বাঙ্গালার ইতিহাস (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)/অষ্টম অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম অধ্যায়।

হেষ্টিংস সাহেব মেকফর্সন সাহেবের হস্তে গবর্ণমেণ্টের ভার সমর্পণ করিয়া যান। কিন্তু ডিরেক্টরেরা, তাঁহার গমন সংবাদ শ্রবণ মাত্র, লার্ড কর্ণওয়ালিস সাহেবকে গবর্ণর জেনেরল ও কম্যাণ্ডর ইন চীফ উভয় পদে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। কর্ণওয়ালিস পুরুষানুক্রমে বড় মানু- ষের সন্তান, ঐশ্বর্য্যশালী ও অসাধারণ বুদ্ধিশক্তিসম্পন্ন ছিলেন এবং পৃথিবীর নানা স্থানে অনেকানেক প্রধান প্রধান কর্ম্ম করিয়া সকল বিষয়েই বিশেষ রূপে পারদর্শী হইয়াছিলেন।

  তিনি, ১৭৮৬ খৃঃ অব্দে, ভারতবর্ষে পহুছিলেন। যে সকল বিবাদ উপস্থিত থাকাতে হেষ্টিংস সাহেবের শাসন অতিশয় বিশৃঙ্খল হইয়া গিয়াছিল, লার্ড কর্ণওয়ালিসের নাম ও প্রবল প্রতাপে সে সমুদায়ের একবারেই নিম্পত্তি হইল। তিনি সাত বৎসর পর্য্যন্ত নির্ব্বিবাদে রাজ্যশাসন করিলেন। অনন্তর, মহীসুরের অধিপতি হায়দরআলির পুত্র টিপু সুল্তানের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাঁহার গর্ব্ব খর্ব্ব করিলেন; পরিশেষে, সুল তানের প্রার্থনায়, তাঁহার রাজ্যের অনেকাংশ ও যুদ্ধের সমুদায় ব্যয় লইয়া সন্ধি স্থাপন করিলেন।

  লার্ড কর্ণওয়ালিস বাঙ্গালা ও বিহারের রাজস্ব বিষয়ে যে বন্দোবস্ত করেন, সেই কর্ম্ম দ্বারাই ভারতবর্ষে তাঁহার নাম চিরস্মরণীয় হইয়াছে। ডিরেক্টরের দেখিলেন, রাজস্ব সংগ্রহ বিষয়ে নিত্য নূতন বন্দোবস্ত করাতে দেশের পক্ষে অনেক অপকার হইতেছে। তাঁহারা বোধ করিলেন প্রায় ত্রিশ বৎসর হইল আমরা দেওয়ানী পাইয়াছি, অতএব এত দিনে আমাদের ইউরোপীয় কর্ম্মকারকেরা অবশ্যই ভূমি বিষয়ে সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়াছেন। তাঁহারা বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন, যে প্রজা ও রাজা উভয়েরি হানিকর না হয় এমত কোন দীর্ঘকালস্থায়ি ন্যায্য বন্দোবস্ত করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। আর তাঁহাদের নিতান্ত এই বাসনা হইয়াছিল যে চিরকালের নিমিত্ত এক রূপ রাজস্ব নিৰ্দ্ধারিত হয়। কিন্তু লার্ড কর্ণওয়ালিস দেখিলেন যে গবর্ণমেণ্টে অদ্যাপি এ বিষয়ের কোন নিশ্চিত সন্ধান পাওয়া যায় নাই; অতএব তিনি অগত্যা পূর্ব্বপ্রচলিত বার্ষিক বন্দোবস্তই আপাততঃ বজায় রাখিলেন।

 ঐ সময়ে তিনি কতকগুলি প্রশ্ন প্রস্তুত করিয়া, এই অভিপ্রায়ে, কালেক্টর সাহেবদিগের নিকট পাঠাইয়া দিলেন যে তাঁহারা ঐ সকল প্রশ্নের যে উত্তর লিখিবেন তাহাতে ভূমির রাজস্ব বিষয়ের সটীক অস্থসন্ধান পাইতে পরিবেন। তাঁহারা যে বিজ্ঞাপনী দিলেন তাহা অতি অকিঞ্চিৎকর; অতি অকিঞ্চিৎকর বটে, কিন্তু তৎকালে তদপেক্ষীয় উত্তম পাইবার কোন আশা ছিল না। অতএব কর্ণওয়ালিস আপাততঃ দশ বৎসরের নিমিত্ত বন্দোবস্ত করিয়া এই ঘোষণা করিলেন যদি ডিরেক্টরেরা স্বীকার করেন তবে ইহাই চিরস্থায়ি করা যাইবেক। অনন্তর, বিখ্যাত সিবিল সরবেণ্ট জান শোর সাহেবের প্রতি রাজস্ব বিষয়ে এক নূতন প্রণালী প্রস্তুত করিবার ভার অর্পিত হইল। তিনি উক্ত বিষয়ে সবিশেষ অভিজ্ঞ ও নিপুণ ছিলেন। চিরস্থায়ি বন্দোবস্ত বিষয়ে তাঁহার নিজের মত ছিল না; তথাপি তিনি উক্ত বিষয়ে গবর্ণমেণ্টের যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিলেন। এই দশসালা বন্দোবস্তে ইহাই নিৰ্দ্ধারিত হইল, এপর্য্যন্ত যে সকল জমীদার কেবল রাজস্ব সংগ্রহ করিতেছেন অতঃপর তাঁহারাই ভূমির স্বামী হইবেন; প্রজারা তাঁহাদিগের সহিত রাজস্বের বন্দোবস্ত করিবেক।

 দেশীয় কর্ম্মকারকেরা রাজস্বসংক্রান্ত প্রায় সমুদায় পুরাতন কাগজ পত্র নষ্ট করিয়াছিল; যাহা অবশিষ্ট পাওয়া গেল, সে সমুদায় পরীক্ষা করিয়া, এবং ইতি পূর্ব্বের কয়েক বৎসরে যাহা আদায় হইয়াছিল তাহার গড় ধরিয়া, কর নির্দ্ধারিত করা গেল। বাজে আদায়ের প্রথা তদবধি রহিত হইল; এবং এই নিমিত্তে জমীদারদিগকে কিছু রেহাই দেওয়া গেল। গবর্ণমেণ্ট ইহাও ঘোষণা করিলেন, নিষ্কর ভূমির সহিত এ বন্দোবস্তের কোন সম্পর্ক নাই,কিন্তু ঐ সকল ভূমির সনন্দ পত্র আদালতে পরীক্ষা করা যাইবেক; যে সকল ভূমির সনন্দ অকৃত্রিম হইবেক সে সমুদায় বহাল থাকিবেক; আর কৃত্রিম বোধ হইলে, তাহ বাতিল করিয়া, ভূমি সকল বাজেয়াপ্ত করা যাইবেক।

 এই সমুদায় প্রণালী ডিরেক্টরদিগের সমাজে সমর্পিত হইলে, তাঁহারা তৎক্ষণাৎ তাহাতে সম্মতি দিলেন, এবং এই বন্দোবস্তই নিৰ্দ্ধারিত ও চিরস্থায়ি করিবার নিমিত্ত কর্ণওয়ালিস সাহেবকে অনুমতি করিলেন। তদনুসারে, ১৭৯৩ সালের ২২এ মার্চ্চ; এই বিজ্ঞাপন দেওয়া গেল যে বাঙ্গালা ও বিহারের রাজস্ব ৩১০৮৯১৫০ টাকা ও বারাণসীর রাজস্ব ৪০০০৬১৫ টাকা চিরকালের নিমিত্ত নিৰ্দ্ধারিত হইল।

 চিরস্থায়ি বন্দোবস্ত হওয়াতে, বাঙ্গালা দেশের যে বিশেষ উপকার দর্শিয়াছে ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। এরূপ না হইয়া যদি পূর্ব্বের ন্যায় রাজস্ব বিষয়ে নিত্য নূতন পরীবর্ত্তের প্রথা চলিত থাকিত, তাহা হইলে এ দেশের কখনই মঙ্গল হইত না। কিন্তু ইহাতে দুই অমঙ্গল ঘটিয়াছে। প্রথম এই যে,ভূমি ও ভূমির মুল্য সটীক না জানিয়া বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। তাহাতে কোন কোন ভূমিতে অত্যন্ত অধিক ও কোন কোন ভূমিতে যৎসামান্য কর নিৰ্দ্ধারিত হইয়াছে। দ্বিতীয় এই যে, সমুদায় ভূমি যখন বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া গেল, তখন যে সকল প্রজারা আবাদ করিয়া চিরকাল ভূমির উপস্বত্ব ভোগ করিয়া আসিতেছিল, নূতন ভূম্যধিকারিদিগের স্বেচ্ছাচার হইতে তাহাদের পরিত্রাণের কোন বিশিষ্ট উপায় নির্দ্দিষ্ট করা হয় নাই।

 ১৭৯৩ সালে, বাঙ্গালার শাসন নিমিত্ত আইন প্রস্তুত হয়। যখন যখন যে যে আইন প্রচলিত করা গিয়াছিল লার্ড কর্ণওয়ালিস সাহেব সেই সমুদায় একত্র সঙ্কলন করিলেন, এবং সংশোধন করিয়া এবং অনেক নূতন নূতন যোগ করিয়া দিয়া তাহা এক গ্রন্থের ন্যায় প্রচার করিলেন। ইহাই অনন্তরজাত যাবতীয় আইনের মূল স্বরূপ। ১৭৯৩ সালের আইন সকল এরূপ সহজ ও তাহাতে এরূপ গুণপনা প্রকাশ হইয়াছে, যে তাহাতে তৎপ্রণেতা গবর্ণর জেনেরল বাহাদুরের যথেষ্ট প্রশংসা করিতে হয়। ঐ সমুদায় আইন দেশীয় কয়েক ভাষাতে অনুবাদিত হইয়া সর্ব্বত্র প্রচারিত হয়।

 ফরষ্টর সাহেব তৎকালে সর্ব্বাপেক্ষীয় উত্তম বাঙ্গালা জানিতেন; তিনি ঐ সমুদায় আইন বাঙ্গালাতে অনুবাদ করেন। এই সাহেব কিয়ৎকাল পরে বাঙ্গালা ভাষায় সর্ব্বপ্রথম এক অভিধান প্রস্তুত করেন। পারসী ভাষায় বিশেষ নিপুণ এডমনষ্টন্ সাহেব পারসী ভাষাতে আইন তরজমা করেন। এই অনুবাদ এমত উত্তম হইয়াছিল যে গবর্ণমেণ্ট সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে দশ হাজার টাকা পারিতোষিক প্রদান করেন। এই সমুদায় আইন অনুসারে বিচারালয়ে যে সকল প্রথা প্রচলিত হয় তাহ প্রায় চব্বিশ বৎসর পর্য্যন্ত প্রচলিত থাকে। পরে, দেশীয় লোকদিগকে বিচারসম্পৰ্কীয় উচ্চ উচ্চ পদ প্রদান করা নিৰ্দ্ধারিত হওয়াতে, তাহার কোন কোন অংশ পরির্ত্তিত হইয়াছে।

 লার্ড কর্ণওয়ালিস সাহেব বিচারালয়ের পাঁচ সোপান স্থাপন করেন। প্রথম, মুন্সেফ ও সদর আমীন; দ্বিতীয়, রেজিষ্টর; তৃতীয়, জিলা জজ; চতুর্থ, প্রবিন্সল্ কোর্ট; পঞ্চম, সদর দেওয়ানী আদালত। তিনি,এই অভিপ্রায়ে, সমুদায় সিবিল সরবেণ্টদিগের বেতন বৃদ্ধি করিয়া দিলেন যে আর তাঁহারা উৎকোচ গ্রহণে লোভ করিবেন না। কিন্তু বিচারালয়ের দেশীয় কর্ম্মকারকদিগের বেতন পুর্ব্ববৎ অতি সামান্যই রহিল। অত্যুচ্চপদাভিষিক্ত ইউরোপীয় কর্ম্মকারকেরা পূর্ব্বে কয়েক শত টাকা মাত্র মাসিক বেতন পাইতেন, কিন্তু এক্ষণে তাঁহারা অনেক সহস্র টাকা বেতন পাইতে লাগিলেন। পুর্ব্বে দেশীয় লোকেরা বড় বড় বেতন পাইয়া আসিয়াছিলেন। ফৌজদার বৎসরে ষাট সত্তর হাজার টাকা পর্য্যন্ত বেতন পাইতেন। এক এক সুবার নায়েব দেওয়ান বার্ষিক নয় লক্ষ টাকার ন্যূন বেতন পাইতেন না। কিন্তু, ১৭৯৩ সালে, দেশীয় লোকদিগের অত্যুচ্চ বেতনও এক শত টাকার অধিক ছিল না।

 লার্ড কর্ণওয়ালিস গবর্ণমেণ্ট দৃঢ়ীভূত করিয়াছেন এবং চিরস্থায়ি বন্দোবস্ত দ্বারা দেশীয় লোকদিগের মঙ্গল করিয়াছেন। দেশীয় লোকেরা তাঁহার দয়ালুতা ও বিজ্ঞতার নিমিত্ত যে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করিয়াছিল তাহা অপাত্রে বিন্যস্ত হয় নাই। ডিরেক্টরেরা তাঁহার অসাধারণ গুণ দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া ইণ্ডিয়া হৌসে তাঁহার প্রতিমুর্ত্তি সংস্থাপন করেন এবং, ভারতবর্ষ পরিত্যাগ দিবসাবধি বিংশতি বৎসর পর্য্যন্ত, তাঁহার বার্ষিক পঞ্চাশ সহস্র টাকা বৃত্তি নিৰ্দ্ধারিত করিয়া দেন।

 ২৮ এ অক্টোবর, সর জান শোর সাহেব গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত হইলেন। তিনি সিবিল কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়া অতি অল্প বয়সে ভারতবর্ষে আগমন করেন। কিন্তু, অল্প দিনের মধ্যেই, অসাধারণ বুদ্ধি নৈপুণ্য ও প্রগাঢ় বিবেচনাশক্তি দ্বারা বিখ্যাত হইয়া উঠেন। দশসালা বন্দোবস্তের সময় তিনি রাজস্ব বিষয়ে এক উৎকৃষ্ট পাণ্ডুলেখ্য প্রস্তুত করেন। ঐ পাণ্ডুলেখ্যে এমত প্রগাঢ় বিদ্যা ও পারদর্শিতা প্রদর্শিত হয়, যে ইংলণ্ডের প্রধান মন্ত্রী শ্রীযুত পিট সাহেবের সম্মুখে উহা উপস্থাপিত হইলে, তিনি তদ্দর্শনে অত্যন্ত চমৎকৃত হইলেন এবং ডিরেক্টরদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া পরামর্শ পুর্ব্বক স্থির করিলেন যে লার্ড কর্ণওয়ালিসসাহেবের পরে ইহাঁকেই গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করিতে হইবেক।

 তাঁহার নিয়োগের পর বৎসর, সুপ্রীমকোর্টের অতি প্রসিদ্ধ,অপক্ষপাতী, বিদ্যাবান্ জজ সর উইলিয়ম জোন্স, সাতচল্লিশ বৎসর বয়ঃক্রম কালে, কালগ্রাসে পতিত হন। সর জান শোর সাহেবের সহিত তাঁহার অত্যন্ত সৌহৃদ্য ছিল। শোর সাহেব তাঁহার জীবন বৃত্তান্ত সঙ্কলন করিয়া এক উৎকৃষ্ট পুস্তক প্রস্তুত ও প্রচারিত করেন।

 ১৭৯৫ সালে, নবাব মুবারিকউদ্দৌলার মৃত্যু হইলে, তৎপুত্র নাজির উল্মুলুক মুরশিদাবাদের সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন। কিন্তু তৎকালে মুরশিদাবাদের নবাব নিযুক্ত করা অতি সামান্য বিষয় হইয়া উঠিয়াছিল। অতএব এই মাত্র কহিলেই পর্য্যাপ্ত হইবেক যে পিতা যেরূপ মসহরা পাইতেন পুত্রও তাহাই পাইতে লাগিলেন।

 সর জান শোর সাহেব, নির্ব্বিরোধে পাঁচ বৎসর ভারতবর্ষ শাসন করিয়া, পরিশেষে কর্ম্মপরিত্যাগের প্রার্থনা করিলেন। তাঁহার অধিকারকালে বাঙ্গালা দেশে লিখনোপযুক্ত কোন গুরুতর ব্যাপার ঘটে নাই। কিন্তু তদীয় শাসনকাল শেষ হইবার সময়ে এক ভয়ানক ব্যাপার উপস্থিত হইল। সৈন্যেরা অসন্তোষের চিহ্ন দর্শাইতে লাগিল; ঐ সময়ে মহীশুরের অধিপতি টিপু সুল্তান, সৈন্য দ্বারা আনুকূল্য পাইবার আশয়ে, ফরাসিদিগকে বারম্বার প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। গত যুদ্ধে ইংঙ্গরেজেরা তাঁহাকে যেরূপ খর্ব্ব করিয়াছিলেন তাহা তিনি এক নিমিষের নিমিত্তেও ভুলিতে পারেন নাই; অহোরাত্র, কেবল বৈরনির্যাতনের উপায় চিন্তা করিতেন। তিনি এমতও আশা করিয়াছিলেন যে ফরাসিদিগের সাহায্য লইয়। ইঙ্গরেজদিগকে এক বারেই ভারতবর্ষ হইতে দূর করিয়া দিতে পারিব। ডিরেক্টরেরা, এই সমস্ত বিষয় পর্য্যালোচনা করিয়া, স্থির করিলেন যে এমত সময়ে কোন বিলক্ষণ ক্ষমতাপন্ন লোককে গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করিয়া পাঠান উচিত। অনন্তর তাঁহারা লার্ড কর্ণওয়ালিস সাহেবকে পুনর্ব্বার ভারতবর্ষের রাজশাসনের ভার গ্রহণার্থ অনুরোধ করিলেন এবং তিনিও তাঁহাদের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন।

 কিন্তু আসিবার সমুদায় আয়োজন হইয়াছে, এমত সময়ে তিনি আয়র্লণ্ডে রাজপ্রতিনিধির পদে নিযুক্ত হইলেন। ডিরেক্টরেরা, বিলম্ব না করিয়া, লার্ড মর্নিঙ্গটনকে গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। এই লার্ড বাহাদুর লার্ড কর্ণওয়ালিস সাহেবের ভ্রাতার নিকট শিক্ষা পাইয়াছিলেন, এবং, সবিশেষ অনুরাগ সহকারে, বিশেষ পরিশ্রম পুর্ব্বক, ভারতবর্ষীয় রাজনীতি শিক্ষা করিয়াছিলেন। তিনি, ১৭৯৮ সালের ১৮ই মে, কলিকাতায় পহুছিলেন। সেই ঝঞ্‌ঝাটের সময়ে যেরূপ দূরদৃষ্টি, পরাক্রম ও বিজ্ঞতা আবশ্যক সে সমুদায়ই তাঁহার ছিল। তিনি ভারতবর্ষীয় রাজ্যশাসনের তার গ্রহণ করিবামাত্র, সাম্রাজ্য বিষয়ক সমুদায় আশঙ্কা একবারে অন্তর্হিত হইল, এবং ইঙ্গরেজদিগের অন্তঃকরণে সাহসের উদয় হইতে লাগিল।

 তিনি ভারতবর্ষে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন টাকা অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য; সৈন্য সকল একে অকর্ম্মণ্য, তাহাতে আবার বিরক্ত হইয়া আছে; উত্তর সীমায় সিন্ধিয়া ও দক্ষিণে টিপু সুল্‌তান পুর্ণশত্রু হইয়া বিভীর্ষিক দর্শাইতেছে; ফরাসিদিগের দিন দিন ভারতবর্ষে বিলক্ষন প্রাদুর্ভাব বাড়িতেছে। তিনি অতিত্বরায় সৈন্য সকল সম্যক্ প্রকারে কর্ম্মঠ করিয়া তুলিলেন; যে সকল ফরাসি সেনাপতি বহুতর সৈন্যসহিত হায়দ্রাবাদে বাস করিত, তাহাদিগকে দূর করিয়া দিলেন; আর তাহারা যে সকল সৈন্য সংগ্রহ করিয়াছিল, সে সমুদায়ের শ্রেণীভঙ্গ করিয়া দিলেন; তাহাদের পরীবর্ত্তে, সেই সেই স্থানে ইঙ্গরেজী সেনা স্থাপিত করিলেন; এবং এক বারেই টিপুর সহিত যুদ্ধের ঘোষণা করিয়া দিলেন। যেহেতু সমুদায় শত্রু মধ্যে তিনিই অত্যন্ত উদ্ধত হইয়া উঠিয়াছিলেন।

 মান্দ্রাজের কৌন্সিলের সাহেবেরা লার্ড ওয়েলেস্‌লির মতের পোষকতা না করিয়া বরং তাঁহার প্রতিকূল হইলেন। অতএব তিনি, ক্ষণমাত্রও বিলম্ব না করিয়া, মান্দ্রাজ যাত্রা করিলেন, এবং, তাঁহাদের তাদৃশ ব্যবহারের নিমিত্ত যথোচিত তিরস্কার করিয়া, স্বয়ং সমস্ত কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন এবং অবিলম্বে এক দল সৈন্যসংগ্রহ করিয়া, ১৭৯৯ খৃঃ অব্দের ২৭ এ মার্চ, টিপু সুল্‌তানের অভিমুখে প্রেরণ করিলেন। টিপুর রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তন, মে মাসের চতুর্থ দিবসে, ইঙ্গরেজদিগের হস্তগত হইল। এই যুদ্ধে টিপু প্রাণত্যাগ করেন। এইরূপে হায়দর পরিবারের রাজ্যাধিকার শেষ হইল। ডিরেক্টরেরা, এই সংগ্রামের বিশেষ বৃত্তান্ত শুনিয়া, গবর্ণর জেনেরল বাহাদুরকে বার্ষিক পঞ্চাশ সহস্র টাকার পেনসিয়ন প্রদান করিলেন।

 লার্ড ওয়েলেস্‌লি সাহেব, সিবিল সরবেণ্টদিগকে দেশীয় ভাষা বিষয়ে নিতান্ত অনভিজ্ঞ দেখিয়া, ১৮০০ খৃঃ অব্দে, কলিকাতায় কালেজ আব ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন। সিবিলেরা ইংলণ্ড হইতে কলিকাতায় পহুছিলে তাঁহাদিগকে প্রথমতঃ এই বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইতে হয়। তাঁহারা যাবৎ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েন তাবৎ কর্ম্মে নিযুক্ত হইতে পারেন না। এই দিব্যালয়ের ব্যবহারার্থে বাঙ্গালা ও অন্যান্য ভাষাতে অনেকানেক গ্রন্থ সংগৃহীত ও মুদ্রিত হইয়াছিল। এই বিদ্যালয় সংস্থাপনের সংবাদ ডিরেক্টরদিগের সমাজে পহুছিলে তাঁহারা সন্তুষ্ট হইলেন; কিন্তু অতিপ্রকাণ্ড ও বহুব্যয়সাধ্য হইয়াছে বলিয়া সকল বিষয়ের সংক্ষেপ করিতে আজ্ঞা প্রদান করিলেন।

 ১৮০৩ খৃঃ অব্দে, লার্ড ওয়েলেসলি সাহেবকে সিন্ধিয়া ও হোলকারের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে হইল। ঐ দুই পরাক্রান্ত সামন্ত অল্প দিনেই পরাজিত ও খর্ব্বীকৃত হইলেন। তাঁহাদের রাজ্যের অনেক অংশ ইঙ্গরেজদিগের সাম্রাজ্যে যোজিত হইল। সেপ্টম্বর মাসে, ইঙ্গরেজেরা মুসলমানদিগের প্রাচীন রাজধানী দিল্লী নগর প্রথম অধিকার করিলেন। পুর্ব্বে মহারাষ্ট্রীয়েরা দিল্লীশ্বরের উপরি অনেক অত্যাচার করিয়াছিলেন। এক্ষণে ইঙ্গরেজেরা তাঁহাকে সম্রাটের পদে পুনঃ স্থাপিত করিলেন। তাঁহার কোন প্রভুশক্তি রহিল না। তিনি কেবল বার্ষিক পনর লক্ষ টাকা মাত্র বৃত্তি পাইতে লাগিলেন।

 সেই সময়ে নাগপুরের রাজোর সহিত বিবাদ উপস্থিত হওয়াতে, লার্ড ওয়েলেসলি বাহাদুর অবিলম্বে উড়িষ্যায় সৈন্য প্রেরণ করিলেন। মহারাষ্ট্ৰীয়েরা যুদ্ধে ভঙ্গ দেওয়াতে, ১৮০৩ খৃঃ অব্দে সেপ্টম্বরের অষ্টাদশ দিবসে, ইঙ্গরেজদিগের সেনা জগন্নাথের মন্দির অধিকার করিল। পরে সমুদায় উড়িষ্যা দেশ বাঙ্গালার সাম্রাজ্যভূক্ত হইল। ৪৮ বৎসর পূর্ব্বে, আলিবর্দ্দি খাঁ, আপন অধিকারের শেষ বৎসরে,মহারাষ্ট্ৰীয়দিগকে এই দেশ সমর্পণ করেন। ইঙ্গরেজের পুরীর পুরোহিতদিগের প্রতি অত্যন্ত দয়া ও সমাদর প্রদর্শন করিলেন এবং পুরীসংক্রান্ত আয় ব্যয় প্রভৃতি তাবৎ ব্যাপারই পুর্ব্ববৎ তাঁহাদিগকে আপন বিবেচনানুসারে সমাধা করিতে কহিলেন। কিন্তু, তিন বৎসর পরে,ইঙ্গরেজেরা,তথাকার কর বৃদ্ধি করিবার অভিপ্রায়ে, আপনারা মন্দিরের অধ্যক্ষতা গ্রহণ করিলেন এবং নিজের লোক দিয়া কর সংগ্রহ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সংগৃহীত ধনের কিয়দংশমাত্র দেবসেবায় নিযোজিত হইত, অবশিষ্ট সমুদায় কোম্পানির ধনাগারে প্রবেশ করিত।

 বহুকালাবধি ব্যবহার ছিল, পিতা মাতারা, আপন আপন শিশু সন্তান সমভিব্যাহারে গঙ্গাসাগরে গিয়া, মন্ত্রপাঠ ও পূজা সমাপন হইলে পর, সাগরজলে শিশুসন্তান নিক্ষেপ করিত। তাহার এই কর্ম্ম ধর্ম্মবোধে করিত বটে কিন্তু ধর্ম্মশাস্ত্রে ইহার কোন বিধি নাই।

গবর্ণর জেনেরল বাহাদুর, এই ব্যবহার একবারে উঠাইয়া দিবার নিমিত্ত, ১৮০২ সালের ২০ এ আগষ্ট, এক আইন জারী করিলেন ও তাহার পোষকতা নিমিত্ত গঙ্গাসাগরে একদল সিপাই পাঠাইয়া দিলেন। তদবধি এই নৃশংস ব্যবহার একবারে রহিত হইয়া গিয়াছে।

 লার্ড ওয়েলেসলি এই মহারাজ্যের প্রায় তৃতীয়াংশ, এবং রাজস্ব বৃদ্ধি করিয়া পনর কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা করেন। কিন্তু,তিনি নিয়ত সংগ্রামে প্রবৃত্ত থাকাতে,রাজস্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঋণেরও বৃদ্ধি হইয়াছিল। ডিরেক্টরেরা, তাঁহার এইরূপ যুদ্ধবিষয়ক অনুরাগ দর্শনে, যৎপরোনাস্তি অসন্তোষ প্রকাশ করিলেন এবং যাহাতে শান্তি সংস্থাপন পুর্ব্বক রাজ্যশাসন হয় এমত কোন উপায় করিবার নিমিত্ত অত্যন্ত ব্যগ্র হইলেন।

 লার্ড ওয়েলেস লি দেখিলেন যে আর আমার উপর ডিরেক্টরদিগের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা নাই! অতএব তিনি তাহাদের লিখিত পত্রের উত্তর লিখিয়া কর্ম্ম পরিত্যাগ করিলেন এবং ১৮০৫ খৃঃ অব্দের শেষে, ইংলণ্ড গমনার্থ জাহাজে আরোহণ করিলেন।

 ডিরেক্টরেরা, ক্ষতি স্বীকার করিয়াও শান্তিস্থাপন ও ব্যয় লাঘব করা কর্ত্তব্য স্থির করিয়া, লার্ড কর্ণওয়ালিস সাহেবকে পুনর্ব্বার গবর্ণর জেলেরলের পদে নিযুক্ত করিলেন। তৎকালে তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ হইয়াছিলেন, তথাপি তাঁহাদের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন এবং, জাহাজে আরোহণ করিয়া, ১৮০৫ খৃঃ অব্দের ৩০এ জুলাই, কলিকাতায় উত্তীর্ণ হইলেন। তিনি, কাল বিলম্ব না করিয়া, ভারতবর্ষীয় ভূপতিদিগের সহিত সন্ধি স্থাপন করিবার নিমিত্ত, পশ্চিমাঞ্চল প্রস্থান করিলেন। কিন্তু তিনি পশ্চিমাভিমুখে যত গমন করিতে লাগিলেন ক্রমে ততই শারীরিক দুর্ব্বল হইতে লাগিলেন। পরিশেষে, গাজীপুরে উপস্থিত হইয়া, ঐ বৎসরের ৫ই অক্টোবর, কলেবর পরিত্যাগ করিলেন। ইংলণ্ডে তাঁহার মৃত্যু সংবাদ পহুছিলে, ডিরেক্টরেরা, তাঁহার উপর আপনাদিগের অনুরাগ দর্শাইবার নিমিত্ত, তাঁহার পুত্রকে চারি লক্ষ টাকা উপহার দিলেন।

 কৌন্সিলের প্রধান মেম্বর সর জর্জ বার্লো সাহেব অবিলম্বে গবর্ণর জেনেরলের পদে প্রতিষ্ঠিত হইলেন। ডিরেক্টরেরা তাঁহাকে এই উচ্চ পদে নিযুক্ত করিলেন, কিন্তু রাজমন্ত্রিরা কহিলেন এই পদে লোক নিযুক্ত করা আমাদের অধিকার। এই বিষয়ে বিস্তর বাদানুবাদ উপস্থিত হইল। পরিশেষে, লার্ড মিণ্টোকে গবর্ণর জেনেরলের পদে নিযুক্ত করাতে, সে সমুদায়ের মীমাংসা হইয়া গেল। সর জর্জ বার্লো সাহেবের অধিকার কালে, গবর্ণমেণ্ট শ্রীক্ষেত্র যাত্রিদিগের নিকট মাসুল আদায়ের ও মন্দিরের অধ্যক্ষতার ভার স্বহস্তে আনিয়াছিলেন। যাত্রির সংখ্যা বৃদ্ধির নিমিত্ত নানা উপায় করা গিয়াছিল। ইহাতে অনেক রাজস্ব বৃদ্ধি হয়। তৎকালে এই যে প্রথা চলিত হইয়াছিল ইহা প্রায় ত্রিশ বৎসরের অধিক প্রবল থাকে।

 লার্ড মিণ্টো বাহাদুর, ১৮০৭ খৃঃ অব্দের ৩১এ জুলাই, কলিকাতায় উত্তীর্ণ হইলেন। তিনি ১৮১৩ খৃঃ অব্দের শেষ পর্য্যন্ত রাজ্যশাসন করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে বাঙ্গালা দেশের রাজকার্য্যের কোন বিশেষ পরীবর্ত্ত হয় নাই। কেবল পঞ্চোত্তরা মাশুল বিষয়ে পূর্ব্বাপেক্ষা কঠিন নিয়মে এক নূতন বন্দোবস্ত হইয়াছিল। লার্ড কর্ণওয়ালিস সাহেব, ১৭৮৮ খৃঃ অব্দে, এই নিয়ম রহিত করিয়া যান; পরে, ১৮০১ খৃঃ অব্দে, পুনর্ব্বার আরম্ভ হয়। এইরূপে রাজস্বের বৃদ্ধি হইয়াছিল বটে; কিন্তু বাণিজ্যের বিস্তর ব্যাঘাত জন্মিল ও প্রজাদের উপরে ঘোরতর অত্যাচার হইতে লাগিল।

 ১৮১০ খৃঃ অব্দে, ইঙ্গরেজেরা, ফরাসি দিগকে পরাজয় করিয়া, বুর্ব্বোঁ ও মরিশস মামক দুই উপদ্বীপ অধিকার করেন, এবং তৎপর বৎসর, ওলন্দাজ দিগকে পরাজিত করিয়া, জাবা নামক সমৃদ্ধ উপদ্বীপও অধিকার করিয়াছিলেন।

 বিংশতি বৎসর পূর্ব্বে কোম্পানি বাহাদুর যে চার্টর লইয়াছিলেন তাহার মিয়াদ পুর্ণ হওয়াতে, ১৮১৩ খৃঃ অব্দে, নূতন চার্টর গৃহীত হইল। এই উপলক্ষে এতদ্দেশীয় রাজকার্য্যসংক্রান্ত কয়েকটি নিয়মের পরীবর্ত্ত হইয়াছিল। দুই শত বৎসরের অধিক কালাবধি, ইংলণ্ডের মধ্যে কেবল কোম্পানি বাহাদুরেরই ভারতবর্ষে বাণিজ্য করিবার অধিকার ছিল। কিন্তু তৎকালে কোম্পানি বাহাদুর ভারতবর্ষের রাজসিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। অতএব, রাজ্যেশ্বরের বাণিজ্য করা উচিত নহে, এই বিবেচনায়, নূতন বন্দোবস্তের সময়, কোম্পানি বাহাদুরের কেরল রাজ্য শাসনের ভার রহিল আর অন্যান্য বণিকদিগের বাণিজ্যে অধিকার হইল। পূর্ব্বে কোম্পানির কর্ম্মকর ভিন্ন অন্যান্য ইউরোপীয়দিগকে ভারতবর্ষে আসিবার অনুমতি প্রাপ্তি বিষয়ে ষে ক্লেশ পাইতে হইত তাহা একবারেই নিবারিত হইল। অতঃপর, ডিরেক্টরেরা যাহাদিগকে অনুমতি দিতে চাহিতেন না, তাহারা বোর্ড অব কণ্ট্রোল নামক সভাতে আবেদন করিয়া কৃতকার্য্য হইতে লাগিল।

 ১৮১৩ খৃঃ অব্দের ৪ঠা অক্টোবর, লার্ড মিণ্টো বাহাদুর, লার্ড ময়রা বাহাদুরের হস্তে ভারতবর্ষীয় রাজ্য শাসনের ভার সমর্পণ করিয়া, ইংলণ্ড যাত্রা করিলেন; কিন্তু, আপন আলয়ে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই, তাঁহার প্রাণত্যাগ হইল। পরিশেষে লার্ড ময়রা বাহাদুরের নাম মারকুইস আব হেষ্টিংস হইয়াছিল।