পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভিটেমাটি থেকে উৎখাত না হওয়ার আশ্বাস এবং ভুক্তাবশিষ্ট এঁটোকাটা কুড়িয়ে নেওয়ার চমৎকার স্বাধীনতা।

 এইজন্যে বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির বিপুল বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূবনেও আসামের পলায়নবাদী ভীরু বঙ্গভাষীরা নিজেদের জন্যে কোনও পরিসর তৈরি করতে পারেনি। আসল কথা, তৈরি করতেও চায় নি। এখানেই বরাক উপত্যকার উপভাষাভাষী বাঙালিদের অভিজ্ঞান ও দুর্বলতা যুগপৎ স্পষ্ট। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে মনে, আমরা কি একই সঙ্গে মাতৃভাষার বাইরে ও ভেতরে? কিন্তু কেন এই বিচিত্র সসেমিরা অবস্থান? তবে কি সর্ষের মধ্যেই কোথাও ভূত রয়ে গেছে? বিশেষত গত দুই দশকের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়, ঘরে ঘরে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তোলার বদলে আমরা ঘরে ঘরে জতুগৃহ গড়ে তুলেছি। এই দুই দশকে মায়েরা বাবারা নিজেদের ছেলেমেয়েদের কিম্ভুতকিমাকার ‘শুদ্ধ’ বাংলা শেখাচ্ছেন। এতে ভঙ্গিটা শুধু শিষ্ট বাংলার কিন্তু উচ্চারণপ্রণালী ও স্বরন্যাসে স্পষ্টতই উপভাষার ধরন। এমন কি বাক্যগঠনেও উপভাষার ছাপ। এতে তৈরি হচ্ছে কেবল হাঁসজারু ও বকচ্ছপ বাংলা ভাষা।

 গত চার দশকের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সেইসব ছেলে-মেয়েরাই বিকট বাংলা বলে থাকে যারা তাদের বাড়িতে ‘শুদ্ধ’ ভাষা বলার প্রাথমিক পাঠ নিয়েছে। এরা মনে মনে উপভাষাকে তাচ্ছিল্য করতে শেখে অথচ বিশিষ্ট বাংলার মূলস্রোতে স্বচ্ছন্দভাবে যোগও দিতে পারে না। কিন্তু একই সঙ্গে উপভাষায় ও শিষ্ট বাংলায় দক্ষ হতে চাই শুধু সতর্কতা ও সংবেদনশীলতা। এরাই যখন গল্প লেখে, কবিতা লেখে, প্রবন্ধ লেখে, নাটক লেখে কিংবা বাচন-নির্ভর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়—তাদের অশিক্ষিত-পটুত্ব পদে পদে শিল্পরস ও সৃষ্টির লাবণ্যকে লাঞ্ছিত করতে থাকে। কারণ ভাষা যখন নানা ধরনের প্রকাশমাধ্যমের আকর, সূক্ষ্মতা ও গভীরতা সেইসব অশিক্ষিত-পটু জনদের জন্যে পুরোপুরি দুপ্রবেশ্য হয়ে যায়। এরই অনিবার্য পরিণতিতে নিজেদের স্থানিক উপসংস্কৃতির সূক্ষ্মতা ও বৈচিত্র্য এবং অপর পরিসরের শৌর্য ও লাবণ্যময় সম্ভাবনা পুরোপুরি অনধিগম্য হয়ে যায়। এরই সূত্র ধরে মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিপূরণের তাড়নায় কূপমণ্ডুকতাই হয়ে ওঠে সর্বজনীন প্রতিরক্ষা ব্যুহ। একদিকে ছিড়ে যায় আমাদের শেকড়, অন্য দিকে মুছে যায় আকাশ। না পারি উপভাষার সহজ লাবণ্য ও খর চলিষ্ণুতার সূত্রে উপসংস্কৃতি ও অপর পরিসরের তাৎপর্য অনুধাবন করতে, না পারি নিজেদের বৃহত্তর চারণভূমিতে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্যে উপযুক্ত করে তুলতে। বঙ্গীয় পরিমণ্ডলের সবচেয়ে প্রান্তিক অঞ্চলের উপভাষাভাষী হিসেবে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে দীর্ঘ ও কঠোর নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জনীয় তাৎপর্য। পদে পদে তাতে স্খলিত হওয়ার আশঙ্কা; কিন্তু সব ধরনের ভ্রষ্টতার হাতছানি এড়িয়ে গিয়ে পৌছাতে পারি সম্ভাবনার স্বর্ণ-শিখর প্রাঙ্গণে। এভাবেই তো পৌঁছেছেন নির্মলেন্দু চৌধুরী ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সৈয়দ মুজতবা আলি ও ভূদেব চৌধুরী, বিপিনচন্দ্র পাল ও সুন্দরীমোহন দাস, অপূর্ব চন্দ ও অমিতাভ চৌধুরী, অশোকবিজয় রাহা ও

৯২