই লিখেছেন, বলেছেন। কিন্তু এক হাজার বছরের সাংস্কৃতিক অর্জন জাতিসত্তার অভিজ্ঞান যে নিতান্ত অবহেলায়, মাত্র কয়েক দশকের আত্মঘাতী অবিমৃষ্যকারিতায়, ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি: এ বিষয়ে তেমন কোনও সচেতনতাই দেখলাম না। বিশ শতকে পৃথিবীর অন্যত্র কিন্তু ইতিহাসের ভ্রান্তি সংশোধিত হতে দেখেছি। বহুধাবিচ্ছিন্ন যাযাবর ইহুদিরা নিজেদের রাষ্ট্র পেয়েছে; অতলান্ত বিস্মৃতি থেকে তুলে এনে মৃতপ্রায় ভাষার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে। দ্বিধাবিভক্ত জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় সীমানা পুনর্নির্ধারিত হয়েছে; ঔপনিবেশিক চক্রান্ত মোকাবিলা করে ভিয়েতনাম বিভাজনকে অস্বীকার করেছে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মরীচিকায় বিভ্রান্ত বাঙালি আর হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্বের চক্রব্যুহ থেকে বেরোতে পারল না। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট আর্যাবর্ত-কেন্দ্রিক ভারতীয় রাজনীতি বাংলাকে দেশবিভাজনের হাঁড়িকাঠে বলি দিয়েছে। বঙ্গভঙ্গ-মন্বন্তর-দাঙ্গা পেরিয়ে-আসা বাঙালি বুঝতেই পারেনি, কী চিরস্থায়ী সর্বনাশের বন্দোবস্ত করছে আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক সমাজ। ভারত ভেঙে পাকিস্তান হল, লক্ষ লক্ষ বাঙালি কয়েক পুরুষের ভিটেমাটি ও ঐতিহ্য থেকে উৎখাত হয়ে অর্জন করল ‘উদ্বাস্তু’ বিশেষণ।

 কোথায় গেল সেইসব বাস্তুহীন জনতা? আসামে-মেঘালয়ে-ত্রিপুরায়-পশ্চিমবঙ্গে। বাষট্টি বছর পরেও এঁরা ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক পরিসরে জলবিভাজনরেখা ডিঙিয়ে

৭০