সময় অসময় নিঃসময়/গ্রহাণুপুঞ্জের আকাশ

উইকিসংকলন থেকে
গ্রহাণুপুঞ্জের আকাশ

এপাশে মায়ের মৃতদেহ, ও পাশে বাবার মৃতদেহ
মাঝখানে সে, মাত্র দু-বছর হল সে পৃথিবীতে এসেছে।
তার মাকে ফুল দিয়ে গেছে
বাবাকেও ফুলে ফুলে ঢেকে দিয়ে গেছে
পৃথিবীতে এত ফুল আছে?
আমরা বড়োরা জানি কখন আমরা ফুল দিই,
জ্বালাই কখন মোমবাতি?

 এবছর ফেব্রুয়ারিতে এই কবিতাটি পড়েছি। অন্তর্জাল আর ই-মেল শাসিত দুনিয়ায় আমরা যতই মহানাগরিক সপ্রতিভ আর চতুর নির্মাণের ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হই না কেন, কবিতার ভাষাকে দুমড়ে মুচড়ে তাক লাগিয়ে দেওয়ার চালাকি দেখতে না-পেয়ে আশ্বস্ত হই যেন। একুশ শতকের এই প্রারম্ভিক দশক যখন ধীরে ধীরে অন্তিম প্রহরে পৌছে যাচ্ছে, এখনও কত অনায়াসে ফুল ও মোমবাতি চিহ্নায়িত বাচনের ভিত্তি হতে পারে। চারদিককার ধূসর ও নিরাবেগ অভ্যাসের ফুর্তি-ফার্তার মধ্যে এখনও চাপা অন্তর্নাট্যের আভাস বিষাদের স্নান আভা বয়ে আনে কবিতায়। মা ও বাবার মৃতদেহের মাঝখানে দু-বছরের একটি বিপন্ন শিশুর উপস্থিতি তো আশ্চর্যজনকভাবে আজকের সময়েরই শিল্পিত উপস্থাপনা। তবু শিল্পের নির্মাণকলাও সমকালের নিষ্ঠুর সত্যকে আড়াল করতে পারে না। কবিও কি তা-ই চেয়েছেন? আসলে এ হল উচ্চারণের সামাজিকতা যা সর্বদা কবির সময়-নিষ্পন্ন অনুভূতির অভিব্যক্তি।

 সাম্প্রতিক সময় ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালি পড়ুয়াদের কাছে অবিমিশ্রভাবে প্রতিভাত হয় কি? যতদিন যাচ্ছে, ভঙ্গুর পৃথিবীর তুমুল অনিশ্চয়তা ও ভরকেন্দ্রহীন ভাবনা কিংবা ভাবনাহীনতার আবর্তে শ্বাসরুদ্ধ হতে হতে খুঁজে পাওয়া কঠিন, কোথায় আমাদের উপনিবেশোত্তর অবস্থানের বহুমাত্রিক স্বীকৃতি আর কোথায়-ই বা আধুনিকোত্তর সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের এলাকা! এ বড় বিচিত্র ঘূর্ণিপাকের সময় যখন সাপ ও নেউল স্বচ্ছন্দে সহাবস্থান করে। শিবির বদল হয় মুহূমুহূ, নন্দন ও প্রতিনন্দনের মধ্যে লক্ষ্মণরেখা লুপ্ত হয়ে যায়। যে-সপ্রতিভ মানুষটি সময়-সচেতনতার পতাকা বয়ে নিয়ে যাওয়ার দুর্নিবার তাড়নায় অন্তর্জাল-সাইবার কাফে-মোবাইল-শপিংমলের ঝাঁ-চকচকে দুনিয়ায় স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে পড়েছে, তার কাছে কবিতা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-নন্দন সহ মূদ্রাস্ফীতি সেনসেক্স-খুচরো দেশপ্রেম তালিবানীকরণ—আর ডি এক্স: সমস্তই তো একই রকম বার্তাহীনতার খবর হয়েই আসে। অর্থাৎ আদৌ আসে না। ব্রেকিং নিউজ হিসেবে হিজড়ে পল্লীর বিয়ে, সরকারি প্রতিবেদনে সমকামিতার বৈধীকরণ প্রক্রিয়া, চিন ও পাকিস্তানের সঙ্গে কভি খুশি কভি গম জাতীয় কূটনৈতিক খেলাধুলো, ক্রিকেটীয় জাতীয়তাবাদের তুমুল উত্থান এবং এ জাতীয় অন্য সব কাল-চিহ্নগুলি আমাদের সমকালকে অজস্র বুদবুদের সমাহার করে তুলেছে।

 এই নৈরাজ্যময় মহোৎসবের মধ্যে কবিতা লেখা হচ্ছে, পড়াও হচ্ছে; রচিত হচ্ছে। ‘ইউজ অ্যাণ্ড থ্রো’ নীতির অনুসারী উপন্যাস নামক ভস্মীভূত অভ্যাসের কঙ্কাল। এইসব পড়ার ভান করতে করতে স্মৃতিলুপ্ত প্রজন্ম বোেকাবাক্সের মোহিনীমায়ায় বুদ হয়ে সা রে গা মা পা এবং সেই জাতীয় আরও অনেক নির্বোধ স্থূলতা, ভাঁড়ামি ও ইতরতার প্রদর্শনী থেকে শিখে নিচ্ছে নয়া প্রাদেশিকতা, আবার পাশাপাশি মেনে নিচ্ছে অভ্যন্তরীন ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের নাগপাশও। হ্যা, এখন সত্যিই চারদিকে দেখতে পাই, শিশুর কাঁধে মড়ার পালকি ছুটে চলেছে নিমতলায় এবং উত্তাল হয়ে উঠেছে বুড়োবুড়িদের লম্বালম্বি বাসরঘরী নাচ! তাই এখনই তো সেই সময় যখন এ-পাশে মায়ের মৃতদেহ এবং ওপাশে বাবার মৃতদেহ নিয়ে ছিন্নমূল ও লক্ষ্যহীন নবীন প্রজন্ম, মাঝখানে রয়েছে যেন ন যযৌ ন তস্থেী। তার না আছে কোনো যাত্রা, না আছে কোনো গন্তব্য। একমাত্র কোনো কবিই দেখতে পান ঘটনা-সংস্থানের অন্তর্বর্তী চিহ্নায়নের তাৎপর্য। আর, লেখেন:

‘এ পাশে তার মা, ও পাশে তার বাবা
সে জানে না আজ তার জন্মদিন
সে আর বাবার দিকে তাকিয়ে নেই
সে তার মায়ের দিকে আর তাকাচ্ছে না
সে তাকিয়ে আছে পুলিশের দিকে
সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে,আমার দিকে
তোমার, তোমার, তোমার দিকে
কিন্তু আমি আর তাকাতে পারছি না ছেলেটার চোখে
যিশুর চোখের মতো চোখ, ছেলেটার আজ জন্মদিন
সবুজ প্রজাপতি হলুদ প্রজাপতি লাল প্রজাপতি
প্রজাপতিগুলো সব গেল কোথায়?

 যেমন কোনো কোনো সকাল রাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর, তেমনই এই প্রশ্নের মুখোমুখি নিরুত্তর হয়ে থাকি। ভাবি, প্রত্যুত্তরযোগ্যতা সত্যিই কি আছে আমাদের? পিকাসো যেমন বলেছিলেন, কবিতার এই বিপন্ন শিশুটি কি গণহত্যা ও আর ডি এক্স-এর বিস্ফোরণে কণ্টকিত পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে পুলিশ ও বন্দুকের দিকে ছুঁড়ে দিতে পারবে এক মুঠো গোলাপের পাপড়ি? গ্যেনিকার ফ্যাসিবাদী হিংস্রতা থেকে বাহাত্তর বছর পরে আমরা কি আরও নিষ্ঠুর জান্তব ঘাতক সময়ের অভিব্যক্তি দেখছি না? দর্শন-সাহিত্যসংস্কৃতি সহ যাবতীয় মানবিক কৃতির প্রকরণ ও অন্তর্বস্ত, নিষ্কর্য ও অন্বিষ্ট কি কেবল ঘাতক সময়ের হনন প্রস্তুতিকেই লক্ষ করবে? না কি বহুমাত্রিক সময়ের বর্ণচ্ছটা কিংবা বর্ণহীনতার তাৎপর্যকে ধারণ করার উপযোগী নতুন কৃৎকৌশল তৈরি করে নেবে? মানুষ-সভ্যতা-ভাবাদর্শ-ইতিহাসের অপমৃত্যুর একমাত্রিক ব্যাখ্যায় তৃপ্ত থেকে শুধু মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার চালাকি ও প্রসাধন রপ্ত করে নেবে? নাকি নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক না হয়ে সক্রিয় পর্যবেক্ষক হিসেবে আপন পরিসর ও অবস্থানকে যথাযথভাবে শনাক্ত করে নেবে যাতে বিপন্ন শিশুর চোখেও খুঁজে নেওয়া যায় যিশুর চোখের মতো চোখ?

 মনে দ্বিধা ও জিজ্ঞাসা জাগে তবু। সর্বজনীন সত্য বা সর্বসঞ্চারী উপলব্ধি বলে কিছু আছে কি আদৌ! বিশ্বায়নের পর্যায়ে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কি আধিপত্যবাদী শশাষণ-চাতুর্য ও চিত্তবৃত্তির উপনিবেশীকরণ সংক্রান্ত যুক্তিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হতে পারে কখনও? সেইসঙ্গে আরও একটি জরুরি জিজ্ঞাসা জাগে। যথাপ্রাপ্ত অবস্থান যেহেতু অনস্বীকার্য এবং আলাদা আলাদা ভাবে ও যৌথভাবে সামাজিক-সাংস্কৃতিকরাজনৈতিক ভূগোলের বিপুল বাধ্যবাধকতা অনতিক্রম্য—সুনির্দিষ্ট অবস্থানগত বাস্তবতা তো প্রাগুক্ত জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রবণতাগুলির পরিগ্রহণকেও নিয়ন্ত্রণ করে। যে-বাংলা ভাষায় এই প্রতিবেদনটি লিখছি, ইতিহাসের নানা পর্বে সেই ভাষা-ব্যবহারকারীদের মননমুদ্রাও বহুবাচনিক হয়ে পড়েছে। কলকাতা মহানগরের শিকড়বিচ্ছিন্ন বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের মুদ্রাদোষে নিজেরা যেভাবে আলাদা হয়ে গেছেন, বিস্তীর্ণ মফস্সলের বাসিন্দা লিখিয়ে ও পড়ুয়াদের সঙ্গে তারা কি ভুলেও কখনও আত্মীয়তা অনুভব করেন? প্রশাসনিক সূত্রে কিংবা সরকারি ব্যবস্থাপনায় এই দুইপক্ষকে নিয়মিতভাবে একই আঙিনায় জড়ো করা হয়। কিন্তু এঁদের মধ্যে পাউরুটির ঐক্যও তো দেখা যায় না। একপক্ষে যদি থাকে ঔদ্ধত্য ও তাচ্ছিল্য তো অন্যপক্ষে থাকে বিচিত্র হীনমন্যতা বা অসূয়াজনিত বিকার। বাংলার ভাষামহল এখন অজস্র পরস্পর-বিরুদ্ধ তাবুর সমাবেশমাত্র। একই ভাষাজননীর সন্তানেরা কেউ কেউ সুয়োরানী ও কেউ কেউ দুয়োরানীর পুত্র কন্যা হয়ে পড়েছেন। স্বভাবত এঁদের প্রত্যেকের সত্য এবং সময় ও পরিসরের মিথস্ক্রিয়ার প্রতীতি পরস্পর দ্বিমেরুবিষম।

 বাংলা নামে দেশের পরিস্থিতিও ঐতিহাসিক কারণে অনিবার্যভাবে জটিল যা আলোচনার জন্যে স্বতন্ত্র প্রবন্ধের পরিসর প্রয়োজন। একই বাংলা ভাষার সন্ততি হয়েও দেশভাগ নামক আদিপাপ কী পশ্চিমবঙ্গে কী পূর্ববঙ্গে সামূহিক স্মৃতিলোপের ফলে মনোভূমি থেকে হারিয়ে গেছে। চর্যাপদেরও আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল যে অখণ্ড বাঙালি বিশ্ববীক্ষার অবিভাজ্য অভিব্যক্তির—১৯৪৭-কে দানবায়িত করে আমরা সেই যাত্রার তাৎপর্য ভুলে গেছি। যে-জাতি মেকি আন্তর্জাতিকতার প্রতি একদেশদর্শী মুগ্ধতায় কৃত্রিম ভঙ্গির অনুকরণে সর্বস্ব পণ করে বসে—সেই জাতির অপমৃত্যু নিশ্চিত। তার ওপর রয়েছে উদ্ভট সংকরসত্তা তৈরির আয়োজন: কোথাও মধ্যপ্রাচ্য আর কোথাও আর্যাবর্ত তার হোতা। ফলে পরম্পরাগত ভাবে নানা পর্যায়ে প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি ধর্মচর্যা-বিশ্ববীক্ষা থেকে নানা ধরনের উপাদান আত্তীকৃত করতে করতে বঙ্গজেরা যে সংশ্লেষণী মননমুদ্রা রপ্ত করে নিয়েছিলেন, আত্মঘাতী মূঢ়তায় সেইসব বিস্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। প্রাক-আধুনিক পর্ব পর্যন্ত অজস্র দ্বন্দ্ব-সংঘাত গোষ্ঠীজীবনে নিশ্চিতভাবে এসেছিল; কিন্তু সেইসব আর যা-ই হোক পায়ের নিচের জমি আর মাথার উপরের আকাশ মুছে দেয়নি। কিন্তু গত শতাব্দীতে যা ঘটল, তাতে বিশ্বায়ন দ্বারা আক্রান্ত বাংলা ভাষা-ব্যবহারকারীদের মধ্যে ময়ূরপুচ্ছধারী কাক হয়ে ওঠার উৎকট আকাক্ষা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠল। নয়া ঔপনিবেশিক প্রভুত্ববাদের কাছে স্বেচ্ছায় সমর্পিত হয়ে যে মগজ-ধোলাইয়ের আয়োজনকে কার্নিভালের উৎসব-মত্ততায় রূপান্তরিত করা হল, তাতে উৎপাদিত হল শুধু মেধার সন্ত্রাস। ফলে হারিয়ে গেল ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, মুছে গেল যাবতীয় অভিজ্ঞান উৎকেন্দ্রিকতার অতিব্যক্ত উপস্থাপনায়। মেকি আন্তর্জাতিকতার অজস্র শিবির গড়ে উঠল মহানগর সহ আধাশহরগুলিতে।

 একে আমাদের নিজস্ব আধুনিকোত্তর পরিস্থিতি বলা যাবে কী না, তা নিয়ে কিছু সংশয় আছে। তবে এটা ঠিক, এই শ্বাসরোধী পরিবেশের মোকাবিলা করতে চান কোনও কোনও কবি-লিখিয়ে। কেউবা হয়তো আরোপিত কুহককে অকাট্য সত্য বলে ধরে নিয়ে তারই আদলে নিজেকে তৈরি করে নেন। সময়ের চিহ্ন আন্তরিকভাবে যাঁরা খুঁজতে চান, তাঁদের প্রতিবেদনে যুগপৎ ফুটে ওঠে শ্লেষ ও বিষাদ, ক্রোধ ও লাস্য। ভাবা যেতে পারে, বাচনের বিশিষ্ট ধরনেই ফুটে ওঠে তাদের প্রতিবাদ ও যন্ত্রণা। এ-প্রসঙ্গে সব্যসাচী ভৌমিকের ‘কালবেলা' কবিতাটিকে তাৎপর্যবহ বলে মনে হয়।

‘অবাক কান্না মিহি কুয়াশায় জড়ানো
নাগরিক মন ছিটকে পড়ছে যন্ত্রে
যন্ত্র মানব একলা এবং সদলে
গণ বাঁধকেই মেঘ হারানোর মন্ত্রে
মন্ত্র সাধন কিংবা শরীর পাতন
শরীরে মিশছে ফেরারী পতিত বিশ্ব
তৃতীয় বিশ্ব শপিং মলের স্বপ্নে
ভাঙা হাঁড়ি কুড়ি বিলিয়ে বিলিয়ে নিঃস্ব

যতবার খুঁজি আগুনের বারমাস্যা
মাটি খুঁড়ে ওঠে একঘটি জল ভিক্ষার
আমরা সবাই কাগজে কলমে ব্যাঘ্র,
আগুন ভুলেছি দশকের ছায়াছত্রে।’

 সময়ের স্বর ও অন্তঃস্বর এভাবেই কবিতার ভাষার গ্রন্থনাকে পাল্টে দেয়। সন্দেহ। নেই যে সময়-চিহ্নিত ছোটগল্প এবং উপন্যাসের ভাষাও একইভাবে পুঞ্জীভূত অভ্যাসের বল্মীকস্তূপ ফুঁড়ে প্রকাশিত হচ্ছে। আর, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেইসব নির্মানবায়নের প্রবণতাকে উপেক্ষা করে বহুধা-বিপন্ন মানুষেরই পাশে দাঁড়াচ্ছে। কেননা নয়া ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের বিকার সংক্রমণকে প্রতিহত করার জন্যে এটাই সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। কিন্তু বাংলাকে অবশ্যই সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে তার আপন ভাষা-অভিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই সময়ের প্রকৃত সত্যকে ধারণ করতে হবে। কথাটা এইজন্যেই জরুরি যে সময়েরও আছে অজস্র আপাত-রূপ অর্থাৎ সত্যভ্রমের চতুর আয়োজন। এই আয়োজন আসলে মেধাবী প্রকাশের নামে নির্মননের সন্ত্রাস, আন্তর্জাতিকতার পূর্বধার্য ভঙ্গির নামে জাতীয় সত্তার শিকড় উৎপাটন। রাজনৈতিক ভূগোলের চাপ যত বেশিই হোক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরম্পরা তাতে আচ্ছন্ন হতে পারে না। আমাদের যৌথ ভাবনা-প্রতিভার অজস্র মোটিফে ও আর্কেণ্টাইপে, অনুপুখে ও মেটা ন্যারেটিভে উচ্চাবচতাময় অভিজ্ঞতার বিবরণে ও অন্তরীকৃত উদ্ভাসনে আমরা জেনে এবং না-জেনে অভিব্যক্তির ঐতিহ্যকে সম্প্রসারিত করে চলেছি। এর কোনও ব্যত্যয় হতে পারে না; যদি হয়, তা আর যা-ই হোক, বাঙালির সার্বিক চেতনাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আপাত-সময়ের বর্নিল আরাখায় যাঁরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন, প্রাগুক্ত মৌলিক সত্যটি তাদের যেন স্বধর্মে ফিরিয়ে আনে।

 পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাইরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যে-সমস্ত উপভাষাভাষী বাঙালিরা আছেন, ইতিহাস তাঁদের ভূগোলকে কতখানি ছিন্নমূল করে দিয়েছে, বাংলা ভাষার অন্য শরিকেরা ভুলেও কখনও সেইসব কথা ভাবেন না। কিন্তু সেইসব অঞ্চলের আলো হাওয়া রোদেও আছে নিজস্ব ছন্দ নয়, আছে জমি ও আকাশের দ্বিরালাপ, আছে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ভরা পিপাসা না-ফুরোনোর যন্ত্রণা, আছে বৃত্তবন্দি অস্তিত্বের আর্তনাদ এবং ঘটাকাশের শর্ত পূরণ করেও দূরবর্তী কোনও মহাকাশের জন্য তৃষ্ণা। আছে রিক্ততা ও সীমাবদ্ধতার বোধ পেরিয়ে যাওয়ার জন্যে আরোপিত মননমুদ্রাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে তথাকথিত মূলস্রোতের পঙক্তিভুক্ত হওয়ার জন্যে অপ্রকাশ্য ব্যাকুলতা। আছে মন্থর সমাজের সঙ্গে অনন্বয়-ক্লিষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিসত্তার নিজস্ব চক্রব্যুহ রচনা। এই উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে ভৌগোলিকভাবে বহুদূরে বসবাসকারী কোনও কবি যখন লেখেন:

‘আমি আজ চূড়ান্ত চিনি না
চিনিনা মানুষ। মরুভূমি
কাকে বলে? কাকে বলে ভূমি?
ভূমি যাকে আমার চাবুকে
বিক্ষত করেছি? আমি চিনি?
আমি চিনি না; কে আকাশ,
কে গাছ, কে গর্দভ, কার পিঠে
আঁকা ভারতের রেলপথ।’

(বাড়ি থেকে পালিয়ে)

 মনে হয়, দূরীকৃত অপর সত্তার চিহ্নায়িত বাচনই যেন ব্যক্ত হয়েছে। আজন্ম লালিত অভিজ্ঞতায় যে জনপদের মানুষেরা আধা-ঔপনিবেশিক শোষণে-লাঞ্ছনায়অপমানে অভ্যস্ত, যাদের ঘরের বদলে তাবু আছে শুধু অন্দরে-বাহিরে, যাঁদেরে ঘিরে থাকে দারিদ্র-মালিন্য-অপুষ্টি আর বহুবিধ প্রতাপের লেজুড়বৃত্তি—তাঁরা চেনেন না কাকে বলে ভূমি আর কাকে বলে আকাশ! কাকে বলে মরুভূমি আর কাকে বলে মানুষের পরিসরতা বোঝার আগেই গোষ্ঠী-ঘৃণার আগুন ঝলসে দিয়ে যায়। আর্থ-রাজনৈতিক বিন্যাসের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে ও উচ্চাবচতায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে অতিসম্প্রতি তীব্রভাবে প্রকট হয়ে পড়েছে অন্তর্ঘাত ও হত্যার চারণভূমি। সমস্ত অস্থির ও অনিশ্চিত যখন, বাংলা ভাষা-ব্যবহারকারীদের মধ্যেও অবধারিতভাবে দেখা দিয়েছে নানাবিধ বিকার ও বিদূষণ, দুশ্চিকিৎস্য আত্মবিস্মৃতি ও অগভীর সফর সঞ্চরণ। সম্ভবত এইসব কিছুর জটিল প্রতিক্রিয়ায় এবং অনিবার্য মনস্তাত্ত্বিক কৌশল হিসেবে কূপমণ্ডুকতার আচরণবিধি মান্যতা পেয়ে গেছে। আরও একবার যেতে পারি কবিতার কাছে যেখানে ঐ পরিত্রাণহীন বিপন্নতায় আক্রান্ত অপরসত্তার প্রচ্ছন্ন হাহাকারই ব্যক্ত হয়েছে বলে ভাবা যেতে পারে:

‘এক ময়লা করেছি আমি
হাত নোঙরা করেছি আমি
আর নামব না নীচে ভাবি
তবু মদের গেলাসে নামি।

এক গেলাসে দুজন নামি
বড় গেলাসে দুজন নামি
অই গেলাস মানে সমাজ
যার ফেনায় পুড়েছি আমি।

বিষ পেরেকের মতো ঘৃণা
এসো বলব না পারছি না
এই পরবাস, অপমান
এর ভেতরেই করি গান।’

(ফেনায় পুড়েছি আমি)

 উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অজস্র জাতি ও উপজাতি সমান্তরালভাবে উপস্থিত রয়েছে কিন্তু সহাবস্থানে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুত্বর্গ Multiculturalism কিংবা Pluralism নিয়ে বহুদিন ধরে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিচ্ছেন, বই লিখছেন, আলোচনাচক্রে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে বিতর্ক করছেন। কিন্তু দেশীয় শাসক এবং ভূ-রাজনীতির তত্ত্বে বিশ্বাসী বৈদেশিক শক্তিগুলির প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য এই মৃগয়াভূমিতে বাস্তব ক্রমশ আরও পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে। বিদ্বৎবর্গের চুলচেরা বিশ্লেষণের কোনও তোয়াক্কা করে না এই বহ্নিমান বাস্তব। বাঙালি-অসমীয়া, উপজাতি-অনুপজাতি, হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক ধৃতরাষ্ট্রদের কল্যাণে কখনও দাবানল হয়ে দাউ দাউ জ্বলে আর কখনও ছাই চাপা আগুনের মতো ধিকি ধিকি পুড়িয়ে দেয় ধৈর্য ও অধ্যবসায় দিয়ে গড়া সাংস্কৃতিক মিলনায়তনগুলি। সাম্প্রতিক বিদ্যায়তনিক গবেষণায় উত্তর-পূর্বাঞ্চল সরকারি অনুদান পাওয়ার পক্ষে চমৎকার ‘বিষয় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সমাজতত্ত্বে, ভাষাবিদ্যায়, পরিবেশ বিজ্ঞানে, মানবিকী বিদ্যায় নানা প্রকল্প নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্বৎবর্গ উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ফালা ফালা করে দেখাচ্ছেন। পাশাপাশি উন্নয়নের নামে সরকারি তহবিল থেকে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে। ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পিছিয়ে-পড়া বর্গগুলির মধ্যে হঠাৎ-নবাবদের সংখ্যা আশ্চর্যজনক ভাবে বেড়ে গেছে। এঁরাই আবার নবার্জিত অর্থনৈতিক কৌলিন্যকে রাজনৈতিক প্রতাপে রূপান্তরিত করার জন্যে নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠী বা ভাষা-গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, জাতিবৈরের বিষ-বীজাণু ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে উত্তর পূর্বাঞ্চল জুড়ে কেবলই দেখা যাচ্ছে। চৈতন্যে মড়কের ছবি আর অন্যদিকে মগজ-ধোলাই এর শিকার হীরের টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি হচ্ছে।

 উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীরা স্বভাবত অরাজক মৃগয়াভূমিতে সহাবস্থান-শূন্য অন্ধকূপে স্বেচ্ছাবন্দি। গত একদশক ধরে নবীনতর প্রজন্ম হ্যামলিনের বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে পাড়ি দিচ্ছে ভারতীয় মানচিত্রের আলোকিত পরিসরে। বিশ্বায়নের উন্মাদনা ভরা আহ্বান পৌছেছে তাদের কাছে এবং ফলে যে-পথ দিয়ে যাচ্ছে তারা, সে-পথ দিয়ে ফিরছে না কেউ। মেধাশূন্য মরুভূমি তৈরি হচ্ছে সর্বত্র, গড়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। সবার অগোচরে বৈপ্লবিক রূপান্তর ইতিমধ্যে ঘটে গেছে বলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মধ্যমেধা ও নিম্নমেধাজনদের দাপট বেড়ে গেছে ভয়াবহ ভাবে। চোরাবালির বিস্তার দ্রুত বাড়ছে এখন। তাই পান্থপাদপের বদলে কাঁটাঝোপ আর ক্যাকটাসের বাড়াবাড়ন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে। তবু লেখা হয় কবিতা ও ছোটগল্প: সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতার চূড়ান্ত অভাব সত্ত্বেও লেখা হয় মৌলিক নাটক, আঁকা হয় ছবি। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রাগুক্ত ঐ অনেকান্তিক সাংস্কৃতিক বীক্ষা ও বহুত্ববাদী জীবনচর্যার সূক্ষ্ম ও গভীর প্রকাশ কতটুকু দেখতে পাই? মাঝে মাঝে অনুবাদের মধ্য দিয়ে প্রতিবেশী সৃষ্টি- ভুবনকে চিনে নেওয়ার উদ্যম হয়। কিন্তু তা সার্বিক পীড়া উপশমের বিশল্যকরণী তৈরি করার পক্ষে মোটেই পর্যাপ্ত নয়।

 এ অঞ্চলের কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে-সব প্রয়াস হয়, তা আসলে সাগরে লহরী সমান। ধারাবাহিক উদ্যম অন্য যে-সব প্রতিষ্ঠান নিতে পারত, তাদের মধ্যে শুধু দেখতে পাই এলিয়ট কথিত ‘Gesture without motion'-এর দৃষ্টান্ত। প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাসের অনুবর্তনে আত্মতৃপ্তি থাকতে পারে কিন্তু তাতে সার্বিক বিচ্ছিন্নতায় ক্লিষ্ট উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে অন্ধবিন্দু থেকে উদ্ভাসনে উত্তীর্ণ করা যায় না, ইন্দ্রপ্রস্থই হোক অথবা জব চার্নকের ঐতিহ্যপুষ্ট কলকাতা, সবার কাছেই উত্তর-পূর্বাঞ্চল যদি সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক ট্যুরিজমের চিড়িয়াখানা বলে গণ্য হয়, তাহলে অন্তর্জাল—বিশ্বায়ন—উপগ্রহ প্রযুক্তি—ধর্মীয় মৌলবাদ—আঞ্চলিক ভাষা-উপনিবেশবাদ ইত্যাদির বিচিত্র ককটেলে ভয়ঙ্কর মাদকই শুধু তৈরি হবে ক্রমাগত। সুতরাং বাংলা ভাষা-ভাষী সহ অন্য সমস্ত ভাষা-ভাবুকদের মধ্যে নিজস্ব বিনিময়ের ক্ষেত্র তৈরি হোক। কেন্দ্র ও পরিধির সুনির্দিষ্ট স্বর্গের সেই পুরনো চিন্তাপ্রণালী ক্লিশে এবং সেইজন্যে বর্জনীয় বলে ঘোষিত হোক। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আলো হাওয়া রোদে যারা পুষ্ট, তাদের কাছে নদী ও অরণ্য, উপত্যকা ও পর্বত লালিত নৈসর্গিক চিহ্নায়কগুলি সত্য হয়ে আসুক। মহানাগরিক বৈদগ্ধ্য, অন্তঃসারশূন্য সপ্রতিভ ভঙ্গি, মেকি আন্তর্জাতিকতার মোহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বভাবত বহুত্ববাদী জীবনে কোথাও প্রাসঙ্গিক নয়। চিড়িয়াখানার জীবদের প্রতি ট্যুরিস্টসুলভ দৃষ্টিপাত তাই প্রত্যাখ্যাত হোক।

 কিন্তু এতসব বলার পরেও আরও অনেক কথা থেকে যায়। একদিকে সংস্কৃতি সমবায়ের অনেকান্তিকতা এবং অন্যদিকে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের প্রতি আনুগত্য: এই বৈপরীত্যের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটবে কীভাবে? সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের সামর্থ্যে যাদের একান্ত নির্ভরতা, তাদের কাছে অস্তিত্বতাত্ত্বিক বা জ্ঞানতাত্ত্বিক মুক্তি আসবে কোন পথে? তাছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নানা কারণে এত জটিল হয়ে পড়েছে যে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীগুলি একে অপরের প্রতি বিরুদ্ধ ও বিদ্বিষ্ট। প্রত্যেকেই চাইছে বিশ্বায়নের মাদকতাময় ভোজসভায় যোগ দিতে আবার সঙ্গে সঙ্গে আপন বন্দিশালাকে অটুটও রাখতে চাইছে। শানিত যুক্তির সংঘর্ষ নয়, পূর্বনির্ধারিত সংজ্ঞা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছোটো ছোটো সংঘের যুক্তিহীন ও পারম্পর্যহীন সংঘাত অপরতার দ্বিবাচনিক তাৎপর্যকে কখনও স্পষ্ট হতে দিচ্ছে না। তার ওপর রয়েছে। প্রত্ন-আধুনিক ও আধা-আধুনিক অভ্যাস-পরম্পরার সঙ্গে নব-ঔপনিবেশিক চিন্তা-প্রণালীর সংকর সমাবেশ। এরই মধ্যে চলেছে নিঃশব্দ বিনির্মাণের পালা। বাংলা ভাষার নান্দনিক ও সাহিত্যিক সংরূপ কর্ষিত হচ্ছে আঞ্চলিক অভিজ্ঞতা ও মননমুদ্রাকে আত্মস্থ করেই। মহাসাগরের মধ্যে ইতস্তত ভাসমান কিছু ভেলার মতো সাহিত্যিক অভিব্যক্তিগুলি জেগে ওঠে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। কখনও কখনও এইসব দ্বীপের মধ্যে সেতু রচিত হয় যদিও, সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতিতে এইসব সেতুর সামাজিক তাৎপর্য সর্বদা স্পষ্ট হয় না।

 ‘Garden of Ethnic variety’ বলে পরিচিত এই অঞ্চল অনস্বীকার্যভাবে অনেকান্তিক অথচ এর স্বাভাবিক পরিণতি বহুবাচনিকতা নয়। এখানে ছিন্নবিচ্ছিন্ন ভাবে আধুনিক জীবনবোধের কিছু কিছু লক্ষণ দেখা গেছে কিন্তু তা আধুনিকতাবাদী প্রবণতা তৈরি করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। কেউ কেউ দূরবর্তী মহানগরের ছত্রছায়ায় একলব্যের মতো স্বয়ংলালিত হয়ে অবক্ষয়বাদ কিংবা আধুনিকোত্তর মুদ্রার আশ্রয় নিয়েছেন বটে, কিন্তু সেইসব অভ্যন্তরীন সংকটেরই প্রমাণ। পাশাপাশি রয়েছে খাসিয়া, গারো, মিজো, মণিপুরি, ডিমাসা, কার্বি প্রভৃতি জাতি বা গোষ্ঠীর লোকায়ত বিশ্ববীক্ষা প্রসূত মৌখিক সাহিত্য নির্ভর পরম্পরা। এদের মধ্যে মণিপুরি অবশ্য সাহিত্যিক সংরূপের নিরিখে বেশ খানিকটা এগিয়ে। কিন্তু এ অঞ্চলের বাংলা-অসমিয়া-হিন্দি সাহিত্যের প্রতিতুলনায় তা তেমন কিছু নয়। সবচেয়ে পরিতাপের কথা, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী হয়েও এরা পরস্পর সম্পর্কে উদাসীন এবং অনাগ্রহী। নইলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অনুবাদ সাহিত্য গড়ে উঠল না কেন? এইজন্যে অনন্ত তাতী যখন চমৎকার অসমিয়া কবিতা লেখেন, ভক্ত সিং ঠক্করী মৈমনসিংহ গীতিকাকে বাংলা থেকে নেপালিতে অনুবাদ করেন, হিন্দিভাষী অশোক বার্মা বাংলায় কবিতা লেখেন, খৈরউদ্দিন চৌধুরী বাংলা ও মণিপুরি ভাষায় কবিতা চর্চা করেন, বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষী সমরজিৎ সিংহ বাংলা কবিতার প্রবাহে যুক্ত হন। মনে হয়, হ্যা, এই ছিল উত্তর-পূর্বের স্বভাবের পথ। ভাষা এখানে বন্দিশালা হওয়ার কথা নয়, তা চেতনায় সেতু নির্মাণের আয়ুধ হতে পারত।

 তার মানে, উত্তর ঔপনিবেশিক প্রতিস্পর্ধার যথার্থ আয়োজন হতে পারত অনেকান্তিক ভাষা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। বহুবাচনিকতার প্রকৃত নিরীক্ষাভূমি হিসেবে গড়ে উঠত যদি উত্তর-পূর্বাঞ্চল, অরূপা পটঙ্গিয়া কলিতা কিংবা সৌরভকুমার চালিহার অসমিয়া ছোটগল্প কারো অনুরোধের অপেক্ষা না করেই অনূদিত হত বাংলায়, মণিপুরিতে, খাসিয়ায়। অথবা নীলমণি ফুকন ও হীরেন ভট্টাচার্যের কবিতার পাশাপাশি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য, উদয়ন ঘোষ, প্রবুদ্ধসুন্দর করদের কবিতা সমান আগ্রহে পড়তেন সমস্ত ভাষাগোষ্ঠীর পড়ুয়ারা। মিথিলেশ ভট্টাচার্য, শেখর দাশ, রণবীর পুরকায়স্থ, দুলাল ঘোষ, দেবব্রত দেবদের বাংলা ছোটগল্প ইন্দিরা গোস্বামী, বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, যোগেশ দাস, জোহিরুল হুসেইনদের অসমিয়া আখ্যানবিশ্বে সম্পৃক্ত হত সৃজনশীল দ্বিবাচনিকতার সামর্থ্যে। বহুবাচনিক এই ভুবনে প্রতিটি সত্তা হত অপর সত্তার সহযোগী ও পরিপূরক। আর, মিথস্ক্রিয়ায়, শৌর্যে ও সৌন্দর্যে ঋদ্ধ হত উত্তর-পূর্বাঞ্চল নামক দূরীকৃত অপর পরিসরের বাসিন্দা বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যিক সমাজ। হল না যে, সেইজন্য কি পুরোপুরি দায়ী অভ্যন্তরীন ঔপনিবেশিকতা? নাকি দেশভাগ ও প্রব্রজনের সহগামী সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বহুবিলম্বিত প্রতিক্রিয়ায় সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক যে-মানচিত্রটি চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে, তার হাঁ-মুখ গহ্বরের শূন্যতা আমাদের সামূহিক সত্তাকে যাবতীয় সংলগ্নতাবোধ সহ গ্রাস করে ফেলেছে: আমাদের জন্যে তাই রয়ে গেছে গন্তব্যহীন যাত্রা- ‘gesture without motion’।

 কিন্তু কী হল না অথচ হওয়ার কথা ছিল—এই নিয়ে আক্ষেপ করা অর্থহীন। কেন হল না, তা নিশ্চয় ভাবা যেতে পারে। তবে কোনও একটি ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে সেই গণ্ডির প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন নিয়ে যদি ভাবি, তা হলে বড় পরিসরের সঙ্গে দ্বিবাচনিকতার নান্দনিক ও ঐতিহাসিক প্রয়োজন অস্পষ্টই রয়ে যাবে। তাছাড়া তথ্য থেকে ভাবনা-বিশ্বের নিয়ন্তা তত্ত্বে যদি পৌছানো না যায়, সমস্ত চেষ্টাই হবে পণ্ডশ্রম মাত্র। একদিকে পরস্পর বিবাদমান ও বেপথুমান জাতিগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সম্ভাব্য অন্বয়ের জন্যে নিরুৎসুক ভাবনা ও উদাসীন অনাগ্রহের টানাপোড়েন এবং অন্যদিকে কল্পিত কোনও সাহিত্যকেন্দ্র বা সংস্কৃতিকেন্দ্রের প্রতি কখনও সচেতন কখনও অবচেতন আনুগত্য: এইসব কিছুর সামগ্রিক প্রতিক্রিয়ায় বিশেষভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষীদের পরস্পর-বিচ্ছিন্ন সাহিত্য-প্রয়াস যেন নেপচুন নামক গ্রহের মতো সৌরমণ্ডলের আলোককেন্দ্রকে পরিক্রমা করে চলেছে। সম্ভবত লেখা উচিত ছিল গ্রহাণুপুঞ্জের মতো। তবু এও অনস্বীকার্য যে পরস্পর-বিচ্ছিন্ন বাংলা ভাষাভাষীদের আত্মতৃপ্ত উদাসীন স্বয়ংলালিত সৌরমণ্ডলে পরস্পরের সঙ্গে যত অনতিক্রম্য ব্যবধানই রচিত হয়ে থাকুক, আত্ম-বিস্মরণ সত্ত্বেও অভিন্ন চেতনার পরম্পরায় প্রত্যেকে লালিত। তা-ই উত্তর-পূর্বাঞ্চল যতই বহুজাতি-উপজাতির সমাবেশ হোক না কেন, Ethnicity সংক্রান্ত গুরুগম্ভীর বিদ্যায়তনিক গবেষণার আঁধি ও ধোঁয়াশা সত্ত্বেও অন্তত সৃজনশীল নন্দনের নিজস্ব বিধি-বিন্যাসকে তা মুছে ফেলতে পারেনি।


 কেন এখানকার সাহিত্যচর্চায় জীবনানন্দ বা বিভূতিভূষণ, নিদেনপক্ষে ওয়ালীউল্লাহ বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়-ভাস্কর চক্রবর্তী-সুবোধ সরকার-খোন্দকার আশরাফ হোসেন আবির্ভূত হলেন না, এ সম্পর্কে আক্ষেপের কোনও মানে হয় না। এখানকার শক্তিপদ ব্রহ্মচারী বা অন্য কেউ কেন শঙ্খ ঘোষ বা উৎপল কুমার বসুর মতো লিখবেন, কেনই বা মিথিলেশ ভট্টাচার্য বা দেবব্রত দেব লিখবেন দেবেশ রায় বা ভগীরথ মিশ্র বা হাসান আজিজুল হকের মতো? একটু আগে স্বতন্ত্র আলো হাওয়া রোদের সঞ্জীবনী উপস্থিতির কথা লিখেছি, তা তো কেবল কথার কথা মাত্র নয়। আমাদের না থাকুক মরুভূমির আকাশে তারা, না-ই বা সপ্রতিভ ভঙ্গিতে লিখলাম আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে।’—আমাদের আছে একান্ত নিজস্ব পা রাখবার ভূমি, আছে অনন্ত ভাসানে যাওয়ার আয়োজন, আছে নিজস্ব কক্ষপথ ও টুকরো টুকরো গাথা-প্রত্নকথা-কিংবদন্তি এবং আছে সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে স্বখাত-সলিল কথা রচনা।

 উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নগরায়ন এসেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কিংবা এসেছিল তবুও আসে নাই জানায়ে গেছে। কিন্তু এখানেই তো হয়েছে—অভূতপূর্ব ভাষা আন্দোলন; বারবার মাতৃভাষার জন্যে প্রাণ দিয়েছে তরুণ তরুণীরা। আর্যাবর্ত ও মধ্যপ্রাচ্যের নিরবচ্ছিন্ন নেতিবাচক ও পশ্চাত্মখী উপস্থিতি এবং নয়া ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী আগ্রাসন সত্ত্বেও ভাষা-চেতনা এখানে এখনও পান্থপাদপের শুশ্রষা এনে দেয়। তাই প্রকট আত্মবিরোধিতা ও আত্মঘাতী তৎপরতা সত্ত্বেও গ্রহাণুপুঞ্জের আকাশ জুড়ে নিজস্ব আলোর প্রাসঙ্গিকতা অম্লান রয়ে গেছে। নইলে অন্তহীন প্রতিকূলতার মধ্যে (যার মধ্যে রয়েছে প্রকাশন সংস্থার অনুপস্থিতিও) নিজেকেই ইন্ধন করে কীভাবে জ্বলে ওঠেন উত্তর-পূর্বের কবি-লিখিয়েরা! এক দশকের আগেই সংঘ ভেঙে যায় এখানে, তবুও নতুন করে শিকড়ে আলোর সন্ধান শুরু হয়। কল্পিত কোনও চিন্তাকেন্দ্র বা প্রধান শিবিরের আশ্রয় নেবার জন্যে নয়, অখণ্ড বাঙালি মননের অবিভাজ্য প্রকাশ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্যেই আপন ভাষায় রচিত বইপত্র সম্পর্কে উৎসুক এখানকার পড়ুয়ারা। উত্তর-পূর্ব থেকে তাকালে সমস্তই তো পশ্চিম; ঢাকা, কলকাতা, ইউরোপ বা আমেরিকা। কেউ রয়েছেন অদূরবর্তী পশ্চিমে আর কেউবা বহু বহু দূরবর্তী পশ্চিমে। বহুবিধ এই পশ্চিমের জানালা আমরা খুলেই রেখেছি। জানি, আলোর সঙ্গে সঙ্গে আসবে আঁধিও, নতুন হাওয়ার সঙ্গে আসবে ধুলো ও মারীবীজ। কিন্তু তা আমাদের ভাষা-জননীর সঙ্গে নাড়ির বাঁধনকে কখনওই ভুলিয়ে দিতে পারবে। এই আমাদের উপনিবেশোত্তর পরিস্থিতি যেখান প্রাক্-আধুনিক পর্যায় আজও সমাজের সর্বত্র উপস্থিত অথচ এরই উপরে চেপে বসেছে পশ্চিমী আধুনিকতাবাদ ও খানিকটা আধুনিকোত্তরবাদের আভাস দিয়ে গড়া আঙরাখা। তবু লেখাই নিঙড়ে নেয় কুশ্রীতা ও দীনতা-ভরা বেঁচে থাকার আয়োজন থেকে জীবন ও নন্দনের মধু। কোনো এক কবি তাই লেখেন:

‘ভাষার গভীরে নেমে এসো বৃষ্টির শ্রাবণ
প্রতিটি আখরে জাগো
শস্য তোক ফুল হোক রূপ তোক প্রতিটি বর্ষণে
কথা থেকে সংকেত জাগুক।’