বাঙ্গালার ইতিহাস (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)/চতুর্থ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ অধ্যায়।

 ১৭৬০ খৃঃ অব্দের ৪ঠা মার্চ, ইঙ্গরেজের মীরকাসিমকে বাঙ্গালা ও বিহারের সুবাদার করিলেন। তিনি এই মহোপকারের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কোম্পানি বাহাদুরকে বর্দ্ধমান প্রদেশের অধিকার প্রদান করিলেন; এবং কলিকাতার কৌন্সিলের মেম্বরদিগকে বিংশতি লক্ষ টাকা উপঢৌকন দিলেন। সেই টাকা তাঁহারা সকলে যথাযোগ্য ভাগ করিয়া লইলেন।

 মীরকাসিম অত্যন্ত বুদ্ধিশালী ও ক্ষমতাপন্ন ছিলেন। তিনি, সিংহাসনে নিবিষ্ট হইয়াই, ইঙ্গরেজদিগকে এবং মীরজাফরের ও নিজের সৈন্য ও কর্ম্মকারকদিগকে যত টাকা দিতে হইবেক, প্রথমতঃ তাহার ঠিক হিসাব প্রস্তুত করিলেন, তৎপরে সেই সকল পরিশোধ করিবার উপায় দেখিতে লাগিলেন। তিনি রাজসভার ব্যয় সংক্ষেপ করিয়া আনিলেন; অভিনিবেশ পূর্ব্বক সমুদায় হিসাব দেখিতে লাগিলেন; এবং, মীরজাফরের শিথিল শাসন কালে, রাজপুরুষেরা যত টাকা অপহরণ করিয়াছিল, অনুসন্ধান করিয়া তাহাদের নিকট হইতে সেই সকল ফিরিয়া লইতে লাগিলেন। তিনি জমীদার দিগের নিকট হইতে কেবল বাকী আদায় করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন এমত নহে, সমুদায় জমীদারীর নূতন বন্দোবস্তও করিলেন। তাঁহার অধিকারের পুর্ব্বে, দুই প্রদেশের রাজস্ব বার্ষিক ১৪২৪৫০০০ টাকা নির্ধারিত ছিল, তিনি বৃদ্ধি করিয়া ২৫৬২৪০০ করিলেন। এই সকল উপায় দ্বারা তাঁহার ধনাগার অনতিবিলম্বে পরিপূর্ণ হইল। ইহাতে তিনি সমস্ত পূর্ব্বতন দেয় পরিশোধ করিতে পারিলেন এবং নিয়মিত রূপে বেতন দেওয়াতে, তদীয় সৈন্য সকল অতিশয় বশীভূত রহিল।

 ইঙ্গরেজেরা তাঁহাকে রাজ্যাধিকার প্রদান করেন। কিন্তু ইঙ্গরেজদিগের অধীনতা হইতে মুক্ত হওয়া তাঁহার মুখ্য অভিপ্রায় হইয়া উঠিল। তিনি বুঝিতে পারিয়া ছিলেন যদিও আমি সর্ব্বসম্মত নবাব বটি, বাস্তবিক সমুদায় ক্ষমতা ও প্রভুত্ব ইঙ্গরেজদিগের হস্তেই আছে। কিন্তু তিনি ইহাও বুঝিতে পরিয়াছিলেন যে বল প্রকাশ ব্যতিরেকে কখনই ইঙ্গরেজদিগের পরাক্রম হইতে আপনাকে মুক্ত করিতে পারিব না; অতএব স্বীয় সৈন্যের শুদ্ধি ও বৃদ্ধি বিষয়ে তৎপর হইলেন। যে সকল সৈন্য অকর্মণ্য হইয়াছিল, তাহাদিগকে ছাড়াইয়া দিলেন; সৈন্যদিগকে ইঙ্গরেজী রীতি অনুসারে শিক্ষা দিতে লাগিসেন; এবং এক আরমানিকে সৈন্যের অধ্যক্ষ করিলেন।

 এই ব্যক্তি পারস্যের অন্তর্গত ইস্পাহান নগরে জন্মগ্রহণ করেন। ইহার নাম গর্গিন খাঁ। ইনি অসাধারণ ক্ষমতাপন্ন ও বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। গর্গিন প্রথমতঃ এক জন সামান্য বস্ত্রব্যবসায়ী ছিলেন; কিন্তু যুদ্ধবিদ্যা বিষয়ে অসাধারণ বুদ্ধি নৈপুণ্য থাকাতে, মীরকাসিম তাঁহাকে সৈনাপত্যে নিযুক্ত করিলেন। তিনিও, দৃঢ়তর অধ্যবসায় সহকারে, স্বীয় স্বামিকে ইঙ্গরেজদিগের অধীনতা হইতে মুক্ত করিবার উপায় দেখিতে লাগিলেন। কামান ও বন্দুক সকল প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিলেন এবং গোলন্দাজদিগকে শিক্ষা দিতে লাগিলে। তাঁহার শিক্ষিত সৈন্য সকল এমত উৎকৃষ্ট হইয়া উঠিল যে বাঙ্গালাতে কখন কোন রাজার সেরূপ ছিল না।

 মীরকাসিম, ইরেজদিগের অগোচরে আপন অতিপ্রায় সুসিদ্ধ করিবার নিমিত্ত, মুরশিদাবাদ পরিত্যাগ করিয়া মুঙ্গেরে রাজধানী করিলেন। ঐ স্থানে তাঁহার আরমানি সেনাপতি কামানের কারখানা স্থাপন করিলেন। বন্দুকের নির্ম্মাণ কৌশলের নিমিত্ত ঐ নগরের অদ্যাপিও যে প্রতিষ্টা আছে, এই গর্গিন খাঁ তাহার আদিকারণ। তৎকালে গর্গিনের বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের বড় অধিক ছিল না।

 সম্রাট শাহআলম তৎকাল পর্যন্ত বিহারের পর্যন্ত দেশে ভ্রমণ করিতেছিলেন। অতএব, ১৭৬০ খৃঃ অব্দের বর্ষা শেষ হইবামাত্র, মেজর কার্ণাক সৈন্য সহিত যাত্রা করিয়া তাঁহাকে সম্পূর্ণ রূপে পরাজয় করিলেন। যুদ্ধের পর কার্ণাক সাহেব সন্ধিপ্রস্তাব করিয়া রাজা সিতাবরায়কে তাঁহার নিকট পাঠাইলেন। সম্রাট তাহাতে সম্মত হইলে, ইংলণ্ডীয় সেনাপতি, তদীয় শিবিরে গমন পূর্ব্বক, তাঁহার সমুচিত সম্মান করিলেন।

 মীরকাসিম সম্রাটের সহিত ইঙ্গরেজদিগের এই সন্ধি বার্ত্তা শ্রবণে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইলেন; এবং আপনার পক্ষে কোন অপকার না ঘটে, এই নিমিত্ত সত্বর হইয়া পাটনা গমন করিলেন। মেজর কার্ণাক মীরকাসিমকে সম্রাটের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত অত্যন্ত অনুরোধ করিলেন। কিন্তু তিনি কোন ক্রমেই সম্রাটের শিবিরে গিয়া সাক্ষাৎ করিতে সম্মত হইলেন না। পরিশেষে এই নির্ধারিত হইল উভয়েই ইঙ্গরেজদিগের কুঠীতে আসিয়া পরস্পর সাক্ষাৎ করিবেন।

 উপস্থিত কার্য্যনির্ব্বাহের নিমিত্ত এক সিংহাসন প্রস্তুত হইল; সমস্ত ভারতবর্ষের সম্রাট তদুপরি উপবেশন করিলেন। মীরকাসিম সমুচিত সম্মান প্রদর্শন পূর্ব্বক তাঁহার সম্মুখবর্তী হইলেন। অনন্তর সম্রাট তাঁহাকে বাঙ্গালা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদারী প্রদান করিলে, তিনি প্রতি বৎসর চতুর্ব্বিংশতি লক্ষ টাকা কর দান স্বীকার করিলেন। তৎপরে সম্রাট দিল্লী যাত্রা করিলেন। কার্ণাক সাহেব কর্ম্মনাশার তীর পর্যন্ত তাঁহার অনুগমন করিলেন। সম্রাট তথায়, কর্ণাকের নিকট বিদায় লইবার সময়, প্রস্তাব করিলেন ইঙ্গরেজেরা যখন প্রার্থনা করিবেন তখনি আমি তাঁহাদিগকে তিন প্রদেশের দেওয়ানী প্রদান করিব। ১৭৫৫ খৃঃ অব্দে উড়িষ্যা প্রদেশ মহারাষ্ট্রীয়দিগকে প্রদত্ত হয়, কেবল সুবর্ণ রেখার উত্তরবর্ত্তি অংশমাত্র অবশিষ্ট থাকে। তদবধি ঐ অংশই উড়িষ্যানামে ব্যবহৃত হইত।

 মীরকাসিম, পাটনার গবর্নর রামনারায়ণ ব্যতিরিক্ত, সমুদায় জমিদারদিগকে সম্পূর্ণরূপে আপন বশে আনিয়াছিলেন। রামনারায়ণের ধনবান্ বলিয়া খ্যাতি ছিল; কিন্তু তিনি ইঙ্গরেজদিগের আশ্রয়চ্ছায়াতে উপবিষ্ট ছিলেন; অতএব, সহসা তাঁহাকে আক্রমণ করা অবিধেয় বিবেচনা করিয়া, নবাব কৌশলক্রমে তাঁহার সর্বনাশের উপায় দেখিতে লাগিলেন। রামনারায়ণ তিন বৎসর . হিসাব পরিষ্কার করেন নাই। কিন্তু ইহাও মনে করিতে হইবেক, যে ঐ সময়ে বিহার দেশ বিপক্ষ সৈন্য দ্বারা যতপরোনাস্তি উৎপাতগ্রস্ত হইয়াছিল। যাহা হউক, নবাব ইঙ্গরেজদিগকে লিখিলেন, রামনারায়ণের নিকট বাকী আদায় না হইলে, আমি আপনকারদিগের দেন। পরিশোধ করিতে পারি না। আর যাবৎ আপনকারদিগের সৈন্য পাটনাতে থাকিবেক তাবৎ ঐ বাকী আদায়ের কোন সম্ভাবনা নাই।

 তৎকালে কলিকাতার কৌন্সিলে দুই পক্ষ ছিল; তন্মধ্যে এক পক্ষ মীরকাসিমের প্রতিকুল, অন্যপক্ষ তাঁহার অনুকূল। গবর্ণর বান্সিটার্ট সাহেব এই পক্ষে ছিলেন। মীরকাসিমের প্রস্তাব লইয়া উভয় পক্ষে বিস্তর বাদানুবাদ হইল। অবশেষে বানসিটার্টের পক্ষই প্রবল হইল। এই পক্ষের মতানুসারে ইঙ্গরেজেরা পাটনা হইতে আপনাদিগের সৈন্য উঠাইয়া আনিলেন; সুতরাং রামনারায়ণ নিতান্ত অসহায় হইলেন; এবং নবাবও তাঁহাকে রুদ্ধ ও কারাবদ্ধ করিতে কালবিলম্ব করিলেন না। গুপ্তধনাগার দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত তাঁহার কর্ম্মকরদিগকে অনেক যন্ত্রণা দেওয়া গেল, তথাপি গবর্ণমেণ্টের সমুচিত ব্যয়ের নিমিত্ত যাহা আবশ্যক, তদপেক্ষায় অধিক টাকা পাওয়া গেল না।

 মীরকাসিম এপর্যন্ত নির্বিবাদে রাজ্যশাসন করিলেন। পরে তিনি কোম্পানির কর্ম্মকারকদিগের আত্মম্ভরিতা দোষে যেরূপে রাজ্যভ্রষ্ট হইলেন এক্ষণে তাহার বর্ণনা করা যাইতেছে।  ভারতবর্ষে যে সকল পণ্যদ্রব্য দেশ হইতে দেশান্তরে নীত হইত তাহার শুল্ক হইতেই অধিকাংশ রাজস্ব উৎপন্ন হইত। এইরূপে রাজস্বগ্রহণ করা এক প্রকার অসভ্যতার প্রথা বলিতে হইবেক; যেহেতু ইহাতে বাণিজ্যের বিলক্ষণ ব্যাঘাত জন্মে। কিন্তু এই কালে ইহা অত্যন্ত প্রচলিত ছিল; এবং ইঙ্গরেজেরাও ১৮৩৫ খৃঃ অব্দের পূর্ব্বে ইহা রহিত করেন নাই। যখন কোম্পানি বাহাদুর সালিয়ানা তিন হাজার টাকার পেস্কস দিয়া বাণিজ্য করিবার অনুমতি পাইলেন তদবধি তাঁহাদের পণ্যদ্রব্যের মাশুল লাগিত না। কলিকাতার গবর্ণর এক দস্তক স্বাক্ষর করিতেন; মাশুলঘাটায় তাহা দেখাইলেই কোম্পানির বস্তু সকল বিনা মাশুলে চলিয়া যাইত।

 এই অধিকার কেবল কোম্পানির নিজের বাণিজ্য বিষয়েই ছিল। কিন্তু যখন ইঙ্গরেজেরা অত্যন্ত পরাক্রান্ত হইয়া উঠিলেন, তখন কোম্পানির যাবতীয় কর্ম্মকারকে রাই নিজ নিজ বাণিজ্য আরম্ভ করিলেন। যত দিন ক্লাইব এ দেশে ছিলেন, তাঁহারা সকলেই, দেশীয় বণিকদিগের ন্যায়, রীতিমত শুক প্রদান করিতেন। পরে যখন তিনি স্বদেশ যাত্রা করিলেন এবং কৌনসিলের সাহেবের অন্য এক নবাবকে সিংহাসন প্রদান করিলেন, তখন তাঁহারা আরো প্রবল হইয়া বিনা শুল্কেই বাণিজ্য করিতে লাগিলেন। ফলতঃ তৎকালে তাঁহারা এমত প্রবল হইয়া ছিলেন যে তাঁহাদিগকে কোন প্রকার বাধা দিতে নবাবের কর্ম্মকারকদিগের সাহস হইত না।

 ইঙ্গরেজদের গোমাস্তারা,শুল্ক বঞ্চন করিবার নিমিত্ত, ইচ্ছানুসারে ইঙ্গরেজী নিশান তুলিত এবং দেশীয় বণিক ও রাজকীয় কর্ম্মকারকদিগকে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ দিত। ব্যক্তি মাত্রেই, যে কোন ইঙ্গরেজের স্বাক্ষরিত দস্তক হস্তে করিয়া, আপনাকে কোম্পানি বাহাদুরের তুল্য পরাক্রান্ত বোধ করিত। নবাবের লোকেরা কোন বিষয়ে আপত্তি করিলে, ইউরোপীয় মহাশয়েরা, সিপাই পাঠাইয়া; তাহাদিগকে ধরিয়া আনিতেন ও কারাবদ্ধ করিয়া রাখিতেন। শুল্ক না দিয়া কোন স্থানে কিছু দ্রব্য লইয়া যাইবার ইচ্ছা হইলে, নাবিকেরা নৌকার উপর কোম্পানির নিশান তুলিয়া দিত।

 ফলতঃ, এইরূপে নবাবের পরাক্রম একবারেই বিলুপ্ত হইল। দেশীয় বণিকদিগের সর্ব্বনাশ উপস্থিত হইল। ইঙ্গরেজ মহাত্মারা অসীম ধনশালী হইয়া উঠিলেন। নবাবের রাজত্ব অত্যন্ত ন্যূন হইল। যেহেতু ইঙ্গরেজেরাই কেবল শুল্ক দিতেন না এমত নহে; যাহারা তাঁহাদের চাকর বলিয়া পরিচয় দিত, তাহারাও তাঁহাদের নাম করিয়া মাশুল ফাকি দিতে আরম্ভ করিল। মীরকাসিম, এই সকল অত্যাচারের উল্লেখ করিয়া, কলিকাতার কৌন্সিলে অনেক বার অভিযোগ করিলেন। পরিশেষে তিনি এই বলিয়া ভয় দেখাইলেন, আপনারা ইহার নিবারণ না করিলে, আমি রাজাধিকার পরিত্যাগ করিব।

 বান্সিটার্ট ও হেষ্টিংস সাহেব এই সকল অন্যায় নিবারণের অনেক চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কৌন্সিলের অন্যান্য মেম্বরের। ঐ সকল অবৈধ উপায় দ্বারা ধন সঞ্চয় করিতেন, সুতরাং তাঁহাদিগের সে সকল চেষ্টা বৃথা হইল। পরিশেষে ঐ সকল অবৈধ ব্যবহারের এত বাড়াবাড়ি হইয়া উঠিল যে কোম্পানির গোমাস্তাদিগের নির্দ্ধারিত মূল্যেই দেশীয় বণিকদিগকে ক্রয় বিক্রয় করিতে হইত। অতঃপর মীরকাসিম ইঙ্গরেজদিগকে শক্রমধ্যে গণনা করিলেন। এবং ত্বরায় নবাব ও ইঙ্গরেজ এই উভয় পক্ষের পরস্পর যুদ্ধ ঘটিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা হইয়া উঠিল।

 ইহার নিবারণার্থে বান্সিটার্ট সাহেব স্বয়ং মুঙ্গেরে গিয়া নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন; নবাবও সৌহৃদ্যভাবে তাঁহার সম্বর্দ্ধনা করিলেন। পরে বিষয় কর্ম্মের কথা উত্থাপন হইলে,মীরকাসিম, কোম্পানির কর্ম্মকারক দিগের অত্যাচার বিষয়ে যৎপরোনাস্তি অসন্তোষ প্রদর্শন পূর্ব্বক, অনেক অনুযোগ করিলেন। বান্সিটার্ট সাহেব, তাঁহাকে অশেষ প্রকারে সান্ত্বনা করিয়া, প্রস্তাব করিলেন, কি দেশীয় লোক কি ইঙ্গরেজ, সকলকেই বস্তুমাত্রের একবিধ অর্থাৎ শতকরা নয় টাকার হিসাবে মাশুল দিতে হইবেক। কিন্তু আমার স্বয়ং এরূপ নিয়ম নির্দ্ধারিত করিবার ক্ষমতা নাই। অতএব কলিকাতায় গিয়া কৌন্সিলের সাহেবদিগকে এই নিয়ম নির্দ্ধারিত করিতে পরামর্শ দিব। নবাব,অত্যন্ত অনিচ্ছা পূর্ব্বক, এই প্রস্তাবে সম্মত হইলেন; কিন্তু কহিলেন যদি ইহাতেও এই অনিয়ম নিবারণ না হয়, তবে আমি মাশুলের প্রথা একবারে রহিত করিয়া দেশীয় ও ইউরোপীয় উভয় জাতিকেই সমান করিব।  বান্সিটার্ট সাহেব, কলিকাতার কেন্সিলে এই বিষয়ে প্রস্তাব করিবার নিমিত্ত, সত্বর হইয়া কলিকাতা প্রত্যাগমন করিলেন। কিন্তু মীরকাসিম, কৌন্সিলের সম্মতি পর্য্যন্ত অপেক্ষা না করিয়া, তৎক্ষণাৎ শুল্কসম্পৰ্কীয় কর্ম্মকারকদের নিকট এই আজ্ঞ পাঠাইলেন যে তোমরা ইঙ্গরেজদের স্থানেও শত করা নয় টাকার হিসাবে মাশুল আদায় করিবে। ইঙ্গারেজেরা মাশুল দিতে অসম্মত হইলেন এবং নবাবের কর্ম্মকারকদিগকে কয়েদ করিয়া রাখিলেন। মফঃসলের কুটার অধ্যক্ষ সাহেবের কর্ম্মস্থান পরিত্যাগ করিয়া সত্বর হইয়া কলিকাতায় আগমন করিলেন। শত করা নয় টাকা শুক্লের বিষয়ে বানসিটার্ট সাহেব ষে প্রস্তাব করিলেন হেষ্টিংস ভিন্ন অন্য সকলেই অবজ্ঞা প্রদর্শন পুর্ব্বক তাহ অগ্রাস্থ করিলেন। তাঁহারা সকলেই কহিলেন যে কেবল লবণের উপর আমরা শত করা আড়াই টাকা মাত্র শুল্ক দিব।

 মীরকাসিম তৎকালে বাঙ্গালায় ছিলেন না যুদ্ধ যাত্রায় নেপাল গমন করিয়াছিলেন; প্রত্যাগমনানন্তর শ্রবন করিলেন যে কৌন্‌সিলের সাহেবেরা মাশুল দিতে অস্বীকৃত হইয়াছেন, এবং উহার কর্ম্মকারকদিগকে কয়েদ করিয়া রাখিয়াছেন। তখন তিনি কিঞ্চিম্মাত্র বিলম্ব না করিয়া পুর্ব্বপ্রতিজ্ঞানুরূপ কার্য্য করিলেন অর্থাৎ বাঙ্গালা ও বিহারের মধ্যে পণ্যদ্রব্যের মাশুল একবারেই উঠাইয়া দিলেন।

 কৌনসিলের মেম্বরেরা শুনিয়া ক্রোধে অন্ধ হইলেন, এবং কহিলেন নবাবকে আপন প্রজাদিগের নিকট পুর্ব্বমত শুল্ক লইতে হইবেক এবং ইঙ্গরেজদিগকে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করিতে দিতে হইবেক। এই বিষয়ে ঘোরতর বিতণ্ডা উপস্থিত হইল। হেষ্টিংস সাহেব কহিলেন মীরকাসিম অধীশ্বর রাজা, নিজ প্রজাগণের হিতানুষ্ঠান কেন না করিবেন। ঢাকার কুঠীর অধ্যক্ষ বাটসন সাহেব কহিলেন এ কথা নবাবের গোমাস্তারা কহিলে সাজে; কৌন্সিলের মেম্বরের উপযুক্ত নহে। হেষ্টিংস কহিলেন পাজী না হইলে এরূপ কথা মুখে আনে না।

 এইরূপ রাগাসক্ত হইয়া কৌন্সিলের মেম্বরেরা এবম্বিধ গুরুতর বিষয়ে বাদানুবাদ করিতে লাগিলেন। পরিশেষে এই নিৰ্দ্ধারিত হইল, যে দেশীয় লোকের বাণিজ্যেই পূর্ব্ব নিরূপিত শুল্ক স্থির থাকে, এ বিষয়ে উপরোধ করিবার নিমিত্ত আমিয়ট ও হে সাহেব মীরকাসিমের নিকট গমন করুন। অনন্তর তাঁহারা তথায় পহুছিয়া নবাবের সহিত কয়েক বার সাক্ষাৎ করিলেন। প্রথমতঃ বোধ হইয়াছিল সকল বিষয়েরি নিম্পত্তি হইতে পরিবেক। কিন্তু পাটনার কুঠীর অধ্যক্ষ এলিস সাহেবের দুর্বৃত্ততা দ্বারা সন্ধির আশা একবারেই উচ্ছিন্ন হইল। কোম্পানির সমুদায় কর্ম্মকারকের মধ্যে তিনি অত্যন্ত অশান্ত ছিলেন। নবাব আমিয়ট সাহেবকে বিদায় দিলেন; কিন্তু তাঁহার যে সকল কর্ম্মকারক কলিকাতায় কয়েদ ছিল,হে সাহেবকে তাহাদের প্রতিভূ স্বরূপ আটক করিয়া রাখিলেন। আমিয়ট সাহেব নবাবের হস্তবহির্ভূত হইয়াছেন বোধ করিয়া, এলিস সাহেব অতর্কিতরূপে পাটনা আক্রমণ ও অধিকার করিলেন। কিন্তু তাঁহার সৈন্য সকল সুরাপানে মত্ত ও অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল হওয়াতে নবাবের একদল বহুসংখ্যক সৈন্য আসিয়া পুনর্ব্বার নগর অধিকার করিল; এলিস ও অন্যান্য ইউরোপীয়েরা রুদ্ধ ও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইলেন।

 মীরকাসিম পাটনার এই বৃত্তান্ত শুনিয়া বোধ করিলেন এক্ষণে অবশ্যই ইঙ্গরেজদিগের সহিত যুদ্ধ ঘটিবেক। অতএব তিনি সমস্ত মফঃসল কুঠীর কর্ম্মকারক সাহেবদিগকে রুদ্ধ করিতে, ও আমিয়ট সাহেবের কলিকাতা যাওয়া বন্ধ করিতে, আজ্ঞা দিলেন। আমিয়ট সাহেব মুরশিদাবাদ পহুছিয়াছেন, এমত সময়ে নগরাধ্যক্ষের নিকট ঐ আদেশ উপস্থিত হওয়াতে, তিনি ঐ সাহেবকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সাহেব উক্ত আদেশ অমান্য করাতে, দাঙ্গা উপস্থিত হইল এবং ঐ দাঙ্গাতে তিনি পঞ্চত্ব পাইলেন। মীরকাসিম শেঠবংশীয় প্রধান বণিকদিগকে ইঙ্গরেজের অনুগত বলিয়া সন্দেহ করিতেন; অতএব তাঁহাদিগকে মুরশিদাবাদ হইতে আনাইয়া মুঙ্গেরে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিলেন।

 আমিয়ট সাহেবের মৃত্যু এবং এলিস সাহেব ও তদীয় সহচরবর্গের কারাবরোধের সমাচার কলিকাতায় পহুছিলে, কৌন্সিলের সাহেবেরা অবিলম্বে যুদ্ধারম্ভ করাই নিৰ্দ্ধারিত করিলেন। বানসিটার্ট ও হেষ্টিংস সাহেব ইহা বুঝাইবার নিমিত্ত বিস্তর চেষ্টা পাইলেন, যে মীরকাসিম পাটনায় যে কএক জন সাহেবকে কয়েদ করিয়া রাখিয়াছেন তাঁহাদের যাবৎ উদ্ধার না হয়, অন্ততঃ তাবৎ কাল পর্য্যন্তও ক্ষান্ত থাকা উচিত। কিন্তু তাহা ব্যর্থ হইল। অধিকাংশ মেম্বরের সম্মতি ক্রমে ইঙ্গরেজদিগের সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইল। সেই সময়ে মীরজাফর স্বীকার করিলেন যে যদি ইঙ্গরেজেরা পুনর্ব্বার আমাকে নবাব করেন, তাহা হইলে আমি কেবল দেশীয় লোকদিগের বাণিজ্য বিষয়ে পূর্ব্ব শুল্ক প্রচলিত রাখিব, আর ইঙ্গরেজদিগকে বিনা শুল্কে ব্যবসায় করিতে দিব। অতএব কৌন্সিলের সাহেবেরা তাঁহাকেই পুনর্ব্বার সিংহসনে নিবিষ্ট করা মনস্থ করিলেন। বায়ত্তরিয়া বৃদ্ধ মীরজাফর তৎকালে কুণ্ঠরোগে প্রায় চলৎশক্তিরহিত হইয়াছিলেন, তথাপি মুরশিদাবাদগামি ইংলণ্ডীয় সৈন্য সমভিব্যাহারে পুনর্ব্বার নবাব হইতে চলিলেন।

 মীরকাসিম স্বীয় সৈন্যদিগকে সুশিক্ষিত করিবার নিমিত্ত অশেষ প্রয়াস পাইয়াছিলেন। বাস্তবিকও, বাঙ্গালাদেশেে কখন কোন রাজার তাঁহার মত উৎকৃষ্ট সৈন্য ছিল না। আর তাঁহার সেনাপতি গর্গিন খাঁও যুদ্ধ বিষয়ে অসাধারণ ক্ষমতাপন্ন ছিলেন। তথাপি উপস্থিত যুদ্ধ অল্প দিনেই শেষ হইল। নবাবের সেনাপতিদিগের পরস্পর অনৈক্য প্রযুক্ত, ১৭৬৩ খৃঃ অব্দের ১৯এ জুলাই, কাটোয়াতে তাঁহার সৈন্য সকল পরাজিত হইল। মতিঝিলে নবাবের যে সৈন্য ছিল ইঙ্গারেজেরা, ২৪ এ, তাহা পরাজয় করিয়া মুরশিদাবাদ অধিকার করিলেন। সুতির সন্নিহিত ঘেরিয়ানামক স্থানে, ২রা আগষ্ট, আর এক যুদ্ধ হয়; তাহাতেও মীরকামিমের সৈন্য পুনরায় পরাজিত হইল। রাজমহলের নিকট উদয়নালাতে তাঁহার এক দৃঢ় গড়খাই করা ছিল নবাবের সৈন্য সকল পলাইয়া তথায় আশ্রয় লইল।

 এই সকল যুদ্ধকালে মীরকাসিম মুঙ্গেরে ছিলেন; এক্ষণে উদয়নালার সৈন্যমধ্যে উপস্থিত থাকিতে মনস্থ করিলেন। তিনি এতদেশীয় যে সকল প্রধান প্রধান লোকদিগকে কারাবদ্ধ করিয়া রাখিয়ছিলেন, প্রস্থানের পুর্ব্বে তাহাদিগের প্রাণদণ্ড করিলেন। পাটনার পূর্ব্ব গবর্ণর রাজা রামনারায়ণের গলদেশে বালুকাপূর্ণ গোণী বদ্ধ করিয়া নদী মধ্যে নিক্ষেপ করিলেন, এবং পূর্ব্বোক্ত কৃষ্ণদাস প্রভৃতি সমুদায় পুত্ত্র সহিত রাজা রাজবল্লভ, রায়রাইয়াঁ রাজা উমেদ সিংহ, রাজা বুনিয়াদ সিংহ, রাজা ফতে সিংহ ইত্যাদি অনেক ব্যক্তির জীবনবধ করিলেন। শেঠবংশীয় দুই জন ধনবান বণিককে মুঙ্গেরের গড়ের বুরুজ হইতে নদীতে নিক্ষেপ করিলেন। বহুকাল পর্য্যন্ত নাবিকেরা, ঐ স্থান দিয়া যাতায়াত কালে, উক্ত হতভাগ্যদ্বয়ের বধ স্থান দেখাইয়া দিত।

 মীরকাসিম এই সকল হত্যা সমাপন করিয়া উদয়নাল স্থিত সৈন্য সহিত মিলিত হইলেন। অক্টোবরের আরম্ভে ইঙ্গরেজেরা নবাবের শিবির আক্রমণ করিয়া তাঁহাকে পরাজয় করিলেন। পরাজয়ের দুই এক দিবস পরে তিনি মুঙ্গেরে গমন করিলেন। কিন্তু ইঙ্গরেজদিগের যে সৈন্য তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতেছিল তাহা নিবারণ করা অসাধ্য বোধ করিয়া, সৈন্য সহিত পাটনা পলায়ন করিলেন। যে কয়েক জন ইঙ্গরেজ তাঁহার হস্তে পড়িয়াছিলেন তাহাদিগকেও সেই সমভিব্যাহারে লইয়া গেলেন।  মুঙ্গের পরিত্যাগের পর দিন, তাঁহার সৈন্য রেবতীরে উপস্থিত হইল। সেই স্থানে তাঁহার শিবির মধ্যে হঠাৎ অত্যন্ত গোলযোগ উপস্থিত হইল। সকল লোকই নদী পার হইয়া পলাইতে উদ্যত। দৃষ্ট হইল কয়েক ব্যক্তি এক শব লইয়া গোর দিতে যাইতেছে। জিজ্ঞাসা করাতে কহিল, ইহা সৈন্যধ্যক্ষ গর্গিন খাঁর কলেবর। বিকালে তিন চারি জন মোগল তাঁহার তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাঁহার প্রাণ বধ করে। এইরূপ প্রচার করিয়া দিয়াছিল যে তাহারা সেনাপতির নিকট পূর্ব্বপ্রাপ্য বেতন প্রার্থনা করিতে যায়; তিনি তাহাদিগকে হাঁকাইয়া দেওয়াতে, তাহারা তরবারি বহিষ্কৃত করিয়া তাঁহাকে বধ করে। কিন্তু সে সময়ে তাহাদিগের মাহিয়ানা কিছুই বাকী ছিল না। নয় দিবস পুর্ব্বে তাহারা বেতন পাইয়াছিল।

 যাহা হউক, ইহা এক প্রকার নিশ্চয় বোধ হইতেছে যে মীরকাসিম স্বীয় সেনাপতি গর্গিন খাঁর প্রাণবধ করিবার নিমিত্ত ছলপুর্ব্বক তাহাদিগকে পাঠাইয়া দেন। গর্গিনের খোজা পিক্রস নামে এক ভ্রাতা কলিকাতায় থাকিতেন। বান্‌সিটার্ট ও হেষ্টিংস সাহেবের সহিত তাঁহার অত্যন্ত প্রণয় ছিল। পিক্রস এই অনুরোধ করিয়া গোপনে গর্গিনকে পত্র লিখিয়াছিলেন যে তুমি নবাবের কর্ম্ম পরিত্যাগ কর; আর যদি সুযোগ পাও তাঁহাকেও রুদ্ধ করবে। নবাবের প্রধান চর, এই বিষয়ের সন্ধান পাইয়া, রাত্রি দুই প্রহর একটার সময়ে, আপন প্রভুকে এই বলিয়া সাবধান করিয়া দেয়, যে আপনকার সেনাপতি বিশ্বাসঘাতক। তৎপরে এক দিবস অতীত না হইভেই, আরমানি সেনাপতি গর্গিন খাঁ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েন।

 তদনন্তর মীরকাসিম সত্বর হইয়া পাটনা পলায়ন করিলেন। মুঙ্গের ইঙ্গরেজদিগের হস্তগত হইল। তখন তিনি বিবেচনা করিলেন পাটনাও পরিত্যাগ করিতে হইবেক এবং পরিশেষে দেশত্যাগীও হইতে হইবেক। ইঙ্গরেজদের উপর তাঁহার ক্রোধের ইয়ত্তা ছিল না; অতএব তিনি পাটনা পরিত্যাগের পূর্ব্বে, সমস্ত ইঙ্গরেজ বন্দীদের প্রাণদণ্ড নিশ্চয় করিয়া, আপন সেনাপতিদিগকে বন্দীগৃহে গিয়া তাহাদের প্রাণবধ করিতে আজ্ঞা দিলেন। ইহাতে তাঁহারা উত্তর করিলেন আমরা ঘাতক নহি যে বিনা যুদ্ধে প্রাণবধ করিব; তাহাদের হস্তে অস্ত্র প্রদান করুন, যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত আছি। তাহারা এইরূপে অস্বীকার করাতে, নবাব শমরূ নামক এক ইউরোপীয় কর্ম্মকারককে তাহাদের প্রাণবধের আজ্ঞা দিলেন।

 এই দুরাত্মা পূর্ব্বে ফরাসিদিগের একজন সার্জন ছিল, পরে মীরকাসিমের নিকট নিযুক্ত হয়। সে এই জুগুপ্সিত ব্যাপার সমাধানের ভার গ্রহণ করিল; এবং কিয়ৎসংখ্যক সৈন্য সহিত কারাগৃহে প্রবিষ্ট হইয়া গুলী করিয়া,ডাক্তর ফুলর্টন ব্যতিরিক্ত,সকলেরি প্রাণবধ করিল। আটচল্লিশ জন ভদ্র ইঙ্গরেজ ও একশত পঞ্চাশ জন গোরা এইরূপে পাটনায় পঞ্চস্থ প্রাপ্ত হইল। শমরু তৎপরে অনেক রাজার নিকট কর্ম্ম করে; পরিশেষে সিরথানার আধিপত্য প্রাপ্ত হয়। এই হত্যায় যে সকল লোক হত হয় তাহার মধ্যে কৌন্সিলের মেম্বর এলিশ, হে, লসিংটন এই তিন জনও ছিলেন। ১৭৬৩ খৃঃ অব্দের ৬ই নবেম্বর, পাটনা নগর ইঙ্গরেজদিগের হস্তগত হইল। এবং মীরকাসিম পলাইয়া অযোধ্যার সুবাদারের আশ্রয় লইলেন।

 এইরূপে প্রায় চারি মাসেই যুদ্ধের শেষ হইল। পর বৎসর, ২২এ অক্টোবর, ইঙ্গরেজদিগের সেনাপতি বক্সারে অযোধ্যার সুবাদারের সৈন্য সকল পরাজয় করিলেন। জয়ের পর উজীরের সহিত যে বন্দোবস্ত হয় বাঙ্গালার ইতিহাসে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। অতএব এস্থলে সে সকলের উল্লেখ না করিয়া, ইহা কহিলেই পর্য্যাপ্ত হইবেক যে তিনি প্রথমতঃ মীরকাসিমকে আশ্রয় দেন, পরে তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি লুণ্ঠন করিয়া তাড়াইয় দেন।

 মীরজাফর দ্বিতীয় বার বাঙ্গালার সিংহাসনে আরূঢ় হইয়া দেখিলেন, ইঙ্গরেজদিগকে যত টাকা দিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন তাহা পরিশোধ করা অসাধ্য। তৎকালে তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ হইয়াছিলেন। তাঁহার রোগ ক্রমে বদ্ধমূল হইয়া আসিয়াছিল। তিনি, ১৭৬৫ খৃঃ অব্দের জানুয়ারি মাসে, চতুঃসপ্ততি বৎসর বয়সে মুরশিদাবাদে প্রাণত্যাগ করিলেন।

 তাঁহার উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করা দিল্লীর সম্রাটের অধিকার। কিন্তু তৎকালে তাঁহার কোন ক্ষমতা ছিল না; বরং তাঁহার নিজ রাজধানীতে প্রবেশ করিবারও উপায় ছিল না। অতএব ইঙ্গরেজদিগের যাহা ইচ্ছা হইল, তাহাই তাঁহারা করিলেন। মণিবেগমের গর্তজাত নজমউদ্দৌলা নামে মীরজাফরের এক পুত্ত্র ছিল। কলিকাতার কৌন্‌সিলের মেম্বরেরা অনেক টাকা পাইয়া তাঁহাকেই নবাব করিলেন। তাঁহার সহিত নূতন বন্দোবস্ত হইল; ইঙ্গরেজেরা দেশরক্ষার ভার আপনাদিগের হস্তে লইলেন, এবং নবাবকে, রাজ্যের দেওয়ানী ও ফৌজদারীসম্পৰ্কীয় কর্ম্মনির্ব্বাহের নিমিত্ত, এক জন নায়েব নাজিম নিযুক্ত করিতে কহিলেন।

 নবাব অনুরোধ করিলেন নন্দকুমারকে ঐ পদে নিযুক্ত করা যায়। কিন্তু কৌন্‌সিলের মেম্বরেরা তাহা স্পষ্টরূপে অস্বীকার করিলেন। বরং বানসিটার্ট সাহেব, ভাবি গবর্ণরদিগকে সাবধান করিবার নিমিত্ত, নন্দকুমারের কুক্রিয়া সকল কৌন্‌সিলের বহিতে বিশেষ বিবরণ করিয়া লিখিয়া রাখিলেন। আলিবর্দ্দি খাঁর কুটুম্ব মহম্মদ রেজা খাঁ নামক এক মুসলমান ঐ পদে নিযুক্ত হইলেন।