বাঁশী/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

বাঁশী ।

____________

প্রথম পরিচ্ছেদ।

 শ্রাবণ মাস। প্রাতঃকাল। গতরাত্রে অনবরত মুষলধারে বৃষ্টি হইয়াছে। এখনও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন; অল্প অল্প বৃষ্টিও পড়িতেছে। বাতাসের জোর ভয়ানক, যেন ঝড় বহিতেছে।

 আমাকে প্রায়ই সকালে উঠিতে হয়। কিন্তু গতরাত্রে প্রায় তিনটা পর্যন্ত কার্য্য করিয়া, এত ভোরে উঠিবার আমার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু মানুষের আজি আর ঈশ্বরের মরজি। মানুষ ভাবে এক—হয় আর।

 এত দুর্যোগেও কোন ভদ্রলোক আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন। আমার চাকর বলিল, “বাবুর বড় দরকার।”

 আমি সে কথা আগেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম। দরকার না হইলে এই ভয়ানক দুর্যোগে—এত সকালে আমার নিকট আসিবেন কেন? কাজেই তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুইয়া বাবুর সহিত দেখা করিলাম। দেখিলাম, তিনি সুপুরুষ; তাহার দেহ উন্নত, বয়স প্রায় চল্লিশ বৎসর। তাঁহার মস্তকে সুচিক্কণ কুঞ্চিত কেশরাশি, হস্তে একগাছি লাঠী, পরিধানে একখানি পাৎলা কালাপেড়ে ধুতি, একটী পাঞ্জাবী জামা, একখানি কোঁচান উড়ানি। পায়ে বার্ণিস জুতা ও রেশমী মোজা।  দেখা হইবামাত্র আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়ের কোথা হইতে আসা হইতেছে?”

 তিনি অতি বিমর্ষভাবে উত্তর করিলেন, “আমি বালিগঞ্জ হইতে আসিতেছি। আমার নাম অমরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বড় বিপদে পড়িয়াই এই অসময়ে আপনার নিকট আসিয়াছি।”

 বিখ্যাত জমীদার অমরেন্দ্রকে চিনে না এমন লোক কলিকাতায় অতি কম। আমিও অনেকবার তাহার নাম শুনিয়াছিলাম, কিন্তু এ পর্য্যন্ত দেখা করিবার সুবিধা হয় নাই।

 আমি কোন উত্তর না করিয়া, তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া আছি দেখিয়া, তিনি বলিলেন, “আমার পরিচিত দুই একটী বড় লোকের বাড়ীতে আপনি যেরূপ সুখ্যাতির কার্য্য করিয়াছেন, তাহাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আপনার দ্বারাই আমার যথেষ্ট উপকার হইবে।”

 আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “অনুমতি করুন, আমি কিরূপে আপনার উপকার করিতে পারি। কি হইয়াছে বলুন, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।” অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “চক্রবেড়ের বিখ্যাত জমীদার প্রাণকৃষ্ণ বাড়ুয্যের ভ্রাতুষ্পত্রীর সহিত আমার পুত্রের বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে। গত কল্য আয়ুবৃদ্ধান্ন উপলক্ষে আমরা চক্রবেড়ে গিয়াছিলাম। জমীদারের বাড়ীতে বিবাহ; ছোট বড় অনেক লোকের সমাগম হইয়াছিল। সকলের আহারাদি শেষ না হইলে আমার ফিরিয়া আসা ভাল দেখায় না মনে করিয়া, আমাকে কাল চক্রবেড়েই থাকিতে হইয়াছিল। আমাদের বাড়ীর আর সকলে কলিকাতায় ফিরিয়াছিল। প্রাণকৃষ্ণবাবুর পরিবারের মধ্যে তাঁহা স্ত্রী ও এক টী দুগ্ধপোষ্য বালক; দুইটী ভ্রাতুষ্কন্যা ছিল—দুই বৎসর পূর্বে একটীর মৃত্যু হওয়ায় এখন আমার ভাবী বধূমাতাই একমাত্র ভ্রাতুষ্কন্যা; তাঁহার শাশুড়ী ঠাকুরাণী ও দূরসম্পর্কীয়া এক বিধবা ভগ্নী। সরকার, চাকর, দাসী, দরোয়ান প্রভৃতি অনেক গুলি বাজে লোকও আছে। রাত্রি প্রায় একটার পরে আমি শয়ন করি। আমার পার্শ্বের গৃহে আমার ভাবী বধূমাতা শয়ন করিয়া ছিল। একজন দাসী তাহাকে মানুষ করিয়াছিল, সেও সেই ঘরে থাকিত। অধিক রাত্রিজাগরণ জন্যই হউক, অথবা অন্যত্র শয়ন করিবার জন্যই হউক, আমার ভাল নিদ্রা হইল না। রাত্রি চারিটার সময় সহসা পার্শ্বের গৃহ হইতে এক ভয়ানক চীৎকার ধ্বনি শুনিতে পাইলাম। কণ্ঠস্বর আমার ভাবী বধূমাতার বলিয়াই বোধ হইল। আমি শয্যা হইতে উঠিলাম, আস্তে আস্তে গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম। মনে করিলাম, পাশের ঘরে গিয়া ব্যাপার কি দেখিয়া আসি; কিন্তু সাহস করিলাম না। নূতন কুটুম্বের বাড়ী, তাহার উপর সে ঘরে আমারই ভাবী বধূমাতা শুইয়া আছে। সাত পাঁচ ভাবিতেছি, এমন সময়ে সেই ঘরের দরজা খুলিয়া গেল। দাসী এক হস্তে একটী অলোক ও অপর হস্তে বধূমাতাকে ধরিয়া তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইল। আমি তখনই তাহাদের নিকট যাইলাম। অন্য সময় হইলে বধূমাতা আমাকে দেখিবামাত্র পলায়ন করিত; কিন্তু তখন সে পলায়ন করিল না। তাহার অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, তাহার জ্ঞান নাই। তাহার সর্বাঙ্গ থর থর করিয়া কঁপিতেছে, ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পড়িতেছে ও মুখ নিতান্ত মলিন হইয়া গিয়াছে। বধূমাতার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, আমারও ভয় হইল। আমি ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া, দাসীকে লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হইয়াছে? বৌমা অমন করিতেছে কেন?”

 দাসী অতি বিষন্নবদনে উত্তর করিল,—“সুধা বড় ভয় পাইয়াছে।”

 আ। ভয় কিসের?

 দা। সুধাকে জিজ্ঞাসা করুন। উহার কথা আমি ভাল বুঝিতে পারিতেছি না।

 আমি সুধার দিকে চাহিলাম। দেখিলাম, সে মাথায় কাপড় দিয়াছে। বোধ হইল, আমাদের কথাবার্তায় তাহার জ্ঞান সঞ্চার হইয়াছিল, সে আমার কথা বুঝিয়াছিল। আমাকে তাহার দিকে চাহিতে দেখিয়া কাঁপিতে কাপিতে অস্পষ্ট ভাবে বলিল, “সেই বাঁশীর আওয়াজ! আমার বড় ভয় হইয়াছে; হয় ত আমি আর এ যাত্রা রক্ষা পাইব না।”

 বৌমার কথায় আমি আশ্চর্যান্বিত হইলাম। আমিও তাহার কথার ভাব বুঝিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোন্ বাঁশী মা? বাঁশীর আওয়াজ শুনিয়া এত ভয়ই বা কিসের? তুমি শান্ত হও; অমন অলক্ষণে কথা আর মুখে নিও না।”

 বৌমা যেন আমার কথায় একটু সুস্থ হইল, খানিক পরে বলিল, “দুই বৎসর হইল দিদির বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হয়। বিবাহের এক সপ্তাহ আগে সেও দুই তিন দিন এই রকম হিস হিস শব্দ ও এক রকম বঁশীর স্বর শুনতে পায়। তাহার পরেই একদিন সে হঠাৎ মারা পড়ে। আজ রাত্রে আমিও প্রথমে এক প্রকার হিস হিস্ শব্দ শুনিতে পাই। শব্দ শুনিয়াই আমার প্রাণে কোন আতঙ্ক হয়। আমি উঠিয়া বামাকে ডাকি। বামা উঠিয়া আলোক জ্বালিল; কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলাম না। আমি আবার শুইবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময়ে বাঁশীর স্বর আমার কর্ণে প্রবেশ করে। আমি ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠি। তখন বামা আমায় ধরিয়া গৃহ হইতে বাহির করিয়া আনে।”

 সুধার কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার দিদি কি তোমাদের খুড়া মহাশয়কে সে সকল কথা বলিয়াছিল?”

 সু। হাঁ কিন্তু তিনি উপহাস করিয়া সে কথা উড়াইয়া দেন।

 অ। তোমার দিদির হঠাৎ মৃত্যুতে পুলিস কোনরূপ গেলযোগ করে নাই?

 সু। হাঁ; পুলিসের লোকে বাড়ী ভরিয়া গিয়াছিল; কিন্তু তাহারাও কিছু করিতে পারিল না।

 আ। তবে তাহার হঠাৎ মৃত্যুর কারণ কি?

 সু। ডাক্তার বলিয়াছিল, অত্যন্ত ভয়েই আমার দিদির মৃত্যু হইয়াছিল।

 অ। আর পুলিস কি বলিল?

 সু। পুলিসেরও সেই মত। আ। আমার ইচ্ছা এ বিষয় একবার তোমার খুড়াকে জানাই।

 আ ইচ্ছা করেন, জানান। কিন্তু কোন ফল হইবে না। তিনি বিশ্বাস করিবেন না; হাসিয়া কথাটা উড়াইয়া দিবেন।

 আ।, বামাও কি বাঁশীর সুর শুনিয়াছে?

 সু। আজ্ঞে হাঁ।

 সকল কথা শুনিয়া আমার বড় ভাল বোধ হইল না। বৌমা ও তাহার দাসীকে সেই সকল কথা অপর কাহাকেও বলিতে নিষেধ করিয়া, আমি তাহাদিগকে বিদায় দিলাম। পরদিবস প্রাতে আমার ভাবী বৈবাহিকের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, আমি আমার বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম; কিন্তু বাঁশীর কথা আর কাহাকেও বলিলাম না।

 অমরেন্দ্রনাথের কথা শুনিয়া আমার মনে হইল, ইহার মধ্যে কোন একটী গুরুতর রহস্য আছে। আমি তাহাকে কহিলাম, ‘আমার সর্ব্ব প্রধান কর্মচারীর আদেশ না পাইলে ত আমি ইহাতে হস্তক্ষেপ করিতে পারি না, সে বিষয়ে আপনি কোনরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছেন কি?”

 আমার কথা শুনিয়া অমরেন্দ্র বাবু কহিলেন, “হাঁ, সে বন্দোবস্ত আমি করিয়াছি, সে কথা আমি আপনাকে বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। আমি আপনার প্রধান কর্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহাকে সমস্ত কথা বলি ও যাহাতে আপনার সাহায্যপ্রাপ্ত হই, তাঁহার নিমিত্ত উপরোধ করি। তিনিও আমার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া, এই কার্য্যের ভার আপনার হস্তে প্রদান করিয়াছেন ও আপনাকে এক পত্রও লিখিয়া দিয়াছেন। তাহারই নিকট হইতে আমি আপনার নিকট আগমন করিতেছি।” এই বলিয়া অমরেন্দ্র বাবু এক্নখানি পত্র আমার হস্তে প্রদান করিলেন। দেখি! ইহা আমার প্রধান কর্মচারীর হস্তলিখিত ও যতদুর সম্ভব তিনি এই বিষয়ে সাহায্য করিতে আদেশ করিয়াছেন।