পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জামশেদপুরে, পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় নৈহাটিতে লিখছেন—এসব তথ্য উৎসুক জনেরা জানতে চাইবেন হয়তো। কিন্তু প্রশ্নাতীত সত্য হল, এঁরা প্রত্যেকেই বাংলা ভাষার লেখক। নিশ্চয় ‘ভাষা ও সাহিত্যের সহিত জাতীয়তার...দুচ্ছেদ্য সম্বন্ধ...ছিন্নভিন্ন হইতে কেহই সম্মতি দিতে পারে না।’ এবং প্রত্যেকে ‘অখণ্ড বঙ্গভাষার উপাসনা’ করে চলেছেন যেহেতু ‘উহার ঢাকাই-রঙ্গপুরী, শ্রীহট্ট-যশোহরী সংস্করণ নাই’। তাই রণজিৎ দাশ-জয় গোস্বামী-রাহুল পুরকায়স্থদের কবিতা কামরুজ্জামান কামু-মাসুদ খান-খোন্দকার আশরাফ হোসেনদের কবিতার পাশাপাশি যখন পড়ি, এঁদের উপভাষাগত অভিজ্ঞান বা জেলাগত অবস্থান নিয়ে কিছুমাত্র চিন্তা করি না। কারণ, ‘অখণ্ড বঙ্গভূমি জুড়িয়া সব বাঙ্গালা'।

 তবু কেন বরাকের বাঙালিদের আজও সীমাহীন মূখতা ও নষ্টামির বিরুদ্ধে লড়তে হয় অবিভাজ্য বাঙালি সত্তার শরিক হিসেবে নিজেদের তর্কাতীত অবস্থান প্রমাণের জন্যে? ইতিহাসের এ এক নিষ্ঠুর কৌতুক। আমাদের জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। একদিকে হিন্দি-হিন্দুত্ব-হিন্দুস্থানের তত্ত্ব, অন্যদিকে ঐশ্লামিক মৌলবাদের ক্রমবর্ধমান নিরেট চাপ। আবার একদিকে অসমিয়াকরণের প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন হুঙ্কার ও ধূর্ততা এবং অন্যদিকে উপনিবেশবাদী চক্রের ইঙ্গিতে সিলেটি জাতীয়তাবাদের সুড়সুড়ি। সম্প্রতি লণ্ডনে ছাপা একটি বই নজরে পড়ল, যেখানে বাংলাদেশে শোষিত ও প্রান্তিকায়িত সিলেটিদের বাঙালি পরিচয় থেকে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ দেওয়া হয়েছে। প্রবাসী সিলেটিরা এই বার্তা ক্রমশ ছড়িয়ে দিচ্ছেন বৃহত্তর শিলচরের নানা এলাকায়। এখনও অবশ্য এই বক্তব্যে খুব একটা ডালপালা গজায়নি। কিন্তু ঘরপোড়া মানুষেরা সিঁদুরে মেঘের লক্ষণ দেখলে শঙ্কিত তো হবেই। মোদ্দা কথা হল, ভুবনমোহনের সময়ের মতো এখন ‘জাতীয়তার বন্ধন শ্লথ করিয়া অবশেষে গৃহে-গৃহে ঘৃণা ও অবিশ্বাসের বীজ ছড়াইয়া’ দেওয়ার আয়োজন অব্যাহত। কবি-লেখকবুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মীরা উপভাষা, লঘুসংস্কৃতি ও অপর পরিসরের ইতিবাচক সম্ভাবনার দিক কর্ষণ করুন। কিন্তু সেইসঙ্গে অনুমোদনযোগ্য লক্ষ্মণরেখার শাসনও অনুধাবন করুন। নইলে নেতি ও উৎকেন্দ্রিকতা তাদের সমস্ত সৃষ্টিমূলক উদ্যমে বরফজল ঢেলে দিতে পারে।

 বিশেষত নাট্যকর্মীরা যেন ওই লক্ষ্মণরেখার মর্ম বুঝতে পারেন। প্রাকৃতায়ন ও ঐতিহ্যমনস্কতা নিশ্চয় অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদের পঙ্কশয্যা থেকে তাদের উত্তরণ ঘটাবে। আর, উত্তর আধুনিক চেতনার মর্মকোষ থেকে তারা দ্রাক্ষামোচনও করবেন। কিন্তু উপভাষা ও তার সহগামী লঘু সংস্কৃতির অবশ্যমান্য সীমান্ত তাদের উপলব্ধিতে ধরা পড়ুক আগে। শিষ্ট ভাষা যেসব ধূসর ও ধুপছায়া অঞ্চলের দ্যোতনা পুরোপুরি ধারণ করতে পারে না, উপভাষা তার সঙ্গে সেতু বন্ধন করুক। অপর পরিসরের অকর্ষিত ও অনাবিষ্কৃত ভূমিতে বীজাধান করুক উপভাষা-বাহিত লঘু সংস্কৃতির অনুষঙ্গগুলি। কিন্তু সেসব থাকুক অন্তর্বয়ন হিসেবে, কদাচিৎ অন্তর্বয়ন মূল প্রতিবেদন হতেও পারে বটে, কিন্তু তা সর্বজনীন ও সর্বত্রগ্রাহ্য হতে পারে না। উপভাষা অঞ্চলে যাঁরা সৃষ্টির

৯৫